শিক্ষার্থীদের আত্মঘাত প্রবণতা বাড়ছে

দেশে প্রতিবছর গড়ে ১১ হাজার লোক আত্মহত্যা করে, যাদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। বিভিন্ন গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। তবে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ১০ গুণ বেশি। এর মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। ১৪ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ এই মানসিক ব্যাধি।

দেশে গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ৩৭ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। সব মিলিয়ে ওই বছরে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা পর্যায়ের মোট ৪৪৬ শিক্ষার্থী নিজেকে শেষ করে দেওয়ার এ পথ বেছে নিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত আত্মহত্যার খবর থেকে তথ্য নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে আত্মহত্যা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৮৬ শিক্ষার্থী।  

যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করার দ্বিতীয় বড় কারণ প্রেমঘটিত। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী আত্মঘাতের পথ বেছে নেয় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অভিমানের জেরে।

আঁচল ফাউন্ডেশনের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ইউনিটের টিম লিডার ফারজানা আক্তার লাবণী জানান, দেশে গত কয়েক বছরে শিক্ষার্থী আত্মহত্যার হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। অঞ্চল ভিত্তিতে আত্মহননের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ঢাকায়, ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। 

এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ, রাজশাহীতে ১৬ দশমিক ৮১, খুলনায় ১৪ দশমিক ১৩, রংপুরে ৮ দশমিক ৭৪, বরিশালে ৮ দশমিক ৫৩, ময়মনসিংহে ৬ দশমিক ২৭ ও সিলেট বিভাগে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ৪৪৬ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৪০ জনই স্কুল ও সমমান প্রতিষ্ঠানের এবং ১০৬ জন কলেজ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ২৮৫ জন ছাত্রী ও ১৬১ জন ছাত্র এবং ৫৪ জন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গত বছরের জানুয়ারিতে ৩৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৯ জন, মার্চে ৪১ জন, এপ্রিলে ৫০ জন, মে মাসে ৪৫ জন, জুনে ৩১ জন, জুলাইয়ে ৪০ জন, আগস্টে ২১ জন, সেপ্টেম্বরে ৩২ জন, অক্টোবরে ৩০ জন, নভেম্বরে ৪৯ জন ও ডিসেম্বরে ৩৪ জন আত্মহত্যা করে। 

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তানসেন রোজ জানান, স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার কারণে কিছু পার্থক্য রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা রোমান্টিক সম্পর্কে ব্যর্থ হওয়া এবং আর্থিক সংকটের কারণেই বেশি আত্মঘাতী হয়ে থাকে। অন্যদিকে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় পড়া শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই পরিবারের সদস্যদের ওপর অভিমানের কারণে এ পথ বেছে নেয়। এ হার ২৭ শতাংশেরও বেশি।

এ বয়সী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার দ্বিতীয় বড় কারণ হচ্ছে প্রেমঘটিত, ২৩ শতাংশেরও ওপরে। এছাড়া পারিবারিক কলহ, হতাশা, মানসিক সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, উত্ত্যক্ত, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে প্রকাশ, পরীক্ষায় অকৃতকার্য বা আশানুরূপ ফল করতে না পারা, পড়াশোনার চাপসহ নানা কারণ রয়েছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বেশিরভাগ সময়ে ক্ষণিকের সিদ্ধান্তেই শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করে বসে। এগুলো কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনার অংশ নয়।’

চিকিৎসকরা জানান, আত্মহত্যা করার বেশ কয়েক দিন বা ঘণ্টা আগে সংকেত ও বিপদের ইঙ্গিত দেখা যায়। সবচেয়ে সুদৃঢ় ও ভয়াবহ সংকেত মৌখিকÑ ‘আর পারছি না’, ‘সবকিছু অর্থহীন’, ‘ভাবছি সব শেষ করে দেব’। এমন মন্তব্য করা ব্যক্তিদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। মাদকাসক্ত, কর্মসংস্থানের অভাব, পারিবারিক কলহ, নির্যাতন, প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়, যৌন নির্যাতন, অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ, কষ্টকর শারীরিক রোগ ইত্যাদি কারণে এ প্রবণতা বাড়ছে।

এ অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে জোর দেওয়ার কথা বলছেন মনোবিজ্ঞানীরা। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটিকে মানসিক অসুস্থতার চেয়ে অপরাধ হিসেবেই চিহ্নিত করা হচ্ছে। 

এ বিষয়ে মনোরোগবিদ ডা. এমএমএ সালাউদ্দীন কাউসার বলেন, ‘যারা আত্মহত্যা করেন তাদের ৯৫ ভাগই কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগেছিলেন। সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে এ ধরনের ঝুঁকি থেকে ভিকটিমকে বাঁচানো সম্ভব। তবে অনেকেই আত্মহত্যার চেষ্টাকারীদের অপরাধী ভেবে মানসিক চিকিৎসা করানো থেকে দূরে থাকে।’ 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের এ অধ্যাপক আরও বলেন, ‘আত্মহত্যার ধরন প্রধানত দুটি- পরিকল্পিত একটি এবং অন্যটি আবেগতাড়িত। তবে এ দেশে অধিকাংশ ঘটনাই আবেগতাড়িত হয়ে ঘটে। এ কারণে তরুণ-তরুণীরাই বেশি আত্মহত্যা করেন।

অন্যদিকে পরিবারে আত্মহত্যা বা হিংস্রতার ইতিহাস, ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা পরিবারের সদস্যের মৃত্যু, বিবাহ বিচ্ছেদ বা পৃথক হওয়া, চাকরি হারানো, কর্মক্ষেত্রে সমস্যা, হাজতবাস, পারিবারিক বা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া ইত্যাদি কারণে আত্মহননের যে ঘটনা ঘটে তা অনেকটা পরিকল্পিত।’ 

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইএমএইচ) এক গবেষণায় জানানো হয়, দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। মোট জনসংখ্যার ১৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কই এ সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ স্নায়বিক পীড়ায়, ৪ দশমিক ৬ শতাংশ গভীর বিষণ্নতায় এবং ১ দশমিক ১ শতাংশ আক্রান্ত সরাসরি মনোব্যাধিতে। পাশাপাশি ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। তবে ৭৫ শতাংশ শিশু চিকিৎসা সেবার বাইরে থাকে।

একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কিন্তু এটি প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট মানসিক চিকিৎসালয় ও কাউন্সেলিং সেন্টার দেশে নেই। মানসিক রোগের চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ২০০ জন।

বিভিন্ন স্থানে আত্মহত্যা হলেও জেলা পর্যায়েই মানসিক রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। শুধু ২২টি মেডিক্যাল কলেজ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পাবনার হাসপাতালে মানসিক রোগের চিকিৎসা হয়। পুরনো আটটি মেডিক্যাল কলেজের একটিতেও এ বিষয়ের কোনো অধ্যাপক নেই। ফলে এ সংক্রান্ত সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। 

বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্ররোচনা ও আত্মহনন একটি ফৌজদারি বা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে যিনি আত্মহত্যা করেন, তাকে আর এই শাস্তি দেওয়ার সুযোগ থাকে না। আবার আত্মহত্যাকে পারিবারিক ইচ্ছায় ‘অপমৃত্যু’ হিসেবে নথিভুক্ত করায় পার পেয়ে যান প্ররোচনাকারীরা। অথচ সেই অপরাধ প্রমাণ হলে ১০ বছর পর্যন্ত শাস্তির বিধান রয়েছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(ক) ধারায়ও নারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনার শাস্তির বিধান উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘কোনো নারীর সম্মতি ছাড়া বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তির দ্বারা সম্ভ্রমহানি হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণে আত্মহত্যা করলে, তাকে প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে বলা হবে।’ এ আইনেও রয়েছে ১০ বছরের শাস্তির বিধান। 

পুলিশ জানায়, কেউ প্রমাণ রেখে আত্মহত্যা করে না। পরিবারের পক্ষ থেকেও এসব ঘটনায় মামলা করতে না চাওয়ায় অপমৃত্যু হিসেবে নথিভুক্ত হয়। অ্যাডভোকেট জাহিদ রহমান বলেন, ‘আত্মহত্যার ঘটনা অপমৃত্যু হিসেবে নথিভুক্ত করলেও নিজের মতো করে পুলিশ তা তদন্ত করতে পারে।

তবে এক্ষেত্রে পরিবারই পুলিশকে সহযোগিতা করে না। কখনো কখনো তদন্ত না করার জন্য অনুরোধ করা হয়, সামাজিকভাবে দ্বিগুণ হেয় হওয়ার ভয়ে। অথচ আত্মহত্যায় বাধ্য করায় প্ররোচনাকারীদের বের করে যদি বিচার হতো, তাহলে পরিস্থিতি পাল্টে যেত।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //