‘অটোপাস’ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। তবে অনেকে বলতে পারছেন না এর বিকল্প কী হতে পারত। তাই তারা এটিকে দেখছেন মন্দের ভালো হিসেবে।
ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ জিয়াউল হক বলেন, ‘অবশ্যই সবাই পাস করবে। তবে ফলটা কী হবে, সেটি নির্ভর করছে তার জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলের ওপর। যাদের জেএসসি ও এসএসসিতে ফল ভালো, তারা অনেকটা নির্ভার। তাদের ফলাফল তো নতুন এই মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ভালো হবে; কিন্তু যারা ওই দুটি পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল করতে পারেননি, এইচএসসিতে ভালো করার আশায় ছিলেন, তারা হতাশ।’
কথা হলো এক অভিভাবকের সাথে। হায়শোরা বেগম বলেন, “আমি ও আমার মেয়ে দু’জনেরই এই খবর শুনে খারাপ লেগেছে। এসএসসি পরীক্ষার সময় আমি অসুস্থ ছিলাম। ফলে আমার মেয়ে ‘এ-প্লাস’ পায়নি। ‘এ’ পেয়েছিল। এবার সে ভালো করে পড়াশোনা করেছিল। আশা ছিল ‘এ-প্লাস’ পাবে; কিন্তু সেই সুযোগ নষ্ট হয়ে গেল।”
এবার এইচএসসিতে ১৩ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থীর সবাই পাস করবে; কিন্তু এর ফল কতটা ভালো হবে, কতটা যৌক্তিক- তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের মধ্যে চলতি বছর জেএসসি ও এসএসসি ফলাফলের গড়ের মাধ্যমে এইচএসসির ফল নির্ধারণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হবে বলে মনে করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আরো দুই-তিন মাস আগে থেকে আমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া দরকার ছিল। আমরা ১০ বা ২০ সেট প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারতাম। একেক বিভাগের পরীক্ষা চার ধাপে হতে পারত। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কম হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেয়া যেত। বেশ কিছু বিকল্প ছিল। পরীক্ষা না নিয়ে এভাবে সবাইকে পাস করালে সামনে অনেক সমস্যার মুখে পড়তে হবে।’
বাংলাদেশে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়, কোনো শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার যোগ্যতা আছে কি-না। আর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলও নির্ভর করে এই দুই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের ওপর। পাশাপাশি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিক্যালে পড়তে চাইলে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিতের মতো কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ন্যূনতম গ্রেড প্রয়োজন পড়ে।
বর্তমান নিয়মে এসএসসির ১০ শতাংশ, এইচএসসির ৩০ শতাংশ ও ভর্তি পরীক্ষার ৬০ শতাংশ- এই নিয়মে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এবার এইচএসসি পরীক্ষা না হওয়ায় ৩০ শতাংশ আর থাকছে না। জেএসসি পর্যায় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে একই বিষয় পড়তে হয়। এসএসসিতে বিভাগ আলাদা হওয়ার পাশাপাশি আলাদা আলাদা বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয় বলে এইচএসসির সব বিষয়ের ফল এই দুই পরীক্ষার গড়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো বিভাগ পরিবর্তন। যেসব শিক্ষার্থী এসএসসি থেকে এইচএসসিতে বিভাগ পরিবর্তন করেছে, তাদের ফল নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জটিলতা তৈরি হবে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, কেউ হয়তো এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে ছিল; কিন্তু এইচএসসির সময় পরিবর্তন করে মানবিক বিভাগ নিয়েছে। ওই বিভাগে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে বর্তমান বিভাগে ফলাফল দেয়া হলে তার যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘সবাই পাস; কিন্তু গ্রেডিংয়ের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। জেএসসি ও এইচএসসিকে সমান গুরুত্ব দেয়া হবে কি-না, আবার বিষয়ভিত্তিক করা হবে কি-না, তা নিয়ে এখনো কাজ করার আছে। মন্দের ভালো হিসেবে এটিকে কতটা পারফেক্ট করা যায়, সেই চেষ্টা করা উচিত। এখনো অনেক সময় আছে। তাই কমিটির উচিত হবে শিক্ষার্থীরা যাতে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেভাবে মূল্যায়ন করা।’
এ জটিলতার ফলে প্রকৌশল ও মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় যোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হতে পারে। এইচএসসি পরীক্ষার পর যেসব শিক্ষার্থী দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। পরীক্ষা না নিয়েই মূল্যায়ন করার ফলে বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো এই শিক্ষার্থীদের নিতে চাইবে না।
উল্লেখ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই ঘোষণার পর এক শিক্ষার্থী এর প্রতিবাদ জানিয়ে আদালতের মাধ্যমে নোটিস দিয়েছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, জেএসসি ও এসএসসির ফলের গড় করার কারণে একদিকে যেমন অনিয়মিত, একাধিক বিষয়ে অকৃতকার্য, প্রস্তুতিহীন শিক্ষার্থীর জন্য সুযোগ তৈরি হবে; তেমনিভাবে কোনো কারণে জেএসসি কিংবা এসএসসিতে কম জিপিএ পাওয়া মেধাবী, পরিশ্রমী শিক্ষার্থীরা তাদের প্রচেষ্টা প্রমাণে ব্যর্থ হবে।
আগের ফলের গড় করে পরবর্তী পরীক্ষার ফল নির্ধারণ এক ধরনের জোরপূর্বক ও বেআইনি আরোপ বলে তিনি দাবি করেন।
এসব বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক দেশকালকে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘এইচএসসি পরীক্ষা যে বাতিল হলো, এটি নিয়ে সামনে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে, আমিও এর সমাধান জানি না। আমি মনে করি, যেসব চ্যালেঞ্জ আসছে, যেসব সমস্যা দেখা দেবে, সবই কিন্তু সত্য। আবার পরীক্ষা কীভাবে নেবে সেটিও একটি বিষয়। ইংলিশ মিডিয়ামে হয়তো পরীক্ষার্থী কম, নিতে পারলো; কিন্তু বাংলা মিডিয়ামে তো কয়েক লাখ শিক্ষার্থী। এত শিক্ষার্থীর পরীক্ষা কীভাবে নেবে, সেটিও আমি জানি না। এই যে শিক্ষার্থীদের মাসের পর মাস বসিয়ে রাখা হয়েছে একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে, এটি আসলেই পীড়াদায়ক। এছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল কি-না, সেটি আমি বলতে পারছি না। তবে পরীক্ষা নেয়াই ছিল বাঞ্ছনীয়।’
কোনো না কোনোভাবে পরীক্ষা নেয়া যেত কি-না, জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘পরীক্ষা কোনোভাবে নেয়া যেত কি-না, সেটি বিবেচনা করে দেখা যেত। আমি মনে করি, পরীক্ষা না নিয়ে একেবারে সহজ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়া হয়নি। শুরু থেকে এত বড় একটি পরীক্ষার বিষয়ে যে পরিমাণে মনোযোগের দরকার ছিল তা হয়নি।’
গত ৭ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানিয়েছিলেন জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে কীভাবে এইচএসসির ফল ঠিক করা হবে, তা নির্ধারণ করবে এ বিষয় সংক্রান্ত একটি পরামর্শক কমিটি। ওই কমিটির সদস্য ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়াররম্যান অধ্যাপক জিয়াউল হক জানান, ঠিক কোন নীতি অনুসরণ করে ফলাফল নির্ধারিত হবে সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া না হলেও, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের কাজ করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ‘কীভাবে জেএসসি পরীক্ষা ও এসএসসি পরীক্ষার বিষয়গুলো যুক্ত করে এইচএসসির বিষয়গুলোর সাথে সম্পৃক্ত করা যায়, তা নিয়ে পরামর্শক কমিটির পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব টেকনিক্যাল কমিটিও কাজ করছে। এসএসসি থেকে এইচএসসিতে যেসব শিক্ষার্থী বিভাগ পরিবর্তন করেছে, তাদের বিষয়টিও পর্যালোচনা করছে কমিটি।’
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh