শিক্ষায় চার চ্যালেঞ্জ

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আনা হয়েছে পরিবর্তন। মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের দক্ষ, সৃজনশীল, জ্ঞান ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আগ্রহী করতে পাল্টানো হয়েছে চিরাচরিত পাঠ্যক্রম। গত বছর থেকে প্রাথমিক উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কিছু ক্লাসে এই নতুন শিক্ষাক্রমের অধীনে পাঠদান শুরু হয়েছে। তবে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। 

এ ছাড়া শিক্ষার মান ও দেশের উচ্চ শিক্ষা কতটা কর্মমুখী তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অন্যদিকে ২০১০ সাল থেকে সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পাঠ্যবই দিচ্ছে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর থেকে সেই বইয়ের মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে, ঠিক তেমনি সময়মতো বই না পাওয়ায় সরকারের সেই উদ্দেশ্য ভেস্তে যাচ্ছে। 

শিক্ষাবিদরা বলছেন, সরকারের নতুন শিক্ষা ও প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর এই চারটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যাগুলো বের করে তা সমাধান, উচ্চ শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার পাশাপাশি যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেওয়া এবং শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। 

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভের পর গঠন করা হয়েছে সরকারের নতুন মন্ত্রিসভা। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন সরকারের গত মেয়াদের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। আর প্রথমবার সরাসরি ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন অধ্যাপক রুমানা আলী টুসি। এর আগে তিনি সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন। 

একাধিক শিক্ষাবিদের ভাষ্য, দেশের শিক্ষার হার বাড়লেও মান বাড়ছে না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে জীবন ও জীবিকার আমূল পরিবর্তন ঘটছে। পেশা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে কর্মসংস্থান। কর্মক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে কর্মক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে নতুন সম্ভাবনা। এসব চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার টেকসই ও কার্যকর সমাধান করা এখন সময়ের দাবি। যার জন্য প্রয়োজন জ্ঞান, দক্ষতা ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা। 

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কারিকুলামে চিরাচরিত পাঠ্যসূচি এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি পাল্টে ফেলা হয়েছে। তুলে দেওয়া হয়েছে দশম শ্রেণির আগে সব পাবলিক পরীক্ষা। থাকছে না জিপিএ পদ্ধতিও। নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজনও রাখা হয়নি। শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো বিভাগে পড়ার সুযোগ পাবেন একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে। 

গত বছর থেকে কয়েকটি ক্লাসে শুরু হয়েছে নতুন কারিকুলামের আলোকে পাঠদান। এর ধারাবাহিকতায় চলতি বছর আরও কয়েকটি ক্লাস যুক্ত হয়েছে। আগামী বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সব ক্লাসে নতুন কারিকুলামের অধীনে পাঠদান চলবে। 

নতুন কারিকুলামের আলোকে পাঠদান শুরু হলেও এই কারিকুলাম শুরুর জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই বলে দাবি শিক্ষাবিদদের। কারিকুলামের শিক্ষকদের দেওয়া হয়নি ঠিকমতো প্রশিক্ষণ। সব বিদ্যালয়ে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক ও অবকাঠামো। এ ছাড়া কারিকুলাম নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। 

নতুন কারিকুলাম নিয়ে একাধিক অভিভাবকের দাবি, নতুন পাঠ্যক্রমে শিক্ষার্থীদের বই পড়ার আগ্রহ কমেছে। পড়ালেখায় তাত্ত্বিক বিষয় শেখার বিপরীতে বেড়েছে কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস। ডিভাইস ব্যবহারের পরিধি বাড়ার সুযোগে বেড়েছে ডিভাইসের প্রতি আসক্তি। স্কুলব্যাগে পাঠ্যবইয়ের চেয়ে বেশি থাকছে শিক্ষা উপকরণ। অভিভাবকরা মনে করছেন, নতুন পাঠ্যক্রমে শ্রেণিকক্ষের বাইরে হাতে-কলমে শিক্ষার ক্ষেত্রে আর বছর শেষে সামষ্টিক মূল্যায়নেও পাঠ্যবইয়ের তেমন কোনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। 

নবম শ্রেণিতে বিভাগ নির্বাচনের সুযোগ থাকবে না শিক্ষার্থীদের। একই সঙ্গে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে দুই যুগ ধরে প্রচলিত জিপিএ পদ্ধতিও। এর ফলে সমাপ্তি ঘটতে চলেছে জিপিএ-৫ কিংবা গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়ার প্রতিযোগিতার। শিক্ষার্থীদের মেধা মূল্যায়নে ব্যবহার করা হচ্ছে পারফরম্যান্স ‘ইন্ডিকেটর’, অর্থাৎ বিশেষ পারদর্শিতার ‘চিহ্ন’। এগুলো হলো- ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ। কোনো শিক্ষার্থী তিনটি বিষয়ে চতুর্ভুজ পেলে পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ার জন্য বিবেচিত হবে না। অভিভাবকদের অনেকেই ৯ম শ্রেণিতে আগের মতো শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী বিভাগ নির্বাচনের এবং মূল্যায়নে ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ ইত্যাদি নির্দেশক বা ইন্ডিকেটর বাতিল করার দাবি জানাচ্ছেন। তারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের দলগত শিখন পদ্ধতি এবং অভিজ্ঞতাভিত্তিক ক্লাসে নানা সরঞ্জামের প্রয়োজন পড়ছে। এতে হঠাৎ করে বেড়েছে শিক্ষা ব্যয়ও; যা কেনা সব অভিভাবকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাই নিম্নবিত্ত শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তারা বলছেন, অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকায় শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষকদের সংখ্যা কম। গ্রাম ও শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধায়ও রয়েছে নানা পার্থক্য। 

এ ছাড়া দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে বেকারত্ব। বিশ্লেষকরা বলছেন, কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে চাকরির বাজারে যাচ্ছেন, কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মিলছে না চাকরি, অথচ তারা উচ্চশিক্ষিত। উচ্চশিক্ষিত হয়েও কেন বেকার থাকতে হয়, সে প্রশ্ন থেকেই যায়! 

অন্যদিকে আরেক সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) গত ডিসেম্বরে জানিয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা দেশের বিভিন্ন কলেজ থেকে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের ৪২ থেকে ৪৮ শতাংশ বেকার অবস্থায় আছেন। ২০২১ সালে এ হার ছিল ৬৬ শতাংশ। জরিপে বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৪২ থেকে ৪৮ শতাংশই বেকার অবস্থায় রয়েছে। বেকার অবস্থায় থাকাদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি বিএ পাস করেছিলেন। ২৩ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী পলিটিক্যাল সায়েন্স থেকে স্নাতক অর্জন করেছেন। লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্টে পাস করেছেন প্রায় ২১ শতাংশ। বেকারদের ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ পাস করেছেন ইসলামের ইতিহাস এবং বাংলায়।

শিক্ষাবিদরা যা বলছেন
শিক্ষাবিদ এ এন রাশেদা বলেন, সবার আগে অবৈতনিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করতে বৃত্তি বাড়ানোর পাশাপাশি ও মিড ডে মিল চালুসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো বাড়ানো ও শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। কারণ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। 

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবীর বলেন, শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করা দরকার। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী যাতে সঠিক শিক্ষা পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের যেন আস্থা থাকে তারা পড়ালেখা করে কিছু একটা করতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী মন্ত্রিসভার কনিষ্ঠ উদীয়মান সদস্য। তিনি উপমন্ত্রী হিসেবে ৫ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিও রুট লেভেল থেকে অনেক কিছু দেখেছেন। মানুষের প্রত্যাশা পূরণে তিনি যেন সচেষ্ট থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এসএম হাফিজুর রহমান বলেন, নতুন কারিকুলাম মাত্র বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। যেসব সমস্যা আছে তা যাচাই-বাছাই করে সমাধান করতে হবে। নতুন শিক্ষামন্ত্রী স্মার্ট মানুষ। আশা করছি তিনি এসব বিষয় সমাধান করবেন। 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, সংখ্যার বিচারে উচ্চশিক্ষায় আমাদের অর্জন অনেক। কিন্তু গুণগত শিক্ষার ব্যাপারে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং যারা মন্ত্রিসভায় এসেছেন তারা কোয়ালিটি এডুকেশনের দিকে নজর দেবেন। এক কথায় তারা শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রতিফলন ইত্যাদি বিষয়ে কাজ করতে হবে। 

তিনি আরও বলেন, দক্ষ জনশক্তি না থাকলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হয় না। দক্ষ জনশক্তি প্রস্তুতে যথাযথ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। সেটা দিলেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হবে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

শিক্ষামন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী যা বললেন
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী জানান, শিক্ষাব্যবস্থা এবং পুরো শিক্ষাকে কর্মমুখী করা আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। একটা সময় সে আলোচনা করা হতো না। বৃত্তির সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্কের জায়গায় কিছুটা দূরত্ব ছিল। সে কাজগুলো আমাদের করতে হবে। এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। শিক্ষার মতো পবিত্র জায়গায় সাধারণ মানুষকে যাতে সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে না হয় সেটা নিশ্চিত করাকে একটি চ্যালেঞ্জ বলে মনে করি। 

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে তা অবশ্যই করা হবে জানিয়ে নতুন শিক্ষামন্ত্রী বলেন, প্রয়োজন হলে এর বাস্তবায়ন/মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হবে। আমাদের মূল লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের শিখন ফল অর্জন। সবাইকে নিশ্চিত করতে চাই যে, এটা স্থায়ী কিছু নয়। নতুন শিক্ষানীতি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে নতুন শিক্ষানীতি তৈরির বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। 

প্রাথমিকের সঙ্গে মাধ্যমিকের সমন্বয় আনার চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বেগম রুমানা আলী টুসী। তিনি বলেন, প্রাথমিকের সঙ্গে মাধ্যমিকের সমন্বয় করে সবাইকে একটা সুন্দর জায়গায় নিতে চেষ্টা করব। এটা তো আসলে একটা জেনারেশন তৈরির জায়গা। স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করতে হলে স্মার্ট নাগরিক প্রয়োজন। সেই জায়গা থেকে কাজ শুরু করব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //