রাজনীতি

জোট কিন্তু বাঁধতেই হবে

‘ফেল কড়ি মাখো তেল’ অনেক পুরনো একটা বাংলা প্রবচন; কালের ধুলায় সে মোটেই মলিন হয়নি, উল্টো অতিব্যবহারে ক্রমাগত উজ্জ্বল ও ধারালো হয়ে উঠেছে। এটি বাজারের কথা। বাজারে যিনি দোকান খুলেছেন তিনি একজন ব্যবসায়ী, পণ্য বিক্রি করছেন মুনাফার জন্য, তাঁর চেষ্টা ক্রেতাকে যতটা পারা যায় ঠকাবেন, পারলে তেলে ভেজাল মেশাবেন। তাঁর কাজ ও নীতি দুটিই পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদ যত শক্তিশালী হয়েছে ‘ফেল কড়ি মাখো তেল’ নীতি ততই বিস্তৃত ও বলশালী হয়েছে, এখন তো বিশ্বময় তার একচ্ছত্র আধিপত্য। কোথায় সে নেই? যেমন স্বাধীনতার পর শোনা সেই আপাত মর্মস্পর্শী ও জনপ্রিয় গানটি : ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না।’ সেখানেও ওই কেনা-বেচার কথা, আসলে যেটা কোনো ভাবেই সত্য নয়। শহীদরা স্বাধীনতা এনেছেন হানাদারদের পরাভূত করে; রক্তের ‘বিনিময়ে’ তাঁরা স্বাধীনতা কিনে এনে আমাদের উপহার দেননি। যুদ্ধটা ছিল জনগণের, তাতে আমরা সবাই ছিলাম, শহীদরা ছিলেন আমাদেরই অগ্রবর্তী অংশ। ব্যাপারটা এমন নয় যে, এক সাগর রক্তে রাজি না হলে হানাদারদের দুই বা তিন সাগর রক্ত দিতে হতো। যুদ্ধক্ষেত্র দরকষাকষির বাজার নয়, জয়পরাজয়ের রণক্ষেত্র বটে।

পুঁজিবাদের এই বাজারী কারবার এখন বিশ্বের সর্বত্র। আর সে-কারণেই বিশ্বের এখন ত্রাহি ত্রাহি দশা। ওই নীতির বিপরীতে পাল্টা আওয়াজও আছে। আমাদের এই বাংলাদেশেই উঠেছে সে আওয়াজ। তুলেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আওয়াজটা হলো, ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না তা হবে না তা হবে না’। এটা পুঁজিবাদের দ্বারা নিপীড়িত বিশ্ববাসী সকলেরই মনের কথা, বিশ্বজনীন প্রবচনে পরিণত হতে পারতো। হয়নি। কারণ বাংলাদেশ একটি প্রান্তিক দেশ; এবং অবশ্যই হতদরিদ্র। এখানকার আওয়াজ বিশ্বময় পৌঁছায় না। পুঁজিবাদ তার বিরোধী আওয়াজগুলো শুনতেও চায় না, কণ্ঠরোধ করে। তবে বাংলাদেশ দরিদ্র বটে; কিন্তু পুঁজিবাদী সে ঠিকই।

বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের অতিসাম্প্রতিক অবদানটা হচ্ছে করোনাভাইরাস। পুঁজিবাদের সে প্রতিনিধি, এবং নিজেও সে পুঁজিবাদী চরিত্রসম্পন্ন। পুঁজিবাদীদের একটি গণমুখপাত্র হচ্ছে আমেরিকার টাইম ম্যাগাজিন। করোনা মহামারির তাণ্ডব দেখে সে পত্রিকা মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছে যে এই আক্রমণ ইতিমধ্যেই, “is challenging our assumptions about humanity, about society, about greed and selfishness, about the need to cooperate[...]” খুবই খাঁটি কথা। বিপদে পড়লে অনেক সময় খাঁটি কথা বের হয়ে আসে বৈকি। প্রাণের টানে। মনুষ্যত্ব ও মনুষ্যসমাজ সম্বন্ধে আমরা অতিউচ্চ ধারণা পোষণ করতাম। আমরা অর্থাৎ পুঁজিবাদী বিশ্বের সুবিধাভোগীরা, এবং তাদের প্রভাবে পড়ে সুবিধাবঞ্চিতরাও। করোনার আক্রমণে সেসব ধারণার ভূলুণ্ঠিত হবার দশা। সত্য হয়ে ফুটে উঠেছে আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রিকতা ও লোলুপতা। ওগুলো অবশ্য ছিল, যতই সভ্য হবার চেষ্টা করুক, মানুষ তো প্রাণীই বটে, প্রাণী জগতেরই এক সদস্য; আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রিকতা ও ভোগলিপ্সা তো তার থাকবেই, আর ওগুলো জয় করেই তো সভ্যতার অগ্রগতি; কিন্তু জয় করা যে মোটেই সম্ভব হয়নি, করোনা এসে এক নিমেষে সেই খাঁটি সত্যটাই উন্মোচিত করে দিল। বলল বাঁচতে হলে পালাও, গুহার ভেতর ঢোকো। অন্যের সঙ্গে মিলবে না। দূরে দূরে থাকবে। মনে করবে সবাই তোমার শত্রু। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলো। শারীরিক দূরত্বকে যে সামাজিক দূরত্ব বলা হচ্ছে, এটা নিতান্ত আপতিক নয়, ঘটনা আসলে সামাজিক দূরত্বই। মানুষ যদি মানুষকে দেখে ভয় পায়; পরস্পরের হাত ধরবে কি, বরঞ্চ হাত যাতে না ধরতে হয় তার বন্দোবস্ততে যদি সে সর্বক্ষণ উদগ্রীব থাকে, তাহলে তো বুঝতেই হবে যে মানুষ তার সামাজিকতার সবটাই খুঁইয়েছে। আর সামাজিকতা না থাকলে তো মানুষ আর মানুষই থাকে না, পশুতে পরিণত হয়। সেটাই ঘটছে। রোগী দেখলে প্রতিবেশী সাহায্য করবে কি দৌড়ে পালাচ্ছে। রোগাক্রান্ত বৃদ্ধ পিতা-মাতা মারা গেলে কাফন-দাফন করতে হবে ভয়ে পরিচয়ই দিতে চাচ্ছে না সন্তানরা; এমনো হয়েছে লাশ ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে দ্রুত সটকে পড়েছে। অবিশ্বাস্য? হ্যাঁ, অবিশ্বাস্যতাই ঘটছে।

এই দুনিয়াতে এখন কোটি কোটিপতিদের সংখ্যা একশ’ দুশ’ নয়, তিন হাজারের কাছাকাছি। তাদের মধ্যে সেরাদের একজন হচ্ছেন বিল গেটস। দাতব্যের জন্যও তিনি বিখ্যাত। করোনা মোকাবেলার ব্যাপারে তিনিও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতোই উদ্বিগ্ন। প্রবন্ধ লিখে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর লেখা দুটি প্রবন্ধ দেখলাম। তিনি মহাজন তাঁর বক্তব্য তাই বিশ্বজুড়ে প্রচার পেয়েছে। প্রথম বক্তব্য ছিল, করোনার মুখোমুখি বিশ্বের এখন এক নম্বর কর্তব্য হচ্ছে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া, শাটডাউন করা, অন্যরা যাকে বলছে লকডাউন সেটা করা। ভালো কথা, এই লকডাউন জিনিসটা ঠিক লক আপ নয়। পার্থক্য আছে, লক আপ করে কারাকর্তৃপক্ষ, কারাবন্দিদেরকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খুপড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। আর লকডাউন হচ্ছে স্বেচ্ছায় বন্দি হওয়া, আত্মরক্ষার জন্য। পরিণাম অবশ্য একই। আটক থাকা। বিল গেটস্ সাহেবের দ্বিতীয় পরামর্শ টেস্ট করো; রোগের সংক্রমণ ঘটেছে কি না সেটা পরীক্ষা করে দেখো। টেস্ট, আরও টেস্ট। তার তিন নম্বর কথা টিকা আবিষ্কার চাই। তাঁর উদ্বেগ মর্মস্পর্শী। বিল গেটস্ সাহেব সুপ্রসিদ্ধ জ্ঞানী, তিনি সবই জানেন, শুধু এটুকু জানেন না যে, আসল ব্যাধিটি হচ্ছে পুঁজিবাদ, যার ওপরে তাঁর ও তাঁদের ধনবৃদ্ধির পূর্ণ নির্ভরতা। তবে এই মহাসংকটের সময়ে তিনি কেবল পরামর্শই দেননি, চিকিৎসা ও ত্রাণের জন্য দানও করেছেন, যদিও দানের পরিমাণ খুবই সামান্য। তাঁর মোট সম্পদের একশ’ ভাগের এক ভাগও নয়, শূন্য দশমিক দুই আট (০.২৮) শতাংশ মাত্র। আমরা নিশ্চিত নই যে কোনটি অধিক মূল্যবান, তাঁর দান নাকি তাঁর উপদেশ। অবশ্য উপদেশও এক প্রকারের দান বটে। তবু তিনি যা হোক হাত উপুড় করেছেন, অন্যধনীরা সেটাও করেননি। করোনা মোকাবেলায় সেরা ধনীদের মধ্যে দাতার সংখ্যা শতকরা এগারো জনও নয়, তারও কম। এঁরা শুধু নিতেই জানেন, দিতে শেখেননি। কারোনাক্রান্ত বিশ্বে মন্দা দেখা দিয়েছে, যেটা স্বাভাবিক; এই মহামন্দার মধ্যেও কিন্তু কোটিপতিদের ধনস্ফীতি বসে থাকেনি; সেটা বরঞ্চ বাড়ছেই। এটাও স্বাভাবিক। কারণ শ্রম আরও সস্তা হচ্ছে, বিপন্ন মানুষ তাদের সম্পদ বলতে যা আছে তা বিক্রি করে দিচ্ছে, দরকষাকষি যে করবে সেই সক্ষমতাটুকু পুরোপুরি হারিয়ে ফেলছে। সব কিছুই চলে যাচ্ছে এবং যাবে ধনীদের হাতে। এমনকি ওষুধ এবং চিকিৎসাও তাদেরই করতলগত। তারাই শাসক। তাদেরকে থামায় এমন কেউ নেই। আর তারা নিজেরা যদি থামতেই শিখতো তাহলে তো অত বড় ধনকুবেরই হতো না। তাদের স্ফীতি রোখে কে!

বলা হচ্ছে করোনাভাইরাস প্রকৃতির সৃষ্টি, মানুষের নয়। এক অর্থে দাবিটি মিথ্যা নয়, যদিও পুঁজিবাদী বিশ্বেরই একাংশ বলে বেড়াচ্ছে যে, চীনের মনুষ্যবিনাশী জীবাণু তৈরির এক গবেষণাগার থেকেই ফাঁকফোকরে কোনো একটি জীবাণু বেরিয়ে গিয়ে এমন দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। এ নিয়ে আবার তদন্তও হবে বলে শোনা যাচ্ছে। তা হোক। আমরা মেনে নিলাম যে, রোগটি এসেছে প্রকৃতি থেকেই; কিন্তু প্রকৃতির কেন হঠাৎ এমন দুর্বুদ্ধি হলো যে সে বেরিয়ে পড়ল মানুষ মারবার মিশন নিয়ে? প্রকৃতির তো এটা স্বাভাবিক কাজ নয়। তার জন্য স্বাভাবিক কাজ হচ্ছে নিজে বেঁচে থাকা। তাহলে? আসলে প্রকৃতির এই অস্বাভাবিক কাজের জন্য প্রকৃতি নিজে দায়ী নয়, দায়ী মানুষই। সকল মানুষ নয়, পুঁজিবাদী মানুষ, প্রকৃতিকে যারা পণ্যে পরিণত করেছে এবং উত্ত্যক্ত করেছে সর্বক্ষণ। প্রকৃতি তার নিজস্ব প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জানানোটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতিরও তো প্রাণ আছে; প্রাণ বাঁচাবার দায় আছে। প্রাণের ওপর আঘাত করলে প্রত্যাঘাত তো সে করবেই। 

কোভিড-১৯ নাম-দেওয়া এই রোগটি একেবারেই আনকোরা। বলা হচ্ছে, এর কোনো ইতিহাস নেই। সেটা ঠিক; কিন্তু এর উৎপত্তি যে-ব্যবস্থা থেকে তার তো লম্বা ইতিহাস রয়েছে। বাদুড়ের গায়ে জীবাণু জন্মে থাকলে তার ওপর পুঁজিবাদী মানুষের অত্যাচারের কারণেই ঘটেছে। একশ’ বছর আগে, সেই ১৯১৮ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষকালে স্প্যানিশ ফ্লু নামে ভয়ংকর এক রোগ দেখা দিয়েছিল। ধারণা করা হয় যে, তার আক্রমণে পাঁচ কোটি লোক মারা গেছে। যুদ্ধের ভেতর মানুষের গা-ঘেঁষাঘেঁষি যাতায়াত, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা, পুষ্টির অভাব, অমানুষিক পরিশ্রম, এসব অস্বাভাবিকতার দরুন রোগটা দেখা দেয় এবং অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের সময়ে মৃত্যু, ধ্বংসলীলা ও উন্মত্ততার ভেতর রোগে মৃত্যুর খবরটি কিছুটা চাপাই পড়ে থাকে। একশ’ বছর পরে এবার এলো আরেক ফ্লু। এখন যুদ্ধ নেই, পৃথিবীময় কথিত শান্তি বিরাজ করছে; জ্ঞানে বিজ্ঞানে চিকিৎসায় প্রযুক্তিতে মানুষ কত কত এগিয়ে গেছে, অবিশ্বাস্য সব উন্নতি; তখন আবার কেন এই উদ্ভবটি ঘটল? ঘটল কিন্তু ওই একই কারণে। যুদ্ধের কারণেই। করোনার আক্রমণটা যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম দুটি বিশ্বযুদ্ধ ছিল পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে দখলদারিত্বের বিবাদ নিয়ে। এবারের এই যুদ্ধটাতে গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাই একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানুষের সভ্যতার ওপর। সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পরে পুঁজিবাদের উল্লসিত মুখপাত্ররা বলেছিল ইতিহাস তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে, অর্থাৎ বিশ্বময় পুঁজিবাদ একচ্ছত্র হয়েছে, আর কোনো বিপদ নেই। মস্ত বড় বিপদটা যে ওই প্রসারিত হওয়ার একেবারে বুকের ভেতরেই কায়দা করে বসে ছিল সেটা নানাভাবে বোঝা গেছে। মানুষ-মারার অস্ত্র উদ্ভাবন ও বিক্রির প্রতিযোগিতা, মাদক ও পর্নোগ্রাফির ব্যবসা, স্থানীয় আকারে যুদ্ধ লাগিয়ে রাখা, ধরিত্রীর উষ্ণতা বৃদ্ধি, সংখ্যালঘু নিপীড়ন, নারী নির্যাতন, ভিন্নমত নিষ্পেষণ, এসব উৎপাতের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের অগ্রগতির যে ধ্বংসাত্মক চরিত্র সেটা ধরা পড়ছিল। অতিআশ্চর্য সব উন্নতির অন্তরালে মানুষের সমস্ত অর্জনকে নষ্ট করে দেবার প্রস্তুতি চলছিল। দুটি বিশেষ দিক ধরে ধ্বংস-প্রস্তুতির ওই অগ্রগতি। এর একটি ভোগবিলাস, অপরটি নিরাপত্তাহীনতা। ভোগবিলাসের তো কোনো সীমা পরিসীমাই দেখা যায়নি, এখনো দেখা যাচ্ছে না। তবে এই বিলাসিতা কতিপয়ের মাত্র, এর উল্টোপিঠে লেখা রয়েছে অধিকাংশ মানুষের বঞ্চনা। অধিকাংশকে বঞ্চিত করেই কতিপয়ের এই ফুলে-ফেঁপে ওঠা। বঞ্চিতদেরও কিন্তু আবার দীক্ষিত করা হয়েছে ভোগবিলাসের নিষ্ঠুর মন্ত্রেই। যে জন্য অর্থনৈতিক বঞ্চনার সঙ্গে সঙ্গে ভোগবিলাসের বঞ্চনার বোধও বঞ্চিতদেরকে পীড়িত করছে। 

ভোগবিলাসের অতৃপ্তি নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করেছে। শুধু তাই নয় নিরাপত্তাহীনতার বৃদ্ধিও ঘটিয়েছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপদের ঝুঁকি বেড়েছে। সব চাইতে ভয়ংকর যে ঘটনা তা হলো গণমানুষের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার প্রতি ভয়াবহ অমনোযোগ। সামরিকীকরণ যে পরিমাণে বেড়েছে, ঠিক সেই পরিমাণেই উপেক্ষিত হয়েছে মানুষের ওই প্রাথমিক নিরাপত্তা, যার সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তাও সংশ্লিষ্ট। মানুষকে নিরাপত্তা দেবার অঙ্গীকার নিয়ে সমাজতান্ত্রিক যে ব্যবস্থাটা এক সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পুঁজিপন্থীদের তৎপরতায় সেটাও ভেঙে পড়েছে। ইংল্যান্ডে যে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস তৈরি করা হয়েছিল সেটাকেও মোটামুটি অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা স্বাস্থ্যসেবার যে সংস্কার আনতে চেষ্টা করেছিলেন তাও কার্যকর হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যতটা সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন ছিল সে-তুলনায় অতিসমান্যই সক্রিয় হতে পেরেছে। 

মোট কথা, বিশ্বব্যাপী উন্নতির মহা হৈ চৈ চলছে; কিন্তু মানুষের মৌলিক যে চাহিদা সেগুলোর দিকে মোটেই নজর দেওয়া হয়নি। ফলে মানুষের জীবনে অনেক রকমের দুর্ভোগ ঘটেছে, তারই একটি আপাতত সবচেয়ে মারাত্মকটি হচ্ছে এই করোনাভাইরাস। অতর্কিতে হানা দিয়েছে, এবং জানিয়ে দিয়েছে যে উন্নতির গৌরবগাথাগুলো কেমন অন্তঃসারশূন্য, সভ্যতা নিজেই কেমন ভঙ্গুর ও অমানবিক। সব রাষ্ট্রেরই শক্তিশালী গোয়েন্দাবাহিনী রয়েছে, তারা রাষ্ট্রদ্রোহীদের (অর্থাৎ সরকারবিরোধীদের) ওপর অহর্নিশ চোখ রাখে, কিন্তু কোথায় কোন রোগ যে প্রস্তুতি নিচ্ছে মানুষ মারবার জন্য তার খবর রাখে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল কাজটা এখন দাঁড়িয়েছে মানুষকে ভয় দেখানো; সংস্থার প্রধান বলেছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে করোনার এই আক্রমণ হচ্ছে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। খাঁটি কথা। কোনো অতিশয়োক্তি নেই। বলেননি, তবে বলতে পারতেন যে আসলে এটি হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আশঙ্কা ছিল আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ বাধবে। একুশ বছর পরে সে আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরেও শোনা যাচ্ছিল আরেকটি যুদ্ধ আসছে। রাখালেরা ভয় দেখাচ্ছিল। পঁচাত্তর বছর পর রাখাল-কথিত সেই বাঘটি সত্যি সত্যি অতর্কিতে হামলা করেছে। বাঘটি অদৃশ্য। যুদ্ধবাজরা যুদ্ধকে ছায়া-যুদ্ধের চরিত্র দেবার সাধনাতে যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছে। তারা ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশন, ধ্বংসকার্যে ড্রোনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি, পারমাণবিক বোমা, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রকে শক্তিশালীকরণ ইত্যাদির গবেষণাতে যত অর্থব্যয় করেছে তার সবটাই তো দেখা যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত শত্রু-মিত্র কাউকেই নিরাপত্তা দিচ্ছে না। সবটাই অপচয়। করোনার আক্রমণ ঠেকাতে ওসব প্রস্তুতি বিন্দুমাত্র কাজে লাগেনি। পুঁজিবাদীরা যে সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে তা দিয়ে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য জীবাণুর মোকাবেলা করার প্রশ্নই ওঠে না। সীমান্তে সশস্ত্র পাহারা, কাঁটাতারের বেড়া, দেয়াল তোলা, সীমান্তে মানুষ হত্যা, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বাধীনতা, অবৈধ অভিবাসী উচ্ছেদ-চূড়ান্ত বিচারে এসব মস্ত মস্ত কথা যে অর্থহীন আড়ম্বর মাত্র করোনার আক্রমণ সেটা রাষ্ট্রকর্তাদের একেবারে ঘাড়ে ধরেই বুঝিয়ে দিল। কর্তারা অবশ্য এই বুঝটাকে পাত্তা দেবে না। তাদের কান স্বার্থের ময়লাতে ঠাসা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আওয়াজটা ছিল গণতন্ত্রকে বাঁচাও। তৃতীয় এই বিশ্বযুদ্ধের অনুচ্চারিত আওয়াজটি হচ্ছে মানুষকে বাঁচাও। সভ্যতার আচ্ছাদনের অন্তরালে যে বন্য নৃশংসতা বিদ্যমান আগের বিশ্বযুদ্ধ দুটি তাকে উন্মোচিত করে দিয়েছিল, মানুষের সযত্নলালিত অনেক মূল্যবোধই তখন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল, এমনকি ধার্মিকদের মনেও ঈশ্বরের কথিত মহানুভবতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল। সভ্য-বলে-কথিত জাতিগুলো পরস্পরকে ধ্বংস করবার উন্মত্ততায় মেতেছিল। এবারকার যুদ্ধ কিন্তু পুঁজিবাদীদের গৃহযুদ্ধের কারণে ঘটেনি। এই যুদ্ধে এক পক্ষ পুঁজিবাদ নিজে, অপর পক্ষ সমগ্র মানব জাতি। করোনামহামারি আক্রমণটা করেছে ওপরের আচ্ছাদনকে নয়, ভেতরের সভ্যতাকেই। জানিয়ে দিয়েছে মানুষ কতটা স্বার্থপর হতে পারে, এবং সেই স্বার্থপরতার কাছে সামাজিকতা ও সহমর্মিতা কেমন ঠুনকো ও বর্জনীয় বিষয়। এই যুদ্ধ মানুষকে নিয়ে গেছে তার আদিম গুহায়, যেখানে লক্ষ লক্ষ বছরের সাধনায় অর্জিত গৌরবগুলোর জন্য কোনো স্থান নেই, সকল স্থান দখল করে নিয়েছে একটি মাত্র অনুভূতি, সেটা হচ্ছে নিজেকে বাঁচাও। বিপদে পড়লে মানুষের ওই দশা হয় বৈকি, হওয়াটাই স্বাভাবিক; কিন্তু এক্ষেত্রে বিপদে একজন দু’জন মানুষ পড়েনি, পড়েছে সমগ্র মানব জাতি। এই যুদ্ধ কি বলে দিল যে জাতিভেদ মিথ্যা, সকল মানুষই এক জাতি? এও কি বলল যে শ্রেণিবিভাজনটাও কৃত্রিম; বিপদের মুখে সবাই সমান? বলেছে হয়তো, কিন্তু এইসব বাণী কোনো কাজে লাগবে না। জাতিভেদ থাকবে, শ্রেণিভেদও ধ্বংস হয়ে যাবে না। কারণ যারা শাসন করে তারা সবাই উচ্চ শ্রেণির, শ্রেণি ভাঙলে তারাও ভাঙবে, সেই সর্বনাশটি তারা মানবে না। প্রাণপণে তারা তাই চাইবে শ্রেণিব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখতে। আর রাখতে গেলে মানুষে মানুষে পার্থক্যগুলোকে উচ্চে তুলে ধরা চাই। বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, দেশ, এসব পার্থক্য তাই থাকবেই। যেমন থাকবে বাজারের ফেল কড়ি মাখো তেল নীতি। এগুলো শুধু থাকবেই না নতুন উচ্চতায় উন্নীত হবে। লক্ষণ ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান। 

কিন্তু এবারের যুদ্ধে যা ঘটল সে তো কেবল বস্তুগত নয়, অত্যন্ত গভীরভাবে মনস্তাত্ত্বিকও। বস্তুগত ক্ষতির পরিমাণ অপরিমেয়। যে সময় ও সম্পদ হারিয়ে গেল তারা আর ফিরে আসবে না। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অর্থনীতিতে এবার যে ধাক্কাটি লেগেছে তেমনটা গত দেড়শ’ বছরে কখনো ঘটেনি। বানিয়ে বলেননি, জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণ থেকেই বলেছেন। কোটি কোটি মানুষ বেকার হবে, অর্ধ-বেকারের সংখ্যা হিসাব করা সম্ভব হবে না, খাদ্য থাকবে কিন্তু নিদারুণ অভাব ঘটবে ক্রয়-ক্ষমতার। এসবের লক্ষণ তো ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে। আর ধনবৈষম্য, দুর্বলের ওপর প্রবলের অত্যাচার, নানা নামে লুণ্ঠনের যে বাস্তবতা এই মুহূর্তে বিদ্যমান সেসব আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে বাধ্য। কারণ যাই ঘটুক ব্যবস্থাটা বদলাবে না। আঘাত পেয়ে সে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরাই বলেছেন যে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের দারিদ্র্যের অবসান ঘটবে বলে যে আশাটা করা হয়েছিল সে-আশা ইতিমধ্যেই ক্ষীণ শুরু করেছে। পুঁজিবাদী লুটেরারা বিন্দুমাত্র ছাড় দেবে না। ফলে দারিদ্র্য-মুক্তির উদারনৈতিক আশাটা যে কেবল ক্ষীণ হয়েই ক্ষান্ত হবে তা নয়, সে-আশা কুহকিনীতেই পরিণত হবে। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল-বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূস উচ্চকণ্ঠে জানিয়েছিলেন, শুনে আমরাও উদ্দীপিত হয়েছি যে দারিদ্র্যকে তিনি জাদুঘরে বন্দি করে ছাড়বেন। একটা সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছিলেন বলে মনে পড়ে, সেই সময় ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত হয়েছে কি না স্মরণ করতে পারছি না, কিন্তু এটা তো দেখতে পাচ্ছি, করোনা দেখিয়ে দিচ্ছে চোখে আঙুল দিয়েই যে, দারিদ্র্য জাদুঘরে আটকা পড়া তো দূরের কথা, কোটি কোটি মানুষকে সে বন্দি করেছে তার কঠিন কারাগারে। ইউনুস সাহেবদের আশাবাদই বরং জাদুঘরে স্থান পাবে বলে মনে হচ্ছে, স্থানাভাব যদি না-ঘটে। উদারনীতির-ভদ্রস্বভাব মানুষদের কেউ কেউ দেখছি আশা করছেন, পৃথিবীটা বদলাবে ঠিকই তবে ভালোর দিকেই যাবে। কারণ মানুষ বুঝবে যে ভুল হয়ে গেছে, মস্ত বড় ভুল। উচিত ছিল সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়ে স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার খাতে ব্যয় বাড়ানো। এই আশাবাদীরা ভরসা করছেন ভ্রান্তির এই বোধ থেকে বিশ্বশাসকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে। কারো কারো এমনও আশা যে, করোনা এটি ধরিয়ে দেবে যে, শ্রেণিবৈষম্যের দরুনই রাষ্ট্রশাসকেরা জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো জরুরি বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করতে পেরেছে এবং সেই উন্মোচনটির ফলে শ্রেণিবৈষম্য একেবারে নির্মূল হয়ে না গেলেও অনেকটাই কমে আসবে। বলাইবাহুল্য এগুলো সবই সুখ-স্বপ্ন। উদারনীতিকদের স্বপ্ন-বিলাস। বাস্তবে এসবের কোনো কিছুই ঘটবে না। রাষ্ট্রশাসকরা মোটেই পরিবর্তিত হবে না। করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বিপত্তিটা ঘটবে এই উদারনীতিরই। পৃথিবী ভাগ হয়ে যাবে এপক্ষে ওপক্ষে এবং সেই ফাঁকে পড়ে বেচারা উদারনীতি হয়তো শুকিয়েই মরবে অনাহারে।

দুই

বস্তুজগতের চরম দশা মনোজগতেও আঘাত হানতে বাধ্য। নির্মম হস্তে করোনা মানুষকে ইতিমধ্যেই বর্বরতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রাণীজগতের সদস্য হলেও মানুষ স্বতন্ত্র এবং বিশিষ্ট। তার বিশিষ্টতার ভেতর প্রধান হচ্ছে সামাজিকতা। মানুষ চিন্তাশীলও বটে; কিন্তু তার চিন্তাশীলতাও কাজ করে ওই সামাজিকতার ভেতরে থেকেই। করোনাভাইরাস ওই সামাজিকতাটাকেই চাইছে একেবারে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিতে। করোনা বলছে বাঁচতে হলে প্রথমে যা করতে হবে তা হলো আইসোলেশন। থাকা চাই অন্য সবার থেকে দূরে। পরিবারের ভেতরে থাকলেও পরিবারের একজন হলে চলবে না, হতে হবে বাইরের কেউ। হাতে হাত মেলানো, পরস্পরকে আলিঙ্গন করা, এসব তো মানবিক অভ্যাস এবং মানবিকতারই প্রকাশ। এগুলো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তা আদিম মানুষের ভেতরেও এক ধরনের সামাজিকতা ছিল, পুঁজিবাদী আধুনিকতা সামাজিকতার সকল প্রবীণকেই একেবারে অপরাধেই পরিণত করে ছাড়লো। অপরের বিপদে আপদে রোগে শোকে সমবেদনা ও শুশ্রূতাতে আদিম মানুষ ছুটে আসতো। একবিংশ শতাব্দীতে এসে শুনতে হলো যে, রোগ হচ্ছে একটা অপরাধ। গা ছুঁলে জাত যাবে, এই ধারণার কতোই না সমালোচনা হয়েছে। ভারতের রাজনীতিক ড. আম্বেদকার তো তথাকথিত উচ্চবর্ণের এই বদভ্যাস সহ্য করতে না পেরে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে নিজেকে বৌদ্ধ বলেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই অচ্ছুৎমার্গের নির্ভুল আনুগত্যটা এখন সকল ধর্মের মানুষদের সর্বজনীন সদভ্যাসে পরিণত হতে চাইছে। বিচ্ছিন্নতা পুঁজিবাদী আধুনিকতার ভেতরেই ছিল। পুঁজিবাদের অন্তরের কথাটা হচ্ছে আত্মকেন্দ্রিক হও, নিজের মুনাফা দেখো, লাগলে অন্য সবাইকে ঠেলে দূরে ফেলে দাও। করোনা ওই অন্তর্বাণীকেই অবমুক্ত করে দিয়েছে, হুকুম করেছে বিচ্ছিন্নতাকে আইন হিসেবে মান্য করবার জন্য। আইন যাতে মানা হয় সে-দিকে নজরদারি করার জন্য সশস্ত্র কোনো বাহিনীর দরকার পড়বে না, আপনজনেরাই দায়িত্বটা পালন করবে। পাহারা দেবে দরজায়।

পুঁজিবাদের আবির্ভাব ঘটেছিল ব্যক্তিস্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে। সামন্তবাদের নিগড় থেকে বের করে এনে ব্যক্তিকে সে মুক্তি দেবে বলেছিল। ব্যক্তিত্বের বোধ সে তৈরিও করে দিয়েছিল মানুষের মধ্যে; কিন্তু সকল মানুষ সমান হলো না। আর সমস্যাটা রয়ে গেল ওইখানেই। ওই বৈষম্যতেই। সুবিধাভোগীরা সুযোগ পেলো সুবিধাবঞ্চিতদেরকে শাসন ও শোষণ করবার। বঞ্চিত মানুষের জন্য ব্যক্তিত্ব বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট রইল না। তারা পরিণত হলো মজুরি-দাসে। পুঁজিবাদ এখন তার সর্বশেষ স্তরে পৌঁছে গিয়ে কেবল মেহনতীদের নয়, সকল মানুষেরই ব্যক্তিত্বকেই নিশ্চিহ্ন করে দেবে বলে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। হুকুম করেছে প্রত্যেকে মুখোশ পরো। ব্যক্তিত্ব মুছে ফেলো। তুমি কে, কতটা তোমার ক্ষমতা সেটা ফলাতে চেয়ো না। তুমিও লক্ষ কোটির একজন। নাম ও পরিচয়বিহীন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেবেছিলেন মহাশক্তিবান তিনি, সকলের থেকে আলাদা; কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল তিনিও গোঁফ নামাতে বাধ্য হয়েছেন। মুখোশ সেঁটেছেন নাক-মুখ ঢেকে। পুঁজিবাদ এখন অমনই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবিনাশী; কিন্তু তাই বলে পুঁজিবাদ যে শ্রেণি মানে না তা তো নয়। শ্রেণিব্যবস্থার সে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিপালক। সে জন্যই হোয়াইট হাউসের ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং সদর রাস্তার জর্জ ফ্লয়েড সমান হবেন না। ট্রাম্প শাসন করবেন এবং ফ্লয়েড তাঁর শাসনামলে পুলিশের গলা-টেপাতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রাণ হারাবেন। পুঁজিবাদের রাষ্ট্রীয় বিধান এমনই। 

তিন

করোনা রোগটা যে চীন থেকে, এমনকি চীনের যে উহান এলাকাটি মাও সে তুঙয়ের সংগ্রামের সময়ে বিপ্লবীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল সেখান থেকেই যে বিশ্বময় ছড়ালো সে-ঘটনাকে নিতান্ত কাকতালীয় বলা যাবে না। চীন এখন আর সমাজতন্ত্রি নেই, রীতিমতো আধুনিক হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক চীন সারা পৃথিবীর মানুষকে বিপ্লবের প্রস্তুতির জন্য আহ্বান জানাতো, এখন পুঁজিবাদী আধুনিকতার কবলে পড়ে মতাদর্শিকভাবে সে নিতান্ত কুপোকাৎ দশাতে রয়েছে। ফলে সে যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের দ্বারা বিশ্ববাসীকে অপ্রস্তুত করে ছাড়বে তাতে বিস্ময়ের কী আছে? পুঁজিবাদীদের পক্ষে এমন কাজই তো স্বাভাবিক। 

চীন এখন বিনিয়োগ করছে পৃথিবীর সব দেশে। ভালোমন্দ দেখে না, সুযোগ দেখা মাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের এই ঢাকা শহরে ওসমানী উদ্যান ধ্বংস করে আন্তর্জাতিক মানের একটি মিলনায়তন বানাবার সরকারি প্রচেষ্টা হয়েছিল; সেটা যে কতটা অবাস্তবিক ও ক্ষতিকর তা চীনের কর্তৃপক্ষের অজানা থাকবার কথা নয়, তবু তারা সরকারকে স্বপ্রণোদিত হয়ে এবং প্রায় বিনাসুদেই ঋণ দিতে এগিয়ে এসেছিল। উদ্দেশ্য যে-করেই হোক ঢুকবে, রাজনৈতিক প্রভাব-বলয়ের ভেতরে ফেলবে, নিজেদের কারিগর নিয়োগ নিশ্চিত করবে, জিনিসপত্র গছিয়ে দেবে, আর ঋণের মূল অঙ্কটা তো রইলই, সময় মতো আদায় করে নেবে। এটি ছোট্ট একটি দৃষ্টান্ত। বিশ্বজুড়ে এমন নৈতিকতাবিহীন বিনিয়োগের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। চীন ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে লজ্জায় ফেলবে বলে কসম খেয়ে বসেছে। সস্তা শ্রমের কল্যাণে পণ্য উৎপাদন করছে দ্রুত এবং বিক্রি করছে সস্তায়। মুনাফা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। উন্নয়ন-উন্মাদনার শিকার হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। নিজের দেশের এবং অন্যদেশের। চীনের জাতীয়তাবাদী অহঙ্কারটা সুপ্রাচীন। তারা মনে করতো তারাই সেরা। তারা কাগজ আবিষ্কার করেছে, ছাপাখানাও। চা-পান করবার বুদ্ধি বিশ্বকে তারাই দিয়েছে। ধর্মমত উদ্ভাবনেও পিছিয়ে থাকেনি। বিভিন্ন দেশে পর্যটক পাঠিয়েছে, আবার নিজের দেশে প্রাচীরও তৈরি করেছে, নির্মাণ কৌশলে বিশ্বের জন্য যেটা বিস্ময়কর। জ্ঞানের চর্চাতেও ছিল শীর্ষে। মাঝখানে, বিশেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর পর থেকে, বিদেশিরা এসে উৎপাত করেছে, আধিপত্য বিস্তার করেছে কোনো কোনো এলাকায়। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সেই আধিপত্যকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া গেছিল। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব চীনকে তার হৃতগৌরব ফেরত আনবার রাস্তা করে দিয়েছে। এই উন্নতির পরে অনভিপ্রেত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে একটা সাময়িক গোলযোগ দেখা দিয়েছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে চীন এখন চলেছে তার গৌরব আরও বৃদ্ধি করার পথে।

এটিই হলো তাদের আধুনিকতার আধুনিক বয়ান। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই বয়ান বিশুদ্ধরূপে জাতীয়তাবাদী। পুঁজিবাদ এই জাতীয়তাবাদকে হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে তুলছে। 

ফলে দেখা যাচ্ছে গলা তুলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা এবং তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ধরে রাখার প্রত্যয় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সমাজতন্ত্রকে চীনের বৈশিষ্ট্য দানের সংকল্পও ব্যক্ত করা হচ্ছে। সমাজতন্ত্রকে জাতীয় বৈশিষ্ট্য দেবার অভিপ্রায় যদি কারও জন্য ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তবে তাদেরকে দোষ দেওয়া যাবে না। হিটলার ও মুসোলিনীও নিজেদেরকে সমাজতন্ত্রীই বলতেন, এবং সেই সমাজতন্ত্রও ছিল তাদের নিজেদের দেশের মতো করেই গড়ে-তোলা, অর্থাৎ কিনা জাতীয়তাবাদী। চীনের আকাঙ্ক্ষাটা হলো জাতীয়তাবাদী রূপেই তারা আধুনিক, অর্থাৎ পুঁজিবাদী হবে। ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্র যে পুঁজিবাদের তুলনাতেও আধুনিক, সে যে পুঁজিবাদের আগে নয় পরেই এসেছে, সেই সরল সত্যটাকে তারা ভুলে বসেছে ইচ্ছা করেই। 

চীনের জাতীয়তাবাদী তৎপরতা তাকে রীতিমতো আগ্রাসী করে তুলেছে। অন্য দেশের রাজনীতিতে চীন ছলে বলে কৌশলে হস্তক্ষেপ করছে। ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত-সংঘর্ষ হয়েছিল ১৯৬২ সালে; তখন মাও সে তুঙ জীবিত, সংঘর্ষটি মিটমাটে শেষ হয়েছিল। ২০২০ সালে এসে সেই সংঘর্ষ আবার বেঁধেছে; কিন্তু এবার চীনের প্রস্তুতি অনেক বড় রকমের। সীমান্তে তারা নানাবিধ স্থাপনা গড়ে তুলেছে; লম্বা মহাসড়ক তৈরি করেছে। নতুন অবস্থান থেকে যে সববে এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। হংকং-এর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে চীনের এতদিনকার নীতি ছিল ‘এক দেশে দুই ব্যবস্থা’; অর্থাৎ চীনের সমাজতন্ত্র এবং হংকং-এর পুঁজিবাদ সহঅবস্থান করবে, অসুবিধা নেই। এখন চীন যেহেতু আর সমাজতন্ত্র নেই তাই পুঁজিবাদের অধীনেই হংকং’কে নিজের মধ্যে টেনে নেবার আইনী ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টায় রয়েছে। ভুক্তভোগীদের জন্য চীনের জাতীয়তাবাদী প্রবণতা যে কেমন মর্মান্তিক ক্ষতি ও দুঃখের কারণ হতে পারে, সেটা তো আমরা ১৯৭১-এ নিজেরাই টের পেয়ে গেছি। পাকিস্তানী হানাদারদের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে তারা টুঁ শব্দটি করেনি, কারণ পাকিস্তান তখন তাদেরকে গোপনে সাহায্য করছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে সহযোগিতার হস্ত প্রসারণের ব্যাপারে। এরপরে মিয়ানমার যখন দশ লক্ষ রোহিঙ্গাকে নিজেদের মাতৃভূমি থেকে উৎপাটিত করে বাংলাদেশে ঠেলে দিল, চীন তখন কাজটির নিন্দা করা দূরে থাক নীরবে মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষকে সমর্থনই দিয়েছে। কারণটা অন্যকিছু নয়, মিয়ানমারের কাছ থেকে তাদের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের সুযোগ রয়েছে। যে চীন একদিন রাশিয়ার সংশোধনবাদী-প্রবণতার নিন্দায় পঞ্চমুখ ছিল, সেই রাষ্ট্রই এখন দেখা যাচ্ছে একনায়কত্ব কায়েম করার ব্যাপারে দৃষ্টান্তমূলক প্রেরণা সরবরাহ করে চলেছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এমন বন্দোবস্ত করে দিয়েছে, যাতে রাষ্ট্রপ্রধান শি চিন পিং আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকতে পারেন; রাশিয়ার পুতিনও সেই মতলবেই ছিলেন, তিনিও একই আয়োজন করিয়ে নিয়েছেন। চীন অগ্রগামী, রাশিয়া পরবর্তী; পথ অভিন্ন। 

চার

চীন নিয়ে এত কথা বললাম এটা পরিষ্কার করার জন্য যে চীন থেকে করোনাভাইরাস ছড়াবার ঘটনাটার পেছনে একটা ঐতিহাসিক প্রস্তুতি রয়েছে। মারাত্মক এই জীবাণুটি চীনের জৈবরাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে বের হোক আর নাই হোক তাদের অধুনা-অবলম্বিত পুঁজিবাদ থেকেই যে সে উৎপন্ন হয়েছে সে-ব্যাপারে তো বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ নেই। অধুনা চীন অতি অল্পসময়ে অবিশ্বাস্য রকমের উন্নতি করেছে এটা ঠিক; কিন্তু সেই উন্নতিতে মানবিক মূল্যের দিকটা মনোযোগ পায়নি। জাতীয় সম্পদের বৃদ্ধি ঘটেছে, কিন্তু মানুষের নিরাপত্তা বাড়েনি, উল্টো কমেছে। তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে অত্যন্ত উন্নত এটা প্রমাণ করার জন্য চীনের হাসপাতালে কত মিলিয়ন শয্যা রয়েছে, কতো মিলিয়ন পেশাগত চিকিৎসক সে-দেশে কাজ করছেন এসবের পরিসংখ্যান প্রাসঙ্গিক বটে, কিন্তু খুবই জরুরি তো ছিল করোনাভাইরাসের মতো মানুষ ও মনুষ্যত্ব-ধ্বংসে অভিলাষী জীবাণু যে তলে তলে যুদ্ধ-প্রস্তুতি নিচ্ছে সেটা জানা। জানলে এবং ব্যবস্থা নিলে বিশ্বব্যাপী মানুষের সমস্ত অর্জন এমনভাবে বিপদগ্রস্ত হতো না। উহানে একটি অস্বাভাবিক রোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, এমন খবর সেখানকার একজন চিকিৎসক তাঁর ফেসবুকে লিখেছিলেন। তাঁর কথাকে মোটেই পাত্তা দেওয়া হয়নি। উল্টো তাঁকে ধমকে দেওয়া হয়েছিল গুজব ছড়ানোর দায়ে। চিকিৎসকের সতর্কবাণী বাসি হলেও ফলেছে; এবং ফলবার ওই প্রক্রিয়াতে চিকিৎসক নিজেও প্রাণ দিয়েছেন। একইভাবে প্রাণ দিয়েছেন ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের একজন বাঙালি চিকিৎসক। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি একটি খোলা চিঠিতে লিখেছিলেন যে, চিকিৎসকদেরকে যথোপযুক্ত ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যনিরাপত্তার সরঞ্জাম দেওয়া দরকার। তাঁর কথা শোনার আগেই তিনি মারা গেছেন ওই করোনা রোগেই। তাঁর চিকিৎসক স্ত্রীও আক্রান্ত হয়েছিলেন; তবে প্রাণে বেঁচে আছেন। চীন ও ব্রিটেন দুই দেশ ঠিকই, পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বীও, তবে ব্যবস্থা এখন একই। 

একশ’ বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লু’র জন্যও কোনো কোনো মহল থেকে চীনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ওই সময়টাতে শ্রমিকের খুব দরকার পড়েছিল। চীন সস্তা শ্রমিক পাওয়া যেত। চীন থেকে বহু শ্রমিক গিয়েছিল যুদ্ধরত ফ্রান্সে। গেছে তারা বদ্ধ ট্রাকে চেপে, গাদাগাদি করে। ফ্রান্সে গিয়ে থেকেছে নোংরা পরিবেশে। রোগটা তারাই ছড়িয়েছিল বলে একটা মত চালু আছে। ইতিহাসের বক্রাঘাত এখানে যে একশ’ বছর পরে এবার আর সন্দেহ নয়, বাস্তবিকই রোগটা ছড়িয়েছে সেই চীন থেকেই। একশ’ বছরে সভ্যতা অনেক অনেক এগিয়েছে, চীনও আগের সেই দুর্দশার অবস্থায় নেই, তবু রোগের দায়ভার যে তাকেই বহন করতে হলো তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে, যা এতক্ষণ বলছিলাম, চীনের উন্নতি মানুষ ও মনুষ্যত্বকে নিরাপদ করেনি। 

তবে একসময়ে চীন যে সমাজতন্ত্রী হয়েছিল ও ছিল সেটা তো মিথ্যা নয়। সমাজতন্ত্রী হওয়ার ওই অভিজ্ঞতার যা অবশিষ্ট আছে তাই তাকে শক্তি ও সাহস দিয়েছে করোনা পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার ব্যাপারে। পুঁজিবাদী বিশ্বের তুলনাতে মোকাবেলাটা সে ভালোভাবেই করেছে। করোনা চিকিৎসার জন্য সাত দিনের ভেতর উহানে তারা যে রকমের একটা হাসপাতাল তৈরি করে ফেলেছে সেটা বাইরের বিশ্বকে রীতিমতো অবাক করেছে। তারপরে আছে করোনা-সংক্রমণের নিয়ন্ত্রণ। সেটাও এমন দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে যার তুলনা পুঁজিবাদী দুনিয়ার কোথাও পাওয়া যাবে না। একই ভাবে, সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার কারণেই, ভিয়েতনামও করোনাকে রুখে দিয়েছে নিজের সীমান্তে। আর কিউবার তো কথাই নেই; তার যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা তা পর্যায়ক্রমিক বর্হিস্থ আক্রমণেও বিপর্যস্ত হয়নি। সমাজতন্ত্রী কিউবা নিজেকে তো রক্ষা করেছেই, আগের মতোই অন্যদেশকেও সাহায্য করেছে। একদা-সমাজতন্ত্রী চীনও সাহায্যের জন্য অন্যদেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাঠিয়েছে, বাংলাদেশেও এসেছিল একটি টিম। 

ভারতের কেরালা রাজ্যে কমিউনিস্টদের যে শাসন অনেক কষ্টে টিকে আছে করোনা ব্যবস্থাপনায় তার যে সাফল্য তেমনটি বৃহৎ ভারতের অন্যকোথাও দেখা যায়নি। বোঝা যায় যে কমিউনিস্টরা যা করতে পেরেছে অন্যরা তা করতে পারেনি। তবে অন্যরা যে কি রকমের কাজ করতে পারে তার নিদর্শনও পাওয়া গেছে, কিন্তু কেরালারই অকমিউনিস্টদের এক কাজে। খাদ্যের খোঁজে জঙ্গল থেকে একটি হাতি এসেছিল কেরালার একটি লোকালয়ে। লোকেরা কয়েকজন হাতীটিকে খুব খাতির করেছে। খেতে দিয়েছে। ক্ষুধার্ত হস্তি ভক্ষণ করেছে যা দিয়েছে তাই। তারপরেই কিন্তু বিস্ফোরণ। খাদ্যের ভেতর লুকানো ছিল বোমা; হাতীর দেহাভ্যন্তরে গিয়ে সেটি বিস্ফোরিত হয়েছে। মরা হাতী যে লাখ টাকা সে তো জানাই ছিল ওই লোকদের। সে জন্যই এই কর্ম সম্পাদন। এটা সেই আচরণেরই অংশ যার দরুন প্রাণী ও প্রকৃতি আজ বিরূপ হয়েছে, এবং প্রকৃতির কাছ থেকে নানা রকমের ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। করোনাভাইরাস যার একটি। 

পাঁচ

চীনের জাতীয়তাবাদী তৎপরতা এখন তাকে আমেরিকার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমেরিকা ধরেই নিয়েছিল যে বিশ্ব থাকবে তাদের কব্জাতে, কিন্তু এখন চীন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকা একদিন গণতন্ত্রের পতাকা উচ্চে তুলে ধরেছিল। ফরাসি বিপ্লবেরও তের বছর আগে ইংল্যান্ডের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রতিষ্ঠাতা পিতারা’ যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি রচনা করেছিলেন তাতে স্বাধীনতা ও সাম্য উভয়ের জন্যই অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছিল; কিন্তু সংবিধান যখন রচিত হলো, তখন নানা রকমের দরকষাকষির ভেতরে পড়ে সাম্যের অঙ্গীকারটি প্রায় অদৃশ্যই হয়ে যায়; সংবিধানে দাসব্যবস্থা উচ্ছেদের কথা বলা হয়নি, এবং ভোটাধিকার কেবল সম্পত্তির পুরুষ মালিকদের জন্যই সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৮৭ বছর পরে আব্রাহাম লিংকন তাঁর বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতায় স্বাধীনতার সঙ্গে সাম্যকে যুক্ত করে গণতন্ত্রের একটি সংজ্ঞা ও স্বপ্ন দাঁড় করিয়েছিলেন; যার ভিত্তি ছিল জনগণ। তিনি বলেছিলেন আমেরিকানদের অঙ্গীকার হবে এটা দেখা যে জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা পরিচালিত এবং জনগণের পক্ষের সরকার যাতে পৃথিবী থেকে কখনোই বিলুপ্ত না হয়। অমন একটি আদর্শ-সরকার কিন্তু আমেরিকাতে কখনোই প্রতিষ্ঠা পায়নি। গেটিসবার্গ বক্তৃতা প্রদানের দু’বছরের মাথাতেই লিঙ্কন নিজেই প্রতিপক্ষের এক লোকের গুলিতে প্রাণ হারান। পরের ইতিহাস তো সবারই জানা। আমেরিকা সাম্যের লক্ষ্যকে ধাপে ধাপে এবং সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেছে। সে পুঁজিবাদী হয়ে উঠেছে, পুঁজিবাদী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী হয়েছে, এবং নিজের দেশে তো অবশ্যই পৃথিবীর যেখানেই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে তার ওপর ক্ষিপ্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হয়ে গেছে, জাপান পরাভূত, তখন জাপানের দুটি শহরের ওপর আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, পঙ্গু করে দিয়েছে আরও অনেককে। উদ্দেশ্য পৃথিবীকে, বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াকে, ভয় দেখানো; জানিয়ে দেওয়া যে আমাদের হাতে মানববিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে যার সাহায্যে এখন থেকে আমরা বিশ্বকে শাসন করব। উৎসাহিত করেছে অস্ত্রনির্মাতা ও অস্ত্রব্যবসায়ীদের, যার ওপরে আমেরিকার সমৃদ্ধির অনেকটাই নির্ভরশীল। সন্ত্রস্ত রাখতে চেয়েছে রাশিয়াকে, কারণ সে-দেশ তখন সমাজতন্ত্রী; অথচ সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া না-থাকলে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রীদের ক্ষমতা ছিল না হিটলারকে হটায়। আণবিক বোমা পদার্থের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার ভেতর যে বিস্ফোরক শক্তি রয়েছে তার দ্বারা তৈরি। এই যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, আমরা এটাতে ব্যবহৃত করোনাভাইরাস তো দেখা যাচ্ছে আণবিক বোমারই উন্নত সংস্করণ। ক্ষুদ্র, অদৃশ্য, এবং অসম্ভব রকমের শক্তিশালী। নিখরচায় মানুষ ধ্বংস করতে ওস্তাদ। না, আমেরিকার কাছ থেকে সে আসেনি, এসেছে আমেরিকারই সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের কাছ থেকে। একদা যে সমাজতন্ত্রী ছিল, কিন্তু এখন যে আমেরিকাকেও পেছনে ফেলতে চায় পুঁজিবাদী তৎপরতায়। আণবিক বোমার জন্ম যেখানে করোনাভাইরাসের জন্মও সেখানেই, পুঁজিবাদে। 

ছয়

আমাদের বাংলাদেশের আশু ভবিষ্যৎটি কেমন দাঁড়াবে? ভালো যে নয় সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। আগের বছর ডেঙ্গুতে কাবু ছিলাম; এ বছরে তার আশঙ্কা যে নির্মূল অবস্থায় আছে তা নিশ্চয়ই নয়। ভয়ংকর একটা বন্যা আক্রমণ করেছে, করোনা না থাকলে তার পরিণাম নিয়ে আরও বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া যেত; বড় বিপদ এসে ছোট বিপদের হিসাব-নিকাশটাকে নিচে চাপা রেখে দিয়েছে; কিন্তু কয়েকটা বিপদ তো একেবারে ঘাড় চেপে ধরবে। অনেক মানুষ ইতিমধ্যেই বেকার হয়েছে, যাদের কাজ আছে তদেরও বড় একটা অংশ ঠিক মতো বেতন পাচ্ছে না। সঞ্চয় ভাঙিয়ে খাচ্ছে। ক্ষুদ্র পুঁজি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। ছাঁটাই চলছে। ছাঁটাই আরও বাড়বে। বিদেশ থেকে আমাদের মেহনতী ভাইরা ফেরত আসবে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ব্যবসা হারিয়েছে; অনানুষ্ঠানিক খাতের লোকদের কর্ম-চাহিদা নেই। জীবিকার সন্ধানে যারা শহরে এসেছিল, তারা দলে দলে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে, কিন্তু গ্রামে কর্মের সংস্থান নেই বলেই না তারা শহরে এসেছিল, গ্রামে গিয়ে খাবেটা কি?

চিকিৎসা ব্যবস্থাটা দুর্বলই ছিল, করোনার আঘাতে তার ভেঙে পড়বার দশা। পণ্য সংস্কৃতির ফেল কড়ি মাখো তেল নীতিটা চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত; পাবলিকের জন্য যেসব হাসপাতাল সেগুলোর অবস্থা দেশের পাবলিকের মতোই করুণ, বিপরীতে প্রাইভেট বেশ রমরমা। তবে প্রাইভেট হাসপাতালে যাবার মতো কড়ি তো আর পাবলিকের পকেটে নেই, যেতে হলে জমিজমা বেচতে হয়, না পারলে নিশ্চিত মরণ। সুবিধাভোগীরা বিদেশে যান; চিকিৎসার জন্য যান, চেক-আপের জন্যও যান। ভিভিআইপি যাঁরা, তাঁরা রাষ্ট্রীয় খরচে বিদেশে যান, তাঁরা যে যাচ্ছেন, সেটা যাবার সময় একবার খবর হয়, ফিরলে সেটাও খবরে আসে; বলা হয় মহামান্যদের দেশে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, মনে হয় দেশ বুঝি তাঁদের জন্য দেশ নয়, বিদেশ বটে। এই যে করোনার সময়, বাংলাদেশ বিদেশ থেকে প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, বিমান চলাচল প্রায় শূন্যের কোঠায়, এরই মধ্যে আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী নাকি বিলেত গেছেন চিকিৎসার ফলোআপের জন্য। তা কিছুটা গোপনীয়তা রক্ষা করেই যেতে হলো। কারণ প্রথমত বার্ষিক জাতীয় বাজেট দেবার সময় তিনি স্বঘোষিত দায়িত্ব নিয়েছেন দেশের একটি মানুষকেও অভুক্ত না-রাখার। আগে খাওয়াবেন, পরে দেখা যাবে টাকা কোথায় থেকে আসে না-আসে। সে-দায়িত্ব পালন সহজ কর্ম নয়; নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিনরাত ব্যস্ত থাকা আবশ্যক, সেই অবস্থায় কি করে বিদেশে যান? দেশে এখন জবাবদিহিতার বালাই না থাক, ব্যক্তিগত চক্ষুলজ্জা তো আছে, বিশেষ করে পাবলিক ফিগার যখন! দ্বিতীয়ত, যাচ্ছেন যে সে তো দুই-একদিনের নয়, দু’সপ্তাহ নাকি তাঁকে কোয়ারেনটিনেই অর্থাৎ বন্দি অবস্থাতেই থাকতে হবে, তাঁর পরে দেখা পাবেন চিকিৎসকের। রাষ্ট্রীয় ভাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যাঁরা আছেন দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর তাঁদের আস্থারই যদি এখন ম্রিয়মান দশা হয়, তাহলে কি কোনো সন্দেহ থাকে যে চিকিৎসা ব্যবস্থাটা কোনমুখে এগোচ্ছে?

আমাদের জন্য প্রতারণা এবং সার্টিফিকেট দুটিই পুরানো ব্যাপার। সার্টিফিকেটে ভেজালও নতুন কোনো উদ্ভাবনা নয়। মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটেই তো ভেজাল ঢুকেছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও ভুয়া সার্টিফিকেটে দেশ সয়লাব হবার জোগাড়। মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট দেওয়াটাই অবশ্য ভুল ছিল। এমন কি গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড দেওয়াটাও। মুক্তিযুদ্ধে কেউ সার্টিফিকেট বা এ্যাওয়ার্ডের লোভে যায়নি। এই যুদ্ধ ভাড়াটেদের যুদ্ধ ছিল না, ছিল জনগণের যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর সার্টিফিকেট বিতরণ ও সার্টিফিকেটের জোরে সুযোগ সুবিধা হস্তগত করণের সুযোগ করে দেওয়াটা ছিল ঘুষ দেওয়ারই শামিল। বাপুরা ঘুষ নাও তবুও শান্ত থাকো, জ্বালিও না, ভাবটা ছিল এই রকমের। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা সরাসরি অংশ নেননি, যুদ্ধ করেননি, রণাঙ্গন থেকে নিরাপদ দূরত্বেই ছিলেন, সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের অতি উৎসাহকে ওই ভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব; কিন্তু যারা করোনা রোগের থাকা না-থাকার ব্যাপারে ভুয়া সার্টিফিকেট দেয় তাদের অপরাধটা সকল অপরাধের সেরা বটে। এ তো অন্যকিছু নয়, মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলাধুলা। এমন কাজ অত সহজে যারা করে তারা আর মানুষ থাকে না, অন্যকিছুতে পরিণত হয়। আর তাদের সাহসটা আসে এই বোধ থেকে যে ধরা পড়বে না। ধরা ওই অপরাধীরাও অনেকদিন পরেনি; নিরীহ মানুষের সর্বনাশ করার কাজটা ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু এক সময়ে আবরণের পক্ষে অপরাধের বিশালতাকে ঢেকে রাখাটা আর সম্ভব হয়নি। ফলে গ্রেফতার এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য ঘটনা।

এমনটা আশা করার কোনো কারণ নেই যে, সামনের দিনগুলোতে প্রতারণা কমবে। কমবে না, আরও বাড়বে। বৃক্ষের স্বভাব বৃদ্ধি পাওয়া। বিষবৃক্ষেরও। সুইজারল্যান্ড- ঘড়ির নির্ভুলতা ও অর্থ জামানতের নিরাপত্তার জন্য বিখ্যাত; ধনকুবেররা সেখানে নিশ্চিন্তে তাদের টাকা জমা রাখে; করোনাকালের মন্দার প্রকোপে দেখা গেছে যে দক্ষিণ এশিয়ার সবদেশের ধনবানদের জমাটাই কমেছে, অবিচল রয়েছে শুধু বাংলাদেশিদেরটাই। বাংলাদেশি ধনকুবেররা নতুন হতে পারেন, কিন্তু জন্ম-পাকা যে সেটা নিঃসন্দেহ। করোনার ধাক্কাতে বিমান চলাচল তো বন্ধ, তাঁরই মধ্যে দেশের কতিপয় বিখ্যাত ধনী নির্বিঘ্নে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। খালি হাতে যাননি নিশ্চয়ই, ভরা-ভরতি অবস্থাতেই গেছেন। নিজেরাই এক ব্যাংকের মালিক-এমন দুই ভাই অন্য একটি ব্যাংকের এমডির বুকে বন্দুক ধরেছিলেন বে-আইনি ঋণ নেবার দাবিতে। বিপন্ন পক্ষ পুলিশে খবর দিলে পরাক্রমশালী দুই ভাই দেশের ভেতরে আত্মগোপন করেননি, বিশেষ বিমানে এবং আইনীপথেই বিদেশে চলে গেছেন। আগামীতে, অবস্থা যখন ‘স্বাভাবিক’ হবে তখন, এমন সব ঘটনা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকবে বলেই আশঙ্কা; কারণ ধনীদের ক্ষমতা আরও বাড়বে। 

সাত

অর্থনীতি যে কোন পথ ধরে এগোবে তার একটি নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাস মিলেছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর অন্তর্ধান দেখে। পাটকলগুলো বাংলাদেশ রাষ্ট্র স্থাপন করেনি, উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। বাংলাদেশ জুট মিলস্ করপোরেশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল পাটকলগুলোকে চালু রেখে উন্নত করার। তা উন্নতি করারই কথা। সাতচল্লিশে পূর্ববঙ্গ যখন স্বাধীন হয় অর্থব্যবস্থার জন্য তখন ভরসা বলতে ছিল দুটি কৃষি-উৎপাদনের ওপরই। একটি ধান অপরটি পাট। ধান মানুষকে জানে বাঁচিয়েছে; পাট রফতানি পয়সা এনেছে, সেই পয়সায় করাচি থেকে রাজধানী সরিয়ে ইসলামাবাদে নতুন রাজধানী গড়া হয়েছে। পাটের ন্যায্য মূল্য চাই, এই দাবীতে পাকিস্তানাধীন পূর্ববঙ্গে তুমুল আন্দোলন হয়েছে। অবাঙালি উদ্যোক্তরা যে পূর্ববঙ্গে পাটকল খুলেছিলেন সেটা লোকসান দেবার জন্য নিশ্চয়ই নয়, মুনাফার জন্যই। এবং প্রচুর পরিমাণ মুনাফা তাঁরা করেছেনও। সীমিত পুঁজি নিয়ে বাঙালি উদ্যোক্তারাও কেউ কেউ এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁরাও লোকসানে পড়েননি। একাত্তরের পরে দেশের পাটকলগুলোকে চালু অবস্থাতেই সদ্যপ্রতিষ্ঠিত জুট মিলস করপোরেশন পেয়ে গেল; কিন্তু চালাতে পারলো না। যাঁরা কর্তা হয়ে এলেন তাঁদের লক্ষ্য ছিল যা পাওয়া যায় দ্রুত হাতিয়ে নেওয়া এবং মানে মানে কেটে পড়া। আমলাতান্ত্রিক অব্যবস্থা ও দুর্নীতির কারণেই লাভের পরিবর্তে লোকসান গোনা শুরু হলো। আদমজী ছিল এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল, সেটি বন্ধ হয়ে গেল। আর তখনই দেখা গেল সীমান্তের ওপারে নতুন নতুন পাটকল গড়ে উঠছে। পাট এখানে, পাটকল ওখানে। পাকিস্তানের শাসকেরা আওয়াজ তুলেছিল এক্সপোর্ট অর পেরিস। বাস্তবে যা ঘটছিল তা সম্পূর্ণ উল্টো, এক্সপোর্ট অ্যান্ড পেরিস। চোরাপথে পাট নিজেও চলে যাচ্ছিল বিভিন্ন দেশে। পাট পাচার, পাটকলের মুনাফা পাচার, এসবের মধ্যেও নতুন নতুন পাটকল খোলা হয়েছে, তাদের সংখ্যা বেড়েছে। জুট মিলস করপোরেশনের হাতে এক সময়ে ৮২টি পাটকল ছিল, কমতে কমতে তাদের সংখ্যা নেমে শেষমেশ দাঁড়িয়েছিল ২৫-এ। এই করোনাকালে সর্বশেষ ওই ২৫টিও শেষ হলো। পাটের রাষ্ট্রায়ত্ত খাত বলতে এখন আর কিছু রইল না। নিঃশেষ। পঁচিশ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ হারালেন। তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারের দশাটা কি হবে? কি দশা হবে পাটের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ীদের? সর্বোপরি পাটচাষির? করপোরেশনের হাতে যে সম্পত্তি ছিল তার দাম নাকি পঁচিশ হাজার কোটি টাকা (বণিক বার্তা, ১৫ জুলাই), সেই সম্পত্তি কে খাবে? বলা হচ্ছে প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপকে দিয়ে দেওয়া হবে। সেটা ছেলে ভুলানো ছলাকলা মাত্র। অচিরেই ধরা পড়বে যে পাবলিক সেক্টর অসমর্থ, মালিকানা তাই প্রাইভেটে চলে যাওয়াটা অতিপ্রয়োজনীয়। বিশেষজ্ঞরা এবং বণিক সমিতিগুলো এরইমধ্যে সরাসরি প্রাইভেটে হস্তান্তরের সৎপরামর্শ দেওয়া শুরু করেছেন। পাবলিকের সম্পত্তি প্রাইভেট হাতিয়ে নেবে, কেউ কেউ হয়তো কল চালু করবেন, এবং পয়সাকড়ির মুখও দেখবেন, অন্যরা যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে টাকা পাচার করে দেবেন বিদেশে, যেখানে তাঁদের ভবিষ্যৎ অপেক্ষমাণ। সোনালি আঁশ হয়তো সোনার বাংলার মতোই রূপকথায় পরিণত হবে। পাটের ক্ষেত্রে পাবলিক সেক্টরের এই যে মর্মান্তিক বিলুপ্তিসাধন এটা করোনার সময়ে না ঘটলে এ নিয়ে কিছু কথাবার্তা এবং প্রতিবাদ হয়তো হতো; কিন্তু পুঁজিবাদী সর্বনাশা করোনা সেটাও ঘটতে দিল না। শ্রমিকরা কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন প্রতিবাদের। এগোতে পারেননি। তাঁদের দু’জন নেতাকে তো গুমই করে ফেলা হয়েছিল, জানাজানি হওয়াতে আপাতত জানে বেঁচেছেন। এখন তাঁদের ‘বিচার’ হবে। অন্যদের জন্য এটি সতর্ক সংকেত অবশ্যই। 

পাটশিল্পের বেলাতে প্রাইভেটের এই যে আগ্রাসন এটা কোনো একক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পাবলিক মার খাবে, প্রাইভেট পুষ্ট হবে, এটাই এখন নিয়ম, এবং আগামীতে এই নিয়মই জোরদার হতে থাকবে। ঘটনা বিভিন্ন ও আপাত বৈচিত্র্যপূর্ণ; কিন্তু অমোঘ নীতি ওই একটাই। পুঁজিবাদের অব্যাহত অগ্রযাত্রা। আমাদের সংবিধানে সমাজতন্ত্রের উল্লেখ ছিল; রাষ্ট্রীয় সেই লক্ষ্য থেকে আমরা ক্রমাগত দূরে সরে গেছি, এবং যতই সরেছি ততই বৃদ্ধি পেয়েছে আমাদের দুর্গতি। দুর্গতির এই বৃদ্ধিটা অবশ্য অনিবার্যই ছিল। যে জাতীয়তাবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছেন ও আছেন, তাঁরা মুখে যাই বলুন ভেতরে ভেতরে সবাই পুঁজিবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। সমাজতন্ত্রের দাবীটা ছিল পাবলিকের, যে পাবলিক যুদ্ধ করেছে, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়নি, যুদ্ধের ময়দানে সর্বক্ষণ উপস্থিত ছিল। এই পাবলিককে দমন করার জন্যই তো পাকিস্তানি হানাদারেরা গণহত্যায় নামে। যুদ্ধটার ভেতরে প্রধান দ্বন্দ্বটা শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাষ্ট্র ক্ষমতায় কারা থাকবে, পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদীরা নাকি বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা। উন্নতির অনুচ্চারিত আদর্শ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না, বিরোধ ছিল উন্নতির ফসল কার গোলাতে উঠবে সেটা নিয়ে। ওই যুদ্ধ অনেক কিছু ধ্বংস করেছে, উন্নতির পুঁজিবাদী ধারণার ওপরও আক্রমণ এসে পড়েছিল, যার সাক্ষী সংবিধানে সমাজতন্ত্রের নামে হলেও উপস্থিতি; কিন্তু পুঁজিবাদী উন্নতির ধারণাটাই শেষ পর্যন্ত নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। সাতচল্লিশের পর থেকেই উন্নতির পুঁজিবাদী পথটা তৈরি করা হচ্ছিল, একাত্তরের পরে ওই পথ আরও পোক্ত ও প্রশস্ত হয়েছে। একাত্তরের রণাঙ্গনে লড়েছে যেমন মরেছেও তেমনি ওই পাবলিকই। বড় নেতাদের মধ্যে কেউই প্রাণ হারাননি। যুদ্ধশেষে তাঁরা আক্ষরিক অর্থেই উড়ে এসে ক্ষমতার প্রস্তুত আসনে বসে গেছেন। পাকিস্তানি হানাদারেরা গোঁফ (মতান্তরে লেজ) নামিয়ে যখন চলে গেল তখন বাঙালি পুঁজিপন্থীরা নির্বিঘ্নে এগিয়ে এলো। লুণ্ঠন ও প্রতারণা নতুন বেগে, ও স্বাধীন ভাবে, চললো। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারেও কোনপ্রকার বিলম্ব ঘটল না। আগের বিদেশী শাসকেরা একই কাজ করেছে, বাংলার সম্পদ নিজের দেশে পাচার করে বাংলাকে নিঃস্ব করেছে। বাঙালি শাসকেরাও সেই পথই ধরলো, যদিও তাদের জন্য নিজস্ব কোনো দেশ ছিল না, অপরের দেশকেই তারা নিজেদের দেশ বানিয়েছে। কি আর করা!

ব্রিটিশ আমলে পাবলিক সার্ভেন্ট নামে একদল মানুষের কথা শোনা যেত; ভানটা ছিল এই রকমের যে ওইসব কর্তাব্যক্তি শাসন-শোষণ করছে না, সেবা করছে। স্বাধীন বাংলাদেশে এখন ওসব ভানভণিতা, ঝুটঝামেলা নেই, এখন পাবলিক সার্ভেন্ট বলে কিছু নেই, সরকারী কর্মচারী মানেই এখন পাবলিকের শাসক, ক্ষেত্র ও মাত্রারই যা হেরফের। উন্নতির এই ধারাটিই অব্যাহত থাকবে। অবশ্যই। আবার বড় প্রাইভেট যে ছোট প্রাইভেটকে নিঃশেষ করবে না তাও মোটেই নয়। করবে। ভীষণ ভাবে এবং অধিক মাত্রায় চলবে সে-কাজ। ক’দিন আগেই তো ময়ূরী নামে একটি বড় লঞ্চ ছোট একটি লঞ্চ, মর্নিং বার্ডকে সদরঘাট এলাকায় একেবারে ইচ্ছাকৃতভাবেই ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে মেরেছে। নিখোঁজ হয়েছেন ছোট লঞ্চের কমপক্ষে ৩২ জন যাত্রী। এরকম ঘটনা অন্যত্র শুধু নয় সর্বত্রই ঘটতে থাকবে। ভোরের ছোট্ট পাখিটি দর্পিতা ময়ূরীর মারণাঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। দুর্বল নারী প্রবল পুরুষের দ্বারা ধর্ষিত হবে। গণধর্ষণও চলবে, এখন যেমন চলছে। ‘মডেলিং-এর জন্য ডেকে এনে তরুণীকে সংঘবদ্ধ গণধর্ষণ’, এই রকমের সংবাদ শিরোনাম আমাদের গা-সহা হয়ে যাবে। এমনকি ক্ষমতাবহির্ভূত রাজনৈতিক দলেরও একাংশ অপরাংশকে ঘায়েল করতে চাইবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি দলের একাংশ যে ভাবে অপরাংশের সভার ভেতর ঢুকে পড়ে এক নিমেষে হত্যা করে যাচ্ছে সেটা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা হবে না। ওই দুই অংশের লড়াইয়ে এ পর্যন্ত শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ভবিষ্যতে এটা আরও ঘটবে ধারণা করা যায়। 

আট

উপসংহারটা তা হলে কি দাঁড়াবে? আমাদের জন্য করণীয়টাই বা কী? 

এ বিষয়ে অনেক কথা বলা হবে, বলা হচ্ছেও। যেমন বলতে পারি করোনার স্পিরিটের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। তা করোনার স্পিরিটটা কী? না, সেটা হলো বিচ্ছিন্নতা। করোনা যা বলছে তা হলো বাঁচতে যদি চাও তাহলে যত তাড়াতাড়ি পারো বিচ্ছিন্ন হও; সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখো। এই স্পিরিটের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অর্থ হচ্ছে সমাজিক হওয়া। সামাজিক হওয়াকেই কেউ হয়তো নাম দেবেন মানবিকতা। সে নামকরণ মোটেই অযথার্থ হবে না। সামাজিকতার ভেতরই মানবিকতা থাকে, এবং সামাজিক ভাবেই মানবিকতা তথা মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়। বনের মানুষেরা ঠিক মানুষ নয়, বনমানুষ বটে।

কিন্তু সামাজিক হওয়াটা কি সম্ভব হবে? করোনা যা করলো তা তো মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দেওয়া। মানুষ মাত্রেই রোগের জীবাণুবাহী, অতএব জাতশত্রু, এই ধারণা প্রোথিত করে দিতে চাইলো মনের গভীরে। করোনা থাকবে না, কিন্তু ধারণাটা? সেটাও চলে যাবে বলে আমরা আশা করবো, কিন্তু যাবে না, আর যায়ও যদি চলে তবেও তার দাগটা থাকবে, নদী শেষ হয়ে গেলেও নদীর দাগটা যেমন থাকে। তবে এই দাগ কিছুতেই মুছে যাবে না। কারণ এর ওপর কোনো পলিমাটি জমবে না, বরং পলিমাটি যা পড়তে চাইবে অনুকূল হাওয়াতে তা উড়ে যাবে। তার চেয়েও বড় সত্য হলো এই যে, করোনায় যে বিচ্ছিন্নতা শেখালো সেটা এসেছে রোগটির জনকজননী যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সেখান থেকেই। করোনা কাবু হবে, কিন্তু পুঁজিবাদ মোটেই কাবু হবে না। সে উঠবে আরও মরিয়া হয়ে। পুঁজিবাদী দুর্বৃত্ত আগামীতে নতুন কোনো রোগ যদি নাও পাঠায় তবে অন্য এবং আরও ভয়ংকর কিছু যে পাঠাবে সেটা একশ’ ভাগ নিশ্চিত। তার তৎপরতা থামবে না। 

বিজ্ঞ মানুষেরা কেউ কেউ বলছেন ‘বাস্তবসম্মত’ কথা। বলছেন করোনা একটা অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ, এর মোকাবিলা করতে হবে। তাঁরা বলছেন টিকা উদ্ভাবন, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন, চিকিৎসা গবেষণায় ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধিকরণ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যরক্ষার বিধি মেনে চলা, রোগীকে আইসোলেশনে রাখা, আরও ভালো কোয়ারেনটাইন ইত্যাদির কথা; কিন্তু মূল চ্যালেঞ্জটা যেখান থেকে আসছে সেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মুখোমুখি দাঁড়ানো এবং তাকে বদলানোর কথাটা মোটেই বলছেন না। আর পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য চলছে বলে যাঁরা মানেন তাঁরাও পুঁজিবাদের অগ্রভাগে বিশেষণ যোগ করে তার মুখ্য পরিচয়টাকে জানি না কেন অস্পষ্ট করে রাখতে চান। তাঁদের কাছ থেকে অবিকশিত পুঁজিবাদ, অনুন্নত পুঁজিবাদ, করপোরেট পুঁজিবাদ, নিও-লিবারেল পুঁজিবাদ, বিকৃত পুঁজিবাদ, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম ইত্যাদির কথা শোনা যায়। প্রতিকার হিসেবে স্ট্রাকচারাল রিফর্ম, ইনক্লুসিভ ডেমোক্রেসি, ক্যাপিটালিজম উইথ এ হিউম্যান ফেইস, নব্য-উদারতাবাদকে প্রত্যাখ্যান, এডজাস্টমেন্ট, এডাপটেশন, এ ধরনের সংস্কারের পথ দেখান। আওয়াজ ওঠে দুর্নীতি দমন চাই। দুর্নীতিবাজদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে; কিন্তু মূল ব্যাধির চিকিৎসা তো ওসব ওষুধে নেই, সেটা রয়েছে অস্ত্রোপচারে। অস্ত্রোপচারেও কুলাবে না, চিকিৎসা আছে পুঁজিবাদকে বিদায় করার ভেতরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের নতুন একটি বক্তব্য পড়লাম। তবে গলার স্বর আগের মতোই কাতর। তিনি বলছেন মানুষের এক নম্বর শত্রু হচ্ছে করোনা, অথচ কোনো কোনো দেশ তা মানছে না। তাঁর এই বক্তব্য সত্যের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে; কিন্তু এক নম্বর শত্রু হিসেবে এই মুহূর্তে যে দুর্বৃত্তটি দৃশ্যমান তার পেছনে যে আসল এক নম্বর নির্বিঘ্নে কলকাঠি নাড়ছে তার কথা তো তিনি বলছেন না। জানলেও অবশ্য বলবার উপায় নেই। কারণ যে দেশগুলো এই শত্রুটির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অনিচ্ছুক তারা ওই ধরনের বক্তব্য পছন্দ করবে না। ওইসব দেশের শাসকরা সবাই পুঁজিবাদের ওপরই ভর করে আছেন, নাড়াচাড়া দিলে তাদের জন্য মহাবিপদ। আগামীতে আইসোলেশনের জায়গাতে আনতে হবে রেসিপ্রোকেশন, এমন বক্তব্যও পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ সেই দেবে এবং নেবে, মেলাবে মিলিবে। শুনতে ভালো, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অকার্যকর। 

আসলে আমাদের কো-অপারেশন চাই। কো-অপারেশন চাই নতুন এক আন্তর্জাতিকতা সৃষ্টির জন্য, যেটির চরিত্র দোকানদারির হবে না, হবে মানবিক। যার লক্ষ্য সীমিত থাকবে না, প্রসারিত হয়ে রূপ নেবে বৈপ্লবিক। আর সে বিপ্লবটা হবে পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করে ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার। অনেকেই বলেন যে রাষ্ট্রকে সামাজিক দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা চাই। সেটা কিন্তু কিছুতেই সম্ভব নয়। রাষ্ট্র সমাজের সুবিধাভোগীদের স্বার্থ রক্ষার কাজে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান, তাকে ধর্মের কাহিনি শুনিয়ে লাভ নেই, তাতে সে উল্টো ক্ষেপে যেতে পারে, ‘জননিরাপত্তা’ নিশ্চিত করার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তলব করে বসতে পারে। যা দরকার তা হলো রাষ্ট্রের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, যার অর্থ দাঁড়াবে বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে ক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণ এবং নাগরিকদের ভেতর অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রত্যেকটি নাগরিককে সবরকমের নিরাপত্তা দেওয়া। বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রগুলো যদি ওই রকমের হতো তাহলে করোনাভাইরাসের আক্রমণটাই ঘটতো না। অঙ্কুরেই সে মারা পড়তো।

নয়

একশ’ বছর আগে, ১৯১৯ সালে, কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস একটি কবিতা লিখেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ‘দি সেকেন্ড কামিং’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ হয়েছে, যুদ্ধ যে কেবল ধ্বংসকার্য চালিয়েছে তা-ই নয়, মানবিক মূল্যবোধগুলোকেও দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। ভীত সন্ত্রস্ত কবি তখন চারদিকে অন্ধকার ও নৈরাজ্য ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাননি। ইতিহাসের অগ্রগতিতে তিনি আস্থাবান ছিলেন না; ভাবতেন ইতিহাস বৃত্তের ভেতর আবদ্ধ, বৃত্তের প্রসারণ আছে কিন্তু বৃত্তের বন্ধন থেকে ইতিহাসের মুক্তি নেই। বাইবেলের শেষ খণ্ডে একটা আশার বাণী উচ্চারিত আছে। সেটি হলো, মানবজাতির প্রাণকর্তা হিসেবে একদা যেমন যীশু খ্রীস্ট এসেছিলেন, তেমনি আরও একজনের আবির্ভাব ঘটবে, অশুভকে যিনি দমন করবেন। চারপাশে ধ্বংসের উৎসব দেখে কবি ইয়েটস কিন্তু শুভ কোনো শক্তির আবির্ভাবের আশা করতে পারেননি। তাঁর আশঙ্কা আসবে ভয়ংকর এক প্রাণী, দেহটা যার সিংহের মতো, মাথাটা মানুষের। ভয়ংকর সেই জন্তু ধীরে ধীরে কিন্তু অনিবার্য গতিতে এগিয়ে যাবে এবং মানুষের সভ্যতাকে গিলে খাবে। 

ইয়েটসের অনুরাগী পাঠকরা বলেন যে কবির ভবিষ্যদ্বাণী যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে। কবিতাটি লেখার বিশ বছরের মধ্যেই তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধেছে। ইয়েটস অবশ্য বিবেচনার মধ্যে নেননি মস্ত এই ঘটনাকে যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালেই ১৯১৭ সালেই রুশ দেশে একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে গেছে। খবর নিশ্চয়ই পেয়েছেন, কিন্তু ওই বিপ্লবকে মানুষের মুক্তির জন্য কোনো সুসংবাদ বলে বিবেচনা করেননি। হয়তো মনে করেছেন যে নৈরাজ্যকে তিনি চতুর্দিকে দেখতে পাচ্ছিলেন এটি তারই অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তিনি দেখে যাননি, তাঁর মৃত্যু ১৯৩৯ সালে, আর কয়েক বছর জীবিত থাকলে ভয়াবহ আরেকটি যুদ্ধই শুধু নয় চীনের বিপ্লবও দেখতে পেতেন, যদিও বিপ্লব দেখে মোটেই তিনি খুশি হতেন না। সভ্যতাগ্রাসী যে প্রাণীটিকে তিনি অগ্রসর হতে দেখেছিলেন সামাজিক বিপ্লবকে সেটির তৎপরতার অংশ হিসেবেই হয়তো গণ্য করতেন এবং কাতর হবেন।

কিন্তু হতাশাবাদী এই কবি-সাহিত্যকরা যাই বলুন মানব-জাতির ইতিহাস কিন্তু এগিয়েছে, এবং বিশেষভাবে এগিয়েছে সামাজিক বিপ্লবের কারণেই। যে বিপ্লব শুধু রাশিয়া ও চীনেই নয় পৃথিবীর অনেক ক’টি দেশেই ঘটেছিল। সামাজিক বিপ্লবের দুটি বস্তুগত শর্ত থাকে। একটি হলো বিদ্যমান ব্যবস্থার পক্ষে ঘর সামলাতে অপারগতা; অন্যটি ওই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক-বিপুলসংখ্যক মানুষের অনস্থা ও বিক্ষোভ। করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে উভয় শর্তই পূরণের পথে আরও এগিয়ে যাবে। ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়বার দশা হবে; কিন্তু ভাঙার পরে গড়বার যদি কোনো পূর্বপরিকল্পনা না থাকে তাহলে অবস্থাটা দাঁড়াবে চরম নৈরাজ্যের, যার আশঙ্কা ইয়েটস প্রকাশ করেছেন তাঁর ওই কবিতায়। 

নৈরাজ্যের পরিবর্তে পৃথিবীব্যাপী নতুন এক সমাজ ব্যবস্থা যাতে প্রতিষ্ঠিত হয় তার জন্য বিপ্লবের বস্তুগত শর্তপূরণের পাশাপাশি দরকার পড়বে সুসংগঠিত আন্দোলনের এবং নেতৃত্বের। আন্দোলনের ভেতর থেকেই নেতৃত্ব গড়ে উঠবে; কিন্তু আন্দোলনের জন্য ব্যাপক ও গভীর সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিও চাই। 

মানুষের ওপর মানুষের আস্থা কমছে। অর্থাৎ কমানো হচ্ছে। কমাচ্ছে রাষ্ট্র। যে-রাষ্ট্র পুঁজিবাদের দাসানুদাস। বাংলাদেশে অতিকষ্টে যে রাষ্ট্রটি আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি তার ওপরে নাগরিকদের আস্থা ক্রমাগত কমছে। নিম্নগমন এখন ভয়াবহ জায়গাতে এসে পৌঁছেছে। একটি জরিপে দেখলাম শিক্ষিত তরুণদের শতকরা আশি জনই জানিয়েছে যে তারা রাজনীতিকে অপছন্দ করে। তা পছন্দ করার কোনো কারণ আছে কি? রাষ্ট্র যাঁরা চালান তাঁরা রাষ্ট্রকে তো মানুষের পক্ষে না রেখে বিপক্ষে নিয়ে গেছেন। 

না, তরুণরা আস্থা রাখতে পারছে না। যে জরিপের কথা বলছিলাম তার ওই শতকরা আশিজনই কিন্তু জানিয়েছে যে তারা দেশে থাকতে চায় না, পারলে দেশ ছেড়ে চলে যাবে। এর কারণও ওই একই। তাদের আস্থা নেই-না জাতীয়তাবাদীদের ওপর, না বামপন্থীদের ওপর; কিন্তু তারা যাবেটা কোথায়? বিদেশে কি তাদের ঘরবাড়ি আছে? টাকা জমা আছে কি বিদেশী ব্যাংকে? সেটা পরের কথা, প্রবেশে অনুমতি দেবে কি বিদেশিরা? তাছাড়া বিদেশ কি নিরাপদ? করোনাভাইরাস কি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েনি? পুঁজিবাদী বিশ্বের কোথাও কি মানুষ নিরাপদে আছে? না, পালাবার জায়গা নেই। পথও নেই। পালিয়ে বাঁচা যাবে না। যেটা করতে হবে সেটা হলো নিজের দেশকেই নিরাপদ করে তোলা, তাকে বদলে ফেলা, এবং বদলানোর জন্য জোট বাঁধা। 

জোট বাঁধতে হলে প্রথমেই যা করা চাই তাহলো ওই যে ফেল কড়ি মাখো তেল ওই নীতিকে পরিত্যাগ করা। পুঁজিবাদী ভাবাদর্শের মোহ সম্পূর্ণরূপে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া। তার জন্য চাই মওলানা ভাসানীর সেই ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না তা হবে না তা হবে না’ আওয়াজটাই। এটা হিংসার কথা নয়, বাঁচার অধিকারের দাবি। বাঁচার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আওয়াজ। এবং অনুসরণ করা দরকার হবে মাও সে তুঙের পরামর্শ, ‘শ্রেণি সংগ্রাম ভুলিও না’। অর্থাৎ সংগ্রামটা হবে বৈষম্য ঘুঁচিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার।

ওই সংগ্রামের ভেতর দিয়েই পৃথিবী বদলাবে। পুঁজিবাদ যতই অকার্যকর হবে তার সুবিধাভোগীরা ততই নির্মম হয়ে উঠবে। সকল শক্তি কাজে লাগিয়ে দমনপীড়ন বৃদ্ধি করবে। দেখা দেবে মহা নৈরাজ্য। পরিবর্তনের কাজটা সুবিধাবঞ্চিতরাই করবে, সঙ্গে থাকবে তারাও যারা বুঝেছে ব্যক্তিগত সুবিধার ব্যবস্থাটা টিকবে না, বরং সামাজিক অগ্রগতিকে প্রতিহতই করবে। বৃদ্ধি করবে নৈরাজ্যের প্রসারকে। সমাজ বিপ্লবের আন্দোলনের পথ ধরে কেনাবেচার জায়গাতে আসবে সমবায়। বিশ্বব্যাপী আওয়াজ উঠবে আর উন্নতি নয়, এখন মুক্তি চাই।

মুক্তির এই আন্দোলনে বিশ্বজনীন অংশগ্রহণ ও সহমর্মিতা থাকবে, কিন্তু এর কোনো একক কেন্দ্র থাকবে না। বিশ্বের সব দেশেই আন্দোলন চলবে। সে-আন্দোলন নৈরাজ্য ঠেকিয়ে সামাজিক বিপ্লবের দিকে এগুবার। জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান অহরহ ঘটবে, পারস্পরিক সাহায্য সমর্থন থাকবে, আধিপত্য থাকবে না তথাকথিত বড় দেশের। 

ইতিহাস শেষ হয়ে যায়নি, যাবেও না; ইতিহাস এগোবে। মানুষ এমন এক বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করবে যেখানে চলাচল হবে অবাধ, সামাজিকতা থাকবে প্রাণে ভরপুর। কেউ গৃহহীন থাকবে না। দরজায় দরজায় পাহারাদার দেখা যাবে না। গোয়েন্দারা গন্ধ শুঁকে বেড়াবে না গাত্রের। দারিদ্র্য হবে অনুপস্থিত। থাকবে প্রাচুর্য ও অবসর। ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার ফলে যে নতুন উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে উঠবে তাতে মানুষের সৃষ্টিশীলতা মুক্তি পাবে। উৎপাদনের মান ও পরিমাণ দুটোই বৃদ্ধি পাবে। বিতরণ বাজারী হবে না, হবে সমবায়ী। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বের। নতুন সেই পৃথিবী গড়ার জন্য জোট বাঁধাটাই হবে সকল দেশের মানুষের কর্তব্য; দেশের ভেতরে এবং বাইরে। নতুন এক আন্তর্জাতিকতা প্রতিষ্ঠা করা চাই যা সম্পূর্ণ মানবিক, এবং বর্তমানের ঘটনাবলি যেখানে পরিণত হবে দুঃস্বপ্নের স্মৃতিতে।   

লেখক : এমিরেটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //