পুঠিয়ায় ভূমি কর্মকর্তার ভুলে মুক্তিযোদ্ধা কন্যার জমি হাতছাড়ার অভিযোগ

রাজশাহী জেলার পুঠিয়ার এসিল্যান্ডের (সহকারী কমিশনার ভূমি) ভুলে মুক্তিযোদ্ধা কন্যার জমি হাতছাড়া হতে যাচ্ছে, আদালতে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় ১৯৮৪ সালের আইনে হওয়া দলিল থেকে জমি কর্তন করে তার সম্পত্তি অন্যকে দিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন এক বীর মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে।

প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম মৃধা হানিফের মেয়ে শাকিলা সুলতানা। তিনি বেলপুকুরিয়ার মাহফুজুর রহমানের স্ত্রী। বর্তমানে তার স্বামী অসুস্থ ও পঙ্গুপ্রায়। রয়েছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া তিন মেয়ে। নিরুপায় শাকিলাকে  স্বামীর সম্পত্তি বাঁচাতে দৌড়াতে হচ্ছে ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে শুরু করে ডিসি অফিস, কোর্ট এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে।

কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, অসুস্থ স্বামী ও তিন মেয়েকে নিয়ে কোন রকমে জীবন যাপন করি, শ্বশুরের আমলের জরাজীর্ণ ঘরটিতে বসবাস করি। বাড়ির সাথে লাগানো আঞ্চলিক মহাসড়কটি বিশ্বরোড হওয়ার পর থেকেই স্থানীয় এক প্রভাবশালীর (বিসমিল্লাহ্ তেল পাম্পের মালিক) কু-নজর পড়ে আমাদের বসবাসের এই জায়গার ওপর। তিনি আমাদের বাড়ির সামনে রোড সংলগ্ন জায়গা কেনার প্রস্তাব দেন। আমরা জমি বেচতে অস্বীকৃতি জানালে, সে জবর দখল করার হুমকি দেন। জবর দখল করার চেষ্টাও করে একবার। কিন্তু আমরা বেলপুকুরিয়া থানাকে বিষয়টি জানালে জবর দখলের হাত থেকে মুক্তি পাই। সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। তিনি এই জমি নিবেন-ই। যত টাকাই লাগুক, তেল পাম্পের পাশেই আলীশান বিল্ডিং তৈরির স্বপ্ন দেখেন শাজাহান। ১৯৮৪ সালে আমাদের এই জায়গার সাথে যাদের এ্যাওয়াজ হয়েছিল (অন্য এলাকা) তাদের এক শরীককে দিয়ে অতিরিক্ত জমি পাবো মর্মে উপজেলা সহকারী ভূমি অফিসে মামলা করান৷ প্রভাব খাটিয়ে এবং বে-আইনিভাবে এসিল্যান্ডকে দিয়ে আমার জমি থেকে ১২.৬৭ শতক জায়গা কেটে নেওয়ার হুকুম করাতেও সক্ষম হন। কিন্তু আমাদের জমি থেকে কাটার হুকুম দিলেও, যাদের সাথে আমাদের এ্যাওয়াজ হয়েছিল তাদের থেকে আমাদের অংশ কিভাবে দেবেন, সেটা নিয়ে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই এসিল্যান্ডের। এরপর তাদের কাছ থেকে জমি কেনাও হয়ে গেছে প্রভাবশালী শাজাহানের।

এখন আমরা আতঙ্কে আছি, যেকোনো সময় তারা আমার জমি দখল করতে আসবে। কিন্তু আমারও এক কথা, দেশের আইন, আদালত, জনপ্রতিনিধি সব নষ্ট হয়ে গেলেও আমরা নষ্ট হয়ে যেতে পারি না, কারণ আমার শরীরে বইছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্ত। এ রক্ত জীবন থাকতে হারবে না। আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও জমি রক্ষা করবো।

তিনি বলেন, অপ্রাপ্ত বয়স্কের (নাবালক/ নাবালিকা) সম্পত্তি তার অভিভাবক বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারে এ রকম আইন আছে। এতে তার স্বত্বের ব্যাঘাত ঘটলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তিন বছরের মধ্যে দেওয়ানী আদালতে (প্রোপার) মামলা দায়ের করে সেই দলিল বাতিলের আবেদন করতে পারবে। না করলে দলিল/খারিজ বহাল থাকবে। এরকম আইন বহাল থাকা অবস্থায় ১৯৮৪ সালের ৭ আগস্ট জফর মন্ডলের ছেলে মো. জেকের আলীর সাথে মৃত আব্দুল কাদেরের নাবালক সন্তান মো. আলমগীর, নাবালিকা মরিয়ম খাতুন ও আফরোজা খাতুনের পক্ষে অভিভাবক হিসেবে তাদের মা মোছা. সহর বানু বেওয়া, চাচা কফির উদ্দিন মন্ডল, আবুল কাশেম ও আবুল হোসেনের সাথে জমি এওয়াজ করেন। প্রথম পক্ষ অর্থাৎ জেকের আলী পান ৩৯ শতক এবং ২য় পক্ষ পান  ২০.৫ শতক। এর অনেক আগেই আমেনা বিবি ও সাহেনা বিবি ১৯৭৫ সালের ২৮ এপ্রিল তাদের প্রাপ্য সম্পূর্ণ জমি বেলপুকুরিয়ার মৃত কছিমুদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ আবুল হোসেনের কাছে বিক্রি করেছিলেন। সেই আমেনা বিবি ও সাহেনা বিবিকে দিয়েই প্রভাবশালী শাজাহান ভূমি অফিসে অতিরিক্ত জমি পাবে মর্মে মামলা করান৷ যদিও ১৯৯৬ সালে পারিবারিক এক গ্রাম্য শালিসের মাধ্যমে তাদের সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় তারা সম্পূর্ণ জমি বিক্রি করেছেন।

এদের আরেক বোন জমি না পাওয়া স্বত্বেও বিক্রি করলে আমরা ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর বানেশ্বর ভূমি অফিস বরাবর খারিজ বন্ধের আবেদন করি। ভূমি অফিসে আবেদন থাকার পরেও একই জমি অন্যের নামে খারিজ করা হয়।

১১ জুন-২৪ উপজেলা ভূমি অফিস, পুঠিয়া, রাজশাহীর নামজারি রিভিউ কেসের আদেশে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এর ১৫০ ধারার বিধান মোতাবেক বিবাদীর নামীয় ৩৮৪/৯-১/৮৬-৮৭ নং নামজারি হতে ৮৫৭ দাগে ০.০৩৯৫ একর জমি, ২৮৫/৯-১/৯৯-২০০০ নং নামজারি হতে ৮৭৭ দাগের ০.০৩৩০ একর ও ৮৫০ দাগের০.০৫৪২ একর জমি কর্তন করে মূল হোল্ডিংয়ে ফেরত প্রদানের জন্য ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, বানেশ্বর ইউনিয়ন ভূমি অফিস, পুঠিয়া, রাজশাহীকে বলা হলো।

জানতে চাইলে পুঠিয়ার উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) দেবাশীষ বসাক বলেন, কোর্টের ডিক্লেয়ারেশন ছাড়া নাবালকের একমাত্র অভিভাবক তার পিতা। দলিলের বিষয়ে তিনি বলেন, দলিল বাতিল করার এখতিয়ার আমার নাই, আমি রেকর্ড সংশোধন করেছি। এই দলিল বিষয়ে দেওয়ানী আদালতে শহিদার পক্ষে একটি মামলা বিচারাধীন বললে তিনি বলেন, আদালতের রেভিনিউ কার্যক্রমের ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকলে কার্যক্রম চালাতে সমস্যা নাই। আমি সকল পক্ষের দাখিলকৃত সকল কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে আদেশ দিয়েছি, এটাতে যেকোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে তার প্রতিকারের জায়গা আছে, তিনি আমার উচ্চতর কোর্ট এডিসি রেভিউনিউ কোর্টে আপিল করতে পারবেন।

এ বিষয়ে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সরকার অসীম কুমার বলেন, অবশ্যই সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। সংক্ষুব্ধ পক্ষের আবেদন আমলে নিলে ৩০ দিনের মধ্যে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) আদেশ আবার রিভিউ করতে পারেন। সেখানে না হলে এডিসি (রাজস্ব), এরপর অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) এবং সর্বশেষ ভূমি আপিল বোর্ডে যেতে পারবেন।

উল্লেখ্য, এ বিষয়টি নিয়ে পুঠিয়া এলাকায় গেলে জানা যায়, ইতোমধ্যে এই এসি ল্যান্ডের বিরুদ্ধে উঠেছে নানা অভিযোগ। সেখানে একটি সিন্ডকেটের মাধ্যমেই করতে হয় নামজারিসহ ভূমি সংক্রান্ত সব কাজ ৷ নামজারি করতে পরিমাণ ও দাম ভেদে ৫ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় সেবা গ্রহীতাকে। টাকা ছাড়া কোন কিছুতেই স্বাক্ষর করেন না তিনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //