ভাঙন আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছে লৌহজংয়ের পদ্মার তীরের মানুষ

ঢেউয়ের আঘাতে ৬ দিনের ব্যবধানে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের ৫টি ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের প্রায় ৭০টি বসতঘর পদ্মা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এমনকি ঢেউয়ের তোড়ে নদী ভাঙন রোধে ফেলা জিও ব্যাগগুলো সরে যাচ্ছে। উপজেলার পদ্মা-তীরবর্তী শিমুলিয়া, খড়িয়া, দক্ষিণ হলদিয়া, সিংহেরহাটি, তেউটিয়া, রাউৎগাঁও, বাগেরবাড়ি, সুন্দিসার, ডহরী এলাকায় তীব্র ঢেউয়ের আঘাতে ফেলে রাখা জিও ব্যাগ তলিয়ে গিয়ে মাটি ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ভাঙন তাণ্ডব অব্যাহত থাকায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে লৌহজংয়ের পদ্মার তীরের মানুষ।

অন্যদিকে লৌহজংয়ে পদ্মার ভাঙন তাণ্ডব শুরু হওয়ায় সম্প্রতি পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদ্দুজামান, মুন্সীগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তহিদুল ইসলাম, উপজেলা চেয়ারম্যান ওসমান গনি তালুকদার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন পদ্মার ভাঙন ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এছাড়া শুক্রবার পদ্মার ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের দ্রুত বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন।


স্থানীয় বাসিন্দা, ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা জানিয়েছেন, বর্তমানে ভাঙনে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপজেলার গাঁওদিয়া ইউনিয়ন, বেজগাঁও ইউনিয়ন, লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়ন ও কনকসার ইউনিয়নের নদীর তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা।

গাঁওদিয়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো. রশিদ শিকদার জানান, রেমালের প্রভাবে পদ্মা হঠাৎ ফুঁসে উঠেছে। সোমবার দুপুর থেকে গতকাল রবিবার পর্যন্ত ৬ দিনে পদ্মার ভাঙনে শুধু গাঁওদিয়া ইউনিয়নের হারিদিয়া গ্রামে অর্ধশতাধিক বসতঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অসময়ে পদ্মার হঠাৎ ভাঙনের কবলে পরে দিশেহারা হয়ে পড়েছে পদ্মার তীরবর্তী বাসিন্দারা। বসতঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় অর্ধশতাধিক পরিবার এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। ভাঙনকবলিত এলাকায় ৬ দিন ধরেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।


অন্যদিকে লৌহজং-তেউটিয়া, বেজগাঁও ও কনকসার ইউনিয়নের আরো ২০টি বসতঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মার প্রবল স্রোত আর উত্তাল ঢেউয়ের কারণে প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম মোল্লা জানান, বছর জুড়েই পদ্মার কমবেশি ভাঙন চলছে। নদী ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ কাজের ধীরগতি ও অপরিকল্পিতভাবে জিও ব্যাগ ও ব্লক ফেলার কারণে ভাঙন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে পদ্মা উত্তাল হয়ে ওঠায় ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে।


ঝাউটিয়া গ্রামের প্রদীপ দাস জানান, আড়াই দশক আগে আমাদের বাড়ি থেকে পদ্মা নদীর প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ছিল। এখন সে নদী একেবারে বাড়ির কাছে। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি, কখন ভাঙন শুরু হয়ে যায়। নদী শাসনের খবর শুনে ভালো লেগেছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মাত্র অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হওয়ায় ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না।

পদ্মার ভাঙনের কবলে থাকা ১২০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ব্রাহ্মণগাঁও বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ আসলাম বলেন, আমি এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। বর্তমানে এ বিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করছি। ছাত্র অবস্থায় দেখেছি, বিদ্যালয় থেকে পদ্মা নদী ছিল কয়েক কিলোমিটার দূরে। আর এখন একেবারে ভাঙনের মুখে।

ভাঙনের ক্ষতিগ্রস্ত শেখ আয়নাল হাসান বলেন, পদ্মার ভাঙনে দুই দশক আগে বসতবাড়ি ও কৃষি জমি হারিয়ে এখন গাওদিয়া গ্রামে আছি। বর্তমানে বসবাস স্থান থেকে নদী মাত্র ২০০ মিটার দূরে। তাই আবারো ভাঙনের শঙ্কা নিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে শঙ্কার মধ্যে দিনযাপন করছি।

লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকির হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমেলের প্রভাবে পদ্মা নদী উত্তাল হয়ে উঠায় প্রচণ্ড ঢেউয়ে নদীতীরবর্তী এলাকার একাধিক স্থানে বালুভর্তি জিও ব্যাগ সরে যাওয়ায় কমবেশি ভাঙন দেখা দিয়েছে। তবে ওইসব এলাকায় আবারও জিও ব্যাগ ও ব্লক ফেলে ভাঙন রোধে কার্যক্রম চলমান রয়েছে।


জানা গেছে, ২০২১ সালে শুরু হওয়া লৌহজং উপজেলার খড়িয়া থেকে ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলার দিঘিরপাড় পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার বাঁধের কাজ ২০২৩ সালের অক্টোবরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ৪৫ শতাংশ। বাঁধ নির্মাণকাজ ধীরগতিতে চলায় ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে নদীর তীরবর্তী হাজার হাজার মানুষ। অনেকেই বাড়িঘর ভাঙনের আশঙ্কায় সতর্কতা অবলম্বন করছেন। কেউ কেউ আবার কাছাকাছি আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। এবারের ভাঙন বর্ষাকালের আগেই আতঙ্ক জাগাচ্ছে।

মুন্সীগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, প্রকল্পের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। ব্লক নির্মাণের কাজ হয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। শুরুতে লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া থেকে টঙ্গীবাড়ি উপজেলার দিঘিরপাড় পর্যন্ত ৯ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা নদীর তীর রক্ষায় ব্যয় ধরা হয় ৪৪৬ কোটি টাকা। পরে আরো ৬ কিলোমিটার তীরে বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর জন্য আরো ৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ বেশি দেওয়া হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, পদ্মার তীর রক্ষা বাঁধের চলমান কাজের ৪৭ শতাংশ শেষ হয়েছে, বাকি কাজ দ্রুত শেষ করা হবে। তবে আপৎকালীন সময়ের জন্য জরুরি ভিত্তিতে পদ্মায় ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জিও ব্যাগ ও ব্লক ফেলার জন্য ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //