ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল

লাখ টাকা বেতনেও খেলার মাঠ নেই

ঢাকার ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোটবড় মিলিয়ে কয়েক হাজার ইংলিশ মিডিয়াম ও কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটিতেই কেবল খেলার মাঠ রয়েছে। তাও আবার আবাসিক বাড়িতে স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠা করায় বাড়ির সামনের সামান্য খালি জায়গাকেই খেলার মাঠ হিসেবে দেখানো হয়। বেশিরভাগ স্কুলে খেলার মাঠের সম্বল দুই-তিনটি দোলনা। যে কারণে ট্যাবে গেম খেলেই সময় কাটায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থী।

পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় শিশুদের সঠিক মানসিক বিকাশ হচ্ছে না বলে মনে করেন অনেক অভিভাবক। তাই তাদের দাবি, সব স্কুলেই খেলার মাঠ রাখা সরকারিভাবে বাধ্যতামূলক করা হোক।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ‘ও’ লেভেল, ‘এ’ লেভেল ও জুনিয়র স্কুল রয়েছে ১৩৭টি। শিক্ষার্থী রয়েছে ৭১ হাজার ৪৫৬ জন। ইংলিশ মিডিয়াম এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭২ দশমিক ২৬ শতাংশ স্কুলেই কোনো খেলার মাঠ নেই। ৩০টি ‘ও’ লেভেল স্কুলের মধ্যে খেলার মাঠ আছে কেবল চারটিতে। এছাড়া ‘এ’ লেভেলের ৯২টি স্কুলে খেলার মাঠ রয়েছে মাত্র ৩০টি এবং ১৫টি জুনিয়র স্কুলের রয়েছে চারটি খেলার মাঠ। আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষার কথা বলে নামকরা এ স্কুলগুলো মাসে লক্ষাধিক টাকা টিউশন ফি নেয়। তার সঙ্গে রয়েছে মোটা অঙ্কের ভর্তি ফি, খেলাধুলা ফি, টিফিন ফি, বই, স্টেশনারিসহ আনুষঙ্গিক আরও নানা ফি। তবে এসব ফির তুলনায় অনেক স্কুলেই সুযোগ-সুবিধা নগণ্য। দেশের ইংশিল মিডিয়াম স্কুলগুলোর ৫৯ দশমিক ১২ শতাংশেই নেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। কম্পিউটার নেই প্রায় ২৬ শতাংশ স্কুলে। কোনো পরিবহন ব্যবস্থা নেই ২৪ শতাংশ স্কুলের। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের জন্য আগে সুস্থ দেহ প্রয়োজন এ জন্য মুক্ত পরিবেশে খেলাধুলার বিকল্প নেই। 

জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে জানিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মধ্যে কায়িক শ্রমের প্রতি আগ্রহ তৈরিতে শরীরচর্চা ও খেলাধুলাকে একটি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে বলা হয়েছে নীতিমালায়। নীতি আছে কিন্তু ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের জন্য এখনো কোনো বিধিমালা হয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ নেই। এক হাতে তো তালি বাজে না। যাদের টাকা আছে তারা মনে করে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ালে খুব ভালো পড়ালেখা হবে, উন্নত মানের শিক্ষা হবে। আসলে সামাজিকভাবেই নৈতিকতার সমস্যা আছে। অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে।’ 

সুনির্দিষ্ট আইন ও বিধিমালা ছাড়াই চলছে বিদেশি রিকুলামে পরিচালিত দেশের বেশিরভাগ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। তাই ইংলিশ মিডিয়ামের জন্য আলাদা বিধিমালা ও আইনের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। তিনি বলেন, ‘শিক্ষানীতিতে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলকে প্রচলিত ধারার মতো একই নিয়মের আওতায় নিয়ে আসার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে সেভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যারা নিয়ন্ত্রক আছেন তাদের শক্ত হাতে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্যারেন্টস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফেরদাউস আজম খান বলেন, ‘টিউশন ফি, উন্নয়ন ফি, বাৎসরিক ফি, পরীক্ষা ফিসহ নানা ফি নিয়ে বছরে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকাও খরচ হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি। বাচ্চাদের খেলাধুলার কোনো ব্যবস্থা নেই বেশিরভাগ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। কিছু স্কুল আয়োজন করছে। অনেক স্কুলেই গ্যারেজে খেলাধুলা করে বাচ্চারা। সুন্দর পরিবেশ না পেলে সুস্থভাবে বাচ্চাদের বেড়ে ওঠা সম্ভব নয়। যত চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে বাচ্চারা বেড়ে উঠবে, তাদের বিকাশ তত বাধাগ্রস্ত হবে। অনেক স্কুলেই ভালো পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছে না।’ 

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার জানিয়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি জাহান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. কাজী তাইফ সাদাত বলেন, ‘একেকটি স্কুল একেক সার্ভিস দিয়ে টাকা নিচ্ছে। এখানে তো কেউ কাউকে জোর করে পড়াচ্ছে না। প্যারেন্টসরা যদি মনে করে তার বাচ্চাকে পড়াবে তাহলে পড়াবে, না হয় পড়াবে না। মাসে ৩ হাজার টাকা টিউশন ফি, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলও আছে আবার লাখ টাকার ওপরে। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ওপর টাকা নেওয়া হয়। ঢাকা শহরে যেসব স্কুলে খেলার মাঠ আছে সেগুলো সরকারি এবং পুরনো। ঢাকায় এখন বাড়ি ভাড়া অনেক বেশি। খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো তাদের নিজেদের মতো করে ম্যানেজ করে নিচ্ছে। প্যারেন্টসরাই তাদের বাচ্চাদের জন্য এসব স্কুল পছন্দ করছেন। খেলার মাঠ কোথা থেকে দেবো! সরকার তো জায়গা দিচ্ছে না।’ 

সংগঠনটির সভাপতি আরও বলেন, ‘ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় কোনো বিধিমালা বা আইনের প্রয়োজন নেই এবং যদি ইন্টারফেয়ার করা হয় তাহলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোও শেষ হয়ে যাবে। বেসরকারি তহবিলে গড়ে উঠছে এসব স্কুল, সরকার কোনো সহায়তা করছে না। যারা নীতিমালা করবে তাদের সন্তানরাই এখানে পড়বে। সবাই তো আর পড়তে পারে না। সবার পড়ারও দরকার নেই। এখানে যত কম ইন্টারফেয়ার হবে ততই আমাদের জন্য ভালো।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আবদুল হালিম বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা সকালে গিয়ে বিকালে ফেরে, সারাদিন পড়াশোনার মধ্যে থাকে। বাইরে যাওয়ার যদি সুযোগ না থাকে তাহলে হিতে বিপরীত হবে। কারণ বাচ্চারা যদি শারীরিকভাবে সুস্থ না থাকে, খেলাধুলা সচেতন না হয়, ফিজিক্যাল এক্সারসাইজের যদি সুযোগ না পায় তাহলে সুস্থ দেহে মনের বিকাশ হবে না। বাচ্চাদের আগে সুস্থ দেহ থাকতে হবে তাহলেই মনের বিকাশ হবে। তবে এটি আমরা ভুলে গেছি। আমরা এখন শুধু পড়াশোনা নিয়ে প্রতিযোগিতা করছি। আবার কেউ কেউ চেষ্টা করছে কতটা বিলাসীভাবে পড়াশোনা করা যায়। মানসিক বিকাশ না ঘটায় পরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা, ডিপ্রেশনসহ নানা সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। এটি অনেকটাই কমে যেত যদি স্কুলে বাচ্চাদের মুক্ত পরিবেশ দেওয়া যেত।’ 

ঢাবির এ শিক্ষাবিদ আরও বলেন, ‘ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি স্ট্যান্ডার্ড ফর্ম্যাটে নিয়ে আসতে হবে সরকারকে। লাগাম টেনে ধরতে হবে। তা না হলে শিক্ষার যে বৈষম্য তা থেকেই যাবে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ব্রেইন ড্রেইনের সঙ্গে ইদানীং টাকাও চলে যাচ্ছে। সেখানে ঘরবাড়ি বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। টাকা দিয়ে বিদেশে পড়াশোনার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। এটিও এক ধরনের দুর্নীতি। সরকারকেই লাগাম টানতে হবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //