শিশুটি ঘুমিয়ে, জানেন না মা নেই

ফুটফুটে এক কন্যা শিশু। এখনো নাম রাখা হয়নি তার। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন। সে জানেন না, তাকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন মা। ঘটনটি ঘটেছে ঝিনাইদহ জেলা শহরের বহুল আলোচিত বেসরকারি রাবেয়া হাসপাতালে।

জানা যায়, জেলার শৈলকুপা উপজেলার মীর্জাপুর গ্রামের আল-আমিন। চাকরি করেন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে। ২৫ মার্চ সকালে স্ত্রী শারমিন খাতুনকে (২৩) নিয়ে আসেন ঝিনাইদহ জেলা শহরের আরাপপুর এলাকার বহুল আলোচিত বেসরকারি রাবেয়া হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সিজার অপারেশন করার পরে দ্বিতীয় সন্তানে মা হন শারমিন। কিন্তু মা ডাক কানে গেল না তার। বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) ভোর রাতে যশোরের বেসরকারি ইবনে সিনা হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে তার (শারমিন)। বিকেলেই গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে তাকে। অজানা ভয়ে স্বজনরা আড়ষ্ট হয়ে পড়েছেন। তারা কেও মুখ খুলছেন না। সংশ্লিষ্ট ডাক্তার রেজা সেকেন্দারের ফোন বন্ধ। রহস্য আরো জটিল আকার ধারণ করে। অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে পড়েছেন তিনি।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়ে, শারমিনের অপারেশন হয় ২৫ মার্চ দুপুরের দিকে। অপারেশন (সিজার) করেন স্থানীয় ডাক্তার রেজা সেকেন্দার। জন্ম নেয় ফুটফুটে এক কন্যা শিশু। অপারেশন থিয়েটার থেকে বেডে (হাসপাতালের বেডে) দেওয়ার পরেই রক্তক্ষরণ শুরু হয়। ধীরে ধীরে শরীরের অবস্থার অবনতি হতে থাকে শারমিনের। আবারো নিয়ে যাওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে। কয়েক ঘণ্টা ধরে আরেক দফায় অপারেশন করা হয়। জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয় তার। ১৯ ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পরেও কোণ উন্নতি হয় না। পাঠিয়ে দেওয়া হয় যশোরের বেসরকারি ইবনে সিনা হাসপাতালে।সেখানে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া শারমিনকে। বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) ভোরের দিকে ওই হাসপাতালের ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। লাশ নিয়ে শুরু হয় দরকষাকষি। আইসিইউ বিল হয়েছে প্রায় পোনে দুই লাখ টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বজনরা জানান, মামলা মর্কদমা না করলে বিল পরিশোধ করে দেবে রাবেয়া হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক। রাজি হয়ে যায় শারমিনের স্বামী। যশোর থেকে দুপুরে মরদেহ নিয়ে নিজ গ্রাম মীর্জাপুরে ফিরে আসেন স্বামী আল-আমিন। বিকেলে গ্রামের কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করা হয় শারমিনকে।

কথা হলো বহুল আলোচিত রাবেয়া হাসপাতালের মালিক সোহেল রানার সাথে। হাসপাতালটি পরিচালিত হয় স্থানীয় একটি প্রভাবশালী গ্রুপের ছত্রছায়াতে। সরকারি হাসপাতালে চাকরি করেন এমন অনেক নামী দামি ডাক্তার এর সাথে জড়িত। সোহেল রানা স্বীকার করেন সিজার করার পরে রুগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। রক্ত বন্ধ হয় না। সেকারণে আরেক দফায় অপারেশন করা হয় তাকে শারমিনকে।

তিনি আরো জানান, এক পর্যায়ে যশোরের ইবনে সিনহা বেসরকারি হাসপাতালে শারমিনকে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) সকালে মৃত্যু হয়েছে। অথচ মৃত্যু হয়েছে গভীর রাতে। ক্লিনিক মালিক আরো জানান আইসিইউ বিল এক লাখ ৭০ হাজার পরিশোধ করা হয়েছে। সর্ব মোট দুই লাখ টাকায় ঘটনাটি মীমাংসা করা হয়েছে। এখন কোন ঝামেলা নেই।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মিথিলা ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, সিজার করার কিছু সময় পরে রক্তক্ষরণ শুরু হলে দ্বিতীয় দফায় অপারেশন করে ওই রুগীর জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়। এরপরেও রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় যশোরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। জানতে পেরেছি ওই রুগীর মৃত্যু হয়েছে। তবে এ ঘটনায় কেও এখনো অভিযোগ করেনি।

এ দিকে শৈলকুপা উপজেলার মীর্জপুর গ্রামে চলছে নিরব শোকের মাতম। রাত ৮টার (২৮ মার্চ) দিকে শারমিনের স্বজন শৈলকুপা উপজেলার স্থানীয় সংবাদ কর্মী চঞ্চল অভিযোগ করেন, ভুল অপারেশনে শারমিনের অকাল মৃত্যু হয়েছে। তিনি দাবি করেন শারমিন সম্পর্কে ভাগ্নি হন। তার প্রথম সন্তানের বয়স মাত্র দুই বছর। নাম আফিয়া খাতুন।

হরিণাকুন্ডু উপজেলার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও ক্লিনিক মালিকের দাপটে কেও মুখ খুলতে পারছেন না বলে জানান চঞ্চল। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায় বেসরকারি ওই হাসপাতালে ইতোপূর্বে ভুয়া ডাক্তার ধরা পড়েছে। ভুল অপারেশন ও অপচিকিৎসার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন একাধিক মা ও শিশু। র‌্যাব পুলিশ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান পরিচালনা করেছে। কিন্তু ফলাফল মেলেনি।

ঝিনাইদহের অলি গলিতে গড়ে উঠা বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রমরমা স্বাস্থ্য বাণিজ্য চলছে। সম্প্রতি জারি করা সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষিত। নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার কিংবা ডিপ্লোমাধারী স্টাফ নার্স। ভোর হতে না হতেই আজব আজব ডিগ্রীধারী ডাক্তারের বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু হয়। শব্দ দূষণে দিশেহারা নগরবাসী।

সিভিল সার্জন ডা. শুভ্রা রানী দেবনাথ বলেছেন ইতোমধ্যে মানহীন ৮টি বেসরকারি ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযান শুরু করা হবে। তত দিনে ভুল অপারেশন অপচিকিৎসায় অকালে মায়ের মৃত্যু এবং মাতৃ হারা হবে শিশু, স্বজন হারাদের কান্নার জল বাষ্প হয়ে আকাশে উড়বে। এমনটি মনে করেন ভুক্তভোগীরা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //