গত চার দশকে বিশ্বব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে গেছে। এর অভিঘাতে সর্বত্র রাষ্ট্রব্যবস্থাও বদলে গেছে। এই সময়ে বাংলাদেশ পরিবর্তিত হয়েছে বাইরের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরিকল্পনা অনুযায়ী। বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাও পরিবর্তিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চাপে। বাস্তবে দেখা যায়, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি গণবিরোধী রূপ ও প্রকৃতি নিয়ে আছে। এর উন্নয়নের জন্য প্রথমে এই অবাঞ্ছিত অবস্থাটাকে ভালোভাবে বুঝে দেখা দরকার।
তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ ও ওয়াশিংটনের কর্তৃত্বে বিশ্বায়ন পৃথিবীতে যুগান্তর ঘটিয়েছে। বাংলাদেশেও ১৯৮০-এর দশক থেকে ঘটে চলছে যুগান্তর। এনজিও ও সিএসও প্রবর্তন, গণতন্ত্রের নির্বাচনসর্বস্ব ধারণা প্রতিষ্ঠা ও নিঃরাজনীতিকরণ, মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন, নারীবাদী আন্দোলন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন, পরিবেশবাদী আন্দোলন, দাতাসংস্থা (doner agency) ও উন্নয়ন-সহযোগী (development partner) রূপে বৃহৎ শক্তিবর্গের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সব ব্যাপারে নিয়ামক হয়ে ওঠা, সাম্রাজ্যবাদী চাপে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাংলাদেশে গণতন্ত্র চাওয়ার জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে এবং ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কে ধারণা দেওয়া, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহার, রাজনীতিতে একটির পর একটি নাগরিক কমিটির দৌরাত্ম্য, নির্বাচনের জন্য অরাজনৈতিক নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, কৃষি, পোশাকশিল্প, বিদেশে শ্রমিক রফতানি ও আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনীতে সৈন্য প্রেরণের মাধ্যমে জাতীয় আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি, বহুত্ববাদ ও অবাধ প্রতিযোগিতাবাদের নীতি গ্রহণ, সমাজে মানুষের কেন্দ্রীয় প্রবণতার (central motive of man and woman in society) পরিবর্তন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ঘটেছে যুগান্তর। মানুষ বদলে গেছে। আগের মানুষ আর নেই। আগের পরিবেশও নেই।
ব্রিটিশ শাসিত বাংলার রেনেসাঁস, বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশী আন্দোলন, ব্রিটিশ শাসনবিরোধী স্বাধীনতা-আন্দোলন, হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ও ইংরেজ সরকারের Divide & Rule Policy, দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং ভারত ভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের একুশদফা কর্মসূচি ও পূর্ববাংলা সরকারের কার্যক্রম, আওয়ামী লীগের ছয়দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যে জীবনবোধ, চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবন-জগৎদৃষ্টি ও রাজনীতি বিকশিত হয়ে চলছিল, ১৯৮০-এর দশক থেকে পূর্বোক্ত কর্মকাণ্ডের কারণে ক্রমে তার অবসান ঘটে এবং ভিন্ন জীবনবোধ ও চিন্তা-চেতনা, ভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষা ও জীবন-জগৎদৃষ্টি আর রাজনীতির নামে নগ্ন ক্ষমতার লড়াই ও স্বার্থের সংঘাত চলছে। আগের রাজনীতি আর নেই, উন্নততর নতুন রাজনীতি গড়ে তোলার চেষ্টাও দেখা যাচ্ছে না। নবযুগ নয়, চলছে এক যুগসন্ধি।
এর মধ্যে ১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি ও সেনাবাহিনীর যুক্ত উদ্যোগে সংঘটিত হয় কমিউনিস্ট বিপ্লব। আফগান জনগণ এই বিপ্লব মেনে নেয়নি। জনগণের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই বিপ্লব ইসলামবিরোধী। ইরানে ১৯৭৯ সালে আয়তুল্লাহ খোমিনির নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হয়। আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে তালেবান, হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাহারিদ প্রভৃতি জঙ্গিবাদী (Armed Islam Fudamentalists) সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্র এই দুই বিপ্লবের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়। আফগান বিপ্লবকে সফল করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে ক্রমে লক্ষাধিক সৈন্য পাঠান। এর প্রতিক্রিয়ায় আফগানিস্তানের রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র ইসলামী দলগুলো প্রবল হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার আধিপত্যের স্বার্থে সোভিয়েত বাহিনী ও ক্ষমতাসীন আফগান কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের মদদে পাকিস্তান তালেবানদের সহায়তাদানে সক্রিয় হয়। আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট সরকার ও সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ভিত্তি করে তালেবানদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে। এক পর্যায়ে তালেবানরা মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে সমগ্র আফগানিস্তান দখলে নিয়ে কাবুলে তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৮০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন যুক্ত উদ্যোগে বিবিসি রেডিওর মাধ্যমে পরিচালনা করে মৌলবাদবিরোধী ও নারীবাদী আন্দোলন। এসব নিয়ে বিবিসি রেডিও ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশে বিরোধীদলীয় রাজনীতির পরিচালক হয়ে উঠেছিল।
১৯৮০ সালের দিক থেকে বিবিসি রেডিও দ্বারা সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যে পরিচালিত মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলন বাংলাদেশে খুব জোরদার হয়েছিল। সমাজতন্ত্রের ও গণতন্ত্রের ব্যর্থতার মধ্যে ওই দুই আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে ধর্মীয় শক্তির পুনরুজ্জীবন ঘটে। এই ঘটনা লক্ষ্য করে ১৯৮০-র দশক থেকে কেউ কেউ বলে আসছেন, ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরছে।
মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালেবান সরকার জাতীয়তাবাদী নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ করে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ২০০২ সালে আফগানিস্তানে সর্বাত্মক সামরিক আক্রমণ চালিয়ে লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করে মোল্লা ওমরের সরকারকে উৎখাত করে। এই সামরিক আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রিটেন যুক্ত ছিল।
বাংলাদেশে গত চার দশকের মধ্যে সংঘটিত পরিবর্তনে দেশের জনগণের ও নেতৃত্বের ভূমিকা কী, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ-তহবিল, জাতিসঙ্ঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কী, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা একান্ত দরকার। দেখা দরকার, কী হতে পারত আর কী হয়েছে, কী আমরা করতে পারতাম আর কী করেছি। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় চরিত্রের কী পরিচয় আমরা দিয়েছি? রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, শিক্ষাব্যবস্থায়, প্রশাসনব্যবস্থায়, বিচারব্যবস্থায় গত পঁয়তাল্লিশ বছরে আমাদের সংস্কৃতির চেহারাটা কী? সংগীতে, চারুশিল্লে, সাহিত্যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় আমাদের জাতির সৃষ্টিশীলতার স্বরূপ কী? আমরা কোন গন্তব্যের দিকে চলছি? সব কিছুই কি অনিবার্য ছিল? আমাদের স্বাধীনতা বলে কি কিছুই ছিল না? স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার আমরা কতটা করেছি? এখন আমাদের লক্ষ্য কী? আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা ও আত্মোৎকর্ষ দরকার।
আমাদের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা তো রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থারই অংশ। তবু সরকার চাইলে এরই মধ্যে ভালো অনেক কিছু করতে পারত-করতে পারে।
শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশের সংবিধানে কিছু কথা লেখা আছে। সংবিধানে লেখা আছে একমুখী প্রাথমিক শিক্ষার ডকথা। কিন্তু কোনো সরকারই তা মান্য করছে না। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা এখন চৌদ্দভাগে বিভক্ত। এটা সংবিধানের ও রাষ্ট্রের স্বার্থের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। জাতীয় শিক্ষানীতিতে (২০১০) কী লেখা আছে সেটা এখন আর বড় কথা নয়, সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী হয়ে সরকার কী করছে, বাস্তবে শিক্ষাব্যবস্থার রূপ ও প্রকৃতি কেমন দেখা যাচ্ছে, সেটাই বড় কথা।
গত আট বছর ধরে সরকার মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে, মূলধারার (এনসিটিবি যে ধারার পাঠ্যপুস্তকের জোগান দেয়) প্রতি যথোচিত গুরুত্ব না দিয়ে এবং ধর্মীয় ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চাপে শিক্ষাব্যবস্থাকে অত্যন্ত বেশি জটিল করে তুলেছে। সরকার এবং সরকারি ধারার অনেকে এমন কিছু কাজ করে আসছে যেগুলো ধর্মীয় শক্তির জন্য উস্কানিমূলক হয়েছে। মূলধারার শিক্ষাকে সরকার যে রূপ দিয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য তা মোটেই কল্যাণকর নয়। সরকার শিক্ষার বিশ্বমান অর্জনের কথা বলে সাম্রাজ্যবাদী নীতির অন্ধ অনুসারী হয়ে চলছে। এতে জাতির আত্মসত্তা দারুণভাবে বিপর্যস্ত। সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা, হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, খ্রিস্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা চালু করেছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে এগুলো থেকে একটি পড়তে হয়; কিন্তু গণতন্ত্র ও নৈতিক শিক্ষা, সমাজতন্ত্র ও নৈতিক শিক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও নৈতিক শিক্ষা, জাতীয়তাবাদ ও নৈতিক শিক্ষা চালু করেনি। সরকার সাম্প্রদায়িকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি কথা বলে এবং কখনো কখনো নানারকম উস্কানিমূলক কাজের দ্বারা প্রতিপক্ষকে সক্রিয় করে কী অর্জন করতে চায়, তা বোঝা যায় না। তবে এটা বোঝা যায় যে, সরকার, সরকারি দল ও অন্যান্য দল অনেক কিছু করে কেবল ক্ষমতার জন্য।
ধর্মনিরপেক্ষতা আর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে রাজনীতিতে, আর নাস্তিকতা ও আস্তিকতা নিয়ে সমাজের স্তরে স্তরে যে বিরোধ সৃষ্টি করা হয়েছে, শিক্ষানীতিতে ও শিক্ষাব্যবস্থায় তার ঘনীভূত প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। নিয়ে জাতীয় জীবনে যে রক্তক্ষয়ী বিরোধ চলছে, তার রাজনৈতিক সমাধান দরকার। বাইরে রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে এর সমাধান সম্ভব নয়। সংঘাত-সংঘর্ষ ও রক্তপাতের অবসান ঘটাতে হবে। চরম সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যে কেবল পুলিশ, র্যাব, কারাগার ও ফাঁসিকাষ্ঠ দিয়ে সমাধান হবে না। কোনো অন্যায়ের অবসানের ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম আর হিংসা-প্রতিহিংসামূলক কার্যকলাপ এক নয়। যে বিচার দ্বারা হিংসা-প্রতিহিংসা বৃদ্ধি পায়, অশান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তা কি কোনো কল্যাণকর বিচার? যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম দুটি কথাই সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া সমীচীন।
শিক্ষাব্যবস্থা নানা ধারা-উপধারায় এমনভাবে বিভক্ত যে তা জাতিগঠন ও রাষ্ট্রগঠনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এ ব্যাপারে শিক্ষক, অভিভাবক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কারও মধ্যেই খুব একটা সচেতনতা নেই। সকলেই চলমান ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে চলছেন, পরিবর্তন সাধনের চিন্তা ও চেষ্টা নেই। বাংলাদেশে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়কৃত পাঠ্যসূচি ও পাঠক্রম অনুযায়ী ইংরেজি মাধ্যমে চালাচ্ছে ও-লেভেল, এ-লেভেল যা ব্রিটিশ স্বার্থে ব্রিটেনের বাস্তবতা অনুযায়ী পরিকল্পিত। তা ছাড়াও বাইরে থেকে বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমে অন্য ধারার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও চালানো হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের মূলধারার শিক্ষাকে দু’ভাগে বিভক্ত করে বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি চালাচ্ছে ‘ইংলিশ ভার্সন’। এনজিও মহল থেকে চালানো হচ্ছে নানা ধরনের বিদ্যালয়। পাশাপাশি আছে আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার ধারা। তাছাড়াও আছে সরকারি ও বেসরকারি কয়েক ধারার মাদ্রাসা। মূলধারার পাঠসূচি, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক মোটেই সন্তোষজনক নয়। এখন মূল ধারার পাঠ্যপুস্তকের হেফাজতীকরণ নিয়ে প্রচারমাধ্যমে বাদ-প্রতিবাদ চলছে। আগে বিতর্ক ছিল জামায়াতীকরণ নিয়ে। সরকার কর্তৃক মাদ্রাসা ধারার আধুনিকীকরণের চেষ্টার প্রতিক্রিয়ায় চলছে মূলধারার ইসলামীকরণের জন্য এই চাপ।
কথিত সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবিমুখ, জ্ঞানবিমুখ, অনুসন্ধিৎসাবিমুখ ও পরীক্ষামুখী করেছে। পঞ্চম, অষ্টম, নবম ও দ্বাদশ শ্রেণিতে প্রবর্তিত পাবলিক পরীক্ষার ফল কেন্দ্রীয়ভাবে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষণা করার অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী যেসব কথা বলে আসছেন, তাতে শিক্ষা সম্পর্কে সম্পূর্ণ পরীক্ষাসর্বস্ব ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষা আর পরীক্ষার ফলকে সমার্থক করে ফেলা হয়েছে। শিক্ষার অর্থ করা হচ্ছে কথিত সৃজনশীল পদ্ধতিতে জিপিএ ফাইভ পাওয়ার প্রস্তুতি। যারা সব পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাচ্ছে তারা সৃজনশীল। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে রাজধানী পর্যন্ত জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের যেভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, তাতে জ্ঞানের প্রতি, শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহের কোনো কারণ থাকে না। এসব পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসকে এখন সবাই মেনে নিচ্ছেন। জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো বই উপহার না দিয়ে দেওয়া হয় ক্রেস্ট। শিক্ষার্থীদের উপহার দেওয়ার মতো ভালো বই কি বাংলাদেশে পাওয়া যায় না? শিক্ষার্থীদের মনে ধারণা দেওয়া হচ্ছে যে ইন্টারনেটের যুগে বইয়ের দিন শেষ।
রাষ্ট্রের সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় পাঠ্যসূচি, পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং পরীক্ষা গ্রহণে প্রতিটি শিক্ষাবোর্ড হওয়া উচিত স্বায়ত্তশাসিত। আর প্রত্যেক শিক্ষাবোর্ডের আওতায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশ করার জন্য আলাদা আলাদা পাঠ্যপুস্তক শাখা প্রতিষ্ঠা করা উচিত। তাতে বিভিন্ন বোর্ডের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের ও শিক্ষার উন্নতি হবে। শিক্ষার পরীক্ষাসর্বস্ব ধারণা পরিহার্য। সর্বত্র বহুত্ববাদ, কেবল শিক্ষাক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ কেন্দ্রিকতাবাদ (absolute centralism) কেন?
শিক্ষা আইন ২০১৬ পড়তে গেলে জাতীয় শিক্ষানীতির অত্যন্ত জটিল ও ভয়াবহ চিত্র সামনে আসে। ক্রমাগত নতুন নতুন বিধি-বিধান জারি করা হচ্ছে। গোটা নীতি ও ব্যবস্থাকে বুঝে ওঠা অত্যন্ত কঠিন। এর মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ নিয়ে তীব্র বিরোধের প্রতিফলন আছে। যেখানে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃতি ও রূপ এত জটিল এবং অন্তর্বিরোধ এত তীব্র, সেখানে এই নীতি ও ব্যবস্থার উন্নতি কীভাবে সম্ভব হবে? জেদাজেদির মধ্যে উন্নতি অসম্ভব।
আমাদের ধারণা, মূলধারার বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার সার্বিক উন্নতি সাধন করা গেলে তা দেখে অন্য সব ধারাও উন্নতিতে আগ্রহী হবে। তীব্র বিরোধমূলক বাস্তবতায় সুফলপ্রদ কিছুই করা যাবে না। মাদ্রাসা ধারার আধুনিকীকরণের চেষ্টার ফলে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, তাতে মূলধারার বাংলা মাধ্যম এখন ভীষণ চাপে আছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্রে কী কী প্রচেষ্টা, প্রতিক্রিয়া ও প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা বিবেচনা করে নতুন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। মূলধারার বাংলা মাধ্যমকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে, বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে ও বাংলা ভাষাকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। ব্লগে, অনলাইনে যাঁরা সক্রিয় আছেন তাঁদের কেবল উপরিতলে তাকিয়ে চিন্তা করা ঠিক নয়, গভীরে ও ব্যাপ্তিতে দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে হবে। সারাদেশে পেশামূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে।
বিশ্বমান অর্জনের নামে জাতীয় স্বাধীনতা ও জাতীয় ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেওয়া মারাত্মক ভুল। পাশ্চাত্য প্রগতিশীল ভাবধারাকে গ্রহণ করতে হবে এবং উপনিবেশবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাদী ভাবধারা পরিহার করে চলতে হবে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার অবস্থাও ভালো নয়। অন্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে চলার ফলে কোনোটাই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। যেভাবে সেমিস্টার-পদ্ধতি চালু করা হয়েছে তাতে উচ্চশিক্ষাকেও পরীক্ষামুখী করে ফেলা হয়েছে। পরীক্ষা আর শিক্ষা যে এক নয়, কেবল পরীক্ষার ফল ভালো করলেই যে কেউ শিক্ষিত হয় না, গোটা জাতিকে এটা বুঝতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা নেই। পরীক্ষাসর্বস্ব এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা নিয়ে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক কারো আনন্দ নেই। এ অবস্থায় ১৯৮০-র দশক থেকেই ব্যাপক প্রসার ঘটেছে কোর্চি সেন্টার, গাইড বুক ইত্যাদির। এগুলোতে শিক্ষার কোনো আয়োজনই নেই, আছে কেবল পরীক্ষার ফল ভালো করানোর আয়োজন। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, পরীক্ষার ফল খুব ভালো করছে- দ্রুত সৃজনশীল হচ্ছে, যারা উদ্যোগী ও পরিশ্রমী, তারা বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎহীন ভেবে ইউরোপ, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়াসহ নানা রাষ্ট্রে নাগরিকত্ব নিচ্ছে। ব্রেইন ড্রেইন সম্পূর্ণ নতুন রূপ নিয়েছে। দেশপ্রেম, স্বজাত্যবোধ, সুনাগরিকের গুণাবলি ও জ্ঞান অর্জন হচ্ছে না।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যত আলোচনা করা হবে, ততই এর ত্রুটি-বিচ্যুতি ও বিকৃতির দিকগুলো সামনে আসবে। জনগণের জন্য অনভিপ্রেত অবাঞ্ছিত অনেক কিছুকে কায়েমি- স্বার্থবাদীরা ক্রমাগত প্রচার করছে।
বাংলাদেশে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার। এর জন্য প্রথম পর্যায়ে দরকার সর্বজনীন কল্যাণে বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের দূরদর্শী চিন্তাভাবনা, আলোচনা-সমালোচনা ও বিচার-বিবেচনা। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে ধারণা যদি ঠিক হয়, তাহলে সেই লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে চেষ্টা চালালে সমাধানযোগ্য সব সমস্যারই সমাধান করা যাবে। লক্ষ্য ও যাত্রাপথ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে এগোতে হবে।
উন্নত প্রযুক্তি ও শ্রমশক্তির কল্যাণে উৎপাদন ও সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু নৈতিক চেতনা নিম্নগামী হওয়ার ফলে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং মানুষ মানবিক গুণাবলি হারিয়ে চলছে। এ অবস্থায় জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যবস্থারও সংস্কার দরকার। অভীষ্ট সংস্কারের জন্য দীর্ঘকালের প্রচেষ্টা লাগবে।
মনে রাখতে হবে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্য আর কায়েমি-স্বার্থবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্য এক নয়। আমরা পরিবর্তন চাই সর্বজনীন কল্যাণে। কায়েমি-স্বার্থবাদ যাদের চালিকাশক্তি, তাদের সঙ্গে সর্বজনীন-কল্যাণবোধ যাদের চালিকাশক্তি, তাদের বিরোধ চিরকালের। সর্বজনীন কল্যাণে, অশুভ বুদ্ধিকে দমন করে, শুভবুদ্ধি অবলম্বন করে এগোতে হবে।
রাষ্ট্রব্যবস্থায় ও শিক্ষাক্ষেত্রে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে সহজে এর উন্নতি সাধন সম্ভব হবে না। অভীষ্ট নির্ণয়ের ও অভীষ্ট অর্জনের জন্য যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের সঙ্ঘবদ্ধ দূরদর্শী ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। অগ্রাধিকার ঠিক করে পর্যায়ক্রমে এগোতে হবে। প্রথম পর্যায়ের কাজের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে কর্মসূচিভুক্ত করা যেতে পারে :
১. প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণির পরিবর্তে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত রেখে এর মান উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রাথমিক হচ্ছে পরবর্তী সকল শিক্ষার ভিত্তি। পঞ্চম শ্রেণির ও অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। স্কুল থেকে প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষা সমাপনের সার্টিফিকেট দেওয়া হবে এবং এগুলোর প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকবে।
পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা প্রবর্তনের ফলে শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং কোচিং সেন্টার, গাইড বুক ইত্যাদির ব্যবসাতে স্বর্ণযুগ দেখা দিয়েছে। এগুলো বাতিল করা হলে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী এবং দেশি-বিদেশি যেসব শক্তি এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে তারা পরিবর্তনে বাধা দেবে। জনমত প্রবল হলে পরিবর্তনে সরকার রাজি হবে।
২. কথিত সৃজনশীল পরীক্ষা-পদ্ধতি পরিবর্তন করে এমন পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে যা শিক্ষার্থীদের মনে পাঠানুরাগ, অনুসন্ধিৎসা, জ্ঞানস্পৃহা, স্বাজাত্যবোধ, সামাজিক সম্প্রীতি, দেশপ্রেম, সুনাগরিকত্ববোধ ও উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা জাগাবে। পরীক্ষার জন্য মূলত বর্ণনামূলক উত্তরের পদ্ধতিকে নবায়িত ও বিকশিত করে কার্যকর করতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আনন্দের যোগ ঘটাতে হবে। বর্তমানে শিশু-কিশোররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে শিক্ষার্থী হিসেবে; কিন্তু তার পরেই তারা বইয়ের বোঝা পিঠে নিয়ে পরীক্ষার্থী হয়ে যায়, শিক্ষার্থী আর থাকতে পারে না। এই অবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। সারাদেশের পাবলিক পরীক্ষার ফল এক কেন্দ্র থেকে প্রকাশ করা এবং ফল প্রকাশের সময় শিক্ষার পরীক্ষাসর্বস্ব ধারণা প্রচার করা বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় শিক্ষাবোর্ডগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, ইউনেস্কো ও ইউনিসেফের অন্ধ-অনুসারীরা পরীক্ষাপদ্ধতির অভিপ্রেত পরিবর্তন সাধনে বাধা দেবে।
সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের অনুসারীরা দুর্বল জাতিগুলোতে শিক্ষার উন্নতি চায় না- তারা কেবল ভালো সার্টিফিকেট দিয়ে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সন্তুষ্ট রাখার ব্যবস্থা চায়। জ্ঞানেই শক্তি, জ্ঞানেই কল্যাণ- বৃহৎ শক্তিবর্গ এটা বোঝে, এবং জ্ঞানকে তারা কেবল নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। বাংলাদেশকে চলতে হবে জাতীয় ঐক্য অবলম্বন করে, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের চেতনা নিয়ে, সাম্রাজ্যবাদী নীতি পরিহার করে।
৩. ইংলিশ ভার্সন বিলুপ্ত করতে হবে। যারা সন্তানদের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে নাগরিক করার জন্য, কিংবা বড় চাকুরি পাওয়ার জন্য ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে চান, তাদের জন্য ব্রিটিশ সরকার ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে ও-লেভেল, এ-লেভেল চালাচ্ছে। তা ছাড়াও আছে বিদেশী সরকার দ্বারা পরিচালিত ইংরেজি মাধ্যমের আরো কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেসবের পাশে ইংলিশ ভার্সনের দরকার নেই। ইংলিশ ভার্সনের জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তার দ্বারা রাষ্ট্র, জাতি ও জনগণের কোনো কল্যাণ হচ্ছে না।
বাংলাদেশে যারা আজকাল কেবল বিশ্বমান অর্জনের কথা বলেন তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও জনজীবনের অবস্থার কথা একটুও ভাবেন না। যারা দ্বৈত নাগরিক, যাদের স্ত্রী অথবা স্বামী অথবা সন্তান দ্বৈত নাগরিক কিংবা বিদেশি নাগরিক, তারা যাতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপসচিব থেকে সচিব, জজকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতে না পারেন, সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে। শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য হবে বাংলাদেশের ভূভাগে উন্নত জনজীবন, উন্নত জাতি ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলা। জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের মূলনীতি হবে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও সর্বজনীন কল্যাণ।
৪. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বাংলা ভাষা শেখার ব্যবস্থাকে যথাসম্ভব উন্নত করতে হবে। সারাদেশে সকল শিশুকে বিদেশি ভাষা শেখানোর দরকার নেই। জাতীয় চাহিদা অনুযায়ী সংখ্যা নির্ধারণ করে নির্দিষ্টসংখ্যক প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ও আরও কয়েকটি বিদেশি ভাষা ভালো করে শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, পৃথিবীর উন্নত ও অনুন্নত কোনো রাষ্ট্রেই, সব শিশুকে বিদেশি ভাষা শেখানো হয় না। বর্তমানে মূলধারার (এনসিটিবি যে ধারার পাঠ্যপুস্তক জোগান দেয়) বাংলা মাধ্যমে ইংরেজি শেখানোর যে ব্যবস্থা আছে, তার পুনর্গঠন দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অন্তত একটি বিদেশি ভাষা সকল শিক্ষার্থীকে ভালো করে শিখতে হবে। বিদেশি ভাষার জ্ঞান দিয়ে বাংলাভাষাকে ও বাংলাভাষার জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে হবে।
৫. প্রাথমিক শিক্ষা সকলকেই গ্রহণ করতে হবে। বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী সারাদেশে
ক) প্রাথমিক পর্যায়ের (পঞ্চম শ্রেণি) পরে একটি শাখায়, এবং
খ) নিম্ন-মাধ্যমিক পর্যায়ের (অষ্টম শ্রেণি) পরে অন্য একটি শাখায়
পেশামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করতে হবে। এটা করা গেলে ঝরেপড়ার সমস্যার সমাধান হবে। পেশামূলক শিক্ষার এই দুই ধারার পাঠ্যসূচিতেই পেশামূলক বিষয়গুলোর সঙ্গে বাংলা ভাষা, জাতীয় ইতিহাস, পৌরনীতি ও নীতিশিক্ষাকে আবশ্যিক বিষয় রূপে স্থান দিতে হবে। পেশামূলক শিক্ষার এই দুই ধারার বাইরে মূলধারার বাংলা মাধ্যমে নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক শাখাকে একীভূত করে এক ধারায় পরিণত করতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মানববিদ্যা, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য এই তিন শাখা থাকবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে জাতীয় ইতিহাস, পৌরনীতে ও নীতিশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক বিষয় রূপে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মূলধারার বাংলা মাধ্যমের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যসূচি, পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তুক উন্নত করতে হবে। মানববিদ্যা, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, চিকিৎসাবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ইত্যাদি সকল ধারার উচ্চশিক্ষার ভিত্তি রূপে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার তিন শাখার পাঠ্যসূচিকে পুনর্গঠিত করতে হবে।
সারা দেশে গরিবদের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যাপ্ত বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পরীক্ষার ফল ও অন্যান্য দিক বিচারে মেধাবি শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করতে হবে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বর্তমানে বাংলা মাধ্যমের মূলধারা খুব বেশি ত্রুটিপূর্ণ ও অবহেলিত। মূলধারার বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাকে উন্নত করা হলে তার পাশে মাদ্রাসা ধারাও উন্নতিতে আগ্রহী হবে। মূলধারার বাংলা মাধ্যমকে উন্নত করা হচ্ছে না বলেই গোটা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সমস্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
৬. মাদ্রাসার বেলায় মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলসমূহের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যে অবস্থা চলছে তাতে বিরোধমূলক নীতি পরিহার করে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে অগ্রাধিকার দিয়ে উন্নতির নীতি গ্রহণ করতে হবে। সব কিছু করতে হবে রাষ্ট্রের সংবিধানের আওতায় থেকে।
৭. বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কলেজে সেমিস্টারের মেয়াদ চার মাস কিংবা ছয় মাসের পরিবর্তে এক বছর করতে হবে। পরীক্ষার ফল গ্রেড পয়েন্টে প্রকাশ অব্যাহত রাখতে হবে, এবং এই পদ্ধতিকে উন্নত করতে হবে। গবেষণায় গবেষকের স্বাধীনতা যতটা সম্ভব বাড়াতে হবে। উচ্চশিক্ষার বিশ বছর মেয়াদি কৌশলপত্রের স্থলে রাষ্ট্রীয় অর্থে, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ অবলম্বন করে, নতুন উচ্চ শিক্ষানীতি প্রবর্তন করতে হবে। গোটা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
৮. জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদভিত্তিক কর্মনীতি নিয়ে গ্রেকো-রোমান-ইউরো-আমেরিকান সভ্যতার প্রগতিশীল মহান বিষয়াদিকে- দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, প্রযুক্তি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদিকে- আমাদের প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী যথাসম্ভব গ্রহণ করতে হবে, আর তাদের উপনিবেশবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাদী বিষয়াদিকে যথাসম্ভব পরিহার করে চলতে হবে। বিশ্বায়নের কর্তৃপক্ষ (যুক্তরাষ্ট্র্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, ন্যাটো, জি-সেভেন, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, জাতিসংঘ) ও তার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র সম্পর্কে সচেতন থেকে কাজ করতে হবে। বাইর থেকে- নিজেদের সত্তাকে সমৃদ্ধ করার জন্য। শিক্ষাক্ষেত্রে এসব বিষয়ে পরিপূর্ণ সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে।
৯. বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রব্যবস্থার সম্ভবপর সকল পর্যায়ে রাষ্ট্রভাষা রূপে প্রতিষ্ঠা করার, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, বিচারব্যবস্থা ও ব্যাংকিং-এ বাংলা প্রচলনের, বাংলা ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা এবং বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গীণ উন্নতির লক্ষ্যে দূরদর্শী জাতীয় পরিকল্পনা ঘোষণা করে কাজ করতে হবে। উচ্চশিক্ষায়, গবেষণায়, বিচারব্যবস্থায়, ব্যাংকিং ও জ্ঞান-বিজ্ঞান-চর্চায় বাংলাভাষা অবহেলিত বলেই বর্তমান পর্যায়ে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। বাংলা ভাষা, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের ভাষা, ধর্মীয় ভাষা ও বিদেশি ভাষা ইত্যাদি বিবেচনা করে সুষ্ঠু জাতীয় ভাষানীতি অবলম্বন করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে জনজীবনের বৈচিত্র্য ও ঐক্য দুটিতেই যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ও সকলের উন্নতির নীতি অবলম্বন করতে হবে। এসব নিয়ে চিন্তায় ও মতপ্রকাশে বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
১০. শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠিত করতে হবে যাতে
ক) সারাদেশে বিভিন্ন ধারার পেশামূলক শিক্ষার মাধ্যমে বৃহত্তমসংখ্যক যোগ্য, দক্ষ, উৎপাদনক্ষম, উন্নত-চরিত্রবল-সম্পন্ন কর্মী সৃষ্টি হয়।
খ) শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শক্তিমান রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার ও ভালোভাবে পরিচালনা করার উপযোগী শিক্ষিত লোক তৈরি হয়। অধিকন্তু,
গ) দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রকৃত জ্ঞানী ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
আরও অনেক গুরুতর বিষয় আছে যেগুলোকে পর্যায়ক্রমে কর্মসূচিভুক্ত করে নিয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের সামনে আছে অজস্র সমস্যার মধ্যেও মহান সব সম্ভাবনা। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি সম্ভাবনার বাস্তবায়ন সম্ভব। জনসাধারণকে জাগতে হবে, ঘুমিয়ে থাকলে কোনো সম্ভাবনাই বাস্তবায়িত হবে না। কর্মসূচি গ্রহণ করে তার বাস্তবায়নের জন্য গড়ে তুলতে হবে সঙ্ঘশক্তি। জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের জন্য পর্যায়ক্রমে সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও পরিচ্ছন্ন কর্মসূচি নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। আন্দোলন গড়ে ওঠার আগেই সরকার যদি সংস্কার পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং তার বাস্তবায়ন আরম্ভ করে, তাহলে তা সরকার ও জনগণ সকলের জন্যই কল্যাণকর হবে। বাংলাদেশকে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রূপে গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নতিশীল রাখতে হবে। গোটা শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ দরকার।
যদি কোনো বিশ্বসরকার গঠিত হয়, তাহলে তার রূপ ও প্রকৃতি হওয়া উচিত আন্তরাষ্ট্রিক-ফেডারেল; এবং তাতে জাতিরাষ্ট্র, জাতি, জাতীয় সংস্কৃতি ও জাতীয় ভাষাকে বিকাশশীল রাখতে হবে। বিশ্বসরকারের কাছে খুব কম বিষয়েরই ক্ষমতা থাকবে, জাতীয় সরকারের কাছেই থাকবে অভ্যন্তরীণ সব ক্ষমতা। বিশ্বসরকার হবে জাতীয় সরকারগুলোর ঊর্ধ্বতন এক সরকার। বিশ্বসরকারের কাছে একটি সেনাবাহিনী রেখে সকল রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করা যাবে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে সর্বজনীন গণতন্ত্র অবলম্বন করে জনগণের স্বাধীন প্রগতিশীল গণরাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলা আমাদের কেন্দ্রীয় কর্তব্য। জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ অবলম্বন করে বিশ্বব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। সেই লক্ষ্যে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রে, জনজীবনের আরম্ভ করা দরকার। সব রাষ্ট্রেই শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার দরকার।
লেখক : শিক্ষাবিদ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক অধ্যাপক
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : আবুল কাসেম ফজলুল হক শিক্ষা
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh