অধিভুক্ত সাত কলেজ দেখভালে ব্যর্থ ঢাবি প্রশাসন

অধিভুক্ত সাত কলেজ সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। অধিভুক্তি নিয়ে শুরুতে উচ্ছ্বাস থাকলেও দেশের ঐতিহ্যবাহী এবং পুরনো কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বর্তমানে সন্তুষ্ট নন এবং তাদের সমস্যাও বেড়েছে বহুগুণে।

অন্যদিকে ঢাবির শিক্ষার্থীরাও অধিভুক্তি নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। এমন অসন্তোষের মধ্যে বারবার সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে তারা। সমস্যার সমাধানে ২৯ আগস্ট ঢাবির সিনেট ভবনে বিশেষ পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৭ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দায়িত্বে থাকাকালে রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাবির অধিভুক্ত করা হয়। এরপর থেকে কলেজগুলোর একাডেমিক বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হচ্ছে। তবে ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতা, ত্রুটিযুক্ত ফলাফল প্রকাশ, সিলেবাসবহির্ভূত প্রশ্নপদ্ধতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে প্রায় তিন লাখ শিক্ষার্থীকে। ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি হ-য-ব-র-ল দেখা গেছে। দফায় দফায় ফল প্রকাশ আর বিভিন্ন কারণে অপেক্ষা মানসিক যন্ত্রণা বাড়িয়েছে শিক্ষার্থীদের।

এসব সমস্যা সমাধানের দাবিতে বারবার রাস্তায় নেমে আসছেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। চলতি বছর জুন থেকে আগস্ট মাসে অন্তত ১০ বার সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন তারা। সর্বশেষ সিজিপিএর শর্ত শিথিল ও সর্বোচ্চ তিন বিষয় পর্যন্ত মানোন্নয়ন দিয়ে পরবর্তী বর্ষে প্রমোশন দেওয়ার দাবিতে টানা আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। গত ২৭ আগস্টও রাজধানীর নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, পাঠদান ঢাবির মতো না হলেও প্রমোশনের ক্ষেত্রে সিজিপিএর ধরা-বাঁধায় আটকে রাখা হয় তাদের। বিজ্ঞান অনুষদে যে কোনো বর্ষে সিজিপিএ ৪.০০-এর মধ্যে জিপিএ ২.০০ পেলেই পরবর্তী বর্ষে প্রমোশন পাওয়া যায়। কিন্তু কলা ও বাণিজ্য অনুষদের সিজিপিএর ক্ষেত্রে প্রথম বর্ষে ২.০০, দ্বিতীয় বর্ষে ২.২৫, তৃতীয় বর্ষে ২.৫০ না পেলে চতুর্থ বর্ষে উত্তীর্ণ হওয়া যায় না। ফলে সব বিষয়ে পাস করেও সিজিপিএ কম থাকায় পরবর্তী বর্ষে প্রমোশন হয় না।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে ফলাফল দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয় ৭-৯ মাসে। নেই নির্দিষ্ট কোনো একাডেমিক প্ল্যান। ক্লাস নেন এক শিক্ষক, প্রশ্ন করেন আরেকজন, খাতা দেখেন অন্যজন। ফলে গণহারে ফেল করেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া একজন মাত্র সমন্বয়ক হওয়ায় সুবিধা-অসুবিধাগুলো জানাতে পারেন না শিক্ষার্থীরা। কোনো সমস্যা হলেই দৌড়াতে হয় ঢাবিতে। সমাধানে চলে যায় মাসের পর মাস। শিক্ষক সংকটের কারণে নিয়মিত ক্লাস হয় না। শিক্ষার্থীর অনুপাতে যতজন শিক্ষক থাকার কথা, তার আদর্শ মানের ধারেকাছেও নেই সাত কলেজ।

সাত কলেজের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, সাত কলেজের দাবি- শিক্ষার্থীদের দাবি, সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করতে হবে, একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রণয়ন, শিক্ষক সংকটের সমাধান, ক্লাসরুম সংকট নিরসন, সিজিপিএর শর্ত শিথিলসহ সাত কলেজেই ডেডিকেটেড ডেস্ক বসাতে হবে। একই সঙ্গে সাত কলেজ নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি শিক্ষার্থীদের। এসব সমস্যা সমাধানে চেষ্টা চলছে। তাদের চিত্র যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব খারাপ এবং তাদের পড়ালেখার মান খুব খারাপ সেটা কিন্তু বলা যাবে না। গত কয়েক বছরে সাত কলেজের লেখাপড়ার মান অনেক উন্নত হয়েছে, সিলেবাসের পরিবর্তন হয়েছে, পাসের হারের দিক থেকেও ঢাবির চেয়ে কম নয়।

অধ্যাপক ড. মাকসুদ বলেন, ‘সাত কলেজ দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ছিল। দীর্ঘদিনের যে প্রভাব, সে প্রভাব ছয় থেকে সাত বছরের মধ্যে দূর হয়ে যাবে এমন চিন্তা করা সঠিক নয়। কিছু কিছু জায়গায় ঢাবিরও দুর্বলতা আছে, যেহেতু ঢাবির নিয়মেই সাত কলেজ চলছে তার প্রভাব সেখানেও পড়ে। আমরা সেসব সংস্কারের চেষ্টা করছি।’

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মাইনুর রহমান মাহিন বলেন, ‘আমরা দ্বিতীয় বর্ষের আট মাস ক্লাস করে জানতে পারি আমরা প্রথম বর্ষে অকৃতকার্য হয়েছি। তখন হয়তো সাত দিন সময় আছে। এর মধ্যে প্রস্তুতি নিয়ে প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। এ নিয়ে আমাদের কলেজ কর্তৃপক্ষের কিছুই করার থাকে না। তারা আমাদের পাঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।’

তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রুহেল রানা বলেন, ‘আমি ফোর্থ ইয়ারে উঠে ইনকোর্স, ক্লাস টেস্ট, অ্যাসাইনমেন্ট যাবতীয় সব শেষে জানতে পারি আমাকে আবার থার্ড ইয়ারে পরীক্ষা দিতে হবে। সব বিষয়ে পাস করার পরও সিজিপিএ ২.৫০ না হওয়ায় পুনরায় একই বর্ষে থাকতে হচ্ছে। আমরা নামেমাত্র অধিভুক্ত, এ ছাড়া কিছুই নই।’

কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘ঢাবির শিক্ষার্থীরা শতভাগ সুবিধা পেলে আমরা পাচ্ছি ১০ ভাগ। আমাদের শুধু লোগো ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ ঢাকা কলেজের আরেক শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রাকিব বলেন, ‘ঢাবি সাত কলেজের সংকট নিরসন না করতে পারলে আমি মনে করি ঢাকা কলেজকে অধিভুক্ত থেকে আলাদা করে দেওয়া হোক। এর জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করা হোক।’

এদিকে সাত কলেজ অধিভুক্তির পর থেকেই তা বাতিল চেয়ে আন্দোলন করে আসছেন ঢাবির শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক সক্ষমতা নিজেদের শিক্ষার্থীদের জন্যই অপ্রতুল বলে মনে করেন তারা। সেখানে সাত কলেজকে অধিভুক্ত করা একটা ভুল সিদ্ধান্ত বলে দাবি করে আসছেন তারা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অধিভুক্তি বাতিলই একমাত্র সমাধান বলে মত ঢাবি শিক্ষার্থীদের।

ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী রিফাত রাশিদ বলেন, ‘ঢাবি প্রশাসনের আয়ের একটা বিশাল উৎস এই সাত কলেজ। ঢাবি প্রশাসন তাই এই সোনার ডিম দেওয়া হাঁসের অধিকার ছাড়তে চায় না। সাত কলেজের একদল শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোওয়ালা সার্টিফিকেটের লোভে এ অধিভুক্তি বাতিল চায় না। কিন্তু সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল আসলে সময়ের দাবি।’

ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন বলেন, ঢাবি এবং সাত কলেজের লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে বিপদে ফেলা, ভোগান্তি বাড়ানো এবং কিছু ক্ষেত্রে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরির মূলে আছে এই অপরিকল্পিত অধিভুক্তি। এর ফলে সীমাহীন অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সেসবের কোনো সুরাহা হয়নি। এসব থেকে মুক্তিতে অধিভুক্তি বাতিলই একমাত্র সমাধান।

ঢাবির সঙ্গে সাত কলেজকে অধিভুক্ত করা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং ভুল সিদ্ধান্ত বলেও মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা। কথাসাহিত্যিক ও ঢাবির ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে সেটা যৌক্তিক, তাদের সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান করা উচিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল এসব কলেজ দেখাশোনা করার জন্য, তারা সেভাবে অভ্যস্তও হয়েছিল; কিন্তু হঠাৎ করে কেন বিভাজন করা হলো এটা আমার মাথায় আসে না। এই যে আমাদের কোনো বিবেচনা ছাড়া, চিন্তা ছাড়া পরিকল্পনা করি তারই ফলাফল হচ্ছে আজকের এ অবস্থা। যার প্রভাব পড়ছে ঢাবিতেও। এখানের শিক্ষক, কর্মচারীদের দিনের বেশিরভাগ সময় সাত কলেজ নিয়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে। আমি মনে করি অতিদ্রুত তাদের পুনরায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তান্তর করা উচিত।’

সাত কলেজের সমন্বয়ক ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা বলেছি যার যার কলেজের শিক্ষার্থী নিজ নিজ কলেজের বিভাগে তাদের সমস্যাটা জানাবে। প্রক্রিয়াটাই হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপে। যাতে তাদের সময় ও অর্থ ব্যয় না হয়। আমি বলেছি ঢাবির রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই হবে। কিছু জটিলতার কারণে শিক্ষার্থীদের ফলাফলে দেরি হয়েছে, আশা করি আগামীতে আর হবে না। আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে তিন বিষয় পর্যন্ত যারা ফেল করেছে, তাদের প্রমোশন দেওয়া হবে না। তবে সিজিপি নিয়ে যে সমস্যা হচ্ছে, সেটার সমন্বয়ের কাজ করছি।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //