দুর্লভ লেখা

মোতাহের হোসেন চৌধুরীর একটি প্রবন্ধ

বিশ শতকের ত্রিশের দশকে ঢাকায় ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ হয়। এই আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। তাদের চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের মুখপত্রের নাম ছিল শিখা। মুসলিম সাহিত্য সমাজ তাই ‘শিখাগোষ্ঠী’ হিসেবেও পরিচিত ছিল। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ছিল আমাদের সংস্কৃতির একটি বিবেকী ধারা। এ ধারারই অন্যতম চিন্তাশীল ব্যক্তি ছিলেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী।

১৯০৩ সালের ১ এপ্রিল নোয়াখালী জেলার কাঞ্চনপুর গ্রামে মোতাহের হোসেন চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। পিতা- সৈয়দ আবদুল মজিদ, মাতা- ফাতেমা খাতুন। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর মাতুলালয় কুমিল্লার দারোগাবাড়িতে কাটে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯২৫ সালে বিএ এবং ১৯৪২ সালে বহিরাগত ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পাস করেন। কিছুকাল মিলিটারি কন্ট্রাক্টরের কাজ করলেও কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু হয়। পরে তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপত্র পেয়েছিলেন; কিন্তু পারিবারিক কারণে যোগ দিতে পারেননি। কাজেই চট্টগ্রাম কলেজেই তাঁর পেশাগত জীবনের পুরোটাই কেটে যায়। এই কলেজেই তিনি আবুল ফজলকে (১৯০৩-১৯৮৩) বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন। ১৯৫৬ সনের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মোতাহের হোসেন চৌধুরী বেঁচেছিলেন মাত্র তেপ্পান্ন বছর। হয়তো এই কারণে, তাঁর লেখাপত্র যা পাওয়া যায়, তা পরিমাণে খুব সামান্যই। তবুও এই স্বল্প সময়ের মধ্যে এবং অল্প লেখাপত্রে তিনি যা রেখে গেছেন, তার মূল্য অসামান্য। তাঁর চিন্তাসাধনার কেন্দ্রে ছিল গভীর এক সংস্কৃতিবোধ। প্রেম, কল্যাণ ও সৌন্দর্যচেতনা সেই সংস্কৃতিবোধের প্রধান কথা। কল্যাণ ও সৌন্দর্যকে তিনি আলাদা করে দেখেননি। তাঁর দৃষ্টিতে ও-দুই-ই ছিল সমান, তথা এক। তাঁর চিন্তায় সৌন্দর্য হচ্ছে পরিমিতিবোধ এবং সুনীতিবোধ। তাঁর মতে, যে কাজ সৌন্দর্যবোধকে পীড়িত করে, তাই নীতিবিরুদ্ধ কাজ। সে জন্য সভ্য মানুষের আরব্ধ কাজ হওয়া উচিত সৌন্দর্য-সাধনা- যার প্রকাশ দেখা যাবে আচারে, ব্যবহারে ও প্রতিদিনের কর্মে। সৌন্দর্যবোধ যে মানুষকে সব রকম ক্ষুদ্রতা, নিচুতা, হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি কুৎসিত চিন্তা থেকে বিরত রাখে- এ বিশ্বাসকে তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে জীবনে লালন করেছিলেন। সুন্দরের উদাহরণ সব সময় চোখের সামনে থাকলে অজ্ঞাতসারে মানুষের রুচি মার্জিত ও উন্নত হয়- এরকম তাঁর মনে হয়েছে।

জীবনে ও সমাজে এই বিশ্বাস কীভাবে বিস্তার লাভ করবে এমন প্রশ্নের উত্তরে মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেন, এর জন্য চাই যুক্তিবিচার ও মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, নিকটবর্তী স্থূল সুখের চেয়ে দূরবর্তী সূক্ষ্ম সুখকে, আরামের চেয়ে সৌন্দর্যকে, লাভজনক যন্ত্রবিদ্যার চেয়ে শিক্ষা ও আনন্দপ্রদ সুকুমার বিদ্যাকে শ্রেষ্ঠ মনে করা, [এবং তাদের জন্য প্রতীক্ষা করতে শেখা]- এসবই মূল্যবোধের নিদর্শন, আর এসবের অভাবই মূল্যবোধের অভাব, যুক্তিবিচারের প্রভুত্ব বলতে বোঝায় জীবনের সব ব্যাপারকে বিচারবুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবার প্রবণতা। যুক্তিবিচার সবার মধ্যেই কিছু না-কিছু থাকে; কিন্তু এই সাধারণভাবে থাকা নয়, বিশেষ ও ব্যাপকভাবে থাকার কথাই বলা হচ্ছে। এ যুক্তি যেন যুক্তিবিচারের পূজা, কার্যসিদ্ধির জন্য তার নামমাত্র ব্যবহার নয়। বিচার-বুদ্ধির যত বেশি প্রতিষ্ঠা সমাজ তথা সভ্যতারও তত বেশি উন্নতি।

তাঁর রচিত তিনটি বইতে উল্লিখিত মতামতের আলোচনা আবর্তিত হতে দেখা যায়। এটাকে তাঁর জীবন-জিজ্ঞাসা বলায় ক্ষতি নেই। যে তিনটি বইতে তাঁর এই জীবন-জিজ্ঞাসা উদ্ভাসিত হতে দেখা যায়, তা হচ্ছে সংস্কৃতি-কথা (১৩৬৫), সভ্যতা (১৩৭২) ও সুখ (১৩৭৫)। তাঁর মৃত্যুর পরে বই তিনটি প্রকাশিত হয়। শেষোক্ত বই দুটি ইংরেজি ভাষায় লেখা দুটি গ্রন্থকে অবলম্বন করে রচিত। ব্রিটিশ নন্দনতাত্ত্বিক ক্লাইভ বেল (১৮৮১-১৯৬৪)-এর ঞযব ঈরারষরুধঃরড়হ অবলম্বনে রচিত হয় সভ্যতা, আর ইংরেজ দার্শিনিক বার্ট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯১৯৭০)-এর The Conquest of Happiness অবলম্বনে সুখ।

মোতাহের হোসেন চৌধুরীর প্রায় সমস্ত লেখা সংকলিত হয় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত এক খণ্ড বইতে, মোতাহের হোসেন চৌধুরী রচনাবলি (১৯৯৫) শিরোনামে। এই সংগ্রহের সম্পাদক ছিলেন সম্প্রতি প্রয়াত সৈয়দ আবুল মকসুদ। তাঁর বিস্তর পরিশ্রম-লব্ধ সংগ্রহ সত্ত্বেও এই সংকলনের বাইরেও কিছু লেখা থেকে গিয়েছিল। গান, কবিতা, প্রবন্ধ ও চিঠিপত্র মিলে তার একটা বড় অংশ মুদ্রিত হয় আমার সম্পাদিত সংস্কৃতি-সাধক মোতাহের হোসেন চৌধুরী (২০০৬) বইতে। মজার ব্যাপার, আমার এই বই প্রকাশিত হবার পরেও কোনো কোনো পত্রিকায় দেখা যায় তাঁর আরও রচনা অগ্রন্থিত রয়ে গেছে! ‘আমাদের সাহিত্যিক দৈন্য’ তেমনি একটি সুন্দর রচনা। বলেছি, মোতাহের হোসেন চৌধুরী লিখেছিলেন কম; কিন্তু যা লিখেছেন, তাতেই পাওয়া যায় তাঁর চিন্তা ও মননের এক অনিন্দ্য সুন্দর প্রকাশ। তাঁর কোনো-একটি লেখাও হেলাফেলা করবার মতো নয়। লেখা ছিল তাঁর কাছে প্রার্থনার মতো আরাধনা বিশেষ। লেখাটাকে তিনি নিয়েছিলেন জীবনের কেন্দ্রীয় সত্যের প্রকাশ হিসেবে। এ জন্য দেখা যায়, তিনি যা রচনা করেছিলেন, তা হয়ে উঠেছে পাঠকের জন্য এক অস্বাদযোগ্য উপাদান। মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে এ এক অতুলনীয় সম্পদ, যেমন সুন্দর, তেমনি নির্ভরযোগ্য।

‘আমাদের সাহিত্যিক দৈন্য’ লেখাটায় তিনি আমাদের একটি বিশেষ মানসিক দুর্বলতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। হিন্দু-মুসলিম যুক্তসাধনার কালে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, হিন্দু-মানস বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলছে সাহিত্যের যে-বিপুল সম্পদ, মুসলিম সমাজ তার থেকে হয়েছেন বঞ্চিত। তার একটা কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন, মুসলিম সমাজ তার সমস্ত মনোভাব প্রকাশের জন্য উপযুক্ত ভাষা নির্বাচন করতে দ্বিধান্বিত থেকেছে! বাংলা ভাষা যে তার মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা, যে ভাষা না হলে তার এক মুহূর্ত চলে না, মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেন, এই মৌল সত্যে তার দ্বিধা কিছুতেই যেতে চায়নি! ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের পরে এটা আরও আত্মঘাতী রূপ নেয় বলে তিনি জানিয়েছেন। কারণ তৎকালীন শাসকশ্রেণি যেমন, তেমনি বাঙালি জাতির একটা বিশেষ শক্তিমন্ত গোষ্ঠী বাংলা ভাষা ব্যাপারে বিতর্ক তৈরি করেন। তাঁরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে তৎপরতা দেখিয়েছেন! এটা যে আত্মঘাতী চিন্তা, তা তাঁরা শাসকশ্রেণির দৃষ্টি দিয়ে দেখার ফলে বুঝতে ভুল করেছেন! তাঁরা বাংলা ভাষাকে বাতিল করে দিয়ে উর্দুর আশ্রয় কামনা করেছিলেন। ভাষার ব্যাপারে এই যে দ্বিধা, মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেন, ফলে তাঁদের পক্ষে সাহিত্যের যথার্থ সাধনা সম্ভব হয়নি! এখানেই বাঙালি অর্থাৎ ‘আমাদের সাহিত্যিক দৈন্য’।

মোতাহের হোসেন চৌধুরীর বর্তমান রচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল তৎকালীন তরুণপত্র নামের সাময়িক পত্রিকার বৈশাখ ১৩৩৪ সনের প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যায়। বাংলা ভাষার দুর্বলতা আজও আমাদের কাটেনি। সেই দুর্বলতা হচ্ছে এ ভাষার চিন্তার দৈন্য, মননের দৈন্য! এই দৈন্য-অতিক্রমী বিবেচনা বর্তমান রচনাটির এক গুরুত্বপূর্ণ ভাববস্তু, তা নিঃসন্দেহ। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এ রচনা মোতাহের হোসেন চৌধুরীর রচনা-সংগ্রহে স্থান পাবে। আজকের পাঠকের সামনে নতুন করে এই লেখার মাধ্যমে তাঁর অসাধারণ সৌন্দর্য-দৃষ্টি ও চিন্তাশীলতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য লেখাটি পুনর্মুদ্রিত করা হলো। বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।

আমাদের সাহিত্যিক দৈন্য
মোতাহের হোসেন চৌধুরী


একটা জাতি উন্নত ব’লে পরিচিত হয় তার মন দিয়ে, তার ধন দিয়ে নয়। বাঙালীর মন সমগ্র পৃথিবীর নিকট হ’তে যে শ্রদ্ধা আদায় করতে পেরেছে মাড়োয়ারীর টাকার তোড়া তার দশ ভাগের এক ভাগও আদায় করতে পারেনি। তার কারণ হচ্ছে এই যে, ধনের প্রাচুর্য্য শুধু মানুষের ঈর্ষা ও বিস্ময় পয়দা করতে পারে, কিন্তু শ্রদ্ধা উদ্রেক করতে পারে একমাত্র মানুষের মনের ঐশ্বর্য্যই।

এখানে প্রশ্ন হবে,- মনের ঐশ্বর্য্যে কোন জাতি কত সম্পদশালী তার জানবার উপায় কি? মানুষের মন তো ‘বে-চু-বে-নমুনা’, সেতো সম্পূর্ণরূপে আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তাকে মাপ দেওয়া যায় কি করে?

উত্তরে বল্ব, সাহিত্যের মধ্যেই মানুষের মন প্রতিফলিত হয়, যখন কোন লেখকের লেখা পাঠ করে থাকি তখন তার মধ্যে লেখকের মনটিকেই প্রকটিত দেখতে পাই। সুতরাং সাহিত্যের দ্বারাই মানুষের অথবা জাতির উন্নতির পরিমাণ করা যায়। যে জাতির সাহিত্য যত সম্পদশালী সে জাতি পৃথিবীতে তত উন্নত বলে পরিচিত। সাদী, রুমী ও ওমর খৈরাম প্রমুখ কবিগণের জন্মভূমি বলে আজো সভ্য দুনিয়া ইরাণের নিকট শ্রদ্ধায় মাথা নত করছে। কালীদাস, বাল্মীকির জন্মস্থান বলে ভারতবর্ষ আজো সকলের সম্মার্নহ হয়ে আছে। আরবী সাহিত্যের জ্ঞান-সম্ভাবের জন্য আজো আরবের অতীত গৌরব গাঁথা দিকে দিকে ঘোষিত হচ্ছে।

এহেন সাহিত্যের দিক দিয়ে বাঙালী মুসলমান যে কত পিছনে পড়ে আছে তা ভাবতে গেলে গা শিউরে উঠে। মধুসূদনের আমল থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত হিন্দু-বাঙলা যে কত প্রতিভাবান সাহিত্যিকের জন্ম দিলো তা হাতের আঙ্গুলে গুণে শেষ করা যায় না। কিন্তু আমাদের নিভৃত মুসলিম বাঙলা এমন একটা শক্তিশালী লেখকেরও জন্ম দিলো না যার নাম করে আমরা বিশ্বের দরবারে বড়াই করতে পারি। আমরা শুধু আমাদের অতীত মনস্বীদের গর্ব করেই বেড়াচ্ছি, বর্তমানের নিস্বতার জন্য মোটেই লজ্জা অনুভব করছিনে। পূর্বপুরুষের দেওয়া জিনিস রক্ষা না করে খুইয়ে বসেছি বলে যে আমরা দিন দিন তাঁদের কর্তৃক অভিশপ্ত হচ্ছি, সে কথাটা আমাদের মনেই নেই।

আমাদের এই সাহিত্যিক দৈন্যের কারণটা অনেকেই অশিক্ষার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চান। কিন্তু আমরা তা মেনে নিতে পারিনে। কারণ বিদ্যাসাগরের আমল থেকে শুরু করে স্বদেশীযুগ পর্য্যন্ত বাংলা যে তার চাইতে কিছু কম শিক্ষিত তা আমরা মনে করিনে। অথচ তখনকার দিনে হিন্দুরা যতটুকু সাহিত্য প্রীতির পরিচয় দিয়েছিল আজকার দিনের মুসলমানরা যে ততটুকু প্রীতির পরিচয় দিচ্ছে তা মনে হচ্ছে না। আসল কথা হচ্ছে এই যে, শিক্ষা আমাদের হচ্ছে ঠিক, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা মোটেই হচ্ছে না। শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মনের বিকাশ সাধন করা। কিন্তু বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল হতে এই যে গ্রাজুয়েটস ও এম. এ ডিগ্রীধারীর দল Manufactured হয়ে আসছে তাদের কজনের যে মনের বিকাশ সাধন হল তা আমরা মোটেই টের পাচ্ছিনে। কারণ তারা নিজেই তাদের পরিচয় দিচ্ছে না। মনের বিকাশ সাধন হয় তখনই যখন মানুষ উদার ও সংযত হয়ে সমস্ত বিশ্বের ও নিজের উন্নতির কথা ভাবতে শেখে, যখন সে সমস্ত বিশ্বকে আপনার অন্তরের আনন্দ দ্বারা মণ্ডিত দেখে। কিন্তু কই, এমন কাউকে তো আমাদের মধ্যে দেখছি বলে মনে হচ্ছে না। শিক্ষাকে আমরা কেবল একটা অর্থকরী উপায় হিসাবেই ধরে নিয়েছি। কতগুলি কেতাব মুখন্ত করে কোন প্রকারে একটা ডিগ্রী নেওয়াই হচ্ছে আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। কারণ, আমরা জানি এ ডিগ্রীটাই কোন প্রকার আমাদের জীবিকানির্বাহের একটা উপায় করে দিতে পারে।

শিক্ষাটা প্রকৃত হলে সাহিত্যের প্রতি আমাদের একটা দুর্দমনীয় স্পৃহা বেড়ে যেত আর সঙ্গে সঙ্গে আমরা এমন কতগুলি প্রতিভাবান লেখকের সাক্ষাত পেতাম যারা কোন দিক দিয়েই আমাদের প্রতিবেশী সাহিত্যিকদের চাইতে হীন হতেন না। কিন্তু আমাদের সে ধরনের শিক্ষা হয়নি। তাই লেখাপড়া করেও আমরা যে তিমিরে সে তিমিরেই আছি। আজ পর্য্যন্ত আমরা কোন প্রকার চিন্তাশীলতারই পরিচয় দিতে পারিনি। অশিক্ষার যুগে বরং ছিল ভালো। কারণ, তখন আমরা আলওয়াল, হামজা প্রমুখ কতিপয় কবিকে পেয়েছিলাম। তাঁরা তাঁদের সমসামরিক হিন্দু কবিগণের সাথে সমান তালে পা ফেলে চলে ছিলেন। কিন্তু শিক্ষার যুগে আমরা সাহিত্যের প্রতি একটা অবজ্ঞা ভাবই প্রকাশ করে আসছি। আমাদের তরুণদের কেউ কেউ হয়তো তাকে মমতার চক্ষে দেখছেন, কিন্তু আমাদের প্রবীনদের অনেকেই সাহিত্যের আবশ্যকতা সম্বন্ধেই সন্দিহান। তাঁরা সাহিত্য চর্চাকে ছেলেখেলার মতই হেলা করে থাকেন।
এই সাহিত্যিক দৈন্য আরো দ্বিগুনিত হয়েছে আমাদের  ভাষা সমস্যার দ্বারা। আমরা সাহিত্য সৃষ্টি করব কি, সাহিত্যের বাহন যে কি হবে তাই এখনো আমাদের ঠিক হয়নি। ভাবের সুপ্রকাশের জন্ম মাতৃভাষাই যে সহজ এবং শ্রেষ্ঠতম উপায় একথা বলা নিষ্প্রয়োজন। কথায় বলে-
নানান দেশের নানান ভাষা
বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা

সুতরাং অন্য সব দেশের মত মাতৃভাষাই আমাদের সাহিত্যের বাহন হওয়া উচিত। কিন্তু মুশকেল হচ্ছে এই যে মাতৃভাষাটা যে আমাদের কি তা নিয়ে এখনো তর্ক চলছে। যদি কেউ আমাদের জিজ্ঞেস করে, পৃথিবীর সবচাইতে বিস্ময়কর ব্যাপার কি তা হলে আমি বলব, বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষা-নির্বাচন-সমস্যা। কারণ বোধ হয় পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এরূপ ঘটনা ঘটেনি। মাতৃভাষাটা এক প্রকার খোদার দেওয়া জিনিস; তা নিয়ে কোন তর্কই চলেনা। ছেলেবেলা মার মুখে শুনে শুনে যে ভাষা শেখা হয় তা-ই হচ্ছে মানুষের মাতৃভাষা। তা হলে দেখা যাবে বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষা বাঙলাই। কারণ, এ ভাষাতেই তাদের শতকরা প্রায় ৯৫ জন প্রথম মুখ খুলে থাকে। কিন্তু অনেক অতি চালাক নেতাশ্রেণীর লোক বাঙলার পরিবর্ত্তে উর্দ্দুকেই মাতৃভাষা রূপে চালিয়ে নিতে চান। এখানে যে তাঁরা খোদার উপর খোদকারী করছেন এ কথা ভুলেই যাচ্ছেন। আশ্চর্য্যরে বিষয় এই যে, যাঁরা চাকরী সমস্যার বেলা শতকরা ৫৫’র দোহাই পেড়ে থাকেন তারাই ভাষা সমস্যার বেলা শতকরা ৯৫’র দাবীকে নাকচ করে শতকরা ৫’এর দাবীকে বহাল রাখতে চেষ্টা করছেন। তাঁদের এই ঘন ঘন মত পরিবর্তনটা মোটেই মানানসই হচ্ছেনা। অবশ্য তাঁরা যদি সুবিধাবাদী দলের হয়ে থাকেন তো ভিন্ন কথা।

যে তিনটি কারণে তারা বাঙলাকে মাতৃভাষা করতে নারাজ সে তিনটি কারণ নিম্নে দেওয়া যাচ্ছে।
১) বাঙলা ভাষায় এমন কিছু নেই যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। সুতরাং এ আমাদের মাতৃভাষা হবার অযোগ্য।
২) বাঙলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা অতএব বাঙলা জানতে হলেই সংস্কৃত জানা দরকার। কিন্তু মুসলমানেরা প্রায়ই সংস্কৃত পড়ে না, আর তাদের তা পড়াও উচিত নয়। সুতরাং বাঙলা বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষা হতে পারেনা।
৩) মুসলমান যে দেশবাসীই হোক না কেন, তার মাতৃভাষাটি এমন হওয়া উচিত যা সমস্ত মুসলিম জগত বুঝতে পারে। কিন্তু বাঙলা ভাষা তেমনটি নয়, সুতরাং বাঙলাকে বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষা করা অসম্ভব।

কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বুঝা যাবে যে প্রথমটি ব্যতীত উপরোক্ত প্রত্যেকটি কারণই অসত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। একের পর এক তা-ই আমরা প্রমাণিত করছি।

প্রথমতঃ বাঙলা ভাষা যে মুসলমানি ভাবে পরিপূর্ণ নয় সে তার দোষ নয়, দোষ আমাদের। আমাদের সেকালের পূর্বপুরুষগণ তার প্রতি যে অনুরাগ ও সহানুভূতি প্রদর্শন করে গেছেন আমরা যদি তা আজ পর্য্যন্ত বজায় রাখতে পারতাম তা হলে আর এমন হ’তনা। এ ভাষায় যে আমাদের কিছু গৌরব করবার নেই এ কথা সম্পূর্ণ সত্য নয়। তার জন্মদাতা রূপে না হোক, অন্ততঃ উৎসাহ ও অনুগ্রহ দাতা রূপে আমরা যথেষ্ট গৌরব করতে পারি।

দ্বিতীয়তঃ বাঙলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা; এ কথা ঠিক নয়। মহামহোপধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বলছেন ‘সংস্কৃত বাঙালার অতি-অতি-অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহী’। অর্থাৎ বলিতে গেলে সংস্কৃতের সহিত বাঙলার কোন সম্পর্ক নাই। প্রাথমিক যুগের বাঙলা ভাষার আলোচনা করলেই এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে। তখনকার বাঙলা ছিল বাঙালীর প্রাণের ভাষা, অর্থাৎ কিনা তখন লোকেরা যে ভাষার কথা বলতে কোন কিছু লিখিবার দরকার হলে সে ভাষারই আশ্রয় নিত। তখনকার বাঙলা হিন্দুর একচেটিয়া সম্পত্তি ছিল না। মুসলমান সে বাঙলায় যথেষ্ট লেখা রেখে গেছেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ই এ ভাষার ধারা বদলিয়ে তাকে সংস্কৃতানুগ করে তুলেন। এর পর থেকেই মুসলমানগণ এ ভাষার চর্চ্চা ছেড়ে দেন এবং তখন হতেই মুসলমানের সাহিত্যিক দুর্দ্দিন শুরু হয়। যাক, সৌভাগ্যের কথা এই যে রবীন্দ্রনাথ বাঙলা ভাষার সত্যিকার চেহারিটি ধরতে পেরে তাকে সম্পূর্ণ নতুন করে গড়ে নিচ্ছেন। তাঁর গড়া ভাষা কোন সম্প্রদায় বিশেষের নয়, সমগ্র বাঙালী জাতির। এ ভাষার মুসলমানরাও কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে পারেন ও করছেন। সুতরাং সংস্কৃত বাহুল্যের অছিলায় একে বর্জ্জন করা চলেনা।

তৃতীয়তঃ কোন দেশের মুসলমানেরই মাতৃভাষা এমন নয় যা সমগ্র মুসলিম জগত বুঝতে পারে। কাবুলী তার কাবুলী ভাষার চর্চ্চা করছে, কিন্তু সে ভাষা সমগ্র মুসলিম জগতের বোধগম্য নয়। ইরাণী ফারসীর সেবা করছে; সে ভাষা সকল দেশের মুসলমানরা বুঝতে পারে না। চৈনিক মুসলমানরা চীনা ভাষায় আলোচনা করছে, সে ভাষাও পৃথিবীর অন্যান্য মুসলমানদের সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ কেউ মনে করে থাকেন উর্দ্দু ভাষা সকল দেশের মুসলমানেরই বোধগম্য; কিন্তু এ কথাটি যে ঠিক নয় তা এবারকার মক্কা কনফারেনসেই প্রমাণিত হয়ে গেছে। যদি উর্দ্দুর এ গুণ থাকতো তা হলে আর মহম্মদ আলী সাহেবকে সেখানে ইংরেজীতে বক্তৃতা দিয়ে অপদস্ত হতে হতনা। এমনি করে একটির পর একটি পরীক্ষা করে দেখলে দেখা যাবে যে, কোন দেশবাসী মুসলমানের মাতৃভাষাই সমগ্র মুসলিম জগতের বোধগম্য নয়। তবে আমরা বাঙালী মুসলমানরা কেন, বাংলাভাষা সমগ্র মুসলিম জগতের লোকেরা বুঝতে পারে না, এ অজুহাতে তার চর্চ্চা বন্ধ করব? ভাষার ঐক্যের আবশ্যকতা হচ্ছে সকল দেশের মুসলমানের মধ্যে ভাবের আদান প্রদানের সুবিধার জন্য। তা করা যেতে পারে রাজ-ভাষা ও মাতৃ-ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম্ম ভাষা রূপে আরবী চর্চ্চা করলে। দেশ কাল ভেদে রাজ-ভাষা ও মাতৃ-ভাষা বিভিন্ন হতে পারে, কিন্তু ধর্ম্ম-ভাষা সকল দেশে ও সকল কালে একই থাকবে। যদি আরবীকে আমাদের তিনটি অবশ্য শিক্ষনীয় ভাষার অন্যতম বলে গ্রহণ করি তা হলেই বিশ্ব-মুসলিম-মিলন সাধন হবে, নতুবা নয়।

এই মাতৃভাষা নির্বাচন সমস্যা আমাদের যে কি অনিষ্ট সাধন করছে তা আর কথায় ব্যক্ত করা যাচ্ছে না। যদি আমরা বাঙলাকেই মাতৃভাষা রূপে গ্রহণ করতাম তা হলে আর আমাদেরও দুর্দ্দশা খটতনা। তবে আমাদের নিরাশ হবারও কারণ নেই। মাতৃভাষা নিয়ে তর্ক চলা সত্ত্বেও অধিকাংশ লোকেই বাঙলাকে মাতৃভাষা রূপে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং অন্যথায় কালের মধ্যেই বাঙলা সাহিত্যের যৎকিঞ্চিত ভাবে একটা ইসলামিক সাড়া আনতে পেরেছেন।

ইতি মধ্যেই আমাদের সমাজে কতিপয় শক্তিশালী সাহিত্যিকের সাক্ষাত পেয়েছি। কবিতার দিক দিয়ে কাজী নজরুল, গোলাম মোস্তফা ও শাহাদাৎ হোসেন প্রমুখ কবিগণ প্রভূত শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। অন্য সাহিত্যে অধ্যাপক শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক কাজী আবদুল ওদুদ, অধ্যাপক আবুল হোসেন, ডিপুটি বরকতউল্লাহ, ইয়াকুব আলী চৌধুরী ও ডাঃ লুৎফর রহমান সাহেবান তাঁদের মৌলিক জ্ঞানগর্ভ রচনার দ্বারা বাঙলা সাহিত্যে একটা স্থায়ী আসন দখল করে নিয়েছেন।

আমরা এস ওয়াজেদ আলী সাহেবের সাহিত্যিক স্পৃহ্য দেখে আশ্চর্য্য ও আনন্দিত হচ্ছি। মুসলমান ইংরেজী শিক্ষিতেরা বিশেষ করে বিলেত ফেরতারা স্বাভবতঃই বাঙলা ভাষাকে হেয় মনে করে থাকেন, কিন্তু ওয়াজেদ আলী সাহেব যে তাকে দস্তর মত প্রাণ ভরে ভালো বাসছেন এ জন্য তিনি ধন্যবাদার্হ। আশা করি তাঁর সাহিত্য প্রীতি আমাদের শিক্ষিত তরুণদের আদর্শ হবে।

রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে কাজী নজরুলই বাঙলার শ্রেষ্ঠ কবি। অবশ্য তাঁর নাম শুনলে আমাদের অনেকেরই গাত্র দাহ শুরু হয়। তা হবারই কথা। এ বাঁধন ভরা সমাজে হারার স্থান হবে কেন? প্রতিভাবানরা প্রায়ই একটু মুক্তিকামী হতে থাকে। তাঁরা সব সময় সকল বাঁধনের ধার ধরে চলতে পারে না। আমাদের সমাজে প্রতিভাবানের কদর নেই। তাই মুক্তিকামী কাজী নজরুল যখন বাঁধনহারা ভাবে চলতে শুরু করলেন তখন প্রথমই তাকে আমরা টিটকিরি দিয়ে অতিষ্ট করে তুল্লেম। ফল হল এই যে তিনি একদিন আমাদিগকে টিটকিরি দিয়ে চলে গেলেন। যদি তার দোষ গুলি আমরা একটু স্নেহের চক্ষে দেখতেম তা হলে এমন হত কিনা সন্দেহ।

যাক, অদূর ভবিষ্যতে বাঙলা সাহিত্য একদিন মুলমানের দানে গৌরবান্বিত হয়ে উঠবে। তখন শুধু হিন্দুরা নয় মুলমানরাও বাঙলা সাহিত্যের ঐশ্বর্য্যে গর্ব্ব করতে পারবে। তাই কবির সুরে সুর মিলিয়ে বলছি,
সেদিন আকাশে নতুন তপণ
নতুন জীবন করিবে বপন
এনহে কাহিনী এনহে স্বপন
আসিবে সেদিন আসিবে।  

সংগ্রাহক ও ভূমিকা : মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //