রম্য

বাজার রঙ্গ

এক

‘এবার রোজায়, দাম কমিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করব। আপনারা কি বলেন?’ মুগডালের প্রস্তাব শুনে মিটিংয়ে বসা নিবাডাসের (নিখিল বাংলাদেশ ডাল সম্প্রদায়) সবাই নড়ে চড়ে উঠল। খেসারি আর থাকতে না পেরে হাত তুলল, আমার একটা কথা ছিল। আপনাদের নামেও যেমন জোট ‘মুগ-মুসুরি’, ডাল সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাবানও আপনারা। ইচ্ছা করলে বছরের যে কোনো সময় নিজেদের দাম বাড়িয়ে নিতে পারবেন; কিন্তু আমার কথাটা একবার ভেবে দেখেন, এই রোজার সিজনে নিজের দাম বাড়াতে না পারলে, আমাকে দাম দেবে কে? 

খেসারির সমর্থনে প্রবলভাবে মাথা দোলাতে থাকা মটর, ছোলা হঠাৎ করে মাথা দোলানো বন্ধ করে দিলো। মুগ যেভাবে আগুন চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে, বিপক্ষে মাথা দোলানোর কারণে মিটিং থেকে বের হয়ে কি ডলা দেয়, কে জানে। পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে ছোলা গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে। ইয়ে মানে বৃহত্তর স্বার্থে কখনো কখনো ক্ষুদ্র স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেই হয়। এবার তো আর অন্যান্য বারের মতো অবস্থা না। গোটা পৃথিবীজুড়ে এমন দুর্যোগ তো আগে কখনো ঘটেনি। তাছাড়া এই করোনাক্রান্ত সিচুয়েশনে মানব সম্প্রদায়ের কথা ভাবা তো আমাদের একান্ত কর্তব্য। আমাদের সেক্রেটারি সাহেব, জনাব মুগের প্রস্তাব তো শুনলাম। সভাপতি সাহেব কি বলেন, এ ব্যাপারে?

সবার চোখ মুসুরির দিকে। চেয়ারে হেলান দিয়ে মোবাইল কানে চেপে সভাপতি মুসুরি কার সঙ্গে যেন চিপা আলাপ চালাচ্ছেন। হাতের ইশারায় মিটিং চালিয়ে নিতে বললেন সেক্রেটারি মুগকে। ফ্লোর পেয়ে মুগ হাতা গুটিয়ে এবার ভাষণ শুরু করল। ভাইসব, আমাদের আশপাশে যারা আছে, তাদের সবার স্বভাব কি জানেন? সুযোগ পেলেই দাম বাড়ানো; কিন্তু আপনারা একবারও কি ভেবে দেখেছেন, জোর করে দাম বাড়ালেই কি নিজের দাম বাড়ে? আর এভাবে দাম বাড়ানোও কি উচিত? এটা কি মগের মুল্লুক?

একটু দূরে বসা অড়হর ফিসফিসিয়ে ওঠে, এটা মগের মুল্লুক হতে যাবে কেন? এটা হলো গিয়ে মুগের মুল্লুক। কার সঙ্গে কি লিয়াজোঁ করে এই উদ্ভট প্রস্তাব এনেছে, কে জানে? পাশে বসা মাষকলাই ফিক করে হেসে উত্তরে কিছু বলার আগেই মুগ এটাক করে অড়হরকে। এই যে অড়হর ভাই, হড়হড়িয়ে কি ঢালছেন মাষকলাই এর কানে? জোরে বলেন, আমরা সবাই শুনি। বিগলিত হাসি উপহার দিয়ে অড়হর দাঁড়িয়ে পড়ল। সেক্রেটারি সাহেব, আপনার প্রস্তাব শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সেই মুগ্ধতার কথাই বলছিলাম মাষকলাইকে। নিজের দাম কমিয়েও যে সবার কাছে দাম বাড়ানো যায়, এটা কখনো কল্পনাই করতে পারিনি। এমন যুগান্তকারী প্রস্তাব এই প্রথম শুনলাম। আমাদের নিখিল বাংলাদেশ ডাল সম্প্রদায়ে এই প্রস্তাবের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মাষকলাই অড়হরের পশ্চাদ্দেশে চিমটি না কাটলে এই তেল মাখা কতক্ষণ চলত কে জানে? চিমটি খেয়ে অড়হর বসে পড়তেই মাষকলাই ফোঁড়ন কাটে, ছুটছো তো ছুটছোই। কথার রেলগাড়ি ইস্টিশন দেখে না? 

আড়চোখে মাষকলাই আর অড়হরের কাজ কারবার দেখে মুগ। ভুরু কুঁচকে কিছু বলার আগেই তাকে ইশারায় কাছে ডাকে মুসুরি। মিটিং এর কোন কথাই শুনতে পারেনি বেচারা। শুনবে কী করে? রোজার আগে আগেই সিন্ডিকেটজনিত ব্যস্ততা এমনভাবে বাড়ে, একটার পর একটা ফোনকলে কান ঝালাপালা। মুগ হাসতে হাসতে এসে কানের কাছে এসে মিটিং এর সারসংক্ষেপ পেশ করে। 

সব শুনে একটু ভেবে নেয় মুসুরি। তারপর সভায় উপস্থিত সবার চোখের দিকে তাকায়। বড় বড় নেতারা এমনি এমনি বড় নেতা হয় না। পাবলিক সেন্টিমেন্ট বুঝতে হয় তাদের। হাওয়া বুঝে পাল তুলতে না জানলে তাল হারিয়ে নৌকাডুবি হয়। 

ধীরে ধীরে মুখ খোলে মুসুরি। প্রিয় স্বজন আমার, আপনারাই বলেন, কি চান? নিজেদের দাম বাড়াতে, তাই তো? আপনারা কি জানেন, হেরে গিয়েও যেমন জেতা যায়, তেমনি জিতে গিয়েও হেরে যাওয়ার গ্লানি কাজ করে মনের ভেতর। জানেন কি, নিজের দাম কমিয়েও দাম বাড়ানো যায়? ভাইয়েরা আমার, জোর করে আর যাই অর্জন করা যায়, সুনাম অর্জন করা যায় না। আপনারাই বলুন, কি করা উচিত এখন? তবে কথা একটাই, জাতীয় স্বার্থে নিবাডাস-এর সবাইকে এক থাকতে হবে। আপনারা যাই সিদ্ধান্ত নেবেন, আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। এখন আপনারা হাত তোলেন, কারা আমার সঙ্গে আছেন? 

ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং বড় নেতার বড় গুন। সভায় উপস্থিত সবাই আবেগে এক হাতের জায়গায় দুই হাত তোলে। শুধু তাই না, দূরে এক চিপায় দাঁড়িয়ে লুকিয়ে সব কথা শোনা ভিন সম্প্রদায়ের এক গুপ্তচরও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে হাত তুলে ফেলে। সভায় মনোযোগ থাকায় কেউ খেয়াল করেনা ব্যাপারটা। 

দুই

‘খবরটা শুনছেন নাকি?’ পাইজম চাল হাঁপাতে হাঁপাতে চালের আড়তে আসে। গুটি স্বর্ণা, নাজিরশাইল, সিদ্ধ, আতপ, বাসমতি, বিরই, চিনিগুড়া, কাটারিসহ উপস্থিত সব চালেরা চোখ বড় বড় করে তাকায় পাইজমের দিকে। আড়চোখে সবার উদ্বিগ্ন চেহারা দেখে খুশিতে মন ভরে ওঠে পাইজমের। একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার শুরু করে। ভাইসব, আপনারা তো জানেন, প্রতিদিন ঘুরে ঘুরে বাজার পরিদর্শন করাটাকে আমি দায়িত্ব মনে করি। সেই দায়িত্ব পালনে আগেও অবহেলা করিনি, এখনও করছি না, ভবিষ্যতেও কোনো দিন করব না। হাততালি পাবার আশায় আড়চোখে এদিক, ওদিক তাকিয়ে হতাশ হয় পাইজম। হায়রে অকৃতজ্ঞের দল, টাকা তো চাইনি তোদের কাছে, মানীগুনি মানুষের বক্তব্য শুনে একটা হাততালি দিতেও কি হাতব্যথা করে? ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে আবার বক্তৃতায় মন দেয়। প্রিয় ভাইয়েরা আমার, করোনার অজুহাতে সবাই হাত গুটিয়ে বসে থাকলে কাজ করবে কে? কোথায় কি হচ্ছে জানবে কে? বাজারের খবর আনবে কে? সরজমিনে ভালো-মন্দ, ক্ষয়-ক্ষতি, লাভ-লোকসান, বিপদ-আপদ দেখার জন্য একজন অন্তঃপ্রাণ ফ্রন্ট লাইনার সৈনিক তো দরকার। কি বলেন আপনারা? এবারও সেই একই দৃশ্য। উপস্থিত প্রত্যেকের চোখে মুখে কৃতজ্ঞভাব তো নে-ই, উল্টো স্পষ্ট বিরক্তি। কেউ কোনো কথা না বলে মুখ শক্ত করে বসে আছে দেখে উত্তরের আশা ত্যাগ করে পাইজম আবার শুরু করে। তো, আজও সেই দায় থেকে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে বের হয়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে এদিক, ওদিক হয়ে ডালপট্টির দিকে মোচড় দিতেই দেখলাম এক বিরল ঘটনা। এমন ঘটনা আমি আমার জীবনে প্রথম দেখলাম। ডালপট্টিতে সবাই মিটিঙে বসেছে। আরে ভাই, এভাবে চোখ গরম করছেন কেন 

সবাই? মিটিঙে বসতেই পারে, এটাকে তো বিরল ঘটনা বলিনি। বিরল ঘটনা হলো, এ কেমন মিটিং, যে মিটিঙে শুধু ডাল সম্প্রদায় ছাড়া আর কেউ নেই? কেন নেই? কীসের গোপন মিটিং! সব প্রশ্নের উত্তর পেতে তাড়াতাড়ি এক চিপায় লুকিয়ে পড়ে কান পাতলাম। আর থাকতে না পেরে মিনিকেট এবার রেগে দাড়িয়ে পড়ল। পাইজম সাহেব, ফালতু কথা অনেক বলেছেন। মাথা ঝি ঝি করছে আপনার কথা শুনে। আর ত্রিশ সেকেন্ড সময় দেয়া হলো আপনাকে, ডালপট্টির মিটিং এর বিষয়টি কি, এক বাক্যে বলার জন্য। বললে বলেন, নাহলে এখান থেকে বিদায় হন। সভাপতি সাহেবের কথা শুনে পাইজম মুখ ফুলিয়ে বলল, বিষয় হলো মূল্য হ্রাস।

বাসমতি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, মূল্যহ্রাস মানে? পাইজমের মুখে আবার হাসি ফুটে উঠল। আড়চোখে মিনিকেটকে দেখে মৃদু আঁচে ঝাঁঝাল খোঁচা মারল- সেটাই তো বলছিলাম, এক বাক্যে কী আর সবকিছু বোঝানো যায়? নিখল বাংলাদেশ ডাল সম্প্রদায় (নিবাডাস) ঠিক করেছে, পেন্ডেমিক অবস্থার কারণে এই রোজার মাসে নিজেদের দাম কমিয়ে দৃষ্টান্ত গড়বে। 

এ কথার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ শুরু হয়ে গেল চারপাশ থেকে। 

চিনিগুড়া: বলে কি? 

পাইজম: যা নিজের চোখে দেখে এলাম, নিজের কানে শুনে এলাম, তাই।

গুটি স্বর্ণা: এই গুটিবাজি চালটা চালল কে? পাশ্ববর্তী কোন দেশের চক্রান্ত নয় তো?

পাইজম: হলে হতেও পারে। ওদের সভাপতি সাহেবকে তো দেখলাম, একটু পর পর ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে।

বিরই: বললেই হলো?

পাইজম: হচ্ছে তো দেখে এলাম।

কাটারি: ওরা দাম কমালে কি আমাদের ওপর কোনো ইফেক্ট পড়বে?

পাইজম: আলবৎ পড়বে। সাইড ইফেক্ট, ব্যাড ইফেক্ট সব ঝপঝপিয়ে পড়বে।

সিদ্ধ: ভাইজান এইসব কী বলেন? ওরা দাম কমালে আমাদের কি?

পাইজম: আমাদের কী মানে? কে না জানে, ডালে চালে খিচুড়ি। আমাদের কারণে সাশ্রয়ে খিচুড়ি পাকাতে না পারলে পাবলিক সিম্পেথি ওদের দিকে ঝুঁকে পড়বে না?

আঠাইশ: শুধু ওদের ওপরই পড়বে? আমাদের ওপর কিছু পড়বে না?

পাইজম: পড়বে না কেন? অবশ্যই পড়বে। ওদের ওপর পড়বে জনগনের সিম্প্যাথি আর আমাদের ওপর পড়বে এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি সেবনরত আমজনতার প্যাথেটিক গালাগালি।

বিরই: তাহলে এখন কি হবে?

পাইজম: হ্যাঁ-হলে কি হবে, না-হলে কি হবে, তাহলে কি হবে, এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবেন আমাদের সভাপতি মিনিকেট সাহেব। সভাপতি সাহেব কি বলেন?

কিছু বলার আগেই সভাপতি সাহেব জোরে হাচ্চি দিয়ে একবার কেশে নিলেন। পাশে বসা নাজিরশাইল এক লাফে দূরে সরে বলল, ভাইজান, কতদিন যাবত হাঁচি-কাশি? জ্বর নাই তো? মিনিকেট নাজিরশাইলের দিকে দাঁত কিড়মিড় করে উঠেই নিজেকে সামলে নিলেন। স্বাভাবিক মিষ্টি হাসি উপহার দিলেন নিখিল বাংলাদেশ চাল সম্প্রদায়ের (নিবাচাস) উদ্দেশে। 

চেয়ারের একটা ব্যাপার আছে, সবার সামনে সভাপতির সিটে বসে বদরাগি হওয়া যায় না। এই রাগ ঝাড়তে হয় একা একা। নাজিরশাইলের এই ব্যবহারটা অদৃশ্য টিস্যুতে পেঁচিয়ে জামার চিপার পকেটে জমা রাখলেন। নাজির ব্যাটাকে একা পেলেই জিলাপির প্যাঁচ দিয়ে চিপকে ধরবেন। ব্যাটার কত্ত বড় সাহস, সবার সামনে বসে তাঁকে অপমান করে! রাগ একটা অদ্ভুত জিনিস। এটা মাথায় নিয়ে না যায় কোন সুচিন্তা করা, না যায় কোনো ভালো কথা বলা। রাগ কমাতে দশ থেকে শূন্য পর্যন্ত গুনে কথা শুরু করলেন সভাপতি সাহেব।

প্রতিবার রোজা-রমজান আসে, আমাদের সবার দাম বাড়ে। মানুষজনও মুখ বেঁকিয়ে, রাগে ক্ষোভে ফোসফোঁস করে কয়দিন। কেউ দিস্তা দিস্তা কাগজের পাতা ভরে অভিযোগ জানায়, কেউ কেউ টিটকারী মেরে কার্টুন আঁকে। এ-টিভি, বি-টিভি থেকে শুরু করে জেড-টিভি পর্যন্ত ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে বাজারে ঢোকে। ফুটেজের পর ফুটেজ আমাদের দেখিয়ে টিভি দর্শকদের সিম্প্যাথি আদায় করে। কেউ বা ফেসবুকে লিখে লাইক, কমেন্টের ঝড় বসায়। তারপরই গোপনে করে আসল কাজটা। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যা লাগবে, তার দশগুণ কিনে নিজেদের ঘরকে বানায় গোডাউন। এ সুযোগে আমরাও নিজেদের দাম বাড়িয়ে নেই ইচ্ছামতো। কেউ কেউ সেঞ্চুরি করে, কেউ কেউ করে ডাবল সেঞ্চুরি, কেউ বা হাঁকায় ট্রিপল সেঞ্চুরি; কিন্তু কথা হলো, এখন কি সেই সময়? পৃথিবীজুড়ে ধেয়ে আসা এমন ভয়াবহ মহামারি কি আর কখনো এভাবে এসে মুহূর্তেই এত প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল? মানুষই যদি না বাঁচে, আমরা বেঁচে কোথায় দাম বাড়াব? ঠিক কী না বলেন?

নাজিরশাইল, স্বর্ণা, মিনিকেট, সিদ্ধ, আতপ, বিরই গোটা চালমহালের সবাই সমস্বরে ঠিক, ঠিক, ঠিক রব তুলল। সভাপতি সাহেবের মনে হলো, শুধু চালমহাল না, চালমহালের পাশের ঝোপ থেকেও কে যেন ‘ঠিক, ঠিক’ বলে উঠল। সভাপতি সাহেব উঁকি দিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার সভায় মন দিলেন। 

তিন

বৈশাখের কাঠফাটা রোদে কাঁচাবাজারে কেউ আর কাঁচা নেই। কেউ পেকে জন্ডিস কালার হয়ে আছে তো কেউ চামড়া কুঁচকে জিহ্বা বের করে দিয়েছে। এমন গরমে কার মাথা ঠিক থাকে? এরইমধ্যে পটল, লাল টসটসে টমেটোর গাঁ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে দেখে টমেটো গিয়েছে ক্ষেপে। কি রে বুইড়া, পেকে পচতে চলেছিস, তারপরেও গা ঘষতে ইচ্ছা করে? লেডিস দেখলে মাথা ঠিক থাকে না, না? করোনা চলছে, কোথায় তিন ফুট দূরে থাকবে, তা না, কোলের কাছে এসে ঘষাঘষি শুরু করে দিয়েছে! বিব্রত পটল কিছু জবাব দেবার আগেই চারপাশে থাকা সবজিরা হো হো করে হেসে উঠল। ঢ্যাঁড়স যেন এ সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। কোমরে হাত দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আপনাকে তখনই বলেছিলাম টমেটো আপা, আমার পাশে আসেন। শুনলেন না তো আমার কথা। শুনলেন ওই লুইচ্চা পটলের কথা। এবার বুঝেন মজা? টমেটো ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দিল, ওরে বাবা, আসছে আরেক সুহৃদ। কষওয়ালা ঢেঁড়সের দেখি মনে বেশ রস জমেছে। আয়, কাছে আয়। 

বিনা টিকিটে সিনেমা দেখতে কার না ভালো লাগে? আলু, কাঁচামরিচ, লাউ, কুমড়া, কাঁচা কলা, ঝিঙ্গা, বরবটি সবাই ভিড় জমালো লাইভ সিনেমা দেখতে। ঠিক এমন সময় দৌড়াতে দৌড়াতে বাজারে ঢুকল বেগুন। কে কোথায় আছ, এদিকে আসো। বিরাট ঘটনা ঘটতে চলেছে। কি হলো আমার কথা কেউ শুনছ না কেন? মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে আলু। কেন, তোমার কথা শুনব কেন? যার কোনো গুণ নাই, সেই বে-গুন এর কথা শুনতে আমাদের বয়েই গেছে।

অন্য সময় হলে আলুর দোষ কিংবা আলুনি নিয়ে দাঁত ভাঙা একটা জবাব দিয়ে দিতো; কিন্তু এখন সে সময় না। রেগে উঠতে গিয়েও তাই রেগে যায়না বেগুন। শুড়ে (যাকে সবাই বোঁটা নামেই চেনে) লাল পতাকা বেঁধে সবাইকে জড়ো হতে বার্তা পাঠায়। লাল পতাকা দেখে উপস্থিত সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। 

নাটকীয় ভঙ্গিতে বেগুন কথা শুরু করে। কেউ কল্পনাও করতে পারবে না, কী খবর নিয়ে এসেছি আমি। ঝোপের আড়াল থেকে শোনা চালপট্টিতে হওয়া মিটিং-এর কথা খুলে বলে সবাইকে। সব শুনে পেঁপে তাকায় কুমড়ার দিকে, কুমড়া তাকায় লাউয়ের দিকে, লাউ চিচিঙ্গার দিকে, চিচিঙ্গা ঝিঙার দিকে, ঝিঙ্গা সজনের দিকে, সজনে বরবটির দিকে, বরবটি মূলার দিকে, মূলা গাজরের দিকে, গাজর সীমের দিকে, সীম ঢেঁড়সের দিকে, ঢেঁড়স টমেটোর দিকে তাকিয়েই সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে তাকায় পটোলের দিকে। পটোল চোখ বড়বড় করে তাকায় বেগুনের দিকে। সবার চোখে একটাই প্রশ্ন, এবার তাহলে আমরা কি করব? 

রোজা মানেই তো পাখনা মেলে নিজেদের দাম বাড়ানোর, পত্রিকার পাতায় চেহারা দেখানোর, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের পর্দায় নিজেকে উপস্থাপনের মোক্ষম সময়; কিন্তু এ সময়ে ভিন্ন স্ট্র্যাটেজি নিয়ে চাল, ডালের মতো থার্ড গ্রেডের আইটেমরা পত্র পত্রিকা, ফেসবুক, টিভি চ্যানেল সব দখল করে নেবে?

জটলা দেখে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ। কীরে ভিড় কীসের এখানে? দুই ভিআইপিকে দেখে হাত কচলাতে কচলাতে পুরো ঘটনা খুলে বলে বেগুন। সব শুনে হেসে উঠে সিন্ডেকেট কুইন পেঁয়াজ। তার দেখাদেখি কাঁচামরিচও হু হা হা হা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে পেঁয়াজ উৎসুক জনতার দিকে তাকায়। ও এই ব্যাপার? সবাই নিজেদের দাম কমিয়ে হিরো সাজবে? সাজাচ্ছি হিরো। যে যার কাজে যাও তো তোমরা। কাল সকালে খবরের কাগজেই দেখে নিও এ সিনেমার বাকি অংশ। 

 চার

ভিড় ফাঁকা হয়ে যেতেই শাড়ির ভাঁজ ঠিক করতে করতে পেঁয়াজ ঝাড়ি লাগায় কাঁচা মরিচকে। এমন ভিলেন মার্কা হাসি শিখলেন কার কাছ থেকে? ‘আমার যা অর্জন, সবই তো আপনার পাশে থেকে-থেকেই আপা’ মাথা চুলকে উত্তর দেয় কাঁচামরিচ। পেঁয়াজ আড়চোখে তাকায় কাঁচামরিচের দিকে। ভালোই তো ডায়ালগবাজ হয়েছেন থেকে-থেকে। এবার ফোন লাগান তো ডাল সভাপতি মুসুরিকে। তারপর ফোন লাগান চাল সভাপতি মিনিকেটকে। কী হলো ফোন না লাগিয়ে কি এত ভাবেন?

কাঁচামরিচ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে আপা।

আপনার মাথায় বুদ্ধি এসেছে নাকি উকুন এসেছে? সেই কখন থেকে দেখছি মাথা চুলকিয়েই যাচ্ছেন। বাসায় ফিরেই উকুননাশক স্যাম্পু দিয়ে গোসল দেবেন। এবার বলেন, কি বুদ্ধি এসেছে?

কাঁচামরিচ অপমান গায়ে মাখে না। অপমান গায়ে মাখলে নেতা হওয়া যায় না। নেত্রী কিছু বলা মানেই আশীর্বাদ। নেত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে কোলে হাত রেখে কথা বলাও বেয়াদবির লক্ষন। কাঁচামরিচ বেয়াদব না। তাই মাথা থেকে হাত নামিয়ে পশ্চাদ্দেশের ওপর রাখে। তারপর নেত্রীর কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলে, দুইবার ফোন দিবো দু’জনকে? তারচেয়ে একসঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করলে কেমন হয়? তাতে আপনার ডাবল পরিশ্রমও হয় না, সময়ও বাঁচে। তাছাড়া ভিডিও কলে এক্সপ্রেশন দেখা যায়। ঘিরিঙ্গিবাজ কেউ পাশ থেকে ঘিরিঙ্গি বুদ্ধি দেবার সযোগ পায় না। পেঁয়াজ শাড়ীর ভাঁজ ঠিক করতে করতে মুগ্ধ চোখে কাঁচামরিচকে আপাদমস্তক স্ক্যান করে ভিডিও কল করতে ইশারা করে। 

পেঁয়াজ: আসসালামু আলাইকুম, কে কেমন আছেন? 

মিনিকেট: ভালো আছি আপা, আপনি কেমন?

মুসুরি: আমিও ভালো আছি, আপনার শরীর ভালো তো?

পেঁয়াজ: জ্বি, ভালোই আছি। আসলে আপনাদের বিরক্ত করতাম না। একটা খবর শুনে আপন লোকদের এই জরুরি তলব।

মিনিকেট: কি খবর আপা?

পেঁয়াজ: দেখেন, আপনারা আমাকে আপন মনে না-ই করতে পারেন, আমি কিন্তু মনে করি। তাই যখনই কোন আজাইরাই হোক, আর বাজাইরাই হোক খবর শুনি, আপনাদের সঙ্গেই মতবিনিময় করি। 

মুসুরি: এটা আপনি কি বললেন? আমরা আপনাকে আপন মনে করব না কেন?

পেঁয়াজ: যদি তাই মনে করতেন, দাম কমানোর ব্যাপারে এত বড় একটা ডিসিশন একা একাই নিতেন? আপনারা থাকেন ডেকোরেশন করা দোকানের ভেতরে অভিজাত এলাকায়। ফ্যানের বাতাস খান, এলইডি লাইটের আলোয় রূপের ঝলক দেখান। আর আমরা থাকি খোলা ময়দানে, রাস্তার ওপর। রোদে পুড়ে ভিটামিন ডি খাই, ধুলাবালি খাই, কাস্টমারের হাতের চাপ খাই, নখের গুতা খাই; কিন্তু তাই বলে এইরকম দূরে ঠেলবেন? কি হলো, কথা বলেন না কেন? 

মুসুরি: আপনার কথা শুনে নির্বাক হয়ে গেছি আপা। আজ বুঝলাম, পুরো বাজারে সবকিছু ছাড়িয়ে আপনার কেন এত দাম, কেন এত সুনাম? আপনার কথার ঝাঁজে চোখে জল না এসে কারও উপায় আছে? 

মিনিকেট: একদম ঠিক কথা বলেছেন ভাই। আপা কথার অলংকারে এত সেজেগুজে নিজেকে উপস্থাপন করেন, নির্বাক হয়ে খালি শুনতে ইচ্ছা করে। আপা, আপনি আমাদের দু’জনের জন্য একটা ভার্চুয়াল কোর্সের আয়োজন করেন। তিন মাসের কোর্স, ফি আপনি যা চান তাই। 

পেঁয়াজ: কোর্স তো আমি করব আপনাদের কাছে। মুহূর্তেই এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে টার্ন নেয়ার কোর্স। এবার দয়া করে বলবেন, এভাবে দূরে ঠেলার কারণটা কি? 

মিনিকেট: প্লিজ আপা ভুল বুঝবেন না। আমরা কখনই আপনাকে আলাদা ভাবিনা। দূরে ঠেলার তো প্রশ্নই আসে না। 

পেঁয়াজ: কোলে তোলারও তো উদ্যোগ দেখিনি কোনোদিন। কোনোদিন কি নিজ থেকে একটা ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, খোলা রাস্তায়, ভ্যানের ওপর কেমন আছি আমরা? 

মুসুরি: আপা, স্বীকার করে নিচ্ছি, এটা একটা বিরাট ভুল হয়েছে। জাতীয় স্বার্থেই আমাদের একে অপরের খবর নেওয়া উচিত। 

পেঁয়াজ: ভুল কি শুধু একটাই হয়েছে? আর একা একা দাম কমানোর ব্যাপারটা?

মিনিকেট: এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার আছে। গোটা দেশজুড়ে এমন পেন্ডেমিক সিচুয়েশনে আমাদের কি একটু মানবিক হওয়া উচিত না?

পেঁয়াজ: হাসালেন ভাই। মানুষই তো মানবিক না, আমরা কেন মানবিক হবো? এই পেন্ডেমিক সিচুয়েশনে মানুষ কি করোনা নিয়ে ব্যবসা করেনি? এখনও করছে না? কার প্রতি মানবিক হবো? আমরা দাম কমালে মানুষ কি মানবিক হবে? আপনাদের এই মানবিকতায় কি সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে? বড় বড় আড়তদাররা কি আমাদের স্টক করে দাম বাড়াবে না? কোথায়, কার জন্য আপনারা মানবিক হবেন শুনি? আপনাদের মানবিকতায় লাভটা হবে কার? 

মুসুরি: এভাবে তো কখনো ভেবে দেখিনি। ঠিকই তো বলেছেন। 

মিনিকেট: সত্যি আপা, আপনি আপনিই। বাজারে সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি করা আপনাকেই মানায়। তাহলে আর দেরি কেন? এখনই কাজ শুরু করে দেই, কী বলেন? 

মুসুরি: হুম তাই তো। অনেক রাত হয়ে গেছে। এখনই কয়েক জায়গায় ফোন দিতে হবে। বাই।

মিনিকেট: বাই। 

পেঁয়াজ: টা, টা, বাই,বাই। মিনি-মুসু ভালো থাকবেন সবাই। 

পাঁচ

পেপার নেবেন পেপার

আজকের তাজা খবর ... 

রোজার আগেই দাম বাড়ল চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব সবজির।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //