প্রেম পিরিতির এমন ধারা
বন্ধু, মন তো মানে না
বুক ফাটে তো নারীর
মুখরে ফোটে না।
বন্ধু রে...
বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত ঠাকুরগাঁওয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এক অনন্য অনুভূতির নাম ‘ধামের গান’। স্বকীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল ধামের গান এই জেলার অমূল্য এক সম্পদ, যা বহু বছর ধরে এ অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষদের মাধ্যমে বেঁচে আছে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই অনন্য পরিবেশনাটি গ্রামের হাজার দর্শকের মনকে আন্দোলিত করে।
‘ধামের গান’ আসলে একটি লোকনাট্য ধারা। নাম শুনে এটিকে গান মনে হলেও ধামের গান এক ধরনের পালা, যেখানে সংলাপের কাজটি করে গান। তাই এটিকে গীতিনাট্যধারাও বলা যেতে পারে। তবে এটি কোনো লিখিত সাহিত্য নয় বরং লোকমুখে প্রচলিত। আবার গানের তালে তালে নৃত্যও এর অনন্য বৈশিষ্ট্য।
ধামের গান মূলত ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত ছিল। দেবদেবীর মহিমাকে ফুটিয়ে তোলা এবং মানুষের মধ্যে ধর্মানুভূতি জাগানোই ছিল ধামের গানের প্রধান উদ্দেশ্য। তবে বর্তমানে ধর্মীয় সীমাবদ্ধতা থেকে সরে এসে ধামের গান এখন মানুষের কথা বলে। গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষের হাসি তামাশা, ভালোবাসা, দুঃখ বেদনা, সামাজিক সমস্যা, জন্ম মৃত্যু ইত্যাদির কথা বলে। তবে প্রাচীন রীতি অনুযায়ী গান শুরুর পূর্বে দেবদেবীর বন্দনা করা হয়ে থাকে। অনেক সময় পূজারও আয়োজন করা হয়।
এর আসর বসে কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে। বিশেষ করে কালীপূজার সময় অর্থাৎ শরৎ-হেমন্ত কালের দিকে এটি অনুষ্ঠিত হয়। ধামের গানের অভিনেতা ও শ্রোতারা মূলত কৃষক জনগোষ্ঠীর। এ সময় মাঠে খুব একটা কাজ থাকে না। আর থাকলেও সন্ধ্যার পর তারা কিছুটা অবকাশ পায় এবং মেতে ওঠে জীবনমুখী সাংস্কৃতিক তৎপরতায়। এরপর সারারাত ধরে সবাই মিলে উপভোগ করেন এই পালা। ধামের গান উপলক্ষে গ্রামে গ্রামে মেলার আয়োজন হয়। হাজার হাজার মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে আসে এই পালা উপভোগ করতে। টানা কয়েক দিন ধরে চলতে থাকে এই পালা।
ধামের গানের উৎপত্তিকাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয় কয়েক শত বছর আগে থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে ধামের গানের প্রচলন চলে আসছে। ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী ময়মনসিংহ গীতিকা ও জারিগান, রংপুরের ভাওয়াইয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা ইত্যাদি যেমন দেশবাসীর কাছে সুপরিচিত তেমনি বাংলাদেশের উত্তরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জনপদ ঠাকুরগাঁওয়ের নিজস্ব ভাষার গান এই ‘ধামের গান’ বাংলা লোকজ সংস্কৃতির এক মৌলিক উপাদান।
ঠাকুরগাঁওয়ের ধামের গানে মূলত এদের স্থানীয় লোকজন যে ভাষায় কথা বলে সেই আঞ্চলিক ভাষাই ব্যবহৃত হয়। পালার কাহিনি আগে থেকে নির্ধারণ করা হলেও বর্তমান নাটক সিনেমার মতো পালার সংলাপ পূর্বনির্ধারিত থাকে না। ঘটনার আবর্তনে শিল্পীরা বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতায় নিজেদের মতো করে সংলাপ পরিবেশন করেন।
‘হলদিশরী সোনাই ফাত্রা’ একটি পালা। এতে একজন বিধবার দুঃখ দুর্দশার কথা বলা হয়েছে। এই অসহায় বিধবা ছাগল পালন করেন। ঘটনাপ্রবাহে একদিন তার ছাগল প্রতিবেশীর ক্ষেতে ধানের চারা খাওয়ার অভিযোগে বন্দি হলে ক্ষেতের মালিকের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় সেই বিধবা গানের সুরে বলে,
আজি হোকর ছাগললা
ও মুই বান্ধীম কতই দূর
মোর নিরাশি বাহে জ্বলেছে আগুন।
মরিয়া গেইছে স্বামীধন মোর
কাঁয় করিবে যতন!
অভাগী স্বামীর মৃত্যু বেদনায় জর্জরিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে সুর করে এই গান গায়। সাধারণ কথাগুলোতে করুণ সুর যোগ করে দিলে তার বেদনা দর্শকরা অনুধাবন করতে পারে সহজেই।
আবার ‘সাইকেল সরী, হ্যান্ডেল বাউদিয়া’ এই পালায় নারীর ক্ষমতাকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই পালায় নারীকে সাইকেল এবং সাইকেলের হ্যান্ডেলকে পুরুষের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। গ্রামে পুরুষেরা সাধারণত ক্ষেতে খামারে কাজ করে, দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। অপরদিকে মহিলারা সংসারের কাজের পাশাপাশি জমির কাজ ও অন্যান্য কাজ করে থাকে। হিসাব করলে দেখা যায় একটি সংসারে নারীদের অবদান পুরুষের থেকে অনেক বেশি। কিন্তু তারপরও নারীর জীবনের নিয়ন্ত্রণ পুরুষের কাছে থাকে। এখানে সাইকেল ও সাইকেলের হ্যান্ডেল দিয়ে নারী পুরুষের এই বৈষম্যকে তুলে ধরা হয়েছে।
‘নয়নজলী অন্ধস্বামী’ কাহিনিতে জমিদারের অন্ধ ছেলে সৎ মায়ের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জমিদারবাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে এক গরিব ঘরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে এক ডাকাতের মেয়ে নয়নজলী বাবার আদেশে এই অন্ধ ছেলেকে বিয়ে করে নিজের নিয়তি স্বীকার করে নেয়। পরবর্তী সময় সেই গ্রামেরই এক ধনী ব্যক্তি নয়নজলীকে লোভ-লালসা দেখালেও সে তার স্বামীকে ত্যাগ করে না। যা মানবিক প্রেমের মূর্তমান উদাহরণ। এই রকম প্রতিটি পালাই গানের সুর এবং হাস্যরসের মাধ্যমে দর্শকদের আকৃষ্ট করে এমন উপদেশমূলক বাণী প্রকাশ করে থাকে।
ধামের গানের একটি মজার বিষয় হলো এখানে পুরুষেরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। তাই যে সকল শিল্পী নারী চরিত্রে অভিনয় করেন এবং গান পরিবেশন করেন তাদের এই ধামের দলে বিশেষ কদর রয়েছে। এদের জন্য বিশেষ ধরনের মেকাপের ব্যবস্থা রয়েছে।
ধামের গানের জনপ্রিয়তাকে কেন্দ্র করে যেসব জায়গায় ধামের আসর বসে সেসব জায়গার নামের সঙ্গে ‘ধাম’ কথাটি যুক্ত করা হয়েছে। যেমন-ঠাকুরগাঁওয়ের আরিচা ধাম, ঢোলপুকুরের ধাম, ফাড়া বাড়ি ধাম, খোঁচা বাড়ি ধাম ইত্যাদি। ঠাকুরগাঁও জেলার পাঁচটি থানায় এ রকম ৬০০টিরও বেশি ধাম আছে। তার মধ্যে ঠাকুরগাঁও সদরেই সর্বোচ্চ। ঠাকুরগাঁও জেলায় বর্তমানে ১২০০ থেকে ১৫০০ ধামের গানের দল রয়েছে।
‘ধামের গান’ নামে লোকনাট্য বাংলাদেশের অন্য কোনো জেলাতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঠাকুরগাঁওয়ের শিল্পী ও কলাকুশলীরা ধামের গানকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলেছে। বর্তমানে কিছু সরকারি পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে ধামের গানের ভিত খানিকটা মজবুত হয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় গবেষণা এবং উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতাই পারবে ধামের গানকে আরও অনেক দূর নিয়ে যেতে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh