বেকারত্ব কমাতে কারিগরি শিক্ষায় নজর দেওয়া জরুরি

কারিগরি শিক্ষা নিলে তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। কমবে বেকারত্ব। আর এতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আরও সহজ হবে। করোনা মহামারির কারণে দেশে বিভিন্ন খাতে কর্মহীন হয়েছে অসংখ্য কর্মক্ষম মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার কারণে নতুন চাকরির সুযোগও কমেছে। এমনিতেই দেশে বেকারত্বের হার অনেক।

করোনাভাইরাসের কারণে সেই সংকট আরও বেড়েছে। বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান খরচ কমাতে কর্মী ছাঁটাই করেছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই নতুন কর্মী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন। এই বেকারত্ব কমাতে কারিগরি শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। দেশের বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত জনগোষ্ঠী মূলত কারিগরি দক্ষতার অভাবে বেকার রয়েছে।

বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর কারণে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এমএসএমই) কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর মতে, করোনার কারণে পোশাক খাতের এক লাখের বেশি কর্মী কাজ হারিয়েছেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) বলছে, এ সংখ্যা আরও বেশি- তিন লাখের মতো। আইএলওর তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে তরুণ প্রজন্ম। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশই বেকার হয়েছেন। করোনার কারণে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে।

আইএলওর হিসাবে, সবাই যদি পূর্ণকালীন কাজ করতেন (সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা), তাহলে বাংলাদেশে করোনায় ১৬ লাখ ৭৫ হাজার তরুণ-তরুণী কাজ হারিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ৪৬টি পাবালিক বিশ্ববিদ্যালয়, ১০৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, দুটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্বাবিদ্যালয়ের অধীনে ৫৫৭টি কলেজ থেকে প্রতি বছর স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাচ্ছেন অর্ধেকের কম। অর্থাৎ প্রায় দুই লাখ স্নাতক পাস শিক্ষার্থী প্রতি বছর বেকার হয়ে পড়ছেন। একপর্যায়ে তাদের অনেকে হয়তো কর্মসংস্থানের খোঁজে সহায় সম্পদ বিক্রি করে পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। কেউ কেউ লেখাপড়ার অতীত ভুলে গিয়ে কৃষি কাজ কিংবা ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোনিবেশ করছেন। অথচ উন্নত দেশগুলোর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও পেশাভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত।

এমনকি এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে- দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে কর্মমুখী শিক্ষা যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর পাঁচ শতাংশ কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত। যেখানে বাংলাদেশে তার পরিমাণ মাত্র এক শতাংশেরও কম। এর কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি অনভিপ্রেত উপেক্ষা। এমনকি সাম্প্রতিককালে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, অনেক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণের যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং ইতিমধ্যে উন্নীত করা হয়েছে, তার মধ্যে কর্মমুখী শিক্ষার দিকটি যথেষ্ট উপেক্ষিত থেকেছে।

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাসহ জাতীয় সক্ষমতা অর্জনে সরকার কারিগরি শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশে বর্তমানে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর যে প্রাচুর্য রয়েছে, তার সুবিধাকে কাজে লাগাতে হলে কারিগরি ধারার শিক্ষকদের আরও যোগ্য ও দক্ষ করে তুলতে হবে। সরকার দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কাজ করে যাচ্ছে।

জানা যায়, আগামী দশকে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশকে কর্মসংস্থান খাতের জন্য প্রতিযোগিতামূলক ও দক্ষ জনবল তৈরি করতেই হবে। এর কোনোই বিকল্প নেই। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ছয় কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে কাজ করেন ছয় কোটি আট লাখ নারী-পুরুষ আর ২৭ লাখ বেকার। বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ৪.২ শতাংশ হলেও যুব বেকারত্বের হার ১১.৬ শতাংশ। করোনাভাইরাসের কারণে জুন-২০২১ সাল নাগাদ সেটি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। 

আইএলওর তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংকটে বিশ্বে প্রতি ছয়জনের একজন বেকার হয়েছে আর বাংলাদেশের প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছে (২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ)। করোনার শুরু থেকে এই বেকারত্ব বাড়ছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের প্রধান নির্বাহী ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, করোনায় সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে তরুণদের ওপর। যত দিন পর্যন্ত অর্থনীতি ঠিক না হবে, তত দিন তাদের সবার শ্রমবাজারে প্রবেশ করাটা কঠিন হবে। করোনা-পরবর্তী সময়ে যেসব কাজ সৃষ্টি হয়েছে, সেসব কাজের ধরনও এখন অনেক ভিন্ন। এখন ডিজিটাল বা আইটিবেজড কাজ বেশি হচ্ছে। ফলে আগের গতানুগতিক শিক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়া যাবে না। বাজার উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ, সেইসঙ্গে কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

চাকরি খোঁজার বৃহত্তম অনলাইন পোর্টাল বিডিজবস ডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, ট্র্যাডিশনাল চাকরি অনেক কমে গেছে। তাই কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে অনেক সময় নিম্নমানের বলে দেখা হয়। এটি ঠিক নয়। বরং এটিই মূলধারা হওয়া উচিত ছিল। শ্রমবাজারে যেসব কাজের চাহিদা আছে, সেসব বিষয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ দিতে সবাইকে আরও মনোযোগী হতে হবে। 

তিনি আরও বলেন, ভোকেশনাল ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে তরুণদের কর্মমুখী করা গেলেই সমাজে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আরও সহজ হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //