চার পুরুষ ধরে দপ্তরি, রাজকীয় বিদায়

রবিবার, ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক ১২টা। চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ বাজার দারুণ কর্মচঞ্চল হয়ে উঠতে শুরু করেছে ততক্ষণে। হাঁটব বলে কথা। বিকেল গড়াতেই গ্রাম থেকে ছুটে আসবে মানুষ। বাজার ঘেঁষে টিকে থাকা প্রাচীন বাবু খাঁ দিঘির পানি ছুঁয়ে বয়ে আসছে ঘূর্ণি হাওয়া- উত্তর পারে দাঁড়িয়ে থাকা জোরারগঞ্জ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দীর্ঘ দালানে এসে ধাক্কা খায়, টিচার্স রুমের সামনে ছোট্ট টুলটিতে বসে থাকা দপ্তরি নুরুল আবছারের সফেদ পাঞ্জাবিতে ঢেউ খেলে যায়। রুগ্ন শরীরে তার বয়সের ছাপ।

হাত ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে একটু গম্ভীরভাবেই উঠে দাঁড়ালেন, তারপর পিতলের ঘণ্টাটি হাতে তুলে নিয়ে টানা বাজাতে থাকলেন ছুটির ঘণ্টা। রোজকার নিয়মের খানিকটা ব্যতিক্রমই ঘটল এদিন- একটু আগেই ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন আবছার। অর্ধ দিবসে ছুটি হয়ে গেল, কিন্তু আজ দুরন্ত ছাত্রছাত্রীর দল ক্লাস ছেড়ে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলো না! একটু ধীরস্থিরভাবে বেরিয়ে এলো। তারপর ঘণ্টা বাজাতে থাকা আবছারের চারপাশে ভিড় করল তারা। স্কুলের আঙিনা ছেড়ে কেউই বেরিয়ে গেল না। সবারই বদনখানি মলিন। তাদের প্রিয় আবছার কাকু আজ স্কুল থেকে বিদায় নিচ্ছেন। অর্ধ দিবস ছুটির কারণও এটি। 

শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া স্কুলটির এই পুরোটা সময় দপ্তরির দায়িত্ব পালন করেছেন নুরুল আবছারসহ তার পরিবারের চার পুরুষ। আবছারই শেষজন। কর্মজীবনের শেষ দিন তাই ভিন্নধর্মী এক আয়োজন করল বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। রাজকীয় পোশাকে সাজিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে, ঘোড়ার গাড়িতে করে নুরুল আবছারকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আগে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা আবছারকে বহনকারী ঘোড়ার গাড়িকে সামনে রেখে বাজার প্রদক্ষিণ করে। 

অভিনব এই বিদায়ি সংবর্ধনার বিষয়ে বলতে গিয়ে উচ্ছ্বাস ঝরল জোরারগঞ্জ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুল আলমের গলায়, ‘নুরুল আবছারকে বহনকারী ঘোড়ার গাড়িটি নিয়ে আমরা যখন বাজার প্রদক্ষিণ করছিলাম তখন উপস্থিত জনতার মাঝে বেশ উৎসবমুখর আবহ তৈরি হলো। সবাই সশব্দে উচ্ছ্বাসের জানান দিতে চেষ্টা করছিলেন। বিদায়ি সংবর্ধনার এই পরিকল্পনাটি আমারই ছিল, তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির পরিশ্রমে সফল হয়েছে আয়োজনটি। 

আড়ম্বরপূর্ণ এই বিদায়ি সংবর্ধনা পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন নুরুল আবছার। তিনি বলেন, ‘আমার দাদার বাবা বাদশা মিয়া, দাদা ছেরাদুল হক, বাবা মুন্সী মিয়া তারপর আমি। আমাদের পরিবারের চার পুরুষ এই স্কুলে ঘণ্টা বাজানের কাজ করেছি। আমাকে দিয়েই শেষ হলো, কারণ আমার ছেলে এ পেশায় আসবে না। শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমার সুন্দর সম্পর্ক ছিল সব সময়। বিদায়বেলা শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের থেকে আমি যে সম্মান পেলাম, তা আমৃত্যু মনে থাকবে।’ বাজার ঘুরে নুরুল আবছারকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িটি যখন স্কুল পেরিয়ে তার বাড়ির পথে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল তখন দিগন্তজুড়ে গোধূলি। ১৯৮৪ থেকে ২০২৫ সাল, ৪১ বছরের কর্মজীবন শেষে বছর ষাটের নুরুল আবছার কিছুটা বিষণ্ণ মনেই বাড়ি ফিরছিলেন। তার তো ক্লান্ত হওয়ার কথা, তবে বিষণ্ণ কেন! কাল থেকে যে নিয়মিত স্কুলে আসা হবে না, স্কুলে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে খুনসুটি হবে না। 

স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী রিয়াজ উদ্দিন রানার কথায় তার সত্যতাও পাওয়া যায়। রানা জানালেন, ‘স্কুলজীবনে শিক্ষকরা যেমন আমাদের শাসন ও স্নেহ করেছেন, তেমনি আবছার কাকাও করতেন। অনেক হাসিঠাট্টা করতাম তাকে নিয়ে, কিন্তু কখনো রাগ করতেন না।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh