বিষবৃক্ষ তামাক চাষে ঝুঁকছেন কৃষক

কম খরচে অধিক লাভের আশায় দেশি-বিদেশি তামাক কোম্পানির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিষবৃক্ষ তামাক চাষে ঝুঁকছেন লালমনিরহাটের কৃষকরা। এতে কৃষক পরিবারগুলোতে দিন দিন বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

কয়েকটি দেশি-বিদেশি তামাক কোম্পানির প্রতিনিধি স্থানীয় কৃষকদের তামাক চাষ সম্প্রসারণে উৎসাহিত করে চলেছে। এখানে বাণিজ্যিকভাবে চারটি জাতের তামাকের চাষ করা হয়। এগুলো হলো এফসিভি, মতিহার, জাতি ও বার্লি। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ঢাকা টোব্যাকো, জাপান টোব্যাকো, আবুল খায়ের টোব্যাকো, নাসির টোব্যাকো, আকিজ টোব্যাকোসহ বেশ কয়েকটি তামাক কোম্পানি বীজ, সার, অগ্রিম ঋণসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তামাক চাষে কৃষকদের আগ্রহী করে তুলছে। এই কোম্পানিগুলোর আর্থিক সহযোগিতা ও বিনা মূল্যে বীজ, ঋণ, সার ও নগদ অর্থসহ তামাক ক্রয়ের নিশ্চয়তার কারণে লালমনিরহাটে তামাক চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মূলত কৃষি বিভাগের উদাসীনতা, তামাক উৎপাদনের আগে কোম্পানিগুলোর দর নির্ধারণ, বিক্রির নিশ্চয়তা, চাষের জন্য সুদমুক্ত ঋণ, কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন ও পরামর্শ দান তামাক চাষ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। গত কয়েক বছর আগেও লালমনিরহাটের যেসব আবাদি জমিতে শীতকালীন মৌসুমে ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা, আলুসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয়েছিল, এখন সেসব জমিতে তামাকের চাষ হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, লালমনিরহাট জেলার পাঁচটি উপজেলাসহ তিস্তা নদীর প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে দিন দিন বেড়ে চলেছে তামাকের  চাষ। নারী-পুরুষ ও ছোট ছোট কোমলমতি শিশুদের নিয়ে চলছে তামাক পরিচর্যার কার্যক্রম। বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে নদীর বুকজুড়ে জেগে ওঠা চরের হাজার হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হওয়া ফসলের মধ্যে বেশির ভাগ চাষ হচ্ছে তামাক। 

লালমনিরহাট সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের কৃষক আকবর আলী জানান, ‘বিএটিসি সিগারেট কোম্পানির মাধ্যমে তামাক চাষিদের জন্য একরপ্রতি জমিতে বীজ বাবদ নগদ তিন হাজার ৬০০ টাকা দেওয়া হয়।  সেই সঙ্গে ইসুবি সারের জন্য  ছয় হাজার টাকা আগাম দেওয়া হয়। এ ছাড়া উৎপাদিত তামাক সঠিক মূল্যে কৃষকের বাড়ি থেকে কেনার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। যে কারণে এলাকায় রবি মৌসুমে বেড়ে চলেছে তামাকের চাষ। প্রশাসনের তেমন পদক্ষেপ না থাকায় তৃণমূল পর্যায়েও বেড়েছে এর চাষাবাদ। 

বর্তমানে শ্রমিকের মজুরি বেড়ে গেছে। যে টাকা খরচ করে ধান, ভুট্টা, শাক-সবজি ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন করা হয়, সেসব বিক্রি করে কোনো কোনো সময় আসল টাকাই ওঠে না। কিন্তু  অল্প খরচে কোম্পানির দেওয়া ঋণ গ্রহণ করে তামাক চাষ করে লাভবান হচ্ছেন কৃষক।  সদর উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের শিবরাম গ্রামের কৃষক মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে তামাক আবাদ করি। এবার ভেবেছিলাম আলুর আবাদ করব কিন্তু আলুর বীজের যে দাম তার সঙ্গে সার কীটনাশকের খরচ তো আছেই। তাই এবারও তামাক কোম্পানি থেকে টাকা নিয়ে তামাক চাষ করছি।’

লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের সাবেক সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায় জানান, তামাক চাষ ও সেবন মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তামাক পাতার বিড়ি, সিগারেট, গুল, খইনি ও জর্দাসহ নানা ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করায় হাসপাতালগুলোতে দিন দিন শ্বাসকষ্ট, চর্ম রোগ, ক্যান্সারসহ নানা ধরনের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তামাক চাষে কৃষকদের পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও রয়েছেন সাধারণ মানুষজন।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের  উপপরিচালক ড. মো. সাইখুল আরিফিন বলেন, গত বছর লালমনিরহাটে প্রায় ৯ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। চলতি বছরে তার থেকেও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

কৃষি জমিতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তামাক চাষ অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কৃষকদের বিনা মূল্যে তামাকের বীজ, সারসহ ঋণও দেওয়ায় তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকরা। তবে তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে এবং এর কুফল সম্পর্কে অবগত করতে কৃষি বিভাগ থেকে নিয়মিত কৃষকদের সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh