বাঁশফুলের দানা থেকে ভাত!

প্রতিবেশী বৃদ্ধের কাছে গল্প শুনেছিলেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার এলুয়াড়ী ইউনিয়নের পাকাপান গ্রামের যুবক সাঞ্জু রায় (২৫)। এরপর শোনা সেই গল্পে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঁশ ফুলের বীজ থেকে দানা সংগ্রহ করে বানিয়ে ফেললেন চাল। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার টাকার দানা বা চাল বিক্রি করেছেন সাঞ্জু রায়। তার সংগ্রহে রয়েছে আরও ৫ থেকে ৬ মণ বাঁশ ফুলের বীজ।

অন্যদিকে উৎসুক এলাকাবাসীর মধ্যে এই দানা (চাল) সংগ্রহ করার হিড়িক পড়েছে। এই দানার ঘ্রাণ আতপ চালের মতো হওয়ায় অনেকে আটা তৈরি করে পিঠা-পুলি-পায়েস ও পোলাও রান্না করছেন। 

পাকাপান গ্রামের সাঞ্জু রায় ও প্রতিবেশী বৃদ্ধ কালিচন্দ্র রায় (৭০) দুজনই দিনমজুর। একদিন মাঠে কাজ করে ওই গ্রামের মানিক চন্দ্র রায়ের পুরনো একটা বাঁশ ঝাড়ের নিচে ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তারা। এ সময় বৃদ্ধ কালিচন্দ্র রায় বাঁশ ঝাড়ে বাঁশ ফুল ও দানা দেখে সাঞ্জু রায়কে গল্প শোনান, ১৯৭১ সালে এরকম বাঁশ ফুলের দানা থেকে চাল সংগ্রহ করতে দেখেছেন। সে সময় অনেকেই এই দানা চাল হিসেবে ভাত রান্না করে খেয়েছেন। এই কথা শুনে সাঞ্জু রায় কিছু দানাদার বাঁশ ফুল সংগ্রহ করে হাতে ডলা দেন। ডলা দিতেই হুবহু চালের মতো দেখতে সাদা দানা বের হয়ে আসে। যার ঘ্রাণ আতপ চালের মতো। তিনি ওই দানাগুলো খেয়ে দেখেন চালের মতো স্বাদ। পরে তিনি এই দানা নিজের পরিবারের সদস্যদের খাওয়ান। ভাতের মতো স্বাদ পেয়ে সাঞ্জু রায় ব্যাপকভাবে বাঁশ ফুলের দানা সংগ্রহ করে চাল উৎপাদন শুরু করেন। 

এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে অনেকে ৪০ টাকা কেজি দরে বাঁশ ফুলের দানা (চাল) সংগ্রহ করেন। খবরটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে বাঁশ ফুলের চাল সংগ্রহের হিড়িক পড়ে যায়।

সাঞ্জু রায়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পাশের ঝাড় থেকে বাঁশের বীজ সংগ্রহ করছেন তিনি। তার মা বাঁশফুলগুলো কুলা দিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করছেন। সেই বীজ পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকাচ্ছেন সাঞ্জু রায়। এরপর সেগুলো ধানের হাসকিং মিলে ভাঙাবেন। বাড়ির উঠানে প্রস্তুতকৃত এমন কয়েকটি বীজের বস্তা দেখা যায়। কিছু দানা ভাঙিয়ে রেখেছেন, গ্রামের অনেকেই তা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বাঁশের ফুল থেকে চাল উৎপাদন করার বিষয়টি এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এটি দেখতে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে উৎসুক মানুষ ভিড় করছেন তার বাড়িতে।

প্রতিবেশী সাবিত্রী রানী, লিপি রানী ও সিমলা রায় জানালেন, বাঁশের বীজ থেকে দানা সংগ্রহ করার বিষয়টি তারা প্রথমে সাঞ্জু রায়ের ছেলেমানুষি ভেবেছিলেন। পরে নীলা রানী নামে এক গৃহবধূ দানা থেকে পাওয়া চাল দিয়ে পায়েস রান্না করে অনেককেই এই পায়েস খাওয়ান। 

ফিরোজা রানী রায় বাঁশ ফুলের দানা থেকে পাওয়া চাল দিয়ে আটা প্রস্তুত করে বিভিন্ন রকম পিঠা পুলি তৈরি করেছেন। যার সুঘ্রাণ একদম আতপ চালের মতো।

সাঞ্জু জানান, এটি বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। প্রতিদিন ২০ কেজি বীজ সংগ্রহ করা যায়। এসব পরিষ্কার করে ভাঙিয়ে দানা বের করলে ধানের সমপরিমাণ চাল হয়। তার কাছে এখন বাঁশ ফুলের দানা থাকলেও চাল নেই। অন্তত ৫০ জন তার কাছে চালের জন্য বলে রেখেছেন। অনেকে আগাম টাকা দিয়ে রেখেছেন। প্রথম দিকে এই চাল ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও চাহিদার সঙ্গে দামও বেড়েছে। এখন তিনি ৭০ টাকা কেজি করে চাল বিক্রি করবেন বলে জানান।

ফুলবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রুম্মান আক্তার বলেন, এটি গবেষণার বিষয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোনো কৃষিপণ্য সার্টিফাই করলে, তখন আমরা সেই বিষয়ে সম্প্রসারণের কাজ করি।

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) আঞ্চলিক কার্যালয় রংপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রকিবুল হাসান জানান, বাঁশের বীজ থেকে চাল উৎপাদন হয় এই প্রথম জানলাম। দেশের কোথাও এমন ঘটনা শোনা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে আমরা শিগগিরই গবেষণার কাজ শুরু করব।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নুরুজ্জামান জানান, বাঁশ এবং ধান একই প্রজাতির। ৫০ বছরে একটি বাঁশ ঝাড়ে একবার ফল আসে। পরে আর সেই বাঁশ ঝাড়টি টিকে থাকে না। তবে বাঁশ ফলের সেই দানা থেকে অবিকল চালের মতো দানা হয়। যার ভাতের স্বাদ ধানের চালের ভাতের মতোই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //