এক-তৃতীয়াংশ ফাঁকা আসন

নতুন বিভাগ খোলায় তোড়জোড়

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সারাদেশে দুই হাজারের বেশি কলেজ বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এতে শিক্ষার্থী রয়েছে ২৯ লাখ। তবে প্রতিবছর এসব কলেজের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসন ফাঁকা থাকছে বা শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে না। শিক্ষক সংকট এবং নিয়মিত ক্লাস না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘসময় ধরে। শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকার পাশাপাশি পাঠ শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী চাকরি না পাওয়ার বিষয়টিও সামনে এসেছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও নতুন নতুন বিষয় খোলার বিষয়ে চলছে তোড়জোড়। 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলো নতুন যে ১০টি বিষয়ে শিক্ষা দিতে চাইছে সেগুলোর মধ্যে ফার্মাসি, বায়োকেমেস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, মেরিন সায়েন্স, ফিশারিজ ও মাইনিংয়ের মতো বিশেষায়িত বিষয় রয়েছে। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই যেখানে বিশেষায়িত বিষয়ে পড়ানোর মান নিশ্চিত চ্যালেঞ্জিং, সেখানে সরকারি এসব কলেজে তা চালু করা অযৌক্তিক বলে মনে করছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। এতে শিক্ষা খাতে আরও বোঝা তৈরির আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদরা। এমনকি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগও (আইএমইডি) এটিকে অবাস্তব বলছে। বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভেবে দেখবে বলেও আশা সংস্থাটির। 

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউজিসির তথ্যমতে, ২০২১ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দুই হাজার ২৫৭টি প্রতিষ্ঠানে মোট আসন ছিল ১২ লাখ ৬৮ হাজার। সে বছর এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিল ৭ লাখ ৪৪ হাজার শিক্ষার্থী। অর্থাৎ প্রায় ৫ লাখ আসন ফাঁকা ছিল। আগের বছরগুলোর চিত্রও একই ছিল। আর শিক্ষার্থীপ্রতি মাথাপিছু ব্যয় ছিল মাত্র ৭৪৩ টাকা। যদিও একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ছিল এক লাখ ৮৫ হাজার টাকার বেশি। আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল এক লাখ ১৯ হাজার টাকার বেশি। একই বছর এসব কলেজে একজন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী অনুপাত ছিল ২৯ জন। প্রকৃতপক্ষে এ অনুপাতের পার্থক্য আরও বেশি। আর এসব কলেজের ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার থাকে বলে ২০২১ সালের এক জরিপে জানিয়েছিল গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস।

নরসিংদী সরকারি কলেজে ২০১৪ সালে শিক্ষক নিয়োগ না দিয়েই মনোবিজ্ঞান ও মার্কেটিং বিভাগ চালু করা হয়েছিল। এর এক বছর পর শিক্ষক নিয়োগ শুরু হয়। চালু থাকা বিষয়গুলোর অনিয়মিত ক্লাস হলেও ‘সরকারি কলেজসমূহে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ’ নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কলেজগুলোতে ১০টি নতুন বিষয় যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুই হাজার ৫১১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। ২০১৮ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পরে দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। পরে আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। প্রকল্পের আওতায় ২০০টি সরকারি কলেজে একাডেমিক ও হোস্টেল নির্মাণ এবং বিজ্ঞান যন্ত্রপাতি সরবরাহের কথা রয়েছে। এর মধ্যে ১৭৬টি ছয়তলা একাডেমিক ভবন এবং ৪৭টি হোস্টেল নির্মাণ করা হবে। আরও বিভিন্ন সংস্কার এবং শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের বিষয় রয়েছে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে কলেজগুলোতে ১০টি নতুন বিষয় চালু করার কথা বলা হয়। বিষয়গুলো হলো- ফার্মাসি, বায়োকেমেস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, জিওলোজি, মেরিন সায়েন্স, ফিশারিজ, পরিবেশ বিজ্ঞান, আইসিটি, ফুড প্রসেসিং এবং টেক্সটাইল ফ্যাশন ডিজাইনিং। 

তবে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ছিল মাত্র ২৬ শতাংশ। ১৭৬টির মধ্যে ১৫টি একাডেমিক ভবনের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আর ৪৭টির মধ্যে ৩৩টি হোস্টেলের কাজ নির্মাণাধীন। কাজের মান নিয়েও বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি সরকারের প্রকল্প মনিটরিংয়ের একমাত্র প্রতিষ্ঠান আইএমইডির এক প্রতিবেদনে প্রকল্পটির মাধ্যমে নতুন বিষয় প্রর্বতনকে অবাস্তব ও অযৌক্তিক বলা হয়েছে। এ প্রকল্পে যথাযথ চাহিদা নিরুপণ না করেই কলেজ ভবন এবং হোস্টল নির্মাণ করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করা হয়। চাহিদা না থাকলেও অনেক উপজেলা পর্যায়ের কলেজে হোস্টেল করা হচ্ছে—জানায় সংস্থাটি। 

এ বিষয়ে আইএমইডির সংশ্লিষ্ট সেক্টরের মহাপরিচালক মু. শুকুর আলী বলেন, নতুন বিষয়গুলো চালুর বিষয়টি মন্ত্রণালয় যেন ভেবে দেখে সেজন্য আমরা এটা প্রতিবেদনে তুলে ধরেছি। প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সাবজেক্ট কমতেও পারে। তবে কতজন শিক্ষক নিয়োগ হবে—এটা প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত নয়। ভবিষ্যতে যেন প্রয়োজনীয়তার নিরিখে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয় সেজন্য প্রতিবেদনে অপ্রয়োজনীয় হোস্টেল নির্মাণের বিষয়টি এসেছে বলে জানান এ কর্মকর্তা। 

অদক্ষতা আর অব্যবস্থাপনায় শিক্ষা খাত বড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের ইমেরিটাস প্রফেসর মনজুর আহমেদ। তিনি বলেন, সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মান নিয়ন্ত্রণ একটি বড় সমস্যা। বিজ্ঞান এবং কর্মমুখী শিক্ষায় মান নিয়ন্ত্রণ আরও গুরুত্বপূর্ণ। মান ঠিক না রেখে নতুন প্রতিষ্ঠান করে শিক্ষার প্রসার ঘটানো হচ্ছে। এতে কোনো ফল আসবে না। শুধু প্রকল্পে টাকা খরচ করে সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মুহা. তারিক আহসান মনে করেন বিশেষায়িত এসব বিষয় সবার জন্য উন্মুক্ত রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, মার্কেটের চাহিদা জেনে সেভাবে এসব বিষয় চালু করাটা জরুরি। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েই মান নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কলেজ পর্যায়ে এটা বিপর্যয় তৈরি করবে। বরং কারিগরি শিক্ষাকে জনপ্রিয় করতে পারলে সেটা অর্থনীতিতে কাজে লাগবে। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭১ সাল থেকে সমুদ্র বিজ্ঞান পড়ানো হচ্ছে। পরে ১৯৮৩ সালে আলাদা সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়। তবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও এখনো এ বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার সবধরনের সুযোগ-সুবিধা তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় প্রধান ড. মো. মোসলেম উদ্দীন। তিনি আরও বলেন, ডাক্তারের কাজ যদি পল্লীচিকিৎসক দিয়ে করানো হয় তা হলে তো হবে না। অন্য ৮-১০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ঢাল-তলোয়ার ছাড়াই বিষয়টি চালু করা হয়েছে। সিলেট কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়টি চালু করা কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্নও তোলেন তিনি। 

এ সেক্টরে কী পরিমাণ এক্সপার্ট দরকার—এটার কোনো ডাটা না তৈরি করে এটা চালু করাটা নিজের পায়ে নিজে কুরাল মারার মতো হবে বলেও মন্তব্য করেন এ অধ্যাপক। তিনি আরও জানান, যারা এ বিষয়ে পড়ছেন তাদের জন্যই এখনো কোনো কাজের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়নি। এরা কোথায় কাজ করবে, এটার আদৌ কোনো দরকার আছে কিনা সে প্রশ্ন রাখেন তিনি। সেখানে কেন, কীভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা চিন্তা করছে। তারা কি না জেনে বা জেনেশুনে ভুল কাজ করছেন, সেটা বোধগম্য নয়। যত্রতত্র এটা শুরু করাটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলছেন অধ্যাপক মোসলেম। 

এদিকে শিক্ষক সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান জানান, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলার কাজ চলমান। আর নতুন করে চারটি বিষয়ে অনার্স চালু হচ্ছে জানালেও কোন কোন বিষয়ে নতুন কোর্স চালু হচ্ছে তা বলেননি তিনি। 

প্রকল্পটির সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে ৩০ জেলার ৬৯ উপজেলায় ৭২টি সরকারি কলেজে সমীক্ষা চালায় আইএমইডি। ১০৮০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রস্তুত করা প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব কলেজে একজন শিক্ষকের বিপরীতে ১০৫ শিক্ষার্থী রয়েছে। যদিও ইউজিসির হিসাবে একজন শিক্ষকের বিপরীতে ২৯ শিক্ষার্থী বলা হচ্ছে। ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কলেজগুলোতে বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের কোনো লোকজন নেই। ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, কলেজে পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ নেই। ৬৯% শিক্ষার্থী বলছেন, কলেজে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমছে। ৫৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করছেন তাদের শিক্ষকরা মানসম্মত না। অধিকাংশ কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাব নেই, যেখানে আছে সেখানেও যন্ত্রপাতি অবহেলায় শোকেসে পড়ে থাকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। 

এদিকে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও বেশ কিছু অবকাঠামোর কাজ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। আবার যেসব কলেজে কাজ শেষ হয়েছে, সেখানেও কাজের মান নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। নরসিংদীর সরকারি আসাদ কলেজের শিক্ষকরা জানান, ভবন বুঝে পাওয়ার আগেই দেয়ালে ফাটল, প্লাস্টার খসে গেছে। লিফট দেওয়ার কথা থাকলেও ভবনে লিফট নেই। পদার্থ বিজ্ঞানের জন্য অপটিক্স ল্যাব রাখা হয়নি। গজারিয়া সরকারি কলেজেও লিফট দেওয়া হয়নি। আরও বেশ কয়েকটি কলেজের ভবন নিয়ে অভিযোগ রয়েছে আইএমইডির প্রতিবেদনে।

সার্বিক বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালকের দায়িত্বে থাকা ড. খন্দকার মুজাহিদুল হক প্রকল্পের ধীর গতির বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘শিক্ষা ভবনে মাউশির এই মুহূর্তে সবচেয়ে গতিশীল প্রকল্প এটি।’ গত পাঁচ বছরে মাত্র ২৬ শতাংশ অগ্রগতি হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি অফিসে গিয়ে কথা বলতে বলেন। প্রকল্পটির মাধ্যমে ৮ হাজার ৬২৫ শিক্ষকের পদ সৃজনের সুপারিশ করা হবে বলে জানান তিনি। ১০টি বিষয় চালুর বিষয়ে ড. মুজাহিদুল জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চালু থাকা ডিপ্লোমা কোর্সের সঙ্গে সমন্বয় করে বিষয়গুলো চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিষয়গুলোতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তবে কোন কোন বিষয় পরিবর্তন হয়েছে সেটি তিনি তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //