বাংলাদেশের রেলওয়ের ইতিহাসের সঙ্গে জগতি রেলস্টেশনের নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই রেলস্টেশনটি কেবল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার সূচনা করেনি, বরং এর মাধ্যমে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের পথও খুলে যায়। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর, বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন তৈরি হয় কুষ্টিয়ার জগতিতে। এই দিনেই বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রথম রেলগাড়ি চলেছিল। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির তৈরি সেই সময়ে ব্রডগেজ রেলপথ ধরে রানাঘাট থেকে দর্শনা হয়ে একটি ট্রেন এসে থেমেছিল কুষ্টিয়ার এই জগতি রেলস্টেশনে; যা তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্বাংশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রেল কোম্পানি ভারতবর্ষে অর্থনৈতিক কাজের জন্য রেলপথ চালু করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এ অঞ্চল বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে এই জগতিতে রেলপথ ও স্টেশন নির্মিত হয়। কিন্তু ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক দেশের প্রথম এ স্টেশনটির বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক ও জরাজীর্ণ। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অবহেলায় সংস্কার কিংবা আধুনিকায়নের অভাবে দোতলা স্টেশন ভবনটি এখন ব্যবহার অনুপযোগী ও পরিত্যক্ত।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ ভগ্নপ্রায় ‘জগতি রেলস্টেশন’-এর লাল ইটের তৈরি দ্বিতল ভবনটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লাল ইটের দালান এখন মলিন। আশপাশ শ্যাওলা, ময়লা জীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। ভবনে ফাটল ধরায় উপরতলাতে কেউ যায়নি বহু বছর। অনেক দিন আগে যাত্রীদের সুবিধার জন্য তৈরি করা ওয়েটিং রুমও ভেঙে গেছে। প্ল্যাটফর্মের ইটও ভেঙে গেছে। ক্ষয়ে গেছে গাঁথুনিও। কক্ষের ভেতরের যন্ত্রাংশ সবই বিকল। এগুলোর কোনো ব্যবহার ও সংস্কার কিছুই নেই।
স্টেশনটিও পরিত্যক্তপ্রায়। কেবল দুটি লোকাল ট্রেন আছে, মাঝে মাঝে অবশ্য ভারত থেকে কয়লা এবং পাথরবাহী মালগাড়ি আসলে এই স্টেশনে অনেক সময় সেগুলো খালাস হয়। তবে স্টেশন পরিচালনা করার জন্য কোনো কর্মচারী নেই।
কুষ্টিয়ার এই স্টেশনটি আকারে ছোট হলেও এর রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। ১৬২ বছরের পুরনো এই স্টেশনটি অনেক কিছুই দেখেছে। উপনিবেশ ব্রিটিশ সরকারের শাসন-শোষণকাল, পাকিস্তানের দুঃশাসন, দেখেছে সেকালের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও জীবনযাত্রা। একালও দেখছে। এর সবকিছুর সাক্ষী হয়ে রয়েছে এই স্টেশন ভবনটি।
বিগত সরকারের সময়ে দেশে অনেক উন্নয়ন কাজ হলেও এ দেশে স্থাপিত প্রথম রেলওয়ে স্টেশনটির কোনো উন্নয়ন হয়নি। দেশের প্রথম রেলস্টেশন হিসেবে স্মৃতি সংরক্ষণে কুষ্টিয়ার জগতি স্টেশনটির উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন এলাকাবাসীসহ সুধীবৃন্দ।
ব্রিটিশরা ওই সময় সরকারি স্থাপনাগুলোতে লাল রঙ ব্যবহার করত। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ব্রিটিশরা চলে গেছে বহু আগে, পাকিস্তানিরাও। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের সময়েও এই রঙের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এমন অনেক ভবন বাংলাদেশ-ভারতে দেখা যায় যেগুলোতে আজও লাল রঙ বিদ্যমান।
তথ্য মতে, ১৮২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জর্জ স্টিফেনসন আবিষ্কৃত বিশ্বের প্রথম স্টিম ইঞ্জিনের রেল উদ্বোধন করা হয়। ‘লোকোমোশন’ নামের ওই ট্রেনটি ব্রিটেনের স্টকটন থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে ডালিংটন পর্যন্ত যায়। এই রেল ইঞ্জিনের প্রথম চালক ছিলেন রেলের আবিষ্কারক সিভিল ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জর্জ স্টিফেনসন নিজেই। ওই সময় ক্রমান্বয়ে বিশ্বজুড়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেলওয়ের বিপ্লব শুরু হয়। রেলের এই অগ্রগতিতে ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায় ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলাও পিছিয়ে ছিল না। ওই সময় ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে বাংলায় রেলওয়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও পণ্য পরিবহনের কাজে এ অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে জগতি রেলওয়ে স্টেশনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাট থেকে কুষ্টিয়ার দর্শনা ও পোড়াদহ হয়ে জগতি পর্যন্ত ব্রডগেজ এই রেলপথের উদ্বোধন করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘জগতি স্টেশন’।
তখন জ্বালানি ‘কয়লা’ পুড়িয়ে কালো-সাদা ধোঁয়া ছড়িয়ে ঝিক ঝিক শব্দে স্টিম ইঞ্জিনের (বাষ্পচালিত) রেলগাড়ি এসে থামত স্টেশনে। রেলগাড়ি দেখতে আশপাশের কৌতূহলী মানুষজনের ভিড় জমত। পণ্য পরিবহনসহ যাত্রীদের পদচারণায় মুখরিত ছিল রেলস্টেশনটি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও কৌশলগত সুবিধাসহ বাণিজ্যিক স্বার্থ বিবেচনায় বাংলায় রেলওয়ে স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল গেট ইন্ডিয়ার পেনিনসুলার রেলওয়ে নামক কোম্পানির নির্মিত মুম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের উদ্বোধন করা হয়। এটিই ছিল ব্রিটিশ ভারতে রেলওয়ের প্রথম যাত্রা। অপরদিকে ১৮৫৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া থেকে হুগলী পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার রেলপথ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলায় প্রথম রেলপথ চালু করা হয়। পূর্ববঙ্গের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে রেললাইন স্থাপনের বিষয়টিও ব্রিটিশ সরকার গুরুত্বসহকারে বিবেচনার পর ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃক কলকাতার শিয়ালদহ থেকে রানাঘাট পর্যন্ত রেলপথ উদ্বোধন করা হয়। এই লাইনকেই পরে বর্ধিত করে ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার (তৎকালীন নদীয়া জেলা) দর্শনা থেকে পোড়াদহ হয়ে জগতি পর্যন্ত ৫৩.১১ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রডগেজ লাইন নির্মাণের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে প্রথম রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
পরে ঢাকার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করতে ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি জগতি স্টেশন থেকে বর্তমান রাজবাড়ী জেলার পদ্মা তীরবর্তী গোয়ালন্দঘাট পর্যন্ত রেললাইন চালু হয়। এ সময় মানুষ কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপে জগতি স্টেশন হয়ে গোয়ালন্দঘাটে নামতেন এবং স্টিমারে পদ্মা নদী পার হয়ে চলে যেতেন ঢাকায়।
ব্রিটিশ সরকার জগতি রেলস্টেশন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু অবকাঠামো গড়ে তোলে এখানে। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেগুলো আজ হারিয়ে গেছে। রেলের স্টিম ইঞ্জিনে পানি খাওয়ানোর জন্য প্ল্যাটফর্মের দুই পাশে নির্মিত বিশাল আয়তনের ওভারহেড পানির ট্যাংক দুটি ইতোমধ্যে পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। ট্যাংক দুটিতে সে সময় কয়লার ইঞ্জিনচালিত পাম্প দিয়ে ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন করা হতো। স্বাধীনতার পূর্বে কুষ্টিয়ায় চিনিকল প্রতিষ্ঠার পর এখানে আখ সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই স্টেশনের। তখন আশপাশের জেলার জন্য ট্রেনে আনা খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী খালাস ও যাত্রী ওঠা-নামা করত স্টেশনে।
কুষ্টিয়াবাসীর দাবি কালের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকা ঐতিহ্যের ধারক দেশের প্রথম এ রেল স্টেশনটির আধুনিকায়ন এবং এর হারানো সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা হোক।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh