বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট

উৎকণ্ঠায় ৫ লাখ শিক্ষার্থী

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আরোপের কথা বলা হয়েছে। এই প্রস্তাব ১০৭টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষার্থীকে চরম উৎকণ্ঠায় ফেলেছে। বাজেট ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। এই বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, এর ফলে তাদের শিক্ষার ব্যয় আরও বাড়বে। করোনাকালীন এ ধরনের সিদ্ধান্তে ড্রপ আউট (ঝরেপড়া) বাড়বে। উচ্চ শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দ্রুত এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে ২০১৫ সালের ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ নামে যে গণআন্দোলন হয়েছিল সেই আন্দোলন করতে এবারও তারা মাঠে নামবেন। সরকার এর আগে ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করলে টানা কয়েক দিন ধরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তা প্রত্যাহার করে নেয়।

‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংগঠনের মুখপাত্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থী শাহ রেজোয়ান বলেন, যদি এই কর আরোপ করা হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফির সঙ্গে বাড়তি টাকা নেবে। অর্থাৎ চাপ পড়বে শিক্ষার্থীদের ওপর। এই টাকা ভার্সিটি কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই নেবে। ২০১৫ সালে যখন শিক্ষার্থীরা পেমেন্ট করতে গেছে, তখন বুঝতে পেরেছে তার ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ২০১০ ও ২০১৫ সালেও বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার ওপরে সরকারের যে অযৌক্তিক কর চাপানোর চেষ্টা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ সরব ছিল। এর ফলে ২০১৫ সালে সরকার সেই ভ্যাট প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল।

  • যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজেদের খরচ চালিয়ে কিছু লভ্যাংশ থাকে, সেই অর্থ তারা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কাজে লাগাবে, সেখানে কর চাপিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত হতে হলে, শিক্ষার মান বাড়াতে হবে; কিন্তু করোনাকালে স্থবির শিক্ষা খাতের গতিকে আরও শ্লথ করবে প্রস্তাবিত বাজেটে আরোপিত ভ্যাট। শিক্ষা একজন মানুষের মৌলিক অধিকার। ভ্যাট আরোপ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থাকে পণ্যে রূপান্তর করার অপচেষ্টা চলছে।
    সলিমুল্লাহ খান
    অধ্যাপক, ইউল্যাব
তিনি আরও বলেন, এখানে দুটি বিষয় কনফিউজড করছে। একটা হলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরকার কেন কর নেবে, আর যদি লাভজনক হয়ে থাকে, তাহলে সরকার আগে কেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হয়ে থাকে। এ দিকে বিদ্যমান ট্রাস্ট আইন-১৮৮২ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান করযোগ্য নয়। তাহলে সরকার কেন এই করের প্রস্তাব করেছে?

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজেদের খরচ চালিয়ে কিছু লভ্যাংশ থাকে, সেই অর্থ তারা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কাজে লাগাবে। সেখানে কর চাপিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত হতে হলে, শিক্ষার মান বাড়াতে হবে; কিন্তু করোনাকালে স্থবির শিক্ষা খাতের গতিকে আরও শ্লথ করবে প্রস্তাবিত বাজেটে আরোপিত ভ্যাট।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষা একজন মানুষের মৌলিক অধিকার। ভ্যাট আরোপ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থাকে পণ্যে রূপান্তর করার অপচেষ্টা চলছে। অথচ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন অনেক ভালো। কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়ও এগিয়ে আছে।

নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেলাল মহিউদ্দীন বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট চালু হলে শিক্ষার্থীদেরই সেটা বহন করতে হবে। কারণ আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা অলাভজনক বলা হলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক পক্ষ মূলত ব্যবসার উদ্দেশ্যেই সেটা করে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও পড়াশোনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোয়ানটিটির চেয়ে কোয়ালিটিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান এখন অনেক ভালো। এর মধ্যে ভ্যাট আরোপ করা হলে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তিনি আরও বলেন, বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা যখন ভালো দিকে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই একটা বাধা এসে দাঁড়াল। অথচ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভালো করার সুযোগ দেওয়া উচিত। কারণ এটা ব্যবসা নয়, অলাভজনক এবং মানুষের মৌলিক অধিকার। এভাবে ভ্যাট আরোপ করলে শিক্ষা একটি পণ্য হিসেবে গণ্য হয়ে যাবে, যা দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।

জানা যায়, যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডস (কিউএস) প্রতি বছর বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করে। গত ৮ জুন সংস্থাটির ওয়েবসাইটে ‘কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংস ২০২২’ শীর্ষক বিশ্বসেরা ১৩০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এবার এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রথমবারের মতো স্থান করে নিয়েছে আরও দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এ দুটি হলো- ব্র্যাক ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। তালিকায় তাদের অবস্থান ১০০১-১২০০ এর মধ্যে। অথচ দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এখানে স্থান হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ের বিশ্ব স্বীকৃত তিনটি তালিকার অন্যতম একটি কিউএস ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং। অপর দুটি হচ্ছে একাডেমিক র‌্যাংকিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিস এবং টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং। প্রতি বছরের এই সময়ে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংস প্রকাশ করে কিউএস।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সচিব অধ্যাপক ফেরদৌস জামান বলেন, সর্বশেষ ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে যে পার্থক্য সেখান থেকে ১৫ শতাংশ কর ধরলে পৌনে আট কোটি টাকার মতো আসে। টাকার অংকে এটা অল্প হলেও সার্বিক বিবেচনায় করোনা পরিস্থিতি মাথায় রেখে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে এই করের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারকে রাজস্ব আয় করতে হবে। কোনো উপায় নেই। মহামারির কারণে আমাদের বিভিন্ন সেক্টরে যেমন অনেক বেশি খরচ; কিন্তু সে তুলনায় আমাদের আয় কম। ঘাটতি বাজেটটাই বেশি। তারপরেও খরচ করে যেতে হবে প্যানডামিকের জন্য।

বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ট্রাস্টের অধীন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় ট্যাক্স-ভ্যাট প্রযোজ্য নয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, সরকার আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের কথা না বলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আইনসিদ্ধ হয়নি। ২০১৫ সালে ভ্যাট আরোপের ফলে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসেন। এবারও যদি সেরকম কিছু হয়, এর দায়ভার কিন্তু আমরা নেব না। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, এ কর আরোপ প্রত্যাহার চাই। কারণ এর ফলে শিক্ষার্থীদের ব্যয় বাড়বে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //