পার পেয়ে যাচ্ছেন অভিযুক্ত উপাচার্যরা

দেশের ৮ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এর আগে আরো ১৩ উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করেছে ইউজিসি। 

মোট ২১ উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের বেশির ভাগই স্বজনপ্রীতি, অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য, ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটায় আর্থিক দুর্নীতিসংক্রান্ত। এছাড়া কারও বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অপরাধের অভিযোগও আছে। 

আইন সংশোধন ও শর্ত শিথিল করে স্ত্রী-সন্তানসহ নিকট আত্মীয়দের নিয়োগ ইস্যুটি সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। আবার নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করে আগের জায়গায় আইন ফিরিয়ে নেয়ার মতো তুঘলকি কাণ্ডও ঘটেছে। 

তদন্ত শেষে ইউজিসি সংশ্লিষ্ট ভিসির বিরুদ্ধে শাস্তির জন্য সুপারিশ করলেও, বেশিরভাগ ভিসির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অনেক দুর্নীতিবাজ ভিসির অনিয়মের তদন্ত প্রতিবেদন শাস্তি না হওয়ার আগেই গায়েব হয়ে গেছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের যথাযথ বিচার না হওয়ায় পার পেয়ে যাচ্ছেন তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা যায়, ২০০৯ সালের পর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যদের বিরুদ্ধেও নানা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এগুলোর মধ্যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আবদুল জলিল মণ্ডল ও ইবির ভিসি অধ্যাপক আবদুল হাকিমকে অপসারণ করা হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনের মুখে বিদায় করা হয় গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসিকে। ইউজিসির তদন্ত দলের অবশ্য এ ব্যাপারে সুপারিশ ছিল। উল্লিখিতদের মধ্যে শুধু জলিল মণ্ডলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা হয়। এছাড়া বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আর কোনো দৃষ্টান্ত নেই। 

এর আগে ২০১৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রগতিমনা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ব্যানারে তাকে অপসারণ করার দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে; কিন্তু পরবর্তীতে তাকে কোনো প্রকার শাস্তি না দিয়ে, দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ দেয়া হয়। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট (২০০১-০৬) সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে সীমাহীন নিয়োগ বাণিজ্য, গণনিয়োগ, আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মওলানা ভাসানী, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। ২০০৭ সালের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংশ্লিষ্ট ভিসিদের অপসারণ করা হয়; কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরেও এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয়সহ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চাপ থাকে। এজন্য অনেক সময় উপাচার্যরা নিয়োগ বাণিজ্যসহ আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। আবার  কেউ কেউ এমন কর্মকাণ্ডে প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপের শিকার হন। তবে এটাও ঠিক যে, কিছু উপাচার্য নানা ধরনের অন্যায়-অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব অভিযোগ আসছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। এর মূল কারণ হচ্ছে বিচারের অভাব। যদি অন্যায় বা বেআইনি কর্মের বিচার না হয়, তবে অপরাধ বাড়াটাই স্বাভাবিক। আগে অ্যাকশন না হলেও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে আমাদেরকে সহযোগিতা করছেন। আমরা তদন্ত করছি। আশা করছি, প্রকৃত অপরাধীদের বিচার হবে।

সম্প্রতি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তবে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, আমি শিক্ষামন্ত্রীর ষড়যন্ত্রের শিকার। 

৪ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবুল খায়েরের পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইউজিসি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এ প্রক্রিয়ার কোনো পর্যায়ে মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রভাব বিস্তারের কোনো সুযোগ নেই। নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ সাহেবের অভিযোগ অসত্য, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উপাচার্যকে কখনো বড় ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি বা অপকর্মের কারণে ফৌজদারি মামলা বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। দু-একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও, সেটি ছাত্রদের আন্দোলনের কারণেই নেয়া হয়েছে। অথচ কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির কাছে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে তাকে পদচ্যুত বা অপসারণ করা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে তাও হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তদন্তও হয় না। তাদের শক্তভাবে ধরতে তদন্ত কমিটিও বিব্রত হয়। আবার তদন্ত করতে গেলে কমিটির সদস্যদের ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগও আছে। এভাবেই পার পেয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এমন পরিস্থিতিতে কোনো উপাচার্য কখনো অপসারণ হলেও পরে নতুন যিনি আসেন, তিনিও সাবেকের দেখানো পথই অনুসরণ করেন বলে তারা জানান।

বেগম রোকেয়া  বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত দলের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে নানান অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তদন্ত করেছি। সব অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেব। প্রতিবেদন মোতাবেক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেবে সেটি আমরা জানি না।

ইউজিসির সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, দুর্নীতি করেও বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না- এমন বিশ্বাস যদি থাকে, তাহলে বেপরোয়া হওয়াটাই স্বাভাবিক। ৮-১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে বর্তমানে আমরা তদন্ত করছি। আরো ১৩টি প্রতিবেদন গত ১৫ মাসে আমি জমা দিয়েছি। আমরা তদন্তে যে তথ্য পেয়েছি, তাতে এই মুহূর্তে কমপক্ষে চারজন উপাচার্যকে অপসারণ করা দরকার। এটি হয়তো হবে না। কেননা এতে ভাবমূর্তির সমস্যা হতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে এদের উপাচার্য করা হলো কেন। সে কারণে আমরা গত এক বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ রেখেছি। শুধু নির্মাণ কাজ চলছে।

সরকারের সচিব, জেলা প্রশাসক নিয়োগের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে সরকারকে। সম্প্রতি বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, নিয়োগে স্বজনপ্রীতি এড়াতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো প্রস্তাবিত ভিসিদের তালিকার সঙ্গে এখন থেকে গোয়েন্দা প্রতিবেদনও যুক্ত হবে। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, একজন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সব একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। তার কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হয়। আমরা চাই, ভালো ইমেজের ব্যক্তি উপাচার্য হোক। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সরকার একজন সিনিয়র অধ্যাপককে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার আগে তার অতীত আমলনামা ও পারিবারিক তথ্য যাচাই-বাছাই করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চাকরিজীবনে তিনি কোন ধরনের চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি করতে গিয়ে কোন ধরনের ভূমিকা নিয়েছেন, বিরোধীদলীয় শিক্ষকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন কি-না- তদন্ত প্রতিবেদনে এসব বিষয় অগ্রাধিকার পাবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //