আশুলিয়ায় চালক-সহকারীর মৃত্যু: ভাড়া বিতর্ক নাকি ভিন্ন কিছু

ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় বাড়তি ভাড়া চাওয়ায় যাত্রীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার জেরে মারধরের শিকার হয়ে একটি যাত্রীবাহী বাসের চালক ও সহকারীর মৃত্যু হয়েছে এমন অভিযোগ উঠলেও এর প্রকৃত ঘটনা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।

আশুলিয়া থানা পুলিশ, এক প্রত্যক্ষদর্শী ও বাসের চালকের সহকারী হিসেবে দাবি করা এক ব্যক্তির বর্ণনার বিবরণে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

পুলিশ বলছে, মারধরে নয়, বরং যাত্রী ওঠানোর সময় এ বাসটির পাশ দিয়ে উত্তরবঙ্গগামী একটি বাস যাওয়ার সময় দুটি বাসের মাঝখানে চাপা পড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

যদিও সোমবার ঘটনার পরপর নিহত চালকের সহকারীর ভাই আতিকু্র রহমান দাবি করে বলেছিলেন, চালকের অপর সহকারী তাকে জানিয়েছেন, ভাড়া বেশি চাওয়া নিয়ে প্রথমে বাসের এক যাত্রীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হন নিহত হৃদয়ের। পরে সাভারের আশুলিয়া থানা এলাকায় বাসটি পৌঁছালে সেখানে ২০-২৫ জন যুবক ওই বাসে ওঠেন। বাসটি ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ডিইপিজেড) এলাকায় পৌঁছালে তারা চালকের সহকারী হৃদয়কে বাস থেকে নামিয়ে বাসের পেছনে নিয়ে ইট দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। এছাড়া চালককেও মারধর করা হয়। এসময় চালকের অপর সহকারী আব্দুর রহমান দৌড়ে কিছু দূর সরে যান। পরবর্তীতে মারধরের শিকার দুজনকে গাজীপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।

আশুলিয়া থানা পুলিশ জানায়, চালক ও চালকের সহকারীকে মারধর করায় তারা মারা গেছেন, এমন খবর পেয়ে রাতে হাসপাতালে যায় পুলিশ সদস্যরা। তবে নিহতের শরীরে আঘাত দেখে এটি মারধরে নিহত নয় এমন সন্দেহ হলে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। রাতেই পুলিশ ওই বাসের চালকের সহকারী আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ভাড়া বেশি নেওয়ায় যাত্রীদের মারধরে তারা নিহত হয়েছেন এমনটি পুলিশকে জানান। পুলিশ পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক প্রত্যক্ষদর্শীর মাধ্যমে জানতে পারেন, ঘটনার সময় বাসের পাশে দুজন ধাক্কাধাক্কি করছিল। এসময় উত্তরবঙ্গগামী একটি বাস ইতিহাস বাসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মাঝখানে ওই দুইজন চাপা পড়েন। এতে সেখানে গুরুতর আহত হলে তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। এটি জানার পর পুলিশের সন্দেহ হলে মঙ্গলবার পুনরায় আব্দুর রহমানকে থানায় ডেকে আনে ও ঘটনাস্থলের পাশ থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে। আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে, তিনি পুলিশকে জানান, ওই সময় কিছুক্ষণের জন্য তিনি গাড়ির চালকের আসনে বসে ছিলেন। চালক ও চালকের অপর সহকারী গাড়ির গেট থেকে নেমে যাত্রীদের ডাকছিলেন। এসময় উত্তরবঙ্গগামী একটি বাস তাদের দুজনকে চাপা দিয়ে চলে যায়। 

এছাড়া পুলিশ জানায়, ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া সিসিটিভি ফুটেজ থেকেও বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

পুলিশের কাছে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দেখা যায়, ডিইপিজেডের সামনে ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভিড় রয়েছে। গাড়িগুলো চলছে ধীরগতিতে। একটি ইতিহাস পরিবহনের বাস সড়কে চন্দ্রামুখী লেনের ডান পাশ ঘেঁষে থামে। কিছুক্ষণ পর পাশ দিয়ে একটি বাবা-মায়ের দোয়া নামে একটি বাস চলে যায়। এর পরপরই ইতিহাস পরিবহনের বাসের গেটটিতে লোকজনের জটলা দেখা যায়। এক পুলিশ সদস্যকে ছুটোছুটি করতে দেখা যায়।

পুলিশের দাবি, মায়ের দোয়া পরিবহনটি যাওয়ার সময় বাসের ওই দুইজনকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়।

ওই ঘটনার সময় পাশেই ছিলেন দাবি করে সুমন শেখ নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ওই সময় শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়কে বাসে উঠিয়ে দিতে ইপিজেডের কাছে আসেন তিনি।

সুমন বলেন, ওই সময় ইতিহাস গাড়ি থেকে দুইজন মারামারি করছিল। তখনই উত্তরবঙ্গের একটি বড় কোস্টার (বাস) তাদের চাপা দেয়। পুলিশ তাদের অটোতে উঠিয়ে হাসপাতালে পাঠায়। আর ভেতরে যে একজন ছিলেন তিনি পালিয়ে যান। 

মঙ্গলবার বিকেলে আশুলিয়া থানায় কথা হয় আব্দু্র রহমানের সঙ্গে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ভাড়া নিয়ে এক যাত্রীর সঙ্গে হৃদয়ের বাগবিতণ্ডা হয়। পরে চালক আমাকে কিছুক্ষণের জন্য তার আসনে বসিয়ে বাস থেকে নামে। ওই সময় সেখানে ওই যাত্রীর পরিচিত আরো তিন-চারজন ছিলেন। এরপর কি হয়েছে আমি জানি না।

ওই সময় কেন সহযোগিতা না করে দূরে সরে গিয়েছিলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ভয় পেয়েছিলাম। তাই দ্রুত নেমে গিয়ে সামনের দিকে চলে যাই পুলিশ খুঁজতে।

গতকাল তিনি বেশি ভাড়া দাবি করায় এক যুবক ও তার পরিচিতরা ইটের আঘাত করে হৃদয়কে এবং সোহেল রানা বাবুকে কেন মারধর করেছে এমনটি কেন হৃদয়ের ভাইকে জানিয়েছিলেন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ওই সময় আমি চাপের মধ্যে ছিলাম। হৃদয়ের আত্মীয় স্বজনরাও বারবার জিজ্ঞেস করছিল, তাই এটি বলেছিলাম। আমি ধারণা করছি, চালক ও হৃদয় বাস থেকে নামার পর উত্তরবঙ্গের একটি বাস পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের চাপা দিয়েছে।

ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত) মো. আব্দুল্লাহিল কাফী বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করায় বাস চালক ও তার সহকারীকে মেরে ফেলা হয়েছে এমন তথ্য পাই। চালকের অপর সহকারীও এমন কথা জানান। কিন্তু হাসপাতালে মৃতদের আঘাতের চিহ্ন দেখে সন্দেহ হওয়ায় আমরা তদন্ত শুরু করি।

তিনি বলেন, মঙ্গলবার চালকের সহকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি জানান ওই ঘটনার সময় তিনি চালকের আসনে ছিলেন। আর অপর দুইজন বাসে যাত্রী ওঠানোর চেষ্টা করছিলেন। এসময় বাসটি বামে চাপাতে গেলে উত্তরবঙ্গগামী একটি বাস ওই বাসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দুই বাসের মাঝখানে পড়ে তারা দুইজন আহত হন। পাশেই থাকা পুলিশ সদস্যরা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। এরপর জানা যায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।

এসপির দাবি, মূলত নিজেকে বাঁচাতে চালকের অপর সহকারী সবাইকে অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়ায় মারধরে মৃত্যুর মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //