শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন কতটা সম্ভব

আবারো কাঠগড়ায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। আমূল পরিবর্তনের কথা ভাবছে সরকার। বলা হচ্ছে- মুখস্থ ও সনদনির্ভর পরীক্ষা বাদ দিয়ে শ্রেণি মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে দক্ষ ও যোগ্য করে তুলতে পরীক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হবে। 

মুখস্থ ও সনদনির্ভর পরীক্ষা বাদ দিয়ে স্থায়ীভাবে মূল্যায়নভিত্তিক ব্যবস্থা তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমনই পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। 

তবে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশের শিক্ষাবিদ, গবেষকরা। প্রচলিত সনদনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে মূল্যায়নভিত্তিক ব্যবস্থায় যাওয়ার সম্ভাবনা, অসুবিধা, চ্যালেঞ্জ নিয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের সাথে কথা বলেছেন শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ যতীন সরকার। 

গত ২১ অক্টোবর মাধ্যমিকের বার্ষিক পরীক্ষার বিষয়ে আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘ন্যাশনাল এক্সামিনেশন অ্যান্ড এসেসমেন্ট সেন্টার প্রতিবেশী দেশগুলোতেও হয়ে গেছে। আমাদের জাতীয় পরীক্ষা ও মূল্যায়ন কেন্দ্র করার বিষয়টি পরিকল্পনাধীন রয়েছে। মূল্যায়ন নিয়ে যে কাজগুলো হয়েছে, এর ধারাবাহিকতায় একটি আইনি সংস্থা তৈরি করারও পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। পরীক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার জন্য গবেষণা করে এ পরিবর্তন আনার কোনো বিকল্প নেই।’ 

গতানুগতিক পরীক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে উল্লেখ করেন নওফেল। 

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘আমরা উন্নত বিশ্বের কথা বলি, উন্নত দেশ হতে চাই। উন্নত বিশ্বের অংশ হতে চাই। আবার উন্নত বিশ্বের যে শিক্ষা ব্যবস্থা, সেখানে কিন্তু প্রত্যেক ক্লাসে গ্রেডিং পরীক্ষা পাস-ফেল, জিপিএ-৫ এ ধরনের উন্মাদনা নেই। শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে হবে। বছরের শেষে বা মাঝখানে পরীক্ষা নিয়েই যে সেটি মূল্যায়ন করা যায়, তা নয়। আরও অনেক ধরনের মূল্যায়নের পদ্ধতি রয়েছে। আমরা ধারাবাহিক মূল্যায়নের যে পদ্ধতিগুলো রয়েছে, সেগুলোতে যেতে চাইছি। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কোথায় কোথায় দুর্বলতা আছে, সামগ্রিকভাবে সেগুলো চিহ্নিত করে দুর্বলতা দূর করতে চাই। আমরা পরীক্ষাভীতি, পরীক্ষার চাপ, শারীরিক মানসিক চাপ চাই না। সে কারণে সনদ ও শুধু পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’

সনদনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে মূল্যায়ননির্ভর ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসলে কতটা বাস্তবসম্মত- এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘পাবলিক পরীক্ষায় সার্টিফিকেট দেয়া হবে না, সনদপ্রথা তুলে দেয়া হবে- তাহলে পরীক্ষা দেয়ার পর আমাকে কি দেয়া হবে? চট করেই তো এটা সম্ভব না। মূল্যায়ন নির্ভরতা কীভাবে করবে, সেটি তো বোঝা যাচ্ছে না। আমাকে যদি সার্টিফিকেট না দেয়া হয়, তাহলে আমি যে পাস করেছি, তার প্রমাণ কীভাবে দেয়া হবে? আসলে আমাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার না। একটি ব্যবস্থা থেকে আরেকটি ব্যবস্থায় যাওয়া তো কঠিন কাজ ও অপ্রয়োজনীয়। কখনো কখনো এমন ধরনের নিরীক্ষা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, তা তো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, এখন চট করে বন্ধ করে দিতে চাইলেই তো বন্ধ করা যাবে না। পরিবর্তন করা যাবে না। আমাদের সব শিক্ষাই তো পরীক্ষানির্ভর। পরীক্ষানির্ভরতা কমাতে না পারলেও সনদ দিতেই হবে। পরীক্ষানির্ভরতা যতদিন থাকবে, সনদের প্রয়োজনীয়তা ততদিন থাকবে। সনদ দিয়েই তো অনেক সময় কুলায় না। সনদ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। সনদের ওপর আস্থা থাকে না।’ 

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সনদ না থাকলে কীভাবে কী হবে, আমি তো বুঝলাম না। সনদ ছাড়া পৃথিবীর কোন দেশে মূল্যায়ন হচ্ছে আমি তো বুঝলাম না। অনেক দেশে ওপেন বুক সিস্টেম পরীক্ষা হয়, অনেক রকম ব্যবস্থা আছে; কিন্তু মূল্যায়নের সনদ দেবে না! বিষয়টি এমন হতে পারে- যখন একজন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দেবে, সেখানে একটা লং টার্ম মূল্যায়ন ব্যবস্থা থাকতে পারে। ক্লাস মার্কস দেবে, অ্যাটেনডেন্স মার্কস দেবে, তারপর এমন হতে পারে- একটা টাস্ক দেবে। কুইজ দিতে পারে। এগুলো একসাথে মূল্যায়ন করতে পারে। মুখস্থ বিদ্যার চেয়ে এটি ভালো। তবে সমাজ কী চায়, কী উপযুক্ত- সেটি ভাবতে হবে। আমেরিকায় মূল্যায়ন করে ক্লাস থেকে, তবে আলটিমেটলি একটি সিজিপিএ দেয়। তবে সনদ তো লাগবে। আমি মনে করি অন্যান্য সব পরীক্ষা বাদ দিয়ে দিক, আগের মতো এসএসসি ও এইচএসসি থাকুক। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর সনদ না দিলেও চলে; কিন্তু একেবারে কোনো সনদ দেবে না, এটি কীভাবে সম্ভব! গ্রেড না দিক; কিন্তু একটা কমপ্লিশন তো দেবে শিক্ষার্থীদের। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে না। আগের ব্যবস্থাকে আপডেট করবেন; এর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, কয়েকজন যোগ্য ব্যক্তিকে কয়েক মাসের সময় দেন- এটি কীভাবে মডারেট করা যায়, প্রক্রিয়াটি কীভাবে কাজ করবে, কোন স্তরে কী পরিবর্তন করা যেতে পারে- সেটি নিয়ে পরবর্তীকালে সরকারকে জানাক। সনদ না দিলেও শিক্ষাবর্ষ শেষ হলে একটি কমপ্লিশন সার্টিফিকেট তো দিতে হবে। এই সেন্সে সনদ দিতেই হবে।’ 

শিক্ষাবিদ যতীন সরকার বলেন, ‘মুখস্থ ও সনদনির্ভর পরীক্ষা বাদ দিয়ে মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে নেয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, এটিই অবমূল্যায়ন হবে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি পরীক্ষা নিয়েই মূল্যায়ন করা উচিত; কিন্তু নতুন করে যে মূল্যায়নের কথা বলা হচ্ছে, তাতে এই মূল্যায়ন শব্দেরই অবমূল্যায়ন হচ্ছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হচ্ছে, তা হয়তো বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে; কিন্তু বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যে ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে- তা ওই শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো বিপর্যস্ত করা ছাড়া কিছু করবে না। কাজেই আমি বলব, পরীক্ষার মতো পরীক্ষাটা নিতে হবে। পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না সেটি বুঝি, পড়াশোনা হচ্ছে না; কিন্তু তারপরও যতটুকু পড়াশোনা হয়, তার একটি মূল্যায়ন পরীক্ষা নেয়াই উচিত।’

নতুন ব্যবস্থা কার্যকর করার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘নতুন ব্যবস্থার সব বিষয়-আশয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভাবতে হবে, পরিকল্পনা জানাতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে, মতামত নিতে হবে। এটি কোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। সরকারি সিদ্ধান্ত হলে চলবে না। শিক্ষা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এটি সবার, পাবলিকের শিক্ষা- কোনো সরকারি ব্যাপার না। সেজন্য কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত দিয়েই চট করে বদল করাটা সঠিক হবে বলে মনে করি না। কারও ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত সিদ্ধান্তের ওপর এটি ছাড়া যাবে না। কিংবা এটি প্রশাসনিক ব্যাপার নয়। এটি জাতির ব্যাপার। তাদের পরামর্শ নিতে হবে, জানাতে হবে। একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন হুট করে নেয়া সমীচিন নয়।’ 

এ প্রসঙ্গে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রথমত, এসএসসি ও এইচএসসিতে সনদ থাকা উচিত। সেখানে একটা অ্যাসেসমেন্ট মার্কস যোগ করতে পারে। ক্লাসের একটা ইভ্যালুয়েশন মার্কস দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের ভালো মতো প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, বাংলাদেশ এখন এই বিষয়টিতে খুব নাজুক অবস্থায় রয়েছে। শিক্ষক যদি প্রশিক্ষিত না হন, তাহলে কীভাবে তিনি পড়াবেন।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে চাইলে একটি বিষয় হতে পারে- শিক্ষার্থীদের ইভ্যালুয়েশন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা। কোন কোন ক্রাইটেরিয়া থেকে ইভ্যালুয়েশন করা হবে সেটি জানাতে হবে, প্রক্রিয়াটি কীভাবে হবে, পাঠ্যবইয়ের বিষয় থাকতে হবে। সনদ একেবারে না থাকলে একটি কমপ্লিশন সার্টিফিকেট দিতে হবে। তবে আমি এসএসসি ও এইচএসসিতে সনদ দেয়া উচিত বলে মনে করি। তবে যা-ই করুক, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আগে করতে হবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //