গড়ল হিসাবের চক্করে সরল বাউবি!

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এবার পরীক্ষা না নিয়েই মূল্যায়ন করা হচ্ছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের। অটোপাসের কল্যাণে ভাগ্য খুলেছে অনেকেরই। পাসের হারেও তাই রেকর্ড, একেবারে শতভাগ। তাদের ফল মূল্যায়ন হচ্ছে জেএসসি ও এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে। 

তবে জটিল এই কাজ শুরু করতে গিয়ে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়ছেন দায়িত্বশীলরা। এসএসসির পর উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে বিভাগ পরিবর্তন, মানোন্নয়ন ও কারিগরি থেকে সাধারণ শিক্ষায় আসা পরীক্ষার্থীদের নিয়েই মূলত এ জটিলতার আশঙ্কা। 

তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) শিক্ষার্থীদের ফল মূল্যায়নের ক্ষেত্রে। এই প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই রয়েছে বেশ কয়েক বছরের শিক্ষা বিরতি। অষ্টম কিংবা এসএসসি পাস করেছেন হয়তো অনেক আগেই। তাদের অনেকেরই জেএসসি পরীক্ষা ছিল না। এখন এসব শিক্ষার্থীর ফল মূল্যায়ন কীভাবে হবে, সেটি নিয়ে বেশ জটিলতায় পড়েছেন কর্মকর্তারা। আবার কয়েক হাজার প্রাইভেট পরীক্ষার্থী আছেন, যাদের সরাসরি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা নেই। তাদের ফল কী হবে, সেটিও একটি জটিল প্রশ্ন। 

এ বিষয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যসচিব ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক অবশ্য বলছেন, ‘এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ আসবে, সেগুলো সমাধান করেই ফল মূল্যায়ন করা হবে। শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।’

শিক্ষার কোনো বয়স নেই

শিক্ষাঙ্গন থেকে ছিটকে পড়া মানুষ যাতে আবার শিক্ষা লাভের সুযোগ পান সে জন্য বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) প্রতিষ্ঠা করা হয়। মেধাবী শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়, যারা দারিদ্র্য ও অন্যান্য সমস্যার কারণে ঝরে পড়েছিলেন। বাউবিতে ভর্তির পর শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য থাকে নির্বিঘ্নে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করার; কিন্তু পরীক্ষায় পাস করার পর শিক্ষার্থীর সনদ চার বছর পর হাতে পাওয়ার নজিরও রয়েছে। আদালতের হলফনামামূলে সনদে নাম সংশোধনের মতো সাধারণ একটি কাজ ছয় মাসেও হয়নি, এমন ঘটনাও ঘটেছে। এ যেন সহজ পদ্ধতিতে পড়ার নামে আরো জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া। আর এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙেপড়া শিক্ষার্থীরা পাস না করেই বাউবি ছাড়েন। অনেকে আবার নিয়মের বেড়াজালে পরীক্ষায় অংশ নেয়ার মেয়াদ শেষে ফেরেন শূন্য হাতে। 

বাউবির এইচএসসি প্রোগ্রামে একজন শিক্ষার্থী প্রথম বর্ষে তিনটি আবশ্যিক ও নৈর্বাচনিক বিষয় হিসেবে তিনটি ও ঐচ্ছিক (যদি কেউ নেন) একটিসহ মোট সাতটি বিষয়ে পাঠগ্রহণ শেষে পরীক্ষা দিতে পারেন। প্রথম বর্ষে যেসব বিষয় নিবেন দ্বিতীয় বর্ষে সেগুলোর (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যতীত) দ্বিতীয়পত্র নিতে হয়। প্রথম বর্ষে ন্যূনতম তিনটি বিষয়ে পরীক্ষায় অংশ না নিলে দ্বিতীয় বর্ষে অবশ্য রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ মেলে না। আবার কেউ চাইলে প্রথম বর্ষে ন্যূনতম তিনটি বিষয়ের পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে পরবর্তী বছরে বসতে হবে বাকি সবগুলো ও

অকৃতকার্য বিষয়ের পরীক্ষায়। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী নিজ সময় ও মেধা অনুসারে দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরে এইচএসসি প্রোগ্রামটি শেষ করে সার্টিফিকেট নিতে পারেন। 

পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণে এসএসসি শেষ করেই একটি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী হিসেবে যোগ দেন মোস্তাফিজুর রহমান। এরপর ব্যস্ততা ও কাজের চাপে ৩-৪ বছর পেরিয়ে গেলেও আর এইচএসসি করা হয়নি তার। পরে অবশ্য বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ছিলেন এবারের পরীক্ষার্থী। প্রস্তুতি থাকলেও করোনাকালে আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি। যদিও নাম উঠেছে পাসের খাতায়। 

তিনি বলছিলেন, ‘ভেবেছিলাম চাকরিতে যোগ দিয়ে আবার পড়ালেখাটা শুরু করব; কিন্তু সংসার চালাতে গিয়ে একটা লম্বা বিরতি পড়ে গেল। পরে ভেবে দেখলাম, জীবনের জন্য শিক্ষাটা খুবই দরকার। তাই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ক্লাস করেছি নিয়মিতই। পরীক্ষায় বসতে না পারলেও ফল কীভাবে মূল্যায়ন হবে, তা নিয়ে বেশ চাপ অনুভব করছি।’ 

গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘ফল প্রকাশ নিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠা দূর হলেও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, কীভাবে মূল্যায়ন হবে। এটি স্বাভাবিক যে, এই মূল্যায়ন বেশ কঠিন একটি কাজ। তবে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক আসবেই। পরামর্শক কমিটি অবশ্য এই নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে ফল প্রকাশ জরুরি। কারণ এইচএসসি ফলের উপরই এই শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নির্ভরশীল।’

তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য ফল তৈরির জন্য শিক্ষাবিদরা অবশ্য একটি পদ্ধতির কথা বলছেন- অষ্টম ও এসএসসিতে ছাত্রছাত্রীরা যেসব বিষয়ের পরীক্ষা দিয়েছে, তার মধ্য থেকে সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া তিনটি বিষয়কে বেছে নিতে হবে। পরে সেগুলোর ও ইন্টার্নাল অ্যাসেসমেন্ট বা অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের (যদি থাকে) গড় নম্বরের মাধ্যমে ফল প্রকাশ করা যেতে পারে। এতে করে কোনো শিক্ষার্থীই আর তেমন বঞ্চিত হবে না। করোনাকালে বিশ্বের অনেক দেশই পরীক্ষা নিতে না পারায় এ পদ্ধতিটিকে অনুসরণ করছে।

বাউবির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সরকার যেভাবে বোর্ডগুলোকে নির্দেশ দিচ্ছে ঠিক একইভাবে আমাদেরও এইচএসসির রেজাল্ট করতে হবে। এর বাইরে যেতে পারবে না ওপেন ইউনিভার্সিটি। তবে আমাদের সমস্যা হচ্ছে, সরকার যেমন এসএসসি ও জেএসসির রেজাল্ট মিলিয়ে এটি করার কথা বলছে, আমাদের তো অনেক শিক্ষার্থীর জেএসসি নেই। তাদের কাছে অষ্টম শ্রেণি পাসেরও সার্টিফিকেট নেই। তাই আমাদের এখন এসএসসি ও এইচএসসির প্রথম বর্ষের রেজাল্ট মিলিয়ে কিছু একটা করার বিষয় নিয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। খুব সহসাই একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’ 

তাহলে অষ্টম শ্রেণির মার্কশিট ও সার্টিফিকেট কেন নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এইচএসসির রেজাল্ট তৈরির জন্যই এগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে চাওয়া হয়। আসলে আমরা সব সম্ভাব্য দিকগুলো নিয়েই কাজ করছি। যেটি সবচেয়ে ভালো হয়, সেটিই বেছে নেয়া হবে।’ 

অনেক আগে যেসব শিক্ষার্থী অষ্টম শ্রেণি পাস করেছেন, তাদের কাছে ওই শ্রেণির মার্কশিট ও সর্টিফিকেট পাওয়া বেশ কঠিন। কেননা কয়েক বছর আগেও অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা বোর্ডভিত্তিক ছিল না। তাই নতুন করে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেকেই জালিয়াতির আশ্রয় নিতে পারেন, নম্বর বাড়িয়ে মার্কশিট তৈরি করবেন সেক্ষেত্রে। কেননা করোনাভাইরাসের কল্যাণে অষ্টম শ্রেণির ওই নম্বরই এইচএসসির রেজাল্টের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। 

এসব বিষয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের এখানে অনেক ক্যারিওভার আছে। অনেক ছাত্র আছে, যারা হয়তো ২০ বছর আগে এসএসসি কিংবা এইট পাস করেছে। এই পুরনো শিক্ষার্থীদের নিয়েই মূলত আমরা সমস্যায় আছি, ওদের রেজাল্ট কিসের ভিত্তিতে দেবো। সার্টিফিকেট কিংবা মার্কশিট সংগ্রহ করতে গিয়ে তাদের জালিয়াতির আশ্রয় নেয়াটাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে জালিয়াতি যাতে না হয় আবার তাদের রেজাল্ট অন্যকোনো পদ্ধতিতে করা যায় কিনা, সেই চেষ্টাই করছি আমরা। শিক্ষার্থীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটিই আমাদের মূল লক্ষ্য।’

বাউবির যুগ্ম-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ এস এম নোমান আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাউবির প্রায় ৪৫ হাজার শিক্ষার্থীর এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল; কিন্তু মহামারির কারণে সম্ভব হয়নি। আটোপাস এসব শিক্ষার্থীর ফল মূল্যায়নে এখন কাজ চলছে। একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পর সেটি কাউন্সিলে যাবে। এ বিষয়ে একটি কমিটি আছে, তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে একটা ভালো কিছু দেয়ার। প্রক্রিয়াটি বোর্ডের সাথে মিলিয়েই করা হচ্ছে। রেজাল্ট প্রায় একসাথেই হবে।’

‘যুগ’ বাড়ে অভিযোগে

শিক্ষার্থী তারিকুল ইসলামের অভিযোগ, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় আমাদের যেন ভোগান্তির শেষ নেই! যথাসময়ে পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় না। অথচ নিয়ম হলো পরীক্ষা শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে ফল প্রকাশ করা। দীর্ঘ সময় পর প্রকাশিত হলেও ওয়েবসাইটে তা পাওয়া যায় না। আবার থাকে ভুলে ভরা। শুদ্ধ করতে আবেদন করার পরও আমলে নিতে চায় না কর্তৃপক্ষ।’

শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষাবর্ষ শুরুর নির্দিষ্ট সময়ের পরও সারাদেশের আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোয় বই পাওয়া যায় না। এক বছরের কোর্স তিন বছরেও শেষ করা যায় না। সেশনজটের কারণে কমেছে শিক্ষার মান। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী আর প্রশাসনের মধ্যে কোনো সমন্বয় ও সমঝোতা নেই বললেই চলে। ফলে বছরের পর বছর শিক্ষার্থীদের শিকার হতে হয় নানা হয়রানির। এমনকি ফরম পূরণের টাকা জমা দিয়েও কর্তৃপক্ষের ভুলে রেজিস্ট্রেশন খাতায় নাম না থাকায় পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন না শিক্ষার্থীরা। আবার সব পরীক্ষায় অংশ নেয়ার পরও ফলাফল আসে অনুপস্থিত। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক এম এ মান্নানের দাবি, ‘শিক্ষার্থীদের মাঝে যেন সঠিক সেবা দেয়া যায়, আমরা সে চেষ্টা করছি। যে উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্ম সেই অবস্থানেই ফিরিয়ে আনতে আমরা কাজ শুরু করেছি। অতীতের অনিয়ম-দুর্নীতি সব পরিষ্কার করে নতুনভাবেই ঘুরে দাঁড়াবে বাউবি।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘বৈশ্বিক মহামারি কভিড-১৯ সংক্রমণে বিপর্যস্ত বিশ্বের প্রায় সব দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বাউবি শিক্ষার্থীদের পাঠ বিরতিতে যাতে শিক্ষাজীবন বিঘ্নিত না হয় সেজন্য অনলাইনে শিক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ভর্তি, রেজিস্ট্রেশনও চলমান। বাউবিতে ভর্তি হতে সশরীরে উপস্থিত হতে হচ্ছে না। পাঠসামগ্রী হাতে না পেলেও ই-বুক আছে। রয়েছে ই-প্ল্যাটফর্ম, আইপি বাউবি টিভি, ইউটিউব, ফেসবুক লাইভ, শিক্ষকের সাথে ইমেইলে যোগাযোগসহ নানা ধরনের ব্যবস্থা। এখন আর ৯টা-৫টা নয়, দিনরাত চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //