র‍্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে ‘৯ মাস বন্দীশালায়’, ৭ মাস ভারতের কারাগারে

‘আমার ছেলের ৮ দিন জ্বর আছাল (ছিল)। আমার কাছেই শুয়া আছাল, র‌্যাব আর সাদাপোশাকে মানুষ ঘরে আইসা ধইরা নিয়া গেছিল। তারা কইছিল জিজ্ঞাসাবাদ কইরা ছাইড়া দিমু। র‌্যাব অফিসে, ডিবি অফিসে, পুলিশের কাছে গেছি কতবার, কোনো খোঁজ পাই নাই। আমার বাবারে এখন ফিরা পাইছি।'

২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট রাতে র‌্যাব পরিচয়ে একটি দল রহমত উল্লাহকে ঢাকার ধামরাইয়ের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। এর পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। রহমতউল্লাহ জানিয়েছেন, নয় মাস একটি বন্দীশালায় নির্যাতনের পর তাকে ভারতে অনুপ্রবেশ করানো হয়েছিল। সেখানে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সাত মাস কারাগারে ছিলেন তিনি। 

প্রায় ১৬ মাস পর গতকাল রবিবার (২২ ডিসেম্বর) দুপুরের দিকে বাড়িতে পৌঁছান রহমতউল্লাহ। ছেলেকে জীবিত ফিরে পাবেন কি না সেটি জানা ছিল না মা মমতাজ বেগমের। ছেলেকে পেয়ে তিনি বলেন, ‘ছেলেরে আমি পাইছি, আমি শান্তি পাইছি। আল্লায় আমার ছেলেরে আমার বুকে আনছে।'

গতকাল বিকেলের দিকে ঢাকার ধামরাই উপজেলার গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়নের বড়নালাই গ্রামে বাড়িতে ফেরে রহমত উল্লাহ।

সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে জড়ো হয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ঘরের ভেতরেও মানুষের ভিড়। হলুদ টি-শার্ট পরে চেয়ারে বসে থাকা তরুণকে ঘিরে সবার চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ। তরুণের মায়ের চোখে অশ্রু, তবে তা আনন্দের। তিনি কখনো ছেলের কপালে চুমু দিচ্ছেন। কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ভাই-বোনের মুখে হাসি।

পরিবারের সদস্যরা জানান, শনিবার (২১ ডিসেম্বর) দুপুরে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন পান রহমত উল্লাহর বড় ভাই মো. ওবায়দুল্লাহ। অপর প্রান্তের ব্যক্তি নিজেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার রহনপুর পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের এসআই (উপপরিদর্শক) মো. ফজলে বারী পরিচয় দিয়ে রহমত উল্লাহকে পাওয়ার কথা জানান। ওবায়দুল্লাহ খোঁজ নিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হন। এরপর পরিবারের চার সদস্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে যান।

মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, ‘এস আই মো. ফজলে বারীর কল পেয়ে আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে রহমত উল্লাহকে নিয়ে বাসায় আসি। শুরুতে রহমত উল্লাহ আমাকে চিনতে পারছিল না। এখনও খুব বেশি কথা বলতেছে না।'

বাড়িতে ফিরেও অনেকটাই চুপচাপ রহমত উল্লাহ। কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। প্রশ্ন করা হলে চুপ থাকছেন। কিছু প্রশ্নের অল্প কথায় জবাব দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘ভারতের জেল থিকা বাইর করছে, তারপর বাংলাদেশে নিয়া আসছে। আজকে বাড়ি আসছি।'

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার পুলিশ জানায়, থানায় আসার পর রহমত উল্লাহ তাদের জানিয়েছেন, গত বছরের ২৯ আগস্ট নিজ বাড়ি থেকে র‌্যাব তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর ঢাকায় নয় মাস চোখ, হাত-পা বেঁধে আটকে রাখা হয়। যেখানে তাঁকে রাখা হয়েছিল, এর আশপাশে বিমান ওঠানামা করত। শুধু খাওয়ার সময় চোখ খোলা রাখা হতো। খাওয়া শেষ হলে আবার তাঁর চোখ বেঁধে ফেলা হতো। এভাবে নয় মাসের মতো রাখার পর গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন হাইয়েস গাড়িতে করে তাঁকে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে নিয়ে যায়। সীমান্ত পার করে রহমত উল্লাহকে ভারতের সীমানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। দু-তিন দিন ভারতে ঘুরার পর ভারতের পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

রহমত উল্লাহ পুলিশকে জানিয়েছেন, অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতে তাঁকে একটি জেলে রাখা হয়। সেখানে ছয় মাসের সাজা হয়। এ ছাড়া এক হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই মাস জেল খাটতে হবে—এমন সাজা হয়। সাত মাস জেল খাটার পর সর্বশেষ দমদম জেলখানা থেকে গাড়িতে করে সীমান্তে আনা হয়। গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে তাঁকে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করা হয়। পরে তিনি গোমস্তাপুর থানায় যান। এরপর থানা-পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পরিবারের তথ্য নেয়।

রহমত উল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদকারী রহনপুর তদন্তকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত ইনচার্জ মো. ফজলে বারী বলেন, প্রথমে রহমত উল্লাহ সন্দেহ করছিলেন, পুলিশ তাঁকে মেরে ফেলতে পারে। তবে পরে কিছুটা স্বাভাবিক হলে তাঁর কাছ থেকে পরিবারের তথ্য নিয়ে ধামরাই থানা-পুলিশের সহযোগিতায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরে তাঁর পরিবারের সদস্যরা থানায় পৌঁছালে নিশ্চিত হতে শনাক্তকরণ মহড়া হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন পাঁচ জন লোককে তাঁর সামনে রেখে ভাইকে শনাক্ত করতে বলা হলে তিনি ভাইকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন।

মো. ফজলে বারী বলেন, ‘তাকে (রহমত উল্লাহকে) জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাকে ধরল কেন? সে উত্তরে বলেছিল, ‘‘তারা বলছে (র‌্যাব) আমি নাকি জঙ্গি করি।” তখন সিডিএমএস (সফটওয়্যার ক্রাইম ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) সার্চ করে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা পাইনি।’

গোমস্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল বাসার বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে রহমত উল্লাহ জানিয়েছেন, নয় মাস তাঁকে দেশেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে রেখেছিল। এরপর যশোর সীমান্ত এলাকায় মোটরসাইকেলওয়ালা দুজন লোকের কাছে দেওয়া হয়। পরে ওরা ভারতে নিয়ে যায়। পাসপোর্ট ছাড়া ভারতে যাওয়ায় ভারতের পুলিশ মামলা দিলে সাত মাস জেল খেটেছেন। গত পরশু গভীর রাতে নৌকা করে রহমত উল্লাহকে নদী পার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। পরে তিনি লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এটা কোন এলাকা? লোকজন তাঁকে এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর জানান। এরপর তিনি থানার আসেন।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh