তারা নিজেদের পরিচয় দেন নমঃশূদ্র হিসেবে। তবে তাদের আরেকটি সুনির্দিষ্ট পরিচয় রয়েছে। কাগজে-কলমে তাদের অভিহিত করা হয় কায়পুত্র নামে। এরা শূকর পালনের পেশায় নিয়োজিত। ২০১৯ সালে সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (এসইএইচডি) প্রকাশিত এক মনোগ্রাফ অনুসারে, কায়পুত্র সম্প্রদায়ের আনুমানিক জনসংখ্যা ১২ হাজার। যশোর, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ ও খুলনার বিভিন্ন গ্রামে এদের বাস।
গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা ও ১৮৬০ সালের দিকে হিন্দুদের মতুয়া সম্প্রদায় গঠনের জন্য পরিচিত হরিচাঁদ ঠাকুরকেই কায়পুত্ররা আদিপুরুষ হিসেবে গণ্য করেন। সমাজের ব্রাত্য বা নিম্নবর্গের এসব মানুষ সমাজে অচ্ছুতই বলা যায়।
শূকর পালের রাখালদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বছরের বেশিরভাগ সময় তারা পরিবার থেকে দূরেই থাকে। দিনে শূকর পালনের জন্য ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয় এদের। রাতে অস্থায়ী তাঁবু খাটিয়ে ঘুমায় তারা। খাওয়া-দাওয়াও পথে-ঘাটে। বিশ্রাম নেওয়ার জায়গায় অস্থায়ী চুলা বানিয়ে এরা রান্না করে। এই কায়পুত্রদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, অন্য কোনো বিকল্প নেই বলে এই পেশায় তারা টিকে আছে। এসইএইচডিয়ের গবেষণা অনুসারে, প্রায় ৮০ শতাংশ কায়পুত্র নিরক্ষর, মাত্র ২৩ শতাংশ এসএসসির গণ্ডিপেরোতে পেরেছে। ফলে গোষ্ঠীটির খুব কম লোকই আনুষ্ঠানিক চাকরি পায়। তাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভাগ্যও আশাব্যঞ্জক বলে মনে হয় না। বিশেষত ছেলেদের স্কুলে পড়ার জন্য কাছের অন্য গ্রামে যেতে হয়। আর মেয়েদের পড়াশোনার সম্ভাবনা, প্রশ্নাতীত।
শূকর পালনের পাশাপাশি গোষ্ঠীটির কিছু পুরুষ সদস্য ইদানীং কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর, দর্জি ও গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কায়পুত্র মাছ ধরার দিকে ঝুঁকছেন।
এরা বিভিন্ন মালিকানাধীন পালের রাখাল হয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ায়। একটি দলে চার থেকে ৫০০ শূকর থাকে। শূকর দলবেঁধে চরে বেড়ায়; মাঝেমধ্যে ঘোঁতঘোঁত শব্দ করে। তাগড়া থেকে শুরু করে বুড়ো, বিভিন্ন বয়সের কয়েকশ কালো শূকর মাঠের মধ্যে চরে বেড়াচ্ছে। কোনোটা একটু দলছাড়া হলেই পিটিয়ে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে সীমানার ভেতর। ঢাকার ফার্মগেটে শূকরের মাংসের একটি বাজার রয়েছে। সেখানে এসব বিক্রি করা হবে প্রতি কেজি ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা দামে। একটি শূকর দল পালন করে তারা পাহারা দেয় কমপক্ষে ২ কোটি টাকার। আর মাসে তারা পায় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। শ্রেণি শোষণের চূড়ান্ত অবস্থায় কায়পুত্ররা।
শূকরের পাল নিয়ে বছরের দশ মাস বাইরে থাকতে হয়। জাত-পাতের বেড়াজালে তাদের অচ্ছুত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যে কারণে প্রচণ্ড ঝড়-বাদলেও তারা কারও বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা হাটবাজারে জায়গা পায় না। ক্ষুধা লাগলেও কোনো হোটেল রেস্তোরাঁয় খেতে পারেন না। সামান্য চা পান করতেও যেতে হয় সবার অলক্ষ্যে রাতের বেলা। কারণ এরা অচ্ছুত। রমেন্দ্রের সঙ্গে পালে কাজ করেন সঞ্জিত আর বঙ্কিম। সঞ্জিত জানান, ছোট-বড় সবাই তাদেরকে তুই-তুকারি করে কথা বলে। পালের শূকর অসাবধানবশত কারও সবজি বা ফসলি ক্ষেতে ঢুকলে নিস্তার নেই। গত ১৬ জুন মধুপুর উপজেলার পীরগাছা গ্রামে কচু ক্ষেতে পালের দুটি প্রাণী ঢুকলে গৃহস্থ তেড়ে আসেন। প্রাণী দুটির সঙ্গে তাকেও পেটানো হয়। ফলে কয়েক দিন ধরে হাঁটাচলা করতে খুব কষ্ট হচ্ছে সঞ্জিতের। তার বক্তব্য, অনেকেই পালের প্রাণী আর তাকে একই সমান মাপেন। তাই প্রাণীর কোনো ভুলে তাকেও শাস্তিটা পেতে হয় সমান সমান। দেশের অন্যতম পিছিয়ে পড়া এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী এই কায়পুত্রদের ঘরের নারীরা ৯০ শতাংশেরও বেশি গৃহিণী।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শূকর পালন ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। ফলে পেশা ছাড়ছেন কায়পুত্ররা। খুলনা-যশোরে কিছুসংখ্যক এবং সাতক্ষীরার মোট ২৯টি কায়পুত্র গ্রাম এখন জেলেগ্রামে পরিণত হয়েছে। এরা যেখানে শূকর চরায় বিলের ভিতরে সেখানে মনুষ্যবসতির চিহ্ন পাওয়া ভার। কেবল ধু-ধু সবুজ প্রান্তর আর নীলচে আকাশ দূরের দিগন্তে গিয়ে একাকার হয়েছে। মাথার ওপর কড়া রোদ ডানা মেলে বসে থাকে। রোদ থেকে খানিকটা রেহাই পাওয়ারও কোনো বন্দোবস্ত নেই আশপাশে; না আছে গাছ, না কোনো ছাউনি। এর চেয়ে কঠিন বাস্তবতা, নিজেদের পরিচয় দেওয়া। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে অচ্ছুত হয়ে বেঁচে থাকার কষ্ট অনেক। চার পুরুষের পেশার সামাল দিতে অধিকারবঞ্চিত কায়পুত্ররা এভাবেই দিন কাটায়।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh