ভিমরুলী: জলে ভাসা পেয়ারার মোকাম

পেয়ারার হাট বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোট্ট খালের ওপরে শত শত নৌকা দুলছে, আর প্রতিটি নৌকায় সবুজ রঙের শত শত মণ পেয়ারা। 

ঝালকাঠি সরকারি কলেজ মোড় থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কীর্তিপাশা ইউনিয়নে ভিমরুলী বাজার। একসময় ঝালকাঠি শহরের পশ্চিম প্রান্ত ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া বাসন্ডা নদী (স্থানীয়রা এটিকে খাল হিসেবে চেনেন) ধরে উত্তর দিকে বাউকাঠি বাজার ও নবগ্রামের পাশ দিয়ে নৌপথে, মাটির রাস্তায় কিছুটা হেঁটে ভিমরুলী যেতে হতো। কিন্তু এখন শহর থেকে ভিমরুলী তো বটেই, একেবারে পেয়ারাবাগান পর্যন্ত চলে যাওয়া যায় সুন্দর সড়ক ধরে। 

জোয়ার-ভাটায় সিক্ত এই জনপদের ছোট ছোট খালগুলো সারা বছরই নাব্য। তবে বর্ষায় তার রূপ যেন আরও সুন্দর। খালের দুই পাড়েই প্রচুর গাছপালা। মাঝে মাঝে জনবসতি। তবে সেগুলো একেবারে খালের কিনারে নয়। একটু ভেতরে। ফলে ভিমরুলী যাওয়ার এই পথটুকুই মনে একধরনের প্রশান্তি এনে দেয়। 

সত্যিকারের রূপসী বাংলা বলতে যা বোঝায়-তা দেখতে ঝালকাঠির এসব ছোট ছোট খাল ও পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কালো পিচের সরু রাস্তায় মোটরসাইকেল বা ইজিবাইক হতে পারে সবচেয়ে আদর্শ। আর এর পরিপূর্ণ রূপে দেখতে আসতে হবে ভরা বর্ষায়-যখন ভিমরুলী বাজারে খালের ভেতরে শত শত নৌকায় পেয়ারার বিকিকিনি চলে। এমন অদ্ভুত সৌন্দর্য দেশের আর কোনো বাজারে নেই। 

এখানে যে মানের পেয়ারা পাওয়া যায়, রাজধানীতে বসে তা অনেক টাকা দিয়েও কিনতে পারবেন না। এর প্রধান কারণ পেয়ারাগুলো দ্রুত নরম হয়ে পেকে যায়। ফলে এখান থেকে পেয়ারা কিনে সাধারণত ঝালকাঠি জেলা এবং এর আশেপাশের এলাকার বাজারেই বেশি বিক্রি হয়। পদ্মা সেতুর সুবিধা নিয়ে কিছু পেয়ারা এখন ঢাকায় যায় বটে, তবে তা পরিমাণে যথেষ্ট কম। 

ঝালকাঠির পেয়ারার অথেনটিক স্বাদ পেতে আপনাকে ভিমরুলী বাজার কিংবা ঝালকাঠি এবং আশেপাশের বাজারে আসতে হবে। ভরা মৌসুমে এলে ছোট ডিঙি নৌকা ভাড়া করে আপনি দিগন্তবিস্তৃত পেয়ারা বাগানের ভেতরে চলে যেতে পারবেন। বাগান মালিকের অনুমতি নিয়ে সরাসরি গাছ থেকে পেয়ারা পেড়েও খেতে পারবেন। 

বাগানের ভেতরের খালগুলো খুবই সরু ও অগভীর। ফলে নৌকা উল্টে গেলেও ডুবে মৃত্যুর শঙ্কা কম। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে বাগানের ভেতরে সাবধানে চলাফেরা করা উচিত। সবচেয়ে ভালো হয়, সঙ্গে কোনো পরিচিত লোক যদি থাকে-যিনি বাগান চেনেন এবং বাগানের রসায়ন জানেন। অনেকে সাউন্ডবক্স নিয়ে যান এবং বাগানের ভেতরে উচ্চস্বরে গান বাজান। এটি পেয়ারা বাগানের জীবনবৈচিত্র্য এবং স্থানীয় জনসাধারণের জন্য খুবই ক্ষতিকর। 

ঝালকাঠি সদর উপজেলার নবগ্রাম, কীর্তিপাশা ও গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বেশ কটি গ্রামে রয়েছে পেয়ারাবাগান। পেয়ারার মৌসুমে পানির ওপরেই বসে চলমান হাট। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজারটি বসে ভিমরুলীতে। এ হাটের মূল পণ্য পেয়ারা। স্থানীয় ব্যক্তিরা একে বলে ‘গৈয়ার হাট’। আষাঢ়-শ্রাবণ মাস হচ্ছে এসব এলাকার পেয়ারা বিক্রির মূল সময়। 

জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর হচ্ছে পেয়ারার মৌসুম। বছরের এই সময়টা এ এলাকায় চলে অঘোষিত পেয়ারা উৎসব। এই সময় দূর থেকেই চোখে পড়বে সারি সারি ডিঙি নৌকা বোঝাই করে পেয়ারা নিয়ে আসার দৃশ্য। কাছে গেলে শুনবেন বেচাবিক্রির হাঁকডাক। 

১৯৭১ সালে এই পেয়ারাবাগান ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম প্রধান ঘাঁটি। পেয়ারা বাগানের একাধিক যুদ্ধের কথা এখনো এই এলাকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সুতরাং বর্ষা মৌসুমে শুধু পেয়ারার ভাসমান হাট দেখাই নয়, আপনি জেনে আসতে পারেন ১৯৭১ সালে এই পেয়ারা বাগানে কী হয়েছিল, সেই ইতিহাসও। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //