বাংলাদেশে রাষ্ট্র সংক্রান্ত আলোচনা

বাংলাদেশে রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা খুবই সাম্প্রতিককালের। রাজনীতি, রাষ্ট্র, ক্ষমতা, আইন, শাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে বাংলাদেশে ধারণা প্রায় শূন্যের কোঠায়। এমনকি বাংলা ভাষাতে রাষ্ট্র নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক, ব্যবহারিক বা পর্যালোচনামূলক লেখা পাওয়া কঠিন। অথচ আমরা একটি স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছি। আমাদের মধ্যে বিপুল আবেগ কাজ করেছে, কিন্তু তার কোনো ঐতিহাসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক তাৎপর্য অনুধাবন করার প্রয়োজনীয়তা আমরা বোধ করিনি।

ফলে তথাকথিত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ একটা চিরায়ত ও ‘আবহমান’ পরিচয়ের মধ্যে খাবি খেয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাস হয়ে গিয়েছে ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। বাঙালি জাতিবাদকে দাঁড় করানো হয়েছে ইসলামের বিপরীতে। এটাই দাবি করা হয়েছে যে ‘বাঙালি’ হওয়ার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নাই। ধর্মের সঙ্গে জ্ঞানতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বোঝাপড়ার কোনো দরকার নাই। 

সংকীর্ণ বাঙালি জাতিবাদী উগ্রতার বাইরে একাত্তরের যুদ্ধ আজ অবধি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে কোনো জ্ঞানতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়নি। অথচ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে আমাদের প্রস্থানবিন্দু। একাত্তরই নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে আমাদের জন্মের নাভি এবং আগামী দিনে বিশ্ব সভায় শক্তিশালী জায়গা আদায় করে নেওয়ার প্রধান ক্ষেত্র। উপমহাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের ছেদবিন্দুও একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ।

নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে আমাদের রক্তস্নাত আবির্ভাবের পরও রাজনীতি, রাষ্ট্র, ক্ষমতা, আইন, শাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তার অক্ষমতা প্রকট। আমরা ইতিহাস সচেতন নই। ইতিহাস খুঁজতে কিংবা লিখতেও জানি না। সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হচ্ছে বর্তমান বা দৃশ্যমান সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতেও শিখিনি। অতীত ঘটনা ঘটনের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং ঐতিহাসিক বিচারে আমরা যেমন অক্ষম ঠিক তেমনই আমরা অদূরদর্শী।

অর্থাৎ আমাদের কর্মকাণ্ডের ফলে কিভাবে জনগণ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় সে ব্যাপারে আমাদের কোনো হুঁশ নাই। জাতিবাদের যুগে একদিকে গড়ে উঠেছে বাঙালি জাতিবাদ আর তার বিপরীতে গড়ে উঠেছে ধর্মীয় জাতিবাদ। উভয়ে একই জাতিবাদী মুদ্রার দুই পিঠ মাত্র। এই বিভাজন তীব্র করা ও জারি রাখার কারণে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শুধু নয়, উপমহাদেশে আমাদের অবস্থান কী দাঁড়াবে কিংবা পরাশক্তিসমূহকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে বিভক্তি আমাদের আরও দুর্বল করে ফেলবে কিনা-সেই সকল বাস্তবোচিত বিবেচনা আমাদের মধ্যে কাজ করে না। 

প্রাচীন ট্রাইবাল বা গোষ্ঠীতান্ত্রিক মানসিকতা আমাদের মধ্যে প্রবল। নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণ্ডির বাইরে আমরা বের হয়ে আসতে পারি না। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে নিজেদের উপলব্ধি করা দূরের ব্যাপার সমাজ যে আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ট্রাইবাল গণ্ডির চেয়ে আরও বৃহৎ বিষয় সেই বোধ আমাদের এখনো তৈরি হয়নি। পাড়ার মস্তান বা ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে হানাহানি যেমন-তেমনি মূল বিষয় বাদ নিয়ে আমরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে হানাহানি করতে পছন্দ করি। ফলে আমাদের নিজেদের মধ্যে বিবাদ বা বিসংবাদ আমরা কথোপকথনের মধ্য দিয়ে কখনোই মেটাতে পারি না। তাছাড়া সামষ্টিক বা সামাজিকভাবে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হয়ে যখন আমাদের আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিস্থিতিতে লড়বার কথা তখন আমরা কাপুরুষ বনে যাই। 

বিভাজন, বিভক্তি ও মতাদর্শিক পশ্চাৎপদতার কারণে বাংলাদেশে আমরা কার্যত একটা গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি জারি রেখেছি। গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখা আমাদের সবচেয়ে দুর্বল ও ভয়ংকর বিপদের জায়গা। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ও ‘বাঙালি জাতিবাদ’ মূলত ধরে নিয়েছে আমরা এখনো অখণ্ড পাকিস্তানে বাস করছি এবং এখনো যুদ্ধ চলছে। কিংবা ভাষা ও সংস্কৃতি বনাম ধর্মের মধ্যে গৃহযুদ্ধ জারি রয়েছে।

রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে বাংলাদেশের জনগণের আত্মিক ও রাজনৈতিক পরিগঠনের যে সকল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শর্ত তৈরির দরকার ছিল, আমরা তা করিনি। যে গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি সেটা সম্ভব হয়েছে দিল্লির অধীনস্থতা বা পরাধীনতা মেনে নিয়ে দিল্লির ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা এবং উপমহাদেশ থেকে হিন্দুত্ববাদীদের ইসলাম নির্মূল কর্মসূচির দরকারে। বাংলাদেশে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের যে চরিত্র তার কারণে আমরা ই গঠনমূলকভাবে রাজনীতি ও রাষ্ট্র নিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার ধারা তৈরি করতে পারিনি।

রাষ্ট্র নিয়ে সম্যক আলোচনা শুরু হবার পরিস্থিতি তৈরি হয় আশির দশকের শুরুর দিকে। এর আগে স্বাধীনতা অর্জন ও নিজেদের নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে ‘গঠন’ করবার কাজ যে সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন কাজ সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের বিরুদ্ধে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০-১৪ জুলাই ২০১৯) সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান।

এরশাদ ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিশাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই প্রথম বাংলাদেশের জনগণ বুঝতে শুরু করল আমরা যদি আসলেই পাকিস্তানের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরাস্ত করে থাকি তাহলে পাকিস্তান আমলের মতো আবার সামরিক শাসন এলো কিভাবে? তখন থেকে আমরা অল্প অল্প সচেতন হওয়া শুরু করি যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি বটে, কিন্তু রাষ্ট্র কী জিনিস এবং কিভাবে তা গঠন করতে হয় সে ব্যাপারে আমাদের কোনো ধারণা নাই। স্বাধীনতা অর্জন মানে বাইরের চিহ্নিত শত্রুকে পরাজিত করা এবং পরাধীনতা থেকে মুক্ত হওয়া। কিন্তু স্বাধীন ও সার্বভৌম জনগোষ্ঠী হিশাবে কিভাবে নিজেদের ‘গঠন’ করতে হয়, সে সম্পর্কে আমরা যারপরনাই অজ্ঞ। 

মনে রাখা দরকার, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় ছুটিতে রংপুরে ছিলেন। বিস্ময়কর যে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। এরপর ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে আটকে পড়া বাঙালিদের সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন। এরশাদ নিজেকে ১৯৮৩ সালে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এবং ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। মনে রাখতে হবে যুদ্ধের সময় এরশাদ পাকিস্তানে আটকা পড়েননি, স্বেচ্ছায় ছুটি কাটিয়ে পাকিস্তানে ফিরে গিয়েছিলেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। 

এই ধরনের একজন ব্যক্তির এত সহজে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে যেতে পারা আমাদের রাজনৈতিক চেতনার মাত্রা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনা অফিসার ও সৈনিকদের সঙ্গে পাকিস্তান ফেরত অফিসার ও সৈনিকদের দ্বন্দ্ব। এরই পরিণতিতে আমরা একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান দেখেছি, সামরিক অফিসারদের বিরুদ্ধে সাধারণ সৈনিকদের বিদ্রোহ দেখেছি, ৭ই নভেম্বর দেখেছি।


আমরা আমাদের চোখের সামনেই একের পর এক স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অফিসার ও সৈনিকদের হত্যা, ফাঁসি বা অপসারণ দেখেছি। শেষে দেখলাম ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ড। এত সব বড় বড় ঘটনা ঘটে যাবার পরও আমাদের হুঁশ হচ্ছে না, কোথায় আমরা ভুল করেছি। কোন কাজটি আমরা করিনি। আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা কিংবা সামাজিক-মতাদর্শিক পরিসরে গোড়ার ভুলগুলো কী? ত্রুটি কোথায়? কেন আমরা ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছি! আমাদের চিন্তা ও কাজে এত আত্মঘাতী ত্রুটি কেন? কিভাবে তার সংশোধন হবে? 

আরও নজির দেওয়া যায়। বাংলাদেশের সংবিধান যেভাবে অনায়াসে কাটাছেঁড়া হয়েছে তাতে বোঝা যায়, যারাই ক্ষমতায় গিয়েছে তারা তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করবার জন্য দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তির মতো নিজ নিজ শাসন ব্যবস্থা পাকা করবার জন্য যখন তখন সংবিধান বদলে দিয়েছে। এমনকি একজন বিচারপতির চাকরি রাখবার জন্যও বাংলাদেশের সংবিধান বদলানো হয়েছে। আশ্চর্য! 

এরশাদ তার সামরিক অভ্যুত্থানকে বৈধ করবার জন্য নির্বাচন করেন এবং যে সংবিধান অমান্য করে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় বসেছিলেন সেই সংবিধানেরই ১৪২ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে সামরিক অভ্যুত্থানকে সাংবিধানিকভাবে ‘বৈধ’ করে নেন। এই সময় রাষ্ট্র, সংবিধান, ক্ষমতা, শাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি রাজনৈতিকবর্গ যে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনার বিষয় সেটা আমার লেখালিখির মধ্য দিয়ে আমি হাজির করতে শুরু করি।

এই সময় থেকেই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে নিজেদের ‘গঠন’ করার কাজ যে অতি প্রাথমিক ও গোড়ার কর্তব্য তার ওপর আমি বারবারই জোর দিয়ে এসেছি। নিজেদের রাজনৈতিকভাবে ‘গঠন’ করবার কাজ দ্রুত নিষ্পন্ন করা দরকার একথা আমি দীর্ঘকাল ধরেই বলছি। ২০০৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘সংবিধান ও গণতন্ত্র’ গ্রন্থের ভূমিকা হিশাবে আমি লিখেছি: 

“মুক্তিযুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য ছিল জাতিগতভাবে যাদের আমরা শত্রু গণ্য করেছি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং তাদের দখলদারি থেকে দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ড শত্রুমুক্ত করা। এই লড়াইয়ের সময় গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র শোষণ নিপীড়ন থেকে মুক্তি ইত্যাদি নানান ধারণা স্লোগান কর্মসূচি আমরা দেখেছি। কিন্তু অভ্যন্তরীণ দিক থেকে যে রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারিত হয় গঠনের প্রক্রিয়া ও ফলাফলে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে-সেই লড়াই আমরা করিনি।

যদিও আমরা গণতন্ত্র নিয়ে কথাবার্তা স্লোগান হুংকার দিয়েছি কিন্তু কী করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম হয়, সেই লড়াইয়ের শত্রু-মিত্র কী করে ঠিক হয়-সেসব বিষয়ে আমাদের ভাবনাচিন্তা আজ অবধি খুবই দুর্বল। সাধারণত সমাজের সংবেদনশীল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই সকল বিষয়ে নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আলাপ আলোচনা চলে। এই তর্ক-বিতর্ক দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি তাদের নিজ নিজ শ্রেণির পক্ষে যুক্তি সন্ধান করে, তত্ত্ব পায় এবং আন্দোলন সংগ্রামে সমাজে নিজ নিজ শ্রেণির আধিপত্য কায়েমের জন্য চেষ্টা চালায়। কিন্তু বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবিতার চরিত্র বিচার করলে আমরা দেখব গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য তাত্তি¡ক সংগ্রাম কখনোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, ঠিক যতটা ছিল সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য আকুতি ও আবেগ।” (মজহার, ২০০৭ পৃ. ১০)

সংবিধান ও রাষ্ট্র সমার্থক নয়

সংবিধান ও রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনার গুরুত্ব এবং রাজনৈতিক তৎপরতার কেন্দ্রে সাংবিধানিক তর্ক-বিতর্ককে নিয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ দরকারি কাজ। তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্কের মধ্য দিয়ে আমরা কিছুটা সেটা উপলব্ধি করেছি। সেই সকল বিতর্কের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যথেষ্ট না হলেও কিছুটা অগ্রসর হয়েছে বলা যায়। সে কারণে বাংলাদেশের সংবিধান ‘সংস্কার’ করবার কথা আজকাল বলা হচ্ছে। এমনকি বিএনপিও তাদের ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা’য় কিছু সীমিত সংস্কারের প্রস্তাব করেছে। কিন্তু সংবিধান ও রাষ্ট্র এক কথা নয়। সংবিধানের কিছু সংশোধন কিংবা রাষ্ট্র কাঠামোর দুই-এক জায়গায় ‘মেরামত’ করলে ইতরবিশেষ ঘটে না। বাংলাদেশের সমস্যা এতে মেটে না। আগের মতোই গোড়ার ভুল হিশাবে থেকে যায়।

দ্বিতীয়ত সংবিধান মানে রাষ্ট্র ক্ষমতাও নয়। ক্ষমতা সংবিধানের আগেই বাইরে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়। সংবিধান নিজে ক্ষমতা নয় কিন্তু সমাজের সক্রিয় ক্ষমতাকে ন্যায্যতা দেয় এবং ক্ষমতা চর্চার উপায় হিশাবে ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ সংবিধান ও ক্ষমতা ভিন্ন বিষয়। সংবিধান সংস্কার মানে ক্ষমতার সংস্কার নয়। তাই সংবিধানের সংস্কার বা রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার ক্ষমতার প্রশ্নকে অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্নভাবে হাজির করে। রাষ্ট্র কাঠামো আর রাষ্ট্র ক্ষমতাও এক কথা নয়। 

সংবিধান প্রণয়নের পরেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলে এবং সংবিধান বদলেও যায়। ঐতিহাসিক ও আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক রয়েছে। তবে দেশকালে বিদ্যমান সুনির্দিষ্ট সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম এবং শক্তির ভারসাম্য হিশাবে রাষ্ট্রক্ষমতা তৈরি হয়। সংবিধান প্রণয়ন কিংবা সংশোধনের সময়ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংগ্রামই আমরা দেখি, সংবিধানে তার প্রতিফলনও ঘটে। কিন্তু সংবিধান সংস্কারের দ্বারা রাষ্ট্র ক্ষমতার কোনো সংস্কার বা বদল ঘটানো যায় না। তেমনি রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কারের দ্বারা ক্ষমতার বিশেষ ইতরবিশেষ ঘটে না। ক্ষমতার চরিত্রে বদল হলে সংবিধানে তার প্রতিফলন ঘটে বা ঘটতে বাধ্য। 

ক্ষমতা বা শক্তির চরিত্রকে সুনির্দিষ্টভাবে বুঝতে হলে আমাদের সুনির্দিষ্টভাবে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে চেনা ও বোঝার দরকার আছে, যেন এর বিপরীতে ‘গণশক্তি’ পরিগঠন ও গণশক্তির তাৎপর্য আমরা বুঝতে পারি। আমাদের প্রশ্ন করতে হবে একাত্তরে আমরা গণশক্তির যে রূপ প্রত্যক্ষ করেছি এবং হিংস্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি সেই শক্তি ক্ষয় হবার মতাদর্শিক এবং রাজনৈতিক কারণগুলো কী? ‘বাঙালি জাতিবাদ’ কিভাবে জনগণকে বিভক্ত করেছে এবং আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির লড়াই থেকে কিভাবে ধর্মকে পৃথক করে একটি গৃহযুদ্ধ জারি রাখার মতাদর্শিক শর্ত তৈরি করেছে।

যেন বাংলাদেশের জনগণকে দিল্লির ইসলাম নির্মূল রাজনীতির অধীনস্থ করা যায়। পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে আমরা দেখি হেগেল এবং তার সমসাময়িকদের মধ্যে ধর্মের সত্যের সঙ্গে বুদ্ধির কিংবা দর্শনের সত্য মোকাবিলা এবং পার্থক্য নিরাকরণের কঠিন প্রয়াস রয়েছে। ল্যুদভিগ ফয়েরবাখে এসে আমরা তার একটা পরিণতি লক্ষ্য করি। এর পরের পর্যায়ে ফয়েরবাখ থেকে কার্ল মার্কসের আবির্ভাব আমরা দেখি। দেখা যাচ্ছে ধর্মের একাট্টা বা একরোখা বিরোধিতা নয়, বরং মতাদর্শিকভাবে ধর্মতত্ত্বের পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই সমাজে চিন্তার বিকাশ ঘটে এবং সমাজ বা জনগণ নিজেদের নিজেরা নতুনভাবে আবিষ্কার করে, চিনতে পারে বা বুঝতে পারে।

এই উপলব্ধি ছাড়া যাদের আমরা ‘জনগণ’ বলি তাদের আবির্ভাব ঘটাও সম্ভব না। কারণ জনগণ স্রেফ আলুর বস্তা না, জনগণের সামষ্টিক চেতনার জগৎ রয়েছে। সেখানে উপলব্ধি ও চিন্তার বিকাশ ঘটানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ। আধুনিক বিশ্বে শক্তিশালী জনগোষ্ঠী হিশাবে হাজির হওয়ার শর্ত হচ্ছে ধর্মের একাট্টা বিরোধিতা নয়, বরং ধর্মের পর্যালোচনা বা মোকাবিলা (মজহার, ২০১৯)। 

ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা আর ফ্যাসিস্ট শক্তি সমার্থক নয়। সমাজে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তি হাজির থাকলেও তা বর্তমান বাংলাদেশের মতো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিশাবে কিভাবে তৈরি হতে সক্ষম হয়েছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিভাবে ফ্যাসিস্ট শক্তি পুরা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই ফ্যাসিস্ট রূপ দান করতে পারল সেটা খুবই গুরুতর রাজনৈতিক জিজ্ঞাসা। আমাদের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ইতিহাসের মধ্যে তার উত্তর খুঁজতে হবে।

সেই ইতিহাস পর্যালোচনা ছাড়া আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ণয় করা অসম্ভব। বাংলাদেশে কিভাবে ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিস্ট শক্তিতে এবং ফ্যাসিস্ট শক্তি কিভাবে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রূপ নিল সেই ইতিহাস ও বাস্তবতা বিচার আমাদের জরুরি কর্তব্য হয়ে উঠেছে। তাই মতাদর্শ হিশাবে ফ্যাসিবাদকে যেমন আলাদাভাবে শনাক্ত করতে পারা জরুরি, তেমনি জরুরি ফ্যাসিবাদের সঙ্গে ফ্যাসিস্ট শক্তির সম্পর্ক বিচার।

একইভাবে ফ্যাসিস্ট শক্তি কিভাবে আমাদের সংবিধান, রাষ্ট্র কাঠামো এবং পুরা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছে সেই ইতিহাস ও প্রক্রিয়া আমাদের বিশ্লেষ ও জানা জরুরি। আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্যে কিংবা রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কে এই সকল গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পর্যালোচনা একদমই অনুপস্থিত। 

ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামকে বিজয়ী গণ-অভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে নতুনভাবে গঠন করাই বাংলাদেশের এখনকার প্রধান রাজনীতি। সেই ক্ষেত্রে সফল হতে হলে রাজনৈতিক বর্গগুলো সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। ‘ফ্যাসিবাদ’ কোনো গালাগালির ভাষা নয়, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিকবর্গ।

কিন্তু এখনো রাষ্ট্র ‘গঠন’ করবার ধারণা আমাদের কাছে যারপরনাই অস্পষ্ট এবং আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার দূরবর্তী বিষয় হয়ে রয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র সংস্কার দাবি কিংবা রাষ্ট্র মেরামত করবার রূপরেখার দাবির গুরুত্ব হচ্ছে অন্তত সাংবিধানিক তর্ককে বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসা। যা ইতিবাচক। কিন্তু এর দুর্বল দিক হচ্ছে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে রাষ্ট্র ‘গঠন’ করবার মর্ম বা গুরুত্ব বুঝতে না পারা। আন্দোলন-সংগ্রামের বিশেষ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান সংস্কারের দাবি তোলা কৌশলগত দাবি হতে পারে। হোক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সংস্কারের আন্দোলনকে কিভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে আমরা উন্নীত করব?

কিভাবে আন্দোলন-সংগ্রামকে আমরা গণশক্তিতে রূপ দেব? নীতি ও কৌশলের মধ্যে সমন্বয় রাখব কিভাবে? আইনি লড়াই-অর্থাৎ সংবিধান সংস্কারের লড়াই আর রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে ফারাক বুঝব কিভাবে? রাষ্ট্র যদি স্রেফ সংবিধান বা আইনি সংস্থা না হয়, তাহলে রাষ্ট্রের মর্ম ও রূপ নিয়ে গোড়ার জিজ্ঞাসাগুলো বাংলাদেশে আমরা কিভাবে তুলব?

জনগণকে সচেতন করে তোলা খুবই কঠিন কাজ। সংবিধান ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক বোঝানো সেই ক্ষেত্রে দূরের কথা। কিভাবে সংবিধান জনগণের জীবন ও জীবিকাকে সরাসরি প্রভাবিত করে সেই দিকগুলো আমরা এখনো বোঝাতে সক্ষম হইনি। দ্বিতীয়ত রাষ্ট্র মানে নিছকই ‘সংবিধান’ নয়, বা শুধুমাত্র আইনি সত্তা নয় সেই ভেদ বিচারও বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক মহলে অতিশয় অস্পষ্ট। তৃতীয়ত আইন মানে ক্ষমতা বা বিশেষ শ্রেণির ক্ষমতা চর্চার রূপ সেই বিষয়েও আমাদের কোনো পর্যালোচনা নাই।

আইন মানে যা বলবৎ যোগ্য, অর্থাৎ শক্তির দ্বারা যাকে বাস্তবায়িত করা হয়। আমাদের ভাষা ব্যবহারের মধ্যে আইন ও ক্ষমতার অভিন্ন সম্পর্ক নিহিত রয়েছে, কিন্তু তার মর্মে আমরা প্রবেশ করি না, বা প্রবেশ করতে চাই না। শাসক বা ক্ষমতাসীন শ্রেণি যখন আইনের শাসনের কথা বলে, তখন তারা আসলে তাদের শ্রেণির একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা চর্চার কথাই বলে। সেটা ব্যক্তির নয়, তাদের নিজ শ্রেণির একনায়কতন্ত্র, অর্থাৎ গরিব, সর্বহারা, হত-দরিদ্র-বঞ্চিতদের ওপর ধনী শ্রেণির একনায়কতন্ত্র, কিন্তু অপর দিকে তাদের নিজ শ্রেণির মধ্যে গণতন্ত্র।

কারণ বিদ্যমান আইন দ্বারা শাসক ও শোষক শ্রেণি তাদের নিজ শ্রেণির স্বার্থই রক্ষা করতে চায়। তাহলে এর বিপরীতে ‘গণশক্তি’ বা জনগণের ক্ষমতা চর্চার কথা যখন ওঠে তখন সেই ক্ষমতার রূপ কেমন হতে পারে? অনিবার্যভাবেই জনগণের দিক থেকে ক্ষমতার রূপ জনগণতান্ত্রিকই হবে। কিন্তু যে শ্রেণি বাংলাদেশে বর্তমান ফ্যাসিস্ট অবস্থা বহাল রেখেছে, ফ্যাসিস্ট শক্তির চর্চা করেছে এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে সেই শ্রেণির বিরুদ্ধে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা ছাড়া জনগণের গণতন্ত্র কায়েম ও বহাল রাখা কিভাবে সম্ভব?

দেখা যাচ্ছে, শ্রেণি ও ক্ষমতার প্রশ্ন বাদ দিয়ে ‘গণতন্ত্র’ নামক বর্গটিও অন্তঃসারশূন্য অর্থহীন বাকোয়াজগিরি। তাহলে গণশক্তি যখন রাষ্ট্রের রূপ নেবে তখন তার সম্ভাব্য রূপ কী হতে পারে? ইত্যাদি বহু জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়েই আমাদের জনগণকে সচেতন এবং গণশক্তি পরিগঠনের শর্ত তৈরি করতে হবে।

শ্রেণির প্রশ্ন উহ্য রেখে রাষ্ট্রকে স্রেফ বল প্রয়োগের হাতিয়ার ভাববার একটা দীর্ঘ বামপন্থি ধারা আছে। যা একপেশে। দৃশ্যমান বলপ্রয়োগের একচেটিয়া ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতেএটা আমরা জানি। ফলে বিপ্লব মানেই ‘ধরো তক্তা মারো পেরেক’ জাতীয় চিন্তায় পর্যবসিত হয়েছে। এই চিন্তার বালখিল্য আকাশ কুসুম গুজব বা বায়না হচ্ছে, ‘আমরা ক্ষমতায় গেলে সব ঠিক করে ফেলব’। জনগণের স্বার্থের পক্ষের দাবিদার রাজনৈতিক দলগুলো সদাসর্বদাই এই ভাঁওতা আমাদের দিয়ে যাচ্ছে। 

ক্ষমতা বুঝি শুধু রাষ্ট্রের হাতেই আছে এবং পুলিশ-মিলিটারি-আইন-ব্যবস্থা দিয়ে ক্ষমতাবান শ্রেণি সেই দৃশ্যমান বল প্রয়োগের ক্ষমতা চর্চা করে এবং জনগণকে বলপ্রয়োগের একচেটিয়া ক্ষমতা দ্বারা দমন ও নিয়ন্ত্রণ করার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় থাকে। ক্ষমতার হাতিয়ারবাদী ধারা তাই মনে করে রাষ্ট্র ক্ষমতা মোকাবিলার পথ অতএব শুধুমাত্র পালটা দৃশ্যমান বলপ্রয়োগ ও সংঘর্ষ। তারা তাই মতাদর্শিক লড়াই, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে উপেক্ষা, কিংবা গৌণ মনে করে। 

কিন্তু দার্শনিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাংস্কৃতিক লড়াই সরাসরি বিদ্যমান ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ এবং নতুন জনগণতান্ত্রিক ক্ষমতা পরিগঠনের শর্ত। জনগণের সঙ্গে ফ্যাসিস্ট শক্তির দ্বন্দ্বের মীমাংসা শান্তিপূর্ণ হবে এটা আশা করা নিছকই পাগলামি। ইতিহাসে তেমন কোনো দৃষ্টান্ত নাই। হিটলার মুসোলিনীকে হঠাবার জন্য বিশ্বযুদ্ধের প্রয়োজন হয়েছে। অতএব গণ-রাজনৈতিক ধারায় বল প্রয়োগ করা যাবে না, এটা আমাদের দাবি না। আমরা ক্ষমতা সম্পর্কে হাতিয়ারবাদী ধারার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে চাই। রাজনীতিতে বল প্রয়োগ করা না করার তর্ক আলাদা বিষয়। 

লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ ভুল বা অসম্পূর্ণভাবে পাঠ থেকে হাতিয়ারবাদী ধারার জন্ম। লেনিনের পুস্তিকার বিষয় হচ্ছে ক্ষমতার রূপ বিচার (লেনিন, ১৯৮৩) এই বইয়ে লেনিন প্রলেতারীয় বিপ্লবের সঙ্গে রাষ্ট্রের ‘ব্যবহারিক সম্পর্ক’ পর্যালোচনা করেছেন। অর্থাৎ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সর্বহারা শ্রেণি রাষ্ট্র নিয়ে কী করবে সেটাই হচ্ছে তার আলোচনার বিষয়। প্লেখানভ ও ‘বেইমান’ কাউৎস্কির সঙ্গে বিপ্লবের ব্যবহারিক প্রশ্ন নিয়ে বিতর্কের জন্য পুস্তিকাটি বিখ্যাত। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ‘ক্ষমতা’-র রূপান্তর কিভাবে ঘটে লেনিন সেটা দেখাতে চেয়েছেন এবং সর্বহারা শ্রেণি কিভাবে বিদ্যমান রাষ্ট্র ভেঙে নিজ শ্রেণির স্বার্থে ব্যবহার করে বা করতে পারে লেনিন সেটা আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন। যেন আমরা ‘বেইমান’ কাউৎস্কির ভূমিকা বুঝতে পারি। 

রাষ্ট্র শুধু বল প্রয়োগের প্রতিষ্ঠান-রাষ্ট্র সম্পর্কে এই নিরঙ্কুশ হাতিয়ারবাদী ধারা থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি। এই অনুমান সর্বহারা, গরিব ও বঞ্চিত-লাঞ্ছিতদের পক্ষে কঠিন, শ্রমসাধ্য ও দীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই-সংগ্রামকে উপেক্ষা করে এবং দাবি করে ক্ষমতাসীন শক্তির বিরুদ্ধে পালটা বল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারলেই সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলা যায়। না, যায় না। রাষ্ট্র শুধু আইনি কিংবা শক্তি প্রয়োগের প্রতিষ্ঠান না, এই হুঁশ আমাদের থাকতে হবে। রাষ্ট্র সমাজের চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরের সঙ্গে যুক্ত। চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে গুণগত রূপান্তর ঘটানো না গেলে বিদ্যমান ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন সম্ভব না।

কিন্তু ক্ষমতা শুধু দৃশ্যমান বল প্রয়োগ দ্বারা নয়, অদৃশ্য বা বিমূর্ত তর্ক-বিতর্কের স্তরেও চর্চা হয়। একে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও জে দং ‘মতাদর্শিক সংগ্রাম’ বলেছেন, যদি শুধু বল প্রয়োগের দ্বারা সর্বহারা শ্রেণির মুক্তি আসত তাহলে তাদের এত কাঁড়ি কাঁড়ি বইপুস্তক লিখতে হতো না। কিন্তু চিন্তা চর্চার বিপুল নজির থাকা সত্ত্বেও হাতিয়ারবাদী চিন্তার আধিপত্যের কারণে আমরা মতাদর্শিক লড়াইয়ের ভূমিকাকে মারাত্মক গৌণ বিষয় মনে করি। গণ-রাজনীতির পক্ষে শক্তিশালী গণ-রাজনৈতিক ধারা গড়ে তুলতে হলে মতাদর্শিক তর্ক-বিতর্কের ধারাকে সবার আগে শক্তিশালী করতে হবে। ক্ষমতা ও রাষ্ট্র সম্পর্কে হাতিয়ারবাদী ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে ক্ষমতা একালে কিভাবে আমাদের মধ্য দিয়ে কাজ করে সেটা বোঝা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

সমাজ বদলের সম্ভাবনা তখনই তৈরি হয় যখন সমাজ বদলের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং মতাদর্শিক তৎপরতা সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে এবং জনগণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠতে পারে। ফ্যাসিস্ট শক্তির মতাদর্শ উৎপাদন ও প্রচারের জন্য বিদ্যমান পত্রপত্রিকা, সাংবাদিকতা ও নানান গণমাধ্যম রয়েছে। শক্তিশালী গণ-রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশ ছাড়া ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট শক্তির মোকাবিলা অসম্ভব। অর্থাৎ গণশক্তি নির্মাণ সরাসরি জনগণের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক তৎপরতা জোরদার করার সঙ্গে যুক্ত। সেই দিক থেকে জনগণের স্বার্থ রক্ষার দাবিদার দলগুলো সম্পর্কে সতর্ক হওয়া দরকার আছে। 

বিশেষত যারা বুদ্ধিবৃত্তিক তর্ক-বিতর্কে অংশ নেয় না, কিংবা যারা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা মোকাবিলা করতে অক্ষম। গণ-আন্দোলন বা গণ-সংগ্রামে কেউ চাইলেও সহজে সংঘর্ষ এড়াতে পারে না। পুলিশ-সেনাবাহিনী, বিচার ব্যবস্থা, কারাগার ইত্যাদি মোকাবিলা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সন্দেহ নাই, কিন্তু ক্ষমতা চর্চার নিরস্ত্র ও রক্তপাতহীন ক্ষেত্র হচ্ছে মতাদর্শ।

‘সংবিধান’ ও রাষ্ট্রের ধারণার পার্থক্য ছাড়াও সাধারণভাবে রাজনৈতিক সাহিত্য বাংলাদেশে অতিশয় দুর্বল। নিজদের রাষ্ট্র হিশাবে ‘গঠন’ নিছকই সাংবিধানিক বিষয় নয়। উকিলদের তৈরি মুসাবিদা দিয়ে রাষ্ট্র বানানো যায় না, সংবিধান সংশোধন বা সংস্কার করেও কোনো ফায়দা নাই। সমাজে চিন্তা-চেতনা, বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা ও চিন্তার বিকাশই রাষ্ট্র ও ক্ষমতার গণতান্ত্রিক রূপ হাজির করার শর্ত। 

বিদ্যমান রাষ্ট্রের সংস্কার নয়, উকিলদের মুসাবিদা নিয়ে সময় নষ্ট ও জনগণকে অযথা বিভ্রান্ত করা নয়, বেয়নেটের আঘাতে সংবিধানকে সশস্ত্র শক্তির জোরে ছেঁড়া ত্যানা বানানো আবার ১৪২ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধ করবার কারসাজিও নয়-আমাদের নতুনভাবে কিভাবে বাংলাদেশ গঠন করা যায় সেই গোড়ার কথাই ভাবতে হবে। সামরিক ও বেসামরিক উভয় প্রকার গণবিরোধী ও ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে।

আমরা দেখেছি কিভাবে ১৪২ অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তি বারবার সংবিধান পরিবর্তন করেছে। সংবিধান সংস্কারের নামেই তারা সেটা করেই চলেছে। ফ্যাসিস্ট শক্তি সংবিধান সংস্কার বা সংশোধন করার মধ্য দিয়ে তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে। অতএব সংবিধান সংস্কার গণতন্ত্রের কোনো গ্যারান্টি না। যে কোনো সংস্কার ১৪২ অনুচ্ছেদের বলে আবার উল্টিয়ে দেওয়া সম্ভব। গণতন্ত্রের গ্যরান্টি হচ্ছে মতাদর্শিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক লড়াই জারি রাখা। 

 লেখক: কবি ও চিন্তক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //