ফিচার

হারিয়ে যাচ্ছে আলপনা ও সরাচিত্রের ঐতিহ্য

অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আর্টের একটা লক্ষণ আড়ম্বর শূন্যতা- সিমপ্লিসিটি। অনাবশ্যক রঙতুলির কলকারখানা, দোয়াত-কলম, বাজনা-বাদ্যি সে মোটেই সয় না।বাংলার লোকশিল্পের আলপনা চিত্র সরাচিত্রের দিকে তাকালে সেই সত্যতা চোখে পড়বে। সে যেন নীরবে হেঁটে গিয়ে মনের এক কোণে বসে পড়ে। তাকে কেউ দেখল বা না দেখল, ডাকল বা না ডাকল তাতে তার কিছু যায় আসে না। নিজেকে জাহির করার কোনো দেখনদারি তার নেই। বাংলার লোকশিল্পের সর্বাঙ্গে যে সহজ সুরের শয়তানি রয়েছে আলপনা সরাশিল্প তার এক চমৎকার উদাহরণ।

আলপনা শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ আলিম্পনা থেকে। এই শব্দের মানে প্লাস্টার করা। একসময় এই লোকশিল্প বাংলার বাড়িতে বাড়িতে দেখা মিলত। শুধু সজ্জা বাড়ানোই না আলপনাকে মনে করা হতো সুখ, শান্তি সমৃদ্ধির প্রতীক।

প্রতিটি পরিবারে মা থেকে মেয়েদের হাত ধরে যুগ যুগ ধরে বহমান এই শিল্প। শুধু মেয়েরাই নয়, আলপনা দেওয়ার শিল্প রপ্ত করেছে পুরুষরাও। শান্তিনিকেতনের এই চারুকলার ইতিহাস শতাব্দী প্রাচীন। বৈদিক নিয়ম মেনে ক্ষিতিমোহন সেন কবিগুরুর অনুপ্রেরণায় এই কলাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। ক্ষিতিমোহন সেনের স্ত্রী কিরণবালা দেবী একজন দক্ষ আলপনা শিল্পী ছিলেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ সুকুমারি দেবীকে আনেন পড়ুয়াদের এই শিল্প শেখাতে। সুকুমারি দেবীও ছিলেন এক দক্ষ আলপনা শিল্পী।

১৯০৯ সালে নন্দলাল বসু অসিত হালদারকে লেডি হেরিংহ্যাম ভগিনী নিবেদিতা অনুরোধ করেন অজন্তা চিত্রকলার ছবি আঁকতে। নন্দলাল বসুর জন্য অজন্তা গুহা খুলে দেওয়া হয়। ১৯১৯ সালে নন্দলাল বসুকে শান্তিনিকেতনের কলা ভবনের অধ্যক্ষ হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি সুকুমারি দেবীর আলপনায় মুগ্ধ হয়ে আলপনা শিল্পকে আরও বিস্তৃত করার সিদ্ধান্ত নেন।

এই আলপনায় মূলত তুলে ধরা হয় প্রকৃতিকে, যেমন শাঁখ, সূর্য, তারা ইত্যাদি। নন্দলাল বসু এই আলপনায় রঙ শেডের মাত্রা যোগ করেন। ফলে আরও বাস্তব চিত্র ফুটে উঠতে শুরু করে আলপনার মাধ্যমে। আজকের যুগে তাই আলপনার নিজস্ব শৈল্পিক ভাষা স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল।

বাংলার আলপনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলার আলপনা দুই রকমের কামনাত্মক নান্দনিক। নান্দনিক আলপনা আঁকা হয় আনুষ্ঠানিক কাজে সৌন্দর্যের প্রয়োজনে; যেমন বিবাহ, উৎসব, সমাবর্তনসহ নানান সমাজিক-পারিবারিক উৎসবের প্রেক্ষিতে। কামনাত্মক আলপনা আঁকা হয় ব্রতানুষ্ঠানে, যেখানে পার্থিব কামনা-বাসনাই প্রাধান্য পায়। উভয়ক্ষেত্রেই নান্দনিকতা কামনার প্রকাশে ব্যবহৃত হয় কিছু মোটিফ। এই মোটিফ প্রকাশের যা চিত্র, তাকেই এখানে চিহ্ন-সংকেত বা প্রতীক বলা হবে। যেমন আলপনায় কয়েকটি বিশেষ অঙ্কনরীতি হল পদ্ম, ধান, সাপ, পেঁচাসহ নানান পাখি, লতাপাতা, কলা, গুয়া, সুপারি, কড়ি, মাছ, ময়ূর, ভ্রমর, প্রজাপতি, হাঁস, মৌচাক নৌকো, সূর্য, চন্দ্র, তারা, গোলাঘর, গরু-বাছুর ইত্যাদি। এই সমস্ত প্রতীকচিহ্নগুলোর কোনোটি পরিবেশ-পরিস্থিতির দ্যোতক; কোনোটি ফসলরূপে আহার্য, কোনোটি বাংলার চিরায়ত জৈব-বৈচিত্র্যের অপরিহার্য অঙ্গ, কোনোটিতে রয়েছে যৌন আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ।


আলপনায় প্রচলিত বহু চিহ্নের সংকেত অধুনা বিলুপ্ত হয়েছে। এসেছে নব-পরিবেশানুগ নবতর তাৎপর্য। এই বিলোপ এবং নবায়নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আলো-আঁধারির ইতিহাস। আলোচনায় আমরা আধুনিকতার মধ্যে আদিমতাকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করব। আলপনায় কখনই কোনো চিহ্ন-সংকেত অবিকল তার বাস্তবের প্রতিরূপ নয়। মানে সাপের হুবহু আদলের বদলে সর্পিল রেখা আঁকা হয়; পদ্মের প্রকৃত ছবির বদলে তার সাংকেতিক ছবি উপস্থাপন করা হয়; এক-দুটি রেখায় ফুটে ওঠে প্যাঁচার অবয়ব; দু-একটি টানেই মাছ আঁকা হয়ে যায়; কিন্তু কেন? শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ তাঁরবাংলার ব্রত‘, গ্রন্থে লিখছেন, তার কারণ শিল্পসৌন্দর্যে লোকসমাজের সীমাহীন অতৃপ্তি। অধ্যাপক মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায় অধ্যাপক কল্যাণ চক্রবর্তীর মতে, উদ্ভিদ প্রাণীর আদি সরলরূপ দর্শনই এর কারণ। এবং এই দেখা লোকস্মৃতিতে বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে এসে আলপনায় চিত্ররূপ পায়। আদিম মানুষ উদ্ভিদ প্রাণীর যে অবয়ব লক্ষ লক্ষ বছর আগে থেকে দেখে এসেছে, তা ছিল আজকের চাইতে অনেকাংশে সরলরূপ। এই সরলতার একককেই আবিষ্কার করার চেষ্টা করে এসেছে সৌন্দর্য-প্রিয় আদিম মানুষ। আলপনা সম্ভবত সবচাইতে প্রাচীন চিত্রকলার এক বিবর্তিত রূপ যেখানে অঙ্কনের মূল কাঠামোটি আবিষ্কারের চেষ্টা হয়েছে। তাই তার সব প্রতীকই সরলরূপে প্রতিভাত। হয়তো আদিম গুহাচিত্রের এক উজ্জ্বল ভৌমাঙ্কন। অজন্তা-ইলোরায় এরই সৌকর্য বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে দেয়ালে দেয়ালে।

আলপনার তন্বিষ্ঠ পাঠ করলে দেখা যাবে সেখানে পরিবেশিত চিহ্ন-সংকেতে পরিবেশ-ভাবনা কতটা গভীরভাবে ধরা দেয়। মাঘ-মণ্ডলের আলপনা, পুণ্যপুকুর ব্রতের আলপনাসহ নানান কামনাত্মক আলপনায় সূর্য-চন্দ্র-তারা-নদী-সমুদ্র-পর্বত-বনানী এবং জৈব-বৈচিত্র্যের সমাহারে যে সামগ্রিক চিত্র উপস্থাপিত হয়, তা লোকশিল্পীর চেনা-পরিচিত জগতের চিত্ররূপ। মানুষ যা দেখে তাই ভাবে, তাই আঁকা হয়ে ধরা দেয়।

বিয়ের আলপনায় মাছ এসেছে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে। বিধবারা মাছ খান না, কেননা তাদের সামাজিক অনুশাসনে সৌভাগ্য-রহিত করে রাখা হয়েছে। তাই বিয়ের আলপনাসহ নানান কামনাত্মক আলপনায় মাছের ব্যবহারের অর্থ দাঁড়ায় সিঁথির সিঁদুরকে অক্ষুণ্ণ রাখা। সাপ বংশবৃদ্ধির প্রতীক; সাপ বা সর্পিল রেখা অঙ্কনের অর্থ যৌনতার প্রকাশ, সন্তান উৎপাদনের আর্জি। কলার চিত্র আঁকা হয় পুরুষের যৌনাঙ্গের প্রকাশার্থে। সাপ সন্তান-উৎপাদনশীল নারীশক্তির প্রতীক। সাপের দুধ-কলার খাবার মিথ যতটা না বাস্তব, তার চাইতেও অধিক তার পরা-বাস্তবতা; লোকসমাজের ফার্টিলিটি-কাল্ট।

দেবী লক্ষ্মী যেহেতু পদ্মাসনা; তাই পদ্মের মাধ্যমে লক্ষ্মীকে অচলা করে রাখার প্রয়াস করেন বাংলার নারী। ধান, ধান-ছড়া, মরাই ইত্যাদি লক্ষ্মীর প্রতীক। আলপনায় কখনও বাঁকা, কখনও সরলরেখায় ধানের শীষ আঁকা হয়। ধানগাছ বাতাসের আন্দোলনে ঢেউ খেলে যায়, শস্যের ভারে নুয়ে পড়ে মাটিতে, ঝড়-বৃষ্টিতে শুয়ে পড়ে তার পাশকাঠি; ধানের এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই সম্ভবত আলপনায় ধানের শীষ আঁকা হয় বাঁকা বা লতানো ভাবে। সেঁজুতি ব্রতের আলপনায় সুপারিবাগান আঁকা হয়; পান-সুপারি স্বামী-সোহাগের প্রতীক, পেট ভরে খাবার পেলে তবেই শৃঙ্গারের সাধ জাগে নারীর হৃদয়ে, তখনই ঠোঁট লাল করে পান-সুপারি খান গৃহস্থ নারী; সেঁজুতি ব্রতে এমন স্বামী-সোহাগের জীবন কামনা করা হয় প্রতিনিয়ত।

বাংলাদেশের ফরিদপুর, বরিশালে তারা ব্রত হতো মাঘ মাসে। এটা হলো সূর্যের ব্রত। বাড়ির মেয়ে উপযুক্ত হলে এই ব্রত পালন করা হতো। যার মূল বক্তব্য ছিল, মেয়ের বর যেন সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়।মেয়েদের এই পুজোর আলপনায় থাকে একটা চাঁদমালা যার ওপরের অংশে সূর্য, তার নিচে নবমণ্ডল, সেখানে সপ্তর্ষি মণ্ডলের আদলে সাতটি বড় তারা, আর সবার নীচে অর্ধেক চাঁদ। উপরে বাঁ-দিকে মানুষের আদল ইন্দ্রকে বোঝাচ্ছে, ডান দিকে একটি পাল্কি যার অর্থ হল ইন্দ্র পাল্কি করে সূর্যকে নিয়ে আসবেন। নিচে আছে বরণডালা, গাড়ু, গামছা, গলার হার, কানের দুল ইত্যাদি। গোটা আলপনায় বর হিসেবে সূর্যকে বরণ করা, তার খাতির মহিলাদের সাজের উপকরণে একটা বিয়ের আবহ তৈরি হয়। যমপুকুর ব্রতের মাধ্যমে চলে মৃত্যুকে দূরে ঠেলে রাখার চেষ্টা। কিন্তু এই ব্রতগুলো এখন আর পৃথক ভাবে পালন করা হয় না। মূলত পৌষ-পার্বণের পূজা-আচ্চার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে এগুলোর ছড়া আলপনার নকশা।


পবলপুকুর ব্রত-এর মতো আলপনায় বটগাছ যেন প্রকৃতির সামীপ্য-সান্নিধ্যে থাকার আকুতি; তার সুপারি গাছ যেন আবাস সন্নিহিত সবুজ-পরতের মাথা উঁকি দিয়ে ধরা দেয়। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার ব্রততে পেঁচা যেন বাস্তবের ধানজমিতে ইঁদুরের আক্রমণ প্রতিহত করবে। কৃষিক্ষেত্রে ইঁদুর ভক্ষণ করে একসময় কৃষকের মন জয় করেছিল পেঁচা, তাই ধন্যবাদ দিতে পেঁচাই হয়ে উঠল ক্ষেত্রলক্ষ্মী, পরে দেবতার মানবী মূর্তিতে দেবী লক্ষ্মীর বাহন হয়ে উঠলো সেই পেঁচা-এক দীর্ঘ সাংস্কৃতিক-বিবর্তনের ইতিহাস; আলপনাতেও তারই লোকস্মৃতি।

কথায় বলে, ঘটে-পটে পূজা। সরাও তেমন একটি পট। লোকশিল্পের আরেকটি উল্লেখযোগ্য শিল্প হলো সরা। গোলাকার মাটির থালা যা দিয়ে বিভিন্ন পাত্র ঢাকা হয়, সেগুলোর ওপর লোকশিল্পীরা নানারকম ছবি আঁকতে শুরু করেন। সরার ওপর পটচিত্রের আদলে বিভিন্ন দেবদেবীর চিত্র অঙ্কন করা হয়। বিশেষত লক্ষ্মী, দুর্গা, মনসা সরা বিখ্যাত। সরার উৎপত্তি মূলত বাংলাদেশের ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল জেলায়। সরা তৈরি করেন কুম্ভকার, পাল সম্প্রদায়ের লোকেরা। বাংলাদেশের যশোর জেলার কুম্ভকাররা নানা আকৃতির সরা বানান। সরা খুব উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করেছে বাঙালির মনে। আবার চিত্রকর হিসাবে বরিশালের খলিশাকোটা অঞ্চলের নাম রয়েছে। ফরিদপুরের সুরেশ্বরী সরার বিশ্বে স্থান করে নিয়েছে রঙের বিন্যাস সরু রেখার জন্য। দেশভাগের পর কিছু সরাশিল্পী পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন এবং বিভিন্ন জায়গায় তারা ছড়িয়ে পড়েন। এরকম জায়গাগুলো হলো নদিয়া জেলার তাহেরপুর, পানিহাটি, সোদপুর, দত্তপুকুর ইত্যাদি।

লক্ষ্মী নারায়ণ ছাড়াও আঁকা হয় পেঁচা, যা ভালো ফসল উৎপাদনের প্রতীক। ছাড়া সরায় আঁকা হয় রাধা কৃষ্ণের মূর্তি, শিব পার্বতীর মূর্তি। ছাড়া মহরমে সরা আঁকা হয় ইসলামিক যোদ্ধা গাজীদের স্মরণ করে। সরা আঁকতে সাধারণত প্রাকৃতিক উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করা হয়। সরা তৈরী হলে পাম গাছের মাড় দিয়ে ওটার ওপর রঙ করা হয়। আজকাল ধর্মীয় অনুষঙ্গেও বাইরেও সরাচিত্র হচ্ছে যা বাড়ি সাজানোতে ব্যবহার করা হয়।

বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায় এই সরাকে। ফুল সরা, ঢাকনা সরা, মুপি সরা, ধূপ সরা, আম সরা, আয়ো সরা, তেলনি সরা, গাজী সরা, অন্তুর সরা, মহরম সরা। সরা আঁকারও বিভিন্ন শ্রেণি আছে। কয়েকটি বিখ্যাত শ্রেণি হল, গণকা সরা, সুরেশ্বরী সরা, এক লক্ষ্মী সরা, তিন পুতুল সরা, পাঁচ পুতুল সরা, জয়া বিজয়া সরা। এসবই আমাদের লোকশিল্প আর লোক থেকে উদ্ভূত শিল্পই লোক শিল্প। লোকশিল্প এককভাবে গড়ে ওঠে না। বহু বছরের গোষ্ঠী জীবনের যাপন থেকে তিল তিল করে উঠে আসে লোক শিল্প। যার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই তবে একে বহনের দায় লোক বা লোকগোষ্ঠীর আছে। কেননা কৃষ্টি বা লোক শিল্পই এক একটি জাতির পরিচয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //