খুলনার কয়রা উপজেলার সকিনা বেগম। ছয় সদস্যের সংসারে অভাবেই কাটছিল তার দিন। অবশেষে হয়তো সুখের দেখাও পেয়েছিলেন তিনি। একই গ্রামের রহমত মিয়ার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সকিনা। সন্তানের আশা তাদের জীবনে আরো আনন্দ বয়ে আনে। সকিনা সন্তানসম্ভবা হন, কিন্তু দুঃখ তার পিছু ছাড়েনি। ১৭ সপ্তাহে গর্ভপাত ঘটে, এতে ভেঙে পড়েন তিনি। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার মা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তবে সেই স্বপ্ন বারবার গর্ভপাতের কারণে অধরাই থেকে যায়। ধীরে ধীরে স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় এবং তার ওপর নানা অপবাদ নেমে আসে। একসময় তিনি স্বামীর ঘর থেকে বিতাড়িত হন।
এই ঘটনা কেবল কয়রা উপজেলার সকিনার নয়, বরং উপকূলীয় অঞ্চলের হাজারো নারীর জীবনের বাস্তব চিত্র। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষ নানান শারীরিক সমস্যায় ভুগছে, বিশেষ করে নারী, কিশোরী ও শিশুরা। লবণাক্ততার কারণে জরায়ুর সংক্রমণ এবং প্রজনন সমস্যাগুলো মারাত্মক রূপ নিচ্ছে, যা অনেক ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, লবণাক্ত পানির প্রভাবে নারীদের অকাল গর্ভপাতের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। জাতীয়ভাবে দেশে জন্মের হার যেখানে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ, সেখানে শ্যামনগর উপজেলায় জন্মের হার ০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী পাঁচ লাখ ৭০ হাজার নারী জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং প্রায় তিন লাখ ১০ হাজার নারী মারা যান।
২০১৮ সালের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, উপকূলীয় এলাকার নারী ও কিশোরীরা তাদের ঋতুস্রাবের সময় যে কাপড় ব্যবহার করেন এবং পুনরায় পানিতে ধুয়ে ব্যবহার করার ফলে লবণাক্ত পানির কারণে নানান অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন। সাতক্ষীরার উপকূল এলাকায় দেখা গেছে, শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ, গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, কৈখালি, রমজাননগরসহ উপকূলবর্তী ইউনিয়নগুলোর বেশির ভাগ নারী সুন্দরবনসংলগ্ন নদীগুলোতে রেণু পোনা ও কাঁকড়া আহরণে সাত-আট ঘণ্টা কাজ করেন। এতে তাদের জরায়ুসহ নানা শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
এই অঞ্চলের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা এত বেশি যে, পানীয় জল সংগ্রহের জন্য মানুষকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভধারণের আগে এবং গর্ভাবস্থায় লবণাক্ত পানি পানের ফলে নারীদের উচ্চ রক্তচাপ ও ইক্ল্যাম্পসিয়ার ঝুঁকি বাড়ে, যা গর্ভপাতের কারণ হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, উপকূলীয় অঞ্চলের ৬০ শতাংশ পানির উৎসে লবণাক্ততার মাত্রা সহনীয় সীমার চেয়ে বেশি। এতে সন্তান ধারণ অনেক ক্ষেত্রে জীবনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অতিরিক্ত লবণাক্ত পানির কারণে নারীদের শরীরে পুষ্টির অভাবও দেখা দেয়। পানি ও খাদ্যের লবণাক্ততা শুধু মা হওয়ার স্বাভাবিক ক্ষমতাকেই নয়, বরং পুরো প্রজন্মের সুস্থতাকেও হুমকির মুখে ফেলছে। এই সংকট মোকাবিলায় স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
কিছু আশার আলোও দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও এবং সরকারি সংস্থার উদ্যোগে লবণাক্ততা মোকাবিলায় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পুকুর ও কূপের মাধ্যমে মিঠা পানি সংরক্ষণ এবং লবণসহিষ্ণু শস্য চাষে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। তবে প্রকৃত সমাধান পেতে দরকার ব্যাপক সচেতনতা এবং কার্যকর পদক্ষেপ।
লবণাক্ততা কেবল একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি নারীর অধিকার ও প্রজন্মগত সুস্থতার প্রশ্ন। মা হওয়ার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার, আর তাই এই সমস্যার সমাধান করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh