সহগ

যাদের আমি ভালোবেসেছি, তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে চলে আসবার সময় আমার বুক ভেঙে গেছে, পোড়া দাগের মতোন আমার চামড়া খামচে ধরেছে তাদের স্মৃতি। অথচ এরা প্রত্যেকে আলাদা, মুখের ভাব, মনের গতি, শরীরের ভাষায়। কেউ এভারলি ব্রাদার্সের ড্রিম ড্রিম ড্রিম শুনে ঘুম মারতো। কেউ আমার মুখ কালো দেখলে সিনেমার আলো নিভলে যেমন করে দর্শক প্রেক্ষাগৃহ ত্যাগ করে সেভাবে আমাকে ত্যাগ করে চলে যেত অন্য কোনো তামাশায়। কেউ পাতার বাসায় একটি মাত্র মহামূল্য ডিমের মতো করে, তা দিত আমায়, কেউ দেয়ালের দিকে ছুড়ে মারতো। 

কার অধিকার ছিল আমার ওপর, কতটা সঙ্গত অধিকার? কার কার ওপর আমার অধিকার ছিল? কাকে দেখলে হাওয়া-লাগা ফুল গাছের মতো দুলে উঠতাম? কার জন্য শরীরময় ঝোপের জোনাকি জ্বলতো? কার দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন পাখির চোখে বাতিঘরের আলো দেখতাম? ছোট ছোট ক্যাটালিস্ট ছাড়া সময়ের নিরিখে এই বিপুল জীবনে তাদের আর কী ভূমিকা ছিল? আলো চলে গেলে আচমকা অন্ধকারে যেমন সব মণ্ডাকার হয়ে যায়, তেমন লাগে ভাবলে। মাঝে মাঝে মনে হয়, কত অসংখ্য শরীরে খণ্ড খণ্ড করে রেখে তাদের ক্ষণিকের অথবা দীর্ঘস্থায়ী ভালোলাগা। সেই খণ্ডের সমষ্টি একটিমাত্র শরীরে মেলে কই? 

এক

আমার গল্প শুরু করতে গিয়ে প্রথম মনে হয়েছিল, উত্তম পুরুষে লিখব না। নামপুরুষে লিখব। যেমন আমার নাম হবে সাহানা। লিখব- 

“প্রথম বিবাহবিচ্ছেদের পর ‘সাহানা’কে তার মা অচেনা পুরুষদের সঙ্গে কফি খেতে যেতে পীড়াপীড়ি করতে লাগল। পুনঃবিবাহার্থে। এর আগে অচেনা ব্যাটা ছেলের সঙ্গে একই রিকশায় বসা- ফুচকা খাওয়া- প্রেম করা নিয়ে তার মায়ের ধ্যানধারণা ছিল ভিক্টোরিয়ান, ‘রিকশায় গা লাগিয়ে বসতে দিবি না’, ‘কেউ বাদাম খাওয়ালে বাদাম খাইয়ে দিয়ে আসবি’, এইবার সেধে মা তাকে কফি খেতে যেতে দিল, অথবা বলা চলে সাহানাকে কফি খেতে পাঠিয়ে দিল। এর অর্থ কী হয়? অর্থ হচ্ছে সাহানার কৌমার্যের মূল্য ছিল, এখন সে কুমারী সাহানা নয়, বিবাহবিচ্ছিন্ন সাহানা। সাহানার মুখের ভাব, চেহারার লাবণ্য, চুলের গোছা, হাতপায়ের চলাফেরা সবকিছুর একটা সরেজমিন তদন্ত করতেই না এই কফিপান-রঙ্গ। তরলপানের সামাজিক অনুষ্ঠান তো নয়, এ হচ্ছে মনোনীতের হাতে গছিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। কফি খেতে যাবার আগে সাহানাকে সামান্য সাজতে হতো, সাদা পোলাও টাইপের সাজ, ভেতো স্বাদ নেই, অথচ বিরিয়ানির ঝকমারিও নেই এমন।” 

এই মায়ের জন্য আড়ালে আমার মনে মানে সাহানার মনে মায়া হলো, এ মায়ার আরেক নাম ‘অনুকম্পা’। সমাজের সঙ্গে বিবাদী হয়ে থাকবার ভূমিকার আরেক নাম ‘বিবাহবিচ্ছিন্না’, সেটা সাহানার মা খুব ভালো করে জানতো বলে তার জন্য মায়া হলো। নৈলে কি আর...

এইসব ভেবে নিয়ে কলম কামড়াতে কামড়াতে আমার মনে হলো, সাহানায় আমার চলছে না। মেয়েটার নাম হওয়া উচিত ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ বা এইরকম কিছু। জ্ঞান আর বিকাশমানতার সম্মিলিত দেবীরূপ-টুপ। তারপর ভাবলাম, উত্তমপুরুষেই লেখা উচিত, আমাকেই এই মেয়েটি হতে হবে, নইলে এই গল্পটা বে-সাইজের জুতার মতো আমার পায়ে ঢলঢল করছে। ঠিক জুত করে লিখতে পারছি না। যদিও আমি-আমি করে এ লেখা লিখলে সেজ ফুপু রাগ করবে এবং মালিহা খালা আর আমাদের বাড়িতেই আসবে না।

ইনফ্যাক্ট মালিহা খালা এবং মালেকা খালা আমাদের বাড়িতে বহুদিন হয় আসে না, তবু আমার আম্মা তাদের আর কখনো আমাদের বাড়িতে না আসা নিয়ে এবং আমাদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কোচ্ছেদ করা নিয়ে শঙ্কিত থাকে। আমার প্রথম বিয়ে ভাঙার সময় এরা আম্মাকে ফোন দিয়ে দিয়ে বলত, “মেয়েটা বঙ্গবাজারের মাল হয়ে যাবে, সেকেন্ড হ্যান্ড, তাই কি তুমি চাও? তার চেয়ে যা হয়েছে তাতে ঝুলে থাকলে ক্ষতি কী তোমাদের?” মালিহা-মালেকা খালাদের চেয়ে অন্তত নামে আধুনিক সুলেখা মামি। সুলেখা মামি আশুগঞ্জের নানিকে দিয়ে আমাকে ফোন দেওয়ালো সৌম্যর সঙ্গে আমার বৌভাতের দিন, একেবারে অনুষ্ঠানের সময়। আশুগঞ্জের নানি আমাকে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করলেন, “এখনকার ভাইসাব ভালো নাকি আগের ভাইসাব ভালো আছিল? টেস কইরা দেখসো বুইন?” এখন আমার কথা হচ্ছে, এইসব উপাখ্যান ভীষণ বে-জুত ভীষণ নিষ্ঠুর, কিন্তু এগুলো সত্যি। পানিপথের যুদ্ধের মতো সত্যি, তৈমুর লঙের খোঁড়া পায়ের মতো সত্যি; কিন্তু এইসব সত্যি বলা যাবে না, লেখা যাবে না, উত্তমপুরুষে বয়ান করা হলে আমার সঙ্গে আত্মীয়তাসূত্রে বাঁধা মালিহা-মালেকা-সুলেখা ইত্যাদি সব সুতো ধরে টান পড়বে, তাদের সঙ্গে পুতুল নাচের সুতোয় গেরো দেওয়া আরও কত আত্মীয় উপুড় হয়ে ভূতলে পড়বে... তাই কি আমি চাই? ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সর্বসমক্ষে ময়লাকাপড় ধোয়া’, তাই কি আমি করতে চাই? আমার মানসম্মান (মানে ওদের প্রতি মায়াদয়া) নেই? 

অতএব, আমি লিখতে শুরু করলাম- “সাহানাকে তার প্রথম বিবাহবিচ্ছেদের পর মা অচেনা পুরুষদের সঙ্গে কফি খেতে যেতে পীড়াপীড়ি করতে লাগল।” ‘সাহানা’ কেটে এরপর ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ করলাম, তারপর ‘প্রথম বিবাহবিচ্ছেদ’ থেকে কেটে শুধু ‘বিবাহবিচ্ছেদ’ লিখলাম। এটা করবার সময় আমার এক এক্স-কলিগ মুজাফফরের কথা মনে পড়ল। সে অফিসে সশব্দে ‘পাত্র চাই’ ‘পাত্রী চাই’ কলামগুলো পড়ত। হৈ হৈ করে হাসতে হাসতে বলত, “আরে আরে পাত্রীর শর্ট ডিভোর্স, মানে কী? বেশি দিন শোয় নাই?” মুখে প্রথম ব্রন উঠবার সময় থেকে ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ ওই যে ড্যানিয়েল স্টিল পড়েছে আর ‘মিলজ অ্যান্ড বুনজ’, যেখানে এন্তার পুরুষ মানুষ বিধবা এবং স্বামী পরিত্যক্তা (বা স্বামীকে পরিত্যাগকারিনী) মেয়েদের ধুন্ধুমার ভালোবাসে, তাদের সন্তানদের বুকে তুলে নেয়... ওসব যে শুধুই গল্প, একেবারেই গল্প, সেটা প্রজ্ঞাপারমিতা তদ্দিনে জানে। সত্য হচ্ছে এই সশব্দে ‘পাত্র চাই’ পড়া মুজাফফর। ওই হাসির শব্দে কেউ জানে না ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতাম আমি, ভেতরে ভেতরে বৃহস্পতি গ্রহের সবচেয়ে নিকটবর্তী চাঁদটার মতো ফুটতাম, আমার বুকজুড়ে গলিত লাভা... আচ্ছা, এই রাগটা সাহানার নাম করে কিংবা প্রজ্ঞাপারমিতার নাম করে লিখলে ফুটবে তো? তারপর নখ কামড়াতে কামড়াতে ভাবলাম, সৌম্যর নামটাও সৌম্য রাখব না। সৌম্য শুভ্র ঋজু এইসব নাম হবে না। কুদ্দুস বা মোতালেব টাইপ কিছু করে দেব। লোকমানও হতে পারে। আমার আত্মীয়মহলে কুদ্দুস-মোতালেব-লোকমান নামের কোনো মামা-চাচা-ফুপা-দুলাভাই এইসব আছে কি না তাও আগেভাগেই মনে করে দেখতে হবে।

এতকিছু ভেবেচিন্তে অবশেষে আমি লিখলাম, ‘আমি সৌম্যর বাড়িতে আসবার পর থেকে প্রতিদিন রাতে একা একা ভাত খাই, আমার সামনে থাকে একটা শূন্য চেয়ার, আর মাথার ওপর জ্বলে একটা সাদা বাতি।’ সাহানা-টাহানা গোল্লায় গেল। এটা তো সাহানার কথা নয়, আমার কথা। আমার রীতিমতো বুকে ব্যথা হয় একা একা ভাত খেতে। ভাত খেতেই এমন লাগে বলে একবার ভাবলাম রাতে কোল্ড ডিনার করব, স্যান্ডউইচ-টুইচ খেয়ে নেব। তাতেও বুকে ব্যথা হয়। সাদা বাতিটা একটা ফানুসের মতো ভাসতে ভাসতে আমার বুকে এসে নামে। মনে হয় এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে একা, আমার চেয়ে অনাদরে আর কেউ নেই। পাখার বাতাস তো একালে কেউ করে না, মেয়ে মানুষকে পাখার বাতাস কোনোকালেই কেউ করত না; কিন্তু ওই যে কেউ বসে থাকবে আমার খাওয়ার সময়, কিংবা মুখোমুখি বসে খাবে... ঠিক পাখার বাতাস না করলেও তেমন একটা ভঙ্গি করে আমার পাতে এক টুকরো পেঁপেসহ আরেকটু ঝোল তুলে দেবে, এইসব ন্যাকা চাহিদা আমার যেতে চায় না। আমার এক বন্ধু, যে আনন্দের-সঙ্গে-বিবাহিত (!), সে ফেসবুকে একদিন পরামর্শ দিল- ‘একা ঘরে ভাত খাওয়ার সময় আচ্ছামতো নাগামরিচ পাতলা ডালে কচলে খাবি দোস্ত, তাইলে চোখ দিয়ে পানি পড়বে, কান দিয়ে ধোঁয়া বের হবে, আনন্দের হরমোন উৎপন্ন হবে, আর একা লাগবে না!’

আনন্দ বিলি করবার জন্য কতরকমের বিকল্প ব্যবস্থা, ওই ড্যানিয়েল স্টিলের প্রেমের গল্প, এই নাগামরিচ। আমার বিবাহিত বন্ধুটি সম্ভবত ভাইব্রেটরের কথা জানে না, ধরা পড়া ভোমরার মতো ধড়ফড়ে যন্ত্র, জানলে বাতলে দিত নিশ্চয়ই। 

দুই

পাস করবার পরে রুহ আর কখনো শাহনাজের সঙ্গে দেখা করতে যায়নি। 

শাহনাজ নাকি বারবার বলত, ‘একদিন তুমি অনেক বড় চাকরি করবে, অনেক বড় মানুষ হবে, কোনো এক মহা রুপসী তোমার প্রেমিকা হবে...কিংবা বউ হবে, সেই মেয়েটাকে নিয়ে আমার কাছে একবার আইসো?’

শাহনাজের শরীর দু’হাতে চটকাতে চটকাতে রুহ উন্মত্ত হয়ে উঠছিল, প্রথম নারী শরীরের অদম্য অধিকার, সে’সময়ে কার এমন কথা ভাল্লাগে! সে সামান্য মুহূর্তের জন্য আনমনা হতে হতে জিজ্ঞেস করেছিল-কেন? সেই মেয়েটাকে দিয়ে তোমার কী প্রয়োজন?

-এই, কৌতূহল বলতে পারো। দেখবো তাকে। মামুলি জবাব করত শাহনাজ, তারপর প্রমত্ত ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ত রুহের ওপর, মহাসমুদ্রে এমন ঢেউয়ের আলাদা নাম আছে। রুহ মানে রুহুল সেভাবেই বর্ণনাটা দিত। ওই গল্প ও ভাবতো শিভালরির গল্প। আমার শুনে প্রথমদিকে গা শিরশির করত, পরে গা গোলাতো। পয়সা দিলে যাকে পাওয়া যায় এমন কোনো মহিলার বিছানায় আমার প্রেমিক অনেকবার গেছে, এটা ভাবলেই আর রুহের দিকে মন ফেরাতে পারতাম না। রুহ অবশ্য মন ফিরিয়ে আনতে জানতো, শরীর দিয়ে। এত ভালো শরীর জানতে আমি আর কখনো কাউকে দেখিনি, যেন স্বরলিপি মুখস্ত করে পিয়ানো বাজাচ্ছে... ও তো শিখেছিল সেই সর্বনাশ বয়ে নিয়ে আছড়ে পড়া। শাহনাজের নাইট স্কুলে। অনেক কম বয়েস থেকে হাতেকলমে শিখেছিল। 

ওসব ভাবতে আমার ভাল্লাগতো না। আমি রুহের ক্যাডেট কলেজের জীবনের কথা ভাবতাম। ওর যে বয়সে একটা পোষা খরগোশ ছিল সেই নির্মল বয়সের কথা ভাবতাম। পেয়ারাবাগে ঢুকে লুকিয়ে সিগ্রেট খেয়ে পেয়ারাপাতা চিবিয়ে ঘরে ঢুকবার বয়সের কথা ভাবতাম। ইচ্ছে করে আমি রুহকে শোনাতাম ‘আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’এর ওইসব অংশ যেখানে নায়িকা নায়ককে জিজ্ঞেস করছে- আমার আগে আর কোনো মেয়ের সঙ্গে শুয়েছ? আর নায়ক কথা- শেখানো টিয়ে পাখির মতো বলছে- না না কখনো না। দু’জনেই যদিও জানে, এ একেবারে সর্বৈব মিথ্যা...ওভাবে আমিও। যেন ব্যবচ্ছেদ করে ওর শাহনাজ-হীন বয়সটাকে আলাদা করে নিয়ে তবেই ওকে ভালোবাসতাম আমি। কেন? রুহ যদি বলত, তোমার জীবনে যতটুকুতে তুমি ফৈজুলের, সেটুকু খলিফার কাঁচিতে কেটে নিয়ে বাকিটুকুকে আমি ভালোবাসি, আমার ভাল্লাগতো? 

কিন্তু রুহ অধ্যায় এখন আসবে না, আরও অনেক পরে। 

তিন

আমাদের ফ্যাকাল্টিতে আমার ক্লাসে পড়ত ইউসুফ। নবীর নামে নাম। নবীদের গুণাবলিই ওর ভেতর ছিল, বুদ্ধিদীপ্ত সহানুভূতিশীল প্রাণবন্ত। দেখতেও ইউসুফ ছিল তার স্বনামসখা ইউসুফ-নবীর মতো, অনেকের মাঝে উৎকৃষ্ট। চেহারায় একরকম পৌরুষের ছাপ, কোঁকড়া চুল মাথাঠাসা, ভাসা ভাসা চোখ, ঈষৎ পুরু ঠোঁট- যেন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কোনো দেশে পানপাত্রের গায়ে আঁকা ছবি থেকে নেমে এসেছে। ইউনিভার্সিটির শেষ দিকে আমাদের ক্লাসমেটরা হঠাৎ করেই আমাকে আর ইউসুফকে নিয়ে ঠাট্টা শুরু করল। আমি জানি ইউসুফ তার জনম-জনম খালাতো বোনকে লিখে দিয়ে উত্তর কাট্টলি থেকে ঢাকায় পড়তে এসেছে, তাকে নিয়ে ঠাট্টা করার মতো কী করলাম আবার! করেছি তো, সতীর্থদের সমীক্ষায় ভরা একটা পত্রিকায় কে কার প্রিয় বন্ধু হলেও হতে পারতো, তাতে আমি ইউসুফের নাম লিখেছি আর ইউসুফ আমার নাম। নেহায়েত কাকতালীয়ভাবেই। ভিড়ের ভিতর বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে ফোকাস করে কথা বলতে হয়, আমি একবার বলেছিলাম আমি ইউসুফের মুখের দিকে তাকিয়ে তর্ক করেছিলাম একবার। এইসব কনফেশন যে অত বিস্ফোরণক্ষম কে জানতো। 

এখন ইউসুফ কেমন আছে, কোথায় আছে সেটা আমার দেখতে এবং জানতে ইচ্ছা করে না এমন পয়গম্বরসুলভ নির্বিকারত্ব আমি অর্জন করিনি, সেটা সত্যি। ফেসবুকে খুঁজে দেখলেই হয়; কিন্তু প্রবল আলস্যের কারণে দেখি না। কী আর দেখব। ওই খালাত বোনের সঙ্গেই নিশ্চয়ই বিয়ে হয়েছে তার, তিনটে বাচ্চা নিশ্চয়ই, আজকাল প্রথম বাচ্চা আনন্দ, দ্বিতীয়টা অ্যাচিভমেন্ট, তৃতীয়টা সেলফ অ্যাকচুয়ালাইজেশন...মাজলোর পিরামিডের শীর্ষ। সামান্য সহিংসভাবে আমি কল্পনা করি, ওর আর ওর সেই খালাত বোনের হয়তো তিনটে মেয়ের পরে অবশেষে একটি পুত্র জন্মেছে, এই মঞ্জিলে মকসুদে না পৌঁছলে আরও কিছু মেয়েবাচ্চা জন্মাতো...রাজা অষ্টম হেনরির চেয়েও বাঙালি উগ্র পুত্রপিয়াসী। ভাবতে ভাবতেই আমি ইউসুফের ব্যাপারে ক্লান্ত হয়ে যাই। 

আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, ইউসুফ এসবের ধার দিয়েও যায়নি। ইউনিভার্সিটির পাট চুকিয়ে দিয়ে সে গঁগ্যার মতো তাহিতিতে চলে গেছে। কিংবা ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে যে জনপদকে ছুঁতে পারেনি এমন কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামে গেছে জীবনের মানে বুঝতে, অথবা (উত্তর কাট্টলির) জীবন থেকে পালাতে। দক্ষিণ সাইবেরিয়াতে এমন কোনো গ্রাম কি আর বাকি আছে, যার কয়েকশ’ মাইল দূরে রেলপথ থেমে গেছে, রাস্তা নেই, অটোমোবাইল নেই। টলটলে বরফগলা পানি আছে, উজ্জ্বল নির্মল আকাশে রোদের খেলা, উছলে পড়া সবুজ জলাভূমি আর বনভূমি থেকে উঁকি দেয় প্লোভার আর হাঁসেদের রোমশ হলদে ছানা। বাতাস ভরে আছে মৌমাছির গুঞ্জনে। চাষারা ওখানে মধুটাও নিজেরাই চাষ করে। আঙিনায় কালো মাটি খুঁড়ে আলু তোলে কোনো খোকা, সেটা ইউসুফের ইউরেশীয় বাচ্চাও হতে পারে। লতা থেকে চাকু দিয়ে কুমড়া কাটে সে খোকার মা...না না দিদিমা। জীবন সেখানে স্তব্ধ, আরেক দিক থেকে দেখলে স্বততঃসঞ্চরণশীল। ‘মুন অ্যান্ড সিক্স পেন্স’এর গগ্যাঁর মতো স্টকব্রোকার লোকটা তাহিতিতে যেমন পালিয়ে গেছিল, ওরকম করে গ্রামে আর পালিয়ে যায় না কেউ? যেতে পারে না ইউসুফ?

কিন্তু আমি কেন তার পলায়ন চাই? কেন আমি চাই না সে উত্তর কাট্টলিতে খালাতো বোনের সঙ্গে বছরকে বছর সাইবেরীয় গ্রামটার রাজহাঁসগুলোর মতো হলুদ হলুদ ছানা প্রসব করুক? কেন চাই সাইবেরীয় সেই গ্রামে তার রুশ বউটা বরং প্রসবকালে মরে যাক? এর উত্তর আমার কাছে নেই বলে ইউসুফকে আমি এই লিস্টে রাখলাম। 

যেন কোনো এক হাহুতাশ ভরা দিনে মনের গহীন বুঁজিয়ে ফেলা কূূপে বালতি ফেললে সেই অগম্য রন্ধ্র থেকে বালতিতে চেপে বের হয়ে আসবে ইউসুফ, রূপবান পয়গম্বর। রুমি বলবেন, সত্য অমন করে বের হয়ে আসে। আদমের রূপের লভ্যাংশ গায়ে মেখে, ইউসুফ নবীর বেশে। আমি কিছু বলবো না। শুধুই লিস্টি করব। 

চার

সে ছিল জীবনানন্দ দাশের সেই ‘সুবিনয় মুস্তফী’র মতো, যার কথা শুনে বেড়াল আর বেড়ালের মুখে ধরা ইঁদুর দুইই হেসে ফেলতো। তবে ঠিক ভূয়োদর্শী যুবা তো সে ছিল না, জীবনানন্দ যতই বলুন। ওর নাম ইবনুল। নার্সারি থেকে আমার বন্ধু। 

সে বহু বহুদিন আগের কথা। তখন ঠিক ইফতারির আগে তুষ দেওয়া বরফ পলিথিনে করে নিয়ে বাড়ির দিকে প্রাণপণে দৌড় দিত ইবনুল। ও’রকম ঊর্ধ্বশ্বাস মুহূর্তের পরে মাগরিবের আজান আর ইফতারি। জরির টুপি আর সাদা সুতির খাটো পাঞ্জাবি পরে ইবনুল ছুটবে মসজিদে, আব্বা বা চাচ্চুদের হাত ধরে। সেকালে আমাকে দেখতে যেমন পুতুল-পুতুল ছিল, ইবনুলকেও ভারি মনোহরণ একটি ছেলেপুতুলের মতোই দেখাতো। তারাবিহ শুরু হবার আগ পর্যন্ত আমরা চাচ্চু আর ফুপ্পির পিছুপিছু ছাদে ঘুরতাম, তারাবাত্তি জ্বালাতাম, ওরা কাকে কাকে নিয়ে গল্প করে আর দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে এসবে কিছুই-বুঝি না মুখ করে কান পাততাম। ইবনুল আর আমি তখন আমপারা মুখস্ত করছি, অথচ আমাদের মুখস্ত হয়েছে ‘পাগলা দাশু’। হুজুরের কাছে পড়তে বসলে হুজুর ইবনুলের কান ধরে এমন টানেন যেন ওটা টানলে বাড়ে, আর আমাকে মধুর গলায় ডাকেনÑ আম্মিজাঁ। হুজুরের পিট্টি ইবনুলের গায়ে লাগে না, ও নাকি বেশরম...বলে মোমেনা ফুপ্পি, ইবনুলের মা (আব্বাকে ভাই ডেকেছিল বলে আমি ওর মাকে ডাকি ফুপ্পি বা মোমফুপ্পি)। বাকিবেলা আমাকে ‘আম্মিজাঁআআ’ বলে ডেকে বেশরম ইবনুল ক্ষেপায়। 

সুরা ফিল শেষ করে আমরা সুরা কুরায়শ ধরেছি, সকালবেলা দুলে দুলে পড়ছি-‘লি ঈ লা ফি কু রাইশ’। শেষে দুই লাইন মিলিয়ে পড়তে গিয়ে ইবনুল পড়লো- ফাল ইয়া বুদু রাব্বা হাআজাল বাইতাল্লাজি... সে কী করে জানবে ‘বাইতাল্লাজি’ পড়া ভুল, হুজুর সারা শরীরের শক্তি নিয়ে ইবনুলের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এমন মার মারলেন যে সেদিন ইবনুল নিজের গা থেকে হাত দিয়ে পাঞ্জাবি খুলতে পারলো না, সে’রাতে ইবনুলের গায়ে জ্বর চলে এলো। ইবনুল মার খেয়ে চলে গেলে অবশ্য হুজুর আম্মিজাঁআআ ডাক দিয়ে আমার গায়ে মাথায় আদর করে হাত বুলাতে গেলেন। রাতে আমরা যুক্তি করলাম, হুজুরকে শিক্ষা দিতে হবে, কঠিন শিক্ষা, বাপের নাম ভুলিয়ে দিতে হবে। যে ভুল করলে আল্লাতালা চুপচাপ সহ্য করেন সেই ভুল করলে হুজুর এমন কসাইয়ের মতন ঝাঁপিয়ে পড়ার কে! মোমফুপ্পিকে বলে দিতে হবে হুজুর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করেন...ইবনুল কঁকিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলো-কই দেখছি সেটা যদি আম্মা জিজ্ঞেস করে?” ইবনুলের চেয়ে আমি তখন দৈর্ঘ্যে বড় হয়ে উঠছি, মেয়েবাচ্চা বলে সমাজ আমাকে একেবারে কার্বাইড দিয়ে পাকিয়ে তুলছে, যে উপস্থিত বুদ্ধির জোরে ব্যাঙের জিভ আঠা ছুড়বার আগেই ফড়িং পালিয়ে যায় সেই বুদ্ধি আমার শরীরে-মনে। বুদ্ধিটা তাকে আমিই দিয়েছিলাম। হুজুর শায়েস্তা হলেন, একেবারে পালিয়ে বাঁচলেন। সুকুমার রায় তো ইবনুলের খুব প্রিয়, সে তারিফের গলায় বল্লো-এইবার বাণ চিড়িয়া নামা!” আমি আর ইবনুল কল্কেগাছটার নিচে সকালের রোদ পোহাতে পোহাতে মোমফুপ্পির হাতের মালপোয়া পিঠা ভাগ করে খেতে খেতে আমৃত্যু বন্ধু থাকবার শপথ নিলাম। 

কিন্তু ইবনুলকে নিয়ে বিপদের শেষ নেই। ও ইচ্ছে করে ঘনঘন বিপদে পড়ত। যেমন মোমফুপ্পির বড়বোন আমফুপ্পি (আমেনাফুপ্পি)। আমফুপ্পির বড় মেয়ে শাহীনুর আপা একবার ম্যাট্রিক ফেল করে এসেছে মোমফুপ্পির বাড়িতে, ইংরেজিতে পাস না করলে আবার ফেল মারবে। প্রতিদিন সকালে সে ফুপার কাছে ইংরেজি পড়তে বসে। ইবনুলের আব্বা মানে এখলাসউদ্দিন ফুপাকে আমরা মোমফুপা ডাকতাম না, কারণ এত বড় ব্যাজস্তুতি করাটা আমাদের মতো ক্ষুদ্র বুদ্ধিদের দিয়েও হতো না। ফুপা ছিলেন ঢালাই লোহায় গড়া। এই ধরা যাক ফুপার ঘরের পাশ দিয়ে ছাদের দিকে উড়ে যাচ্ছি ঘুড়ি ওড়াব আমরা, ফুপা দাঁড় করিয়ে বলবেন-ট্র্যান্সলেশন বল, ‘হেনা হয় গ্রামের সুন্দরী মেয়ে’। ‘মিথ্যাবাদী রাখাল বালককে কেহ বিশ্বাস করিল না’। ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মরিয়া গেল’। একটা পারলে আরেকটা। ফাঁদের পরে ফাঁদ। ইংরেজি পারলে মানসাংকের ধাঁধা ধরবেন ফুপা, না পারলে শাস্তি। এহেন ফুপা শাহীনুর আপাকে টাস্ক দিয়ে বাজার ঘুরে আসতে গেছেন, ইবনুল ঘুরঘুর করছিল ওখানে। ওখানে একমাত্র দর্শনীয় যা ঘটছিল তা হচ্ছে শাহীনুর আপা চোখের জলে ভাসতে ভাসতে চিন্তা করে পাচ্ছে না ‘গোল করিও না’র এই গোলটার ইংরেজি কি? ইবনুল চোখের পানির তামাশা দেখে ছাদে চলে এলেই হতো, সে বলে দিলো-গোল মানে সার্কেল। পেছনে ফুপা দাঁড়িয়ে তা সে খেয়াল করেনি। একেবারে আগ বাড়িয়ে মার খেল ইবনুল। 

তারপর ধরা যাক, মাগরিবের সময় ইবনুল সেজেগুজে ফুরফুরে পাঞ্জাবি আর জরিদার টুপিটা পরে মসজিদে গেছে, কে তাকে ফিরতিপথে লাঠি-লজেন্স ঘুষ ধরিয়ে দিয়েছে আর সঙ্গে একখানা চিঠি। খামে লেখা ‘ছোট্ট খামের অসীম প্রীতি’। ভেতরে লাইনটানা কাগজে কবিতা লেখা- ‘সোহাগ-মায়া উচ্ছলতায় পূর্ণ তোমার ফুলের ডালি, নতুন দিনের কল্পনাতে তোমার বুকে পথ সোনালি’ ইত্যাদি। লম্বা কবিতা, সেই কবিতার ভিতর ‘নিপুণ তোমার তুলির ছোঁয়ায় মোদের জীবন উঠুক রেঙে’র মতো লাইন আর ‘দিশারী’র মতো সেকেলে শব্দ। ‘পথ দিশারী দেবে তোমায়, দেবে পথের পরিচয়’। পড়লে মনে হয় প্রেমপত্র নয়, মানপত্র দিচ্ছে। পিত্তি জ্বলে গেল আমার। বকতে বকতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম, তখন ইবনুল বল্লো, “শোন, সুকুমার রায় লিখেছেন ‘ছাগল ভাবে সামনে এ কী, একটুখানি গুঁতিয়ে দেখি’, তো এই লোকটা তোকে একটু গুঁতিয়ে দেখতে গেছে তুই আওয়াজ করিস কি না। ওরকম ভাবলেই তো হয়।” সুকুমার রায়ের কাছে ইবনুলের সর্বরোগের সমাধান ছিল তখন। আর লজেন্স যে ঘুষ দিয়েছে, সে তো খারাপ ছেলে হতে পারে না অতএব, তার চিঠি হাতে করে আনাই যায়- এমনি মুখ ইবনুলের। এরকম ভাই-টাইপের বন্ধু-টাইপের মানুষও কবে কখন ‘ছাগল ভাবে সামনে এ কী, একটুখানি গুঁতিয়ে দেখি’ মনে করে প্রেমের প্রস্তাব দেয়, সে গল্প করতে আমার একেবারেই ভালো লাগবে না। তাই ওই গল্প বাদ।

পাঁচ

বুড়ো লোকটা একটা ধাবমান ফার্স্ট ব্র্যাকেটের মতোন বেঁকে হেঁটে আসতো শিউলিতলা দিয়ে। সকালবেলার রোদেই সে কী তেজ! প্রতিদিন আসতো। নাকি আমাকেই দেখতে আসতো। বলত নাশতা খেতে খেতে। ফৈজুলের বাবার দিকের গ্রামসম্পর্কের আত্মীয়, আবার এককালের সহকর্মী। বুড়ো এলেই ফৈজুলের মা আমাকে কনুই দিয়ে সরিয়ে দিত লুচির কড়াইয়ের সামনে থেকে-ও তুমি পারবে না মা, সবার হাতে লুচি ফোলে না। অভ্যাস নেই। লোকটা অবশ্য লুচি না ফুললেও দিব্যি খেত ঝোলে ডুবিয়ে, আর বড় মায়াভরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতো, বলত-আহাহা। বলত-আমার ছেলের বৌরা আমাকে খেতে দেয় না। বড় রুচিহীন নালিশ। ফৈজুলের মা অবশ্য আমাকে আবার ঠেলে দিত সামনে-একটু যত্ন করো বুড়াকে, বুড়ার অনেক পয়সা! কাঁচা পয়সা হয়তো ছিল অনেক, একদিন দেখি আমার জন্য সোনারুর কাছ থেকে নিজে ডিজাইন দেখিয়ে দিয়ে একটা আংটি গড়ে এনেছে। আংটিটা লতার মতন অনামিকা জড়িয়ে থাকে কয়েক প্যাঁচে, সোনার পাত দিয়ে গড়া উজ্জ্বল পানপাতা ফলে রয়েছে সেই লতায়। বড় বেশি উজ্জ্বল, প্রগলভ। সেই আংটি নিজহাতে আমার আঙুলে পরিয়ে বুড়ো বললো-এই আমার আশীর্বাদ, কখনো বেচবে না। আর তুমি যদ্দিন এখানে থাকবে, আমি তোমার হাতে নাশতা খেতে আসব। আমি ঢেঁকির মতন উবু হয়ে তাকে সালাম করলাম। লোকটার গায়ের বুড়ো-বুড়ো গন্ধ ছাপিয়ে আমার নাকে এলো শিউলিতলার গন্ধ, বিষাদলক্ষ্মী, হিমিকাবিলাসিনী শেফালি। 

ফৈজুলদের বাড়িতে পোলাওয়ের চাল দানাদানা অথচ সেদ্ধ অথচ আঠালো নয় এমন করে রাঁধতে হতো। রান্নায় চুল পেলে উঠে যেত ওরা, মাছের আঁশ পেলে বিরক্ত হতো, লেবু ঠিকঠাক টুকরো না হলে লেবু ছুঁড়ে দিত রান্নাঘরের দিকে। ঘরের কোনো কোণে একটা ছেঁড়া কাগজ পড়ে থাকলে কথা শোনাতো। খাটপালঙ্ক সকালেই টানটান আয়তক্ষেত্র না হলে রাগ করত। ঝুল দেখলে রাগ করত। ফৈজুলের বড় চাচার ছেলে স্থানীয় একটি মেয়েকে বিয়ে করে এনেছিল, বড় ‘লক্ষ্মী’ মেয়ে, ভাসুর-দেবরদের সঙ্গে কখনো খেতে বসে না, ডাক্তার মানা করার পরেও স্বামীর ইচ্ছায় তিনবার সিজার সেকশন করিয়ে বাচ্চা নিয়েছে। ওর স্বামী ওকে হরলিক্সের বোতলের ঢাকনা (তখন প্লাস্টিকের হতো না এই ঢাকনা) গরম করে একবার চাকা চাকা দাগ করে দিয়েছিল পিঠে, মেয়েটি সহ্য করেছে বলেই আজ তার সোনার সংসার! আমাদের মতো শহরের অসভ্য মেয়ে নয় যে তিনজনে এক রিকশায় চড়ে ঢাকার নরক-গুলজার রাস্তায় বের হয়! এসবে আর কার কী হয় বা হতো জানি না, আমার মতো অসভ্য মেয়ের অসহ্য রাগ হতো। একদল মেয়ে থাকে আমাদের সবার বাড়িতে, তাদের নাম মা-খালা-ফুপু-নানী-দাদী-চাচী...এদের কাজ হয় দোয়ারকি দেয়া, ‘এভাবেই সব মেনে নিতে হয়’। আমি পারছিলাম না তো। আমার হাড় আমার মন যে বিষের ডালপালার মতো আড় হয়ে থাকতে জানে। সেই ডালপালায় রাতের বেলায় কোনো ফুল ফোটায় কার সাধ্যি। 

তবু বাড়িটায় আমার জন্য ইতস্তত অনেক আদর ছড়িয়ে ছিল, অ-গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের কাছে। যেমন যে বুয়া লুঙ্গি পরে কাজে আসতো আর কোরালমাছ আতপচাল ধোয়া পানিতে ভিজিয়ে রাখত, সেই বুয়া আমাকে ভালোবাসতো। ভালোবাসতো তার অকালবিবাহিতা মেয়ে শমসুন, শ্বশুরবাড়ি থেকে কত মিথ্যে বলেটলে সে লক্কড়ঝক্কড় বাসে চড়ে আমাকে দেখতে আসতো, সেই দুরূহ যাত্রা আমি কি ভুলতে পারি। যে চৌকিদার রাতে হৈ হৈ করে ওদের বাড়ি পাহারা দিত আর দিনমান বেড়ার ঘরটায় ঘুমোতো বা নালায় ভাতের টোপ ফেলে মাছের অপেক্ষায় ঝিমোতো, সেও আমাকে খুব ভালোবাসতো, হাতে কোনো বোঝা দেখলেই ছুটে আসতো; কিন্তু যাকে দিয়ে আমি এই সমস্ত ভালোবাসার চক্রের সঙ্গে সংযুক্ত, সেই সংযোগে একটা বিষম গ-গোল ছিল। ফৈজুল। 

সে আমার পাশে বসে, আমার সঙ্গে রিকশায় ঘুরে, আমার গায়ে জুতমতো চড়ে ইত্যাদি কোনো মুদ্রাতেই সুখী ছিল না। রাতের বেলা আমাকে বলত- লিপিস্টিক ছাড়া আমার বিছানায় উঠবে না, দুষ্টু জামা (লেসের লঞ্জারি) ছাড়া কাছে আসবে না-আমি ম্যাক্সি তুলে লাগাতে পারি না। আমি জানি না অন্য কোনো মেয়ে হলে কেমন লাগতো। প্রতি রাতে কটকটে লিপস্টিক লাগিয়ে বিছানায় আসতে গিয়ে ওই সংক্ষিপ্ত যাত্রাপথেই আমার ভেতর সবকিছু শুকিয়ে যেত, যেন ল্যাম্পপোস্টের তলায় আলোর বৃত্তে রঙ মেখে দাঁড়িয়ে আছি বেশ্যার মতোন...এমন লাগতো। 

-লিপস্টিক কি তুমি এমনিতে দাও না? সবকিছুতে এত বাধো বাধো লাগে তোমার! সবকিছুতে ঝামেলা পাকাও। রাস্তার লোকের জন্য দাও আর আমার জন্য দিতে অসুবিধা? হাসব্যান্ড চাইলে বউ কী না করে! আমার কলিগ তানজিনা বরকে প্রতিদিন একবার সালাম করে।

আমি তাকে কী করে বোঝাই, রাতে শুতে আসবার আগে প্রতিবার ওই লিপস্টিক মাখার ব্যাপারটা ‘আমাকে লাগান’ টাইপের সাইনবোর্ডের মতো অশ্লীল কেন লাগছে! আমিই কি ছাই বুঝি। ও আমাকে যা বোঝায় তাই তো বুঝি! আসলে তা বুঝি না, যেমন বোঝায় তেমন বুঝলে কি আর অত ঠোক্কর খেতাম, আমি আমার মতো করে বুঝি। এই যেমন প্রথম দু’রাত মাথাব্যথার ছল করে ঘুমিয়ে থাকলো। তখন বিশ্রী রাগ উঠেছিল আমার। যা পারে না, তার সব দোষ আমার কী করে হয় প্রতিবার? প্রতিবার ফৈজুল বলত, ‘তুমি গরম হতে পারো না দেখে আমার হয় না।’ আমি জবাব করতাম না, ক্লান্ত লাগতো, সে কি আর জানতো না গরম হতে হতে স্বতঃবাষ্পীভূত হতে হতে ঠান্ডা হয়েছি, পুরো প্রক্রিয়াটাই ওর কাছ থেকে একহাত দূরে শুয়ে থেকে ঘটেছে, ও তো ল্যাটেন্ট হিটের নামই শোনেনি। আমি বলতাম-তাহলে বরং আজকে থাক।” সে ক্ষিপ্ত হয়ে বলত, ‘শালার আমি কাউকে লাগায় দেখে আসব পারি নাকি পারি না।’ এমন বাজে কথা প্রথম দিন শুনে কেঁদে উঠে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কাকে পাবে পরীক্ষামূলকভাবে শোবার জন্য?’ ফৈজুল ফনা নামানো গলায় বলেছিল- “চাইলে পাওয়া যায়।” ভাগ্যিস ঘরে আলো বলতে ডিমলাইটটা জ্বলতো, একটা উড়ে যাওয়া পাখির নীলাভ ডিমের মতন। সে আলোতে ফৈজুলের উদ্ধত সপ্রতিভ মুখটা ভাগ্যিস দেখা যাচ্ছিল না, যে মুখে স্পটলাইটের আলো পড়লেই অনর্গল বেরিয়ে আসতো মানুষের মুক্তি আর নারীস্বাধীনতার কথা। ইরেক্টাইল ডিসফাংশন আছে এমন লোক যদি সারাবেলা-‘তোমার কারণে কিছু হয় না’ বলতে থাকে, বলতেই থাকে, তা মানবার মতো লক্ষ্মী এবং বরকে সেলাম করা বউ আমি তো নই। অতএব একদিন আমি হিসহিস করে বলে দিয়েছি-তুমি হচ্ছো সবচেয়ে বাজে কম্বিনেশন। মেজাজ কঠিন, শিশ্ন নরম।’ ইংরেজিতে বলেছি, বাংলায় বললে হয়তো এত ক্ষেপতো না। 

ছয়

এখন আমি প্রজ্ঞাপারমিতাই হই বা সাহানা, আমার তো একটা পটভূমি আছে, পূর্বপরিচয়ও একটা দেয়া চাই। 

কোথা থেকে এই গল্প শুরু করব? এই একটা দুরূহ ব্যাপার। এই শুরুটা। মোটের ওপর বুঝেই গেছেন আপনারা, আমি লাবণী। ওসব সাহানা প্রজ্ঞাপারমিতা ইত্যাদি নামটামের আড়ালে এই আমার নাম। সুবলচন্দ্র মিত্রের লাল খেরো কাপড়ে বাঁধাই মোটাসোটা অভিধানটায় আছে, ‘মুক্তার অভ্যন্তরে যে সুন্দর তরল ছায়া পরিদৃষ্ট হয় তদ্রুপ ছায়া অঙ্গে বিদ্যমান থাকিলে তাহাকেই লাবণ্য বলা যায়’, সেটা দেখে আমার নাম যে-ই রাখুক তার প্রতি আমার মনটা প্রসন্ন হয়েছিল, মনে আছে। আর এও নিশ্চয়ই বুঝে গেছ-আমি বাংলায় পড়েছি অথচ নাক উঁচু, নকল বাঘটার মতো থ্যাবড়ানো নয় আমার নাক। 

এই গল্প কোথা থেকে শুরু করা যায়, তাই নিয়ে ভেবে দেখলে আমার কাছে নিম্নোক্ত অপশনগুলো আছে।

ক.) সুলেখা মামী রঙ্গ করে আমার বাপের সংসারে হাঁড়ির হাল দেখে বলেছিল, ‘যেমন হাঁড়ি তেমন সরাই জুটবে কিন্তু, এমন ঘরে তেমন বর আসবে না। জানো তো, তোমার বাপ যদি গরিব হয় সে তোমার কপাল; কিন্তু শ্বশুর যদি গরিব হয় সেটা তোমার বোকামি। ছেলেরা এই বোকামি কখনো করবে না।’ সেকালের অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর ‘প্রথম কদমফুল’এর কাকলির মতো আমিও ঘাড় বাঁকিয়ে বলে ফেলতে পারতাম- ‘বিদ্যা ছাড়া বুঝি রূপ হয়?’ আমি কি ফেলনা? কিন্তু কাকলির সেই প্রশ্নের পর অনেক দশক অতিবাহিত হয়েছে, প্রমাণিত হয়েছে বিদ্যাহীনার রূপকেই নিরুপদ্রব রূপ বলে, যে রূপ উপদ্রব নিয়ে আসে তা লোকে একালে চায় না। মনে ভাবতাম, সুলেখা মামী একদিন ঠিক দেখবে, আমার পাশে দাঁড়িয়ে বিদ্যাবতী স্ত্রী প্রাপ্তির সৌভাগ্যে জ্বলজ্বল করছে সে, মানে আমার বর। অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো, সম্ভাব্যের ইঙ্গিতে ভরপুর যুবক। সোনার বদলে রাংতার ফঙ্গবেনে জিনিস নয়, কৃতকৃত্য। কৃতবিদ্য। তাকে আমার পাশে বা আমাকে তার পাশে একটুও বেমানান লাগছে না। ওই মাছের ঝোল মাখতে মাখতে নকল বাঘছাল পরে বাঘ সাজার পরামর্শ দেয়া লোকগুলোর মুখের বাক্যি হরে যাওয়ার মতো বিদ্বান সে। কিংবা ‘অভয়ের বিয়ে’তে উত্তম কুমার যেমন বিদ্বান অথচ সাংসারিক বুদ্ধিতে আকাট ছিল সেইরকম বিদ্বান। সেই আশাভরা সময় থেকে শুরু করতে পারি।

খ.) নাকি কাজী অফিসের নথিপত্রের স্তূপের ওপর একটা লোম-ওঠা কালো বেড়ালের ছানা শুয়ে ছিল, সেই বেড়ালের দিকে তাকিয়েছিলাম অপলক, ফৈজুলের সঙ্গে ডিভোর্সের কাগজপত্রে সিগনেচার দিতে এসেছি, আমাকে তিনবার বলানো হলো যে, ‘আমি নিজের নফসের ওপর বাইন তালাক লইলাম’... আর আমি চমকে বাপের দিকে তাকিয়ে বললাম- “ডিভোর্সের কারণ হিসেবে ‘মতের অমিল’ লেখা কেন আব্বা?” আমি আর আমার বাপ উভয়ই তো জানি মতের অমিলের চেয়ে আরও কত ভয়ানক কারণে আমি ঐ অফিসে এসেছি, মতের অমিলের চেয়ে আরও কত সাংঘাতিক সব অমিল হয়। সেখান থেকে এই গল্প শুরু করব? নাটকীয় হবে শুরুটা। 

গ.) নাকি পাকা-কথা হয়ে যাবার পরের দিনগুলো থেকে শুরু করব? 

যা অনিবার্য, তা নির্বিঘ্ন করবার জন্য যা যা করা দরকার তাই তাই করতে যখন আমি রাজি হয়ে গেলাম। হাতপায়ের নখ ঘষিয়ে (শানিয়ে) আনলাম, চুল দাঁত ইত্যাদি পলিশ করালাম, ঘৃত কুমারী মাখলাম- কস্তুরি হলুদ মাখলাম, শসার রস করে খেলাম- আলুকোরা চোখে থুপে শুয়ে রইলাম কয়েক বেলা, পুঙ্খানুপুঙ্খ সাজিয়ে তুল্লাম নিজেকে, শরীরের ওজন ঠিকঠাক করে রাখতে ক’দিন উপোস করলাম (তাতে খুব অসুবিধে হলো না, এম্নিতে মুখের রুচি চলে গেছে)...কিনা শরীরের সঙ্গে আরেকটা শরীরের বিয়ে হচ্ছে যেন এমন। অত দরকার ছিল না, মনে আনন্দ বিকশিত হলে চেহারার লাবণ্যে কমতি পড়ে না। মুক্তার তরল ছায়া এমনিই শরীরে পরিদৃষ্ট হয়। কোথাও তো গচ্ছিত রয়েছে আমার আনন্দ, আমার সুখ, যা আমার ন্যায্য, যা আমার প্রাপ্য। কোথাও তো আছে এমন অগাধ সাদা যার সান্নিধ্যে শান্তি। এইসব আশা-ভরসার কথা ভেবে নিয়ে আমি লাবণী/ প্রজ্ঞাপারমিতা/ সাহানা প্রথমবার তৈরি হয়ে গেছিলাম বিয়ে করতে। 

ঘ.)কিংবা কস্ট্যুম ড্রামার মতো করে শুরু হোক গল্পটা।

দ্বিতীয় বিয়েতে সাজলে লোকে বলবে কী! তবু সেটা ‘বিয়ে’ এমন মন-রাখা সাজ দেয়া তো চাই, কার মন রাখা হয় তাতে কে জানে! সুরমারঙ গাঢ় রেখা চোখে, ঠোঁটে সুরকি-লাল লিপস্টিক। গায়ে আসমানির ওপর রুপালি জরিতে নিভু নিভু কাজ করা শাড়ি, জমিনে ছোট ছোট ময়ূর আর হাতি, পাড়ে পানপাতা। পরলেই কেমন ডানা ঝটপটিয়ে উড়াল দিতে চাওয়া কবুতরী মনে হবে পরনেওয়ালাকে। পার্লারের মেয়েরা সেই শাড়ির ক্রেতার রুচির প্রশংসা করছিল; কিন্তু শাড়ির ওই নিভন্ত ভাব দেখেই কেউ কেউ গা-টেপাটেপি করে কীসব বলছিল, যেন ওরা জানে এই নিভুসাজ ওই চুল্লির আঁচ মরে আসা রঙের বিয়ের শাড়ি দ্বিতীয়বারের বারতা... খুশি মেশানো লজ্জায় ভরা মুখ নেই, আশঙ্কায় পান্ডুর মুখ। আমার গলায় বড় হার, হারটা ঘিরে বেদানার টনটনে দানার মতো চুনিগুলো। সেজেগুজে আয়নায় দেখলাম আমার মথিত ফুলের মতো রূপ, ক্লান্ত। তবু ফুল। পার্টির শেষে, পরিত্যক্ত টিনের ক্যানের মতো ঠনঠনে আমার মন। আমার হৃদয়। তা সেই কবুতরীর দেশের সাচ্চা কাঞ্জিভরম শাড়ি কসরত করে পরে বাড়ি এসে দেখলাম বাড়িতে কেউ নেই, সব্বাই কমিউনিটি সেন্টারে চলে গেছে। ফররুখ মামার ড্রাইভার হাসমত আমাকে পার্লারে নিয়ে গেছিল, বাড়িতেও গাড়ি চালিয়ে সে নিয়ে এসেছে। অবস্থা দেখে হাসমত মুখ শুকনো করে বল্লো, “আপা তাড়াতাড়ি চলেন, আপনারে ছাড়াই বিয়া হইয়া যাইব গিয়া মনে হয়!” লোকটা ফাজিল। পরে আমি বিবাহসভায় এলাম। ‘অ্যান্ড দেয়ার ওয়াজ লাইট’। অন্ততঃ আশুগঞ্জের নানীর ফোনটা আসবার আগ অব্দি... বলো তো সেখান থেকে এই গল্প শুরু করি? 

ঙ.) কিংবা একটা পুরনো কেল্লার চত্বরে আমরা শেষ বিকেল কাটিয়েছিলাম মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে, সেটার নাম ছিল ‘চলতি-বুর্জ’। কেল্লাটা নাকি আগে নদীর গায়ে-গায়ে লাগোয়া ছিল, এখন নদীর ধার থেকে কম করেও একশো হাত দূরে। মানে নদী সরে গেছে এমন ভাববার বুদ্ধি হয়নি লোকের। তারা ভেবে নিয়েছে কেল্লাটাই চলে-ফিরে পিছু হটে গিয়েছে। নদী তো মেয়েলি, কেল্লা পুরুষালি- স্থানান্তরে যাবার অধিকার কেবল তারই। সেখানে ফুরিয়ে যাওয়া বিকেলের আলোয় বসে বসে সাতবুড়ির এক বুড়ির মতো আমার মনে হলো- ওর কেমন দুবলা চেহারা, আমি ওর খুব যত্ন করব, প্রতিদিন একটু করে ছানা- মৌসুমের ফল, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মলা মাছের তরকারি, পাতলা চিকেন স্টু। ধুত, এটা অভিনব কোনো চিন্তা নয়, নীরদ সি চৌধুরী ওঁর স্ত্রীকে বিয়ের রাতে ‘বেঠোফেন’ বানান জিজ্ঞেস করেছিলেন, আর স্ত্রী ওঁর শীর্ণ- রোগাটে হাত তুলে নিয়ে বলেছেন, ‘আমি তোমার খুব যত্ন করব!’ রাজ্যের বইয়ে যা পড়েছি, তা ছাড়া আমার ভেতর পাকিয়ে পাকিয়ে আর কিছু উঠে আসছে না তো কী করব! একটা দেহাতি বৌ বাচ্চা-কোলে কাছাকাছি এসে আমাদের জরীপ করছিল, বাচ্চাটার ভোঁদড়ের মতো কপালজোড়া ড্যাবডেবে চোখ, ভারী কৌতূহলী। 

আমি ভাবছি আর কয়েক দিন পরে উড়োজাহাজে করে উড়ে যাব নভান্তরে। প্লেন টেক অফ করার পর আমার মনে হবে, সংকীর্ণ জীবন থেকে মুক্তির পথে চললাম, যাকে বলে ‘অগ্রসর’ হওয়া-ফিজিক্সের ভাষায় অন্ততঃ তাই হলাম। ওই ‘আগেকার ভাইসাবের টেস’ আর ‘শর্ট ডিভোর্স’ ছেড়ে তো চললাম। যেখানে দেয়াশলাইয়ের সরু-সরু শলার মতো আলু কাটা না হলে আলুভাজি খেতে না পারা দেবর নেই। যেখানে ঘরের-কাজ-আম্মু-করতে-দেয়নি-বলে-একেবারেই-কিছু-শিখে-আসিনি জা নেই। যেখানে বৌ-জব্দ-কিলে শাশুড়িও নেই। যেখানে বউগুলারে-নখের-আগায়-রাখতে-পারেন না-ক্যান-আম্মা স্বামী নেই। আমার মাতৃকুলের মতে- এমন নিষ্কন্টক জীবন আর হয় না। বিকেলের ফুরফুরে বাতাস আমার কানে মায়ের মতো গলায় এইসব প্রবোধ দিচ্ছিল, ঘোলা পানি থেকে মেছো গন্ধ আসছিল নদীর, সৌম্যর শার্টের প্রান্ত উড়ছিল কোনো মুক্তির ছাড়পত্রের মতো। আমি তখনো অভিনব কিছু বলা যায় কি না ভাবছি। ওকে নিয়ে আমার ভিতর যে শিউরে শিউরে ওঠা, সেটা অভিনব; কিন্তু সেটা তো আর বলা যায় না। 

তোমাদের একটা কথা বলি? একটা বাঁশপাতার ঠোঙায় গরম আঠালো কমলাঝুরি বুন্দিয়া- এই দৃশ্যটা বিকেলবেলার রোদে দেখতে যেমন, প্রেমকে দেখতে সেইরকম জ্বলজ্বলে ঝলমলে ক্ষুধা-উদ্রেককর। যখন সেটা কারো মুখে ভাস্বর হয়ে ধরা দেয়। সেই ঝলমলে দৃশ্য কারো মুখে দেখবো বলেই না আমি আরেকবার স্রোতের তোড়ের মুখে ছেড়ে দিলাম আমার জীবন। আমি তো জানি অচিন্ত্য কুমার লিখেছিলেন- ‘প্রথমই পরম নয় সবসময়। কখনো কখনো দ্বিতীয়ও অদ্বিতীয়।’ সেখান থেকে শুরু করব? আম্মা- আব্বাকে তো ভালোবেসেছিলাম প্রাণাধিক, ফররুখমামা বা সুলেখামামী এদের সবার জন্যও আমার একরকমের কৃপা মেশানো ভালোবাসা ছিল, সেসব ভাসিয়ে দিয়ে রশি খুলে দিয়ে ভেসে পড়লাম দুর্মূল্য সেই জ্বলজ্বলে ঝলমলে দৃশ্য দেখবার আশায়, সেইখান থেকে? শুরু করব?  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //