প্রমিত বাংলার ভবিষ্যৎ

এই শিরোনামে বক্তৃতার আয়োজন করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি (ডিইউডিএস)। বর্তমান প্রবন্ধ ওই বক্তৃতার লিখিত রূপ। প্রবন্ধের আকার দেওয়ার সময়ে বক্তৃতার মূল আলাপ ও যুক্তিতে বড় কোনো বদল করিনি, কেবল লিখিত ভাষার স্বাভাবিক গতির স্বার্থে শৈলীগত পরিবর্তন করেছি।

প্রথমেই মনে করিয়ে দেই, প্রমিত বাংলার ভবিষ্যৎ বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নয়। ‘বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ’ নামে বহু প্রবন্ধ লেখা হয়েছে; কিন্তু সতর্ক থাকা দরকার, প্রমিত বাংলা নিয়ে আমরা যে আলাপ করছি, সেটা ‘বাংলা ভাষা’ নিয়ে আলাপ নয়। দুটি আলাদা জিনিস। মানুষ সাধারণত ভাষার পরিবর্তনে উদ্বিগ্ন হয়। এর কারণ হলো, সে যে ভাষা শিখতে শিখতে বড় হয়েছে, এবং পরে অনেক কষ্ট করে প্রমিত রূপ রপ্ত করেছে, তার হেরফেরে সে ভীষণ রকম উদ্বিগ্ন বোধ করে।

এই যে কষ্ট ছাড়া রপ্ত করা এবং পরে কষ্ট করে রপ্ত করা-এ প্রসঙ্গে পরে আবার আসব। আমাদের আজকের আলাপের জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। মানুষ ভাষাটা, মানে মুখের ভাষাটা-জন্মের পর থেকে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে এবং অনায়াসে শেখে। আর পরে কষ্ট করে শেখে লিখিত ভাষা। ওটাই আসলে প্রমিত ভাষা। পরিশ্রম করে শেখা প্রমিত রীতিতে একটু হেরফের ঘটলে মানুষ উদ্বিগ্ন হয়। মনে করে, ভাষা বুঝি নষ্ট হয়ে গেল।

১৮৭৮ সালে লেখা বিখ্যাত ‘বেঙ্গলি স্পোকেন অ্যান্ড রিটেন’ প্রবন্ধে শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, লোকে জানে যে ভাষা পরিবর্তিত হবেই; মানুষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে জানে, ভাষা পরিবর্তিত হবেই; কিন্তু মানুষের যে জীবৎকাল, আর ভাষার পরিবর্তনের যে হার, এ দুটো আসলে সমানুপাতিক নয়। বেশিরভাগ লোক যত দিন বেঁচে থাকে, ওই সময়ের মধ্যেই ভাষার খুব দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন ঘটে।

কিন্তু পরিবর্তনটা এমন ধীরগতিতে আর অলক্ষ্যে ঘটে যে, সাধারণ মানুষ বদলটাকে উপলব্ধি করতে পারে না। ফলে শ্যামাচরণ লিখেছেন, এবং আরও অনেকে-মানুষ ভাষার পরিবর্তন হবে জেনেও, ভাষা পরিবর্তন হচ্ছে জেনেও, ভাষাকে স্থিতাবস্থায় রাখতে চায়। এটা পুরো পৃথিবীর যে কোনো ভাষাভাষী মানুষের সাধারণ প্রবণতা। ফলে ভাষা খানিকটা বদলে গেলেই মানুষ উদ্বিগ্ন হয়। এ উদ্বেগ অমূলক। 

মানুষ ভাষা মিশ্রণেও উদ্বিগ্ন হয়। ওই উদ্বেগও অর্থহীন। ভাষামাত্রই মিশ্র অস্তিত্ব। খাঁটি বাংলা, খাঁটি ভাষা, খাঁটি বাঙালি-এ ধরনের চিন্তা মানুষ নিত্যই করে থাকে। কিন্তু জাতির মতো ভাষার ক্ষেত্রেও চিন্তাটা কেবল অমূলকই নয়, অজ্ঞানতাপ্রসূতও বটে। খাঁটি ভাষা, সংস্কৃতি বা জাতি নিতান্তই সোনার পাথর বাটি। এডোয়ার্ড সাইদ তার বিশ্বখ্যাত ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বইতে লিখেছিলেন, মানুষ যতটা কল্পনা করতে পারে, মানুষের ব্যষ্টিক-সামষ্টিক অস্তিত্ব তার চেয়েও অধিক মিশ্র প্রকৃতির।

ভাষার ক্ষেত্রে আমরা প্রত্যেকেই লিখছি-বলছি-‘ভাষা বহতা নদীর মতো’। কিন্তু একথা বলতে কী বোঝায়, সেটা অনুধাবন করা খুব সহজ নয়। সত্যি সত্যি ভাষা কিন্তু বহতা নদীর মতোই; অথচ ‘বহতা নদীর মতো’ বলতে ঠিক কী বোঝায়, সেটা বোধের আওতায় আনা সহজ কাজ নয়।

আমরা যদি বহমান নদীটাকে একটা মুহূর্তের জন্য বরফ বানিয়ে ফেলতে পারতাম, তাহলে ঠিক একটা জায়গায় পানির, স্রোতের, প্রবাহের, এবং অনান্য উপাদানের যে রূপটা পাওয়া যেত, সেটাকে ভাষার একটা মুহূর্তের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যেত। কিন্তু যেহেতু নদী এভাবে বরফ হয়ে যায় না, নদী চলতেই থাকে, ফলে মুখে বললেও নদীর প্রবাহের মতো করে ভাষাকে উপলব্ধি বা অনুমান করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। 

এতক্ষণ আমরা যে ভাষার কথা বললাম, সেটাকে বলতে পারি প্রাকৃতিক ভাষা। আমি এখানে রূপকের আশ্রয় নিয়ে বললাম, ভাষা হচ্ছে প্রকৃতির মতো। কোন ভাষা? যে ভাষা একটা নির্দিষ্ট কাঠামোয় অনুধাবন করা খুবই মুশকিল। বাংলা ভাষা মানে কী? বাংলা ভাষা মানে হাজার হাজার ভাষা­রূপের সমষ্টি। বাংলা ভাষা বলে নির্দিষ্ট কিছু নাই। কেউ যদি বলতে চায়-এটা বাংলা ভাষা; যদি নির্ধারণ করতে চায় বাংলা নামের ভাষাটির নির্দিষ্ট কোনো রূপ, তাহলে সে ব্যর্থ হবে।

সব ভাষার ক্ষেত্রেই ওই একই কথা। ভাষা সবসময় অনির্দিষ্ট রকমফেরের সমষ্টি। মিখাইল বাখতিন বিখ্যাত ‘ডায়ালজিক ইমাজিনেশন’ কেতাবে লিখেছিলেন-শ্রেণি, পেশা, বর্ণ, বয়স ইত্যাদি যত রকম বিভাজন কল্পনা করা যায়, ভাষা তত রকম। তিনি আরও বলেছেন, প্রত্যেক মুহূর্তের ভাষা আলাদা; প্রত্যেক জায়গার ভাষা আলাদা; প্রত্যেক বছর, মাস, এমনকি ঘণ্টায়ও নতুন ভাষা পয়দা হয়। মানুষ যে কোনো পরিস্থিতিতে নতুন ভাষা সৃষ্টি করে। ফলে আমরা ভাষা বলতে যে একটা নির্দিষ্ট, শুদ্ধ, অপরিবর্তনীয় অস্তিত্ব বুঝি, তা ভাষার স্বভাবের সঙ্গে যায় না।

ভাষার যে স্বাভাবিক অস্তিত্ব, স্বাভাবিক রূপ-এটাকে রূপকার্থে প্রাকৃতিক রূপ বলা যেতে পারে। সেদিক থেকে আলোচ্য প্রমিত বাংলাকে বলতে পারি সাংস্কৃতিক রূপ। আলোচনার সুবিধার্থে এ রূপক সম্পর্ক তৈরি করা হলো। প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক কথা দুটি আমরা যে অর্থে ব্যবহার করি সে অর্থেই এখানে শব্দ দুটি ব্যবহৃত হলো। এখন আবার উদ্বেগের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। আলোচনার শিরোনামের মধ্যেই এক ধরনের উদ্বেগ নিহিত আছে। সরাসরি বলা না থাকলেও নিহিতার্থে আছে। 

এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, বাংলা ভাষা নিয়ে কোনো উদ্বেগ অনর্থক। এ ধরনের যে কোনো উদ্বেগ অশিক্ষা এবং কুশিক্ষামূলক। বাংলা এক বিশাল ভাষা। প্রায় ২৫-৩০ কোটি মানুষের ভাষা। জীবন্ত জিয়ল ভাষা। বাংলায় বিপুল মানুষ জীবনযাপন করে। ফলে এ ভাষা অনন্তকাল ধরে বহমান থাকবে। কেউ যখন এ উদ্বেগ প্রকাশ করে, তখন সে বুঝে বা না বুঝে আসলে যা ভাবে তা হলো, এই মুহূর্তে আমি যে বাংলা ব্যবহার করছি, ঠিক একশ বছর পর এই বাংলাটা থাকবে কি না।

মানুষের অন্য অসংখ্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মতো এটাও একটা অমূলক উদ্বেগ। যাকে আমরা বলেছি বাংলার প্রাকৃতিক রূপ, তা নিজের নিয়মে পরিবর্তিত হতে থাকবে এবং সজীব-সক্রিয় ভাষা হিসেবে বিদ্যমান থাকবে। এখনকার মতো থাকার প্রশ্নই আসে না। আসলে প্রমিত বাংলা নিয়েও কোনো উদ্বেগের কারণ নাই। তবে একটু আলাদা কারণে।

‘প্রমিত বাংলার ভবিষ্যৎ’ বলে কিছু থাকতেই পারে না, তার কারণ হলো, প্রমিত কোনো স্থির বা অনড় কিছু নয়। আমরা যখন বলি ‘প্রমিত বাংলার ভবিষ্যৎ’তখন তার মধ্যে এরকম স্থির ও অপরিবর্তনীয় কিছুর অনুমান থাকে। এবং আলাপটা মুখ্যত হয় এর ব্যত্যয় নিয়ে। ভাষার স্বভাব ও কার্যকরতার দিক থেকে বলা যায়, এ ধরনের আলাপ খুব কাজের হয় না। 

কিন্তু আমরা যখন প্রমিত বাংলার ভবিষ্যতের কথা বলি তখন, অনুমান করা যায়, আমরা শঙ্কার কথা ভাবি। সে আশঙ্কার আলোচনা করার আগে বুঝতে হবে, প্রমিত ভাষা কী বস্তু। প্রমিত ভাষা মানে স্ট্যান্ডার্ড বা মানভাষা। প্রমিত মানে শুদ্ধএরকম ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। আমাদের বেশিরভাগ মানুষ ‘প্রমিত’ না বলে যে ‘শুদ্ধ ভাষা’ লব্জটা ব্যবহার করে, তার আলাদা কারণ আছে; ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক ব্যাকরণ আছে।

এ লেখায় সে আলোচনার সুযোগ নাই। আমরা বরং খুব প্রাথমিকভাবে প্রমিতের ধারণাটা ব্যাখ্যা করি। প্রমিত আদতে সমাজ ও রাষ্ট্র-পরিচালনাকারী ভদ্রলোকশ্রেণির ভাষা। প্রমিত এবং রাষ্ট্র এ দুটোকে একাকার করে ব্যাখ্যা করার বিস্তর ফজিলত আছে। ভদ্রলোক বা অধিপতি শ্রেণি, যারা রাষ্ট্র চালায়, যারা সংস্কৃতিবান হিসেবে পরিচিত ও প্রভাবশালী, তাদের মুখের ভাষার অনুকরণে ঐতিহাসিকভাবে তৈরি হওয়া, বেড়ে ওঠা এবং লিপিবদ্ধ হওয়া ভাষারূপ, যা রাষ্ট্র চালানোর মতো যত রকমের আনুষ্ঠানিক কাজ আছে, সেগুলোতে ব্যবহৃত হয়, তা-ই প্রমিত ভাষা।

ভদ্রলোকরাই যেহেতু রাষ্ট্র চালায়, ফলে তারা দাবি করবে যে তাদের মুখের ভাষাই ভাষার ‘শুদ্ধ’ রূপ। এ ধরনের ভাষারূপই কালক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রমিত ভাষারূপ হিসেবে। দুনিয়ার ইতিহাসে আমরা যদি একশটা ভাষার উদাহরণ নিই, তাহলে অন্তত ৯০টা ভাষার ক্ষেত্রে হুবহু এ কথা প্রযোজ্য হবে। এক-দুইটা ভাষার ক্ষেত্রে প্রমিতের ইতিহাসটা ভিন্নরকম হতে পারে। যে দুই-একটা দেশে নানা কারণে ভিন্নরকম হয়েছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে একটা। 

বাংলাদেশে প্রমিত বাংলার ইতিহাসটা একটু ভিন্নরকম হয়েছে। প্রমিত যতক্ষণ মুখের ভাষা থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত উদ্বেগ আসলে কম থাকে। প্রমিতের বিধিবদ্ধ রূপ তৈরি হয় লেখার ভাষায়। এটা ঠিক যে, লেখার ভাষা মুখের ভাষাকে অনুসরণ করে; কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না ভাষা লিখিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ভাষাকে এরকম কোনো বিধিবদ্ধ রূপে কল্পনা করা দুরূহ। ভাষা বিধিবদ্ধ হয় লেখায় এবং এখানে একটা গোলমাল হাজির হয়; কারণ, ভাষা লেখার জিনিস নয়।

ভাষা হলো মুখে বলার জিনিস, এবং কানে শোনার জিনিস। কিন্তু আমরা যারা শিক্ষিত, লেখাপড়া করে ভাষার প্রমিত রূপ শিখেছি, শেখার জন্য কষ্ট করেছি, এবং অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা হয়েছি, তাদের একটা সচেতন-অচেতন ধারণা হয় যে, ভাষার প্রকৃত রূপ বুঝি লেখার রূপ।

এ ধারণাটা ভুল। তবে এ ধারণার কিছু কার্যকরতা আছে। আমরা আগেই একটা রূপক তৈরি করে নিয়েছি-প্রকৃতির বিপরীতে সংস্কৃতিকে স্থাপন করেছি। সংস্কৃতির মধ্যে যেমন কতকগুলো বানানো ব্যাপার থাকে, বানোয়াট ব্যাপার থাকে, ওই লেখার ভাষা এবং প্রমিতের মধ্যেও তেমনি কতকগুলো বানোয়াট ব্যাপার আছে। তবে এটা কার্যকর। এটা কাজে লাগে। 

প্রমিত ভাষার সংজ্ঞায়নের জন্য মিখাইল বাখতিনের ধারণা খুব কাজের। বাখতিন স্ট্যান্ডার্ড কথাটি ব্যবহার করেন নাই, তবে তিনি ‘ইউনিটারি ল্যাঙ্গুয়েজ’ বলে একটা আইডিয়া ব্যবহার করেছেন। বাখতিন রুশ ভাষায় লিখেছেন, ইংরেজি অনুবাদে কথাটা এরকম দাঁড়িয়েছে। বাখতিন বলছেন, ‘এই ইউনিটারি ল্যাঙ্গুয়েজটা আসলে নানান ধরনের চর্চার মধ্য দিয়ে, নানান ধরনের কেন্দ্রায়ণের মধ্য দিয়ে বিপুল পরিমাণ উপভাষাগত বা ভাষাগত বৈচিত্র্যকে পাশ কাটিয়ে একটা একক রূপ ধারণ করে।’

বাখতিনের ভাষায়, ওই বহুবিচিত্র বাস্তবতা ও সংশ্লিষ্ট ভাষারূপগুলোর সমাহারকে বলা যাবে ‘হেটারোগ্লসিয়া’। যে কোনো অবস্থান ও অবস্থায় বহু বাস্তব একসঙ্গে ক্রিয়াশীল থাকে। আমরা ওই সমন্বিত বাস্তবের মধ্যেই বসবাস করি। এটাকেই তিনি নাম দিয়েছেন হেটারোগ্লসিয়া। বাংলায় বলতে পারি ‘সমন্বিত-বাস্তব’। যে বাস্তবের মধ্যে অসংখ্য বাস্তব একসঙ্গে থাকে। তার মধ্য থেকে একটা ভাষা প্রধান হয়ে ওঠে। একে তিনি বলেন ইউনিটারি। 

বাখতিনের এ ধারণা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রমিত রীতি খুবই কেজো একটা জিনিস। প্রমিত ভাষা আমাদের জন্য খুবই উপকারী একটা রূপ। এটা আমাদের লাগে। কেন? কারণ আমরা দশজন মিলে একসঙ্গে কথাবার্তা বলি। প্রমিত ভাষা লাগে; কারণ আমরা সংগঠন চালাই। স্ট্রাকচার হলো ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে যাওয়া। যখনই আমরা ব্যক্তিতে ছাড়িয়ে যাই, তখন দশজন মিলে ভাগাভাগি করতে পারি এমন ভাষার দরকার হয়।

প্রমিত ভাষা আমাদের লাগে, কারণ আমাদের পড়াশোনা করতে হয়, আমাদের লেখালেখি করতে হয়। আমাদের কবিতা লিখতে হয়। কিন্তু বাখতিন একই সঙ্গে আমাদের মনে করিয়ে দেন, যেমন মনে করিয়ে দেন আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ভাষা-বিশ্লেষক দেবেশ রায়, ‘ভাষা তাজা থাকে যখন গলা ও জিভের উষ্ণতা পায়।’ দেবেশ রায় মনে করেন, এবং বাখতিন যা বলেছেন তা থেকেও বোঝা যায়, যে কোনো প্রমিত রীতি জিভ ও গলার উষ্ণতা থেকে খানিকটা বঞ্চিত হয়ে কৃত্রিম রূপ ধারণ করে।

এটি নিজেকে আলাদা করে রাখতে চায়, কিন্তু সব সময় পারে না; কারণ তাকে কাজ করতে হয় একটি বহুবাস্তব-সমন্বিত বাস্তবতার মধ্যে ক্রিয়াশীল বিচিত্র ভাষার ভিতরে থেকে। এরকম একটা টেনশন কিন্তু প্রমিতের মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকে। টেনশনটা হলো, যে জিনিসটা প্রকৃতিগতভাবে আলাদা নয়, তাকে আলাদা করে নেওয়ার টেনশন। 

‘প্রমিত বাংলার ভবিষ্যৎ’ কথাটার মধ্যেও ঠিক এরকম একটা টেনশনের ব্যাপার আছে। তার কারণটা মুখ্যত ঐতিহাসিক। আগেই বলেছি, দুনিয়ার অন্তত ৯০ ভাগ স্ট্যান্ডার্ড ভাষার রূপ ঠিক হয়েছে ওই ভাষাভাষী সবচেয়ে ভদ্র ও ক্ষমতাবান জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা অবলম্বনে; কিন্তু বাংলায় খানিকটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। বাংলা ভাষার প্রমিত রূপটা যখন জমে উঠছিল, তখন বাংলা অঞ্চল ছিল উপনিবেশিত।

ফলে লোকাল এলিট নিজেদের কাছা সামলানোর কাজে, আর কলোনিয়াল মাস্টারদের অনুসরণ করার জন্য এত ব্যস্ত ছিল যে, তারা হ্যাডম দেখিয়ে ঘোষণা করতে পারে নাই, ‘আমি যেম্নে কথা কই, সেটাই আমার স্ট্যান্ডার্ড’। ঘটনাটা আরও জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঘটেছে। তবে মোদ্দা কথাটা এই, আমাদের প্রমিত রীতি পুরোপুরি ভদ্রলোকদের জবান থেকে আসেনি।

অনেকেই জানেন, প্রমথ চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথসহ প্রমিত বাংলার যে আন্দোলন করেছিলেন, সেটা বাংলা অঞ্চলে পরে খুবই প্রতাপশালী হয়েছিল। তো, ওই প্রমথ চৌধুরী অন্য প্রসঙ্গে এমন একটা কথা বলেছিলেন, যা দিয়ে আমাদের প্রমিত রীতি তৈরি হওয়ার ইতিহাসটা সুন্দরভাবে বর্ণনা করা যায়। তিনি বলেছিলেন, ভাষা মুখ থেকে কলমে যায়, কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে কলম থেকে মুখে আসার ফলে মুখে বিস্তর কালি লেগেছে। কথাটা তিনি আরও সুন্দর করে বলেছেন, আমি আমার মতো করে বললাম। 

এ হলো প্রমিত বাংলার ইতিহাসের এক দিক। এরপর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরেকটা ঘটনা ঘটেছে। একটু ভিন্ন রকম। পাকিস্তান আন্দোলনের সময়ে এবং পাকিস্তান আমলে সে ঘটনাটা ঘটল। একদল লোক চাইল, আরবি-ফারসি শব্দ একটু বেশি পরিমাণে বাংলা ভাষায় আনতে। যদি বাংলাকে একটুখানি মুসলমানি করা যায় তাহলে এটা পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে-এরকম চিন্তা তখন কারও কারও মধ্যে জোরদার ছিল।

তাদেরকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। এর কারণ, আগে উনিশ শতকের কলকাতায়আরেক দল বাংলা ভাষা থেকে প্রচলিত আরবি-ফারসি পুরোপুরি বাদ দিয়েছিল। পাকিস্তান আমলে একদল চাইল আরবি-ফারসি কিছু আসুক। এর ফলে গোলমাল তৈরি হলো। গোলমালের কারণ, এ প্রস্তাবটা পাকিস্তান রাষ্ট্রতন্ত্রের নানা নিপীড়ন আর অন্যায্যতার পক্ষে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

ফলে, পাকিস্তান আমলে আমাদের যারা প্রমিত বাংলা নিয়ে কাজ করেছেন, তারা বেশিরভাগই তড়িঘড়ি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, কলকাতায় কলোনিয়াল আমলে যে প্রমিত বাংলা জমে উঠেছিল, সেই ভাষাকে হুবহু আমরা ঢাকায় প্রমিত বাংলা হিসাবে গ্রহণ করব। ওইকালের লোকদের প্রায় সবার লেখালেখির মধ্যে এ উদ্বেগের চিহ্ন আছে। আমি অন্য এক প্রবন্ধে মুহম্মদ আব্দুল হাই রচনাবলি অবলম্বনে এ টানাপড়েনের কিছু দিক চিহ্নিত করেছিলাম। 

স্বাভাবিকভাবেই দাবি উঠেছিল, ঢাকার প্রমিত বাংলা হওয়া উচিত ঢাকার লোকদের মুখের ভাষার উপর নির্ভর করে। সব মানুষ নয়, ঢাকার এলিটদের মুখের ভাষা অবলম্বনে। কিন্তু সেটা হতে পারেনি। পলিটিক্যাল ও অন্য নানান কারণে অনেকেই বললেন, কলকাতার যে ভাষাটা ইতিমধ্যেই জমে উঠেছে, সেটাকেই আমরা অনুসরণ করব। এ চিন্তাটা স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশে খুব জোরালোভাবে বিদ্যমান থেকেছে। তার প্রমাণ কী? আমি দুটো প্রমাণ হাজির করছি।

ভাষার প্রমিতায়ন হয় প্রধানত ব্যাকরণ ও অভিধানের (উচ্চারণ অভিধানও এ তালিকাভুক্ত) মধ্য দিয়ে। বাংলা একাডেমির উচ্চারণ অভিধান কিংবা ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত জাতীয় সম্প্রচার কেন্দ্রের উচ্চারণ অভিধান হয়েছে প্রধানত অধ্যাপক নরেন বিশ্বাসের হাত ধরে। বাংলা একাডেমির গুরুত্বপূর্ণ ব্যাকরণ বেরিয়েছিল ২০১১ সালে। এর সঙ্গে আরও যোগ করা যায় জামিল চৌধুরী প্রণীত ও বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আধুনিক বাংলা অভিধানের নাম। এর প্রত্যেকটিতে কলকাতার উচ্চারণভঙ্গি, বানানভঙ্গি ও ভাষার অন্যসব উপাদান ঢাকার প্রমিত ভাষায় চড়াও হয়েছে। 

কলকাতার সঙ্গে ঢাকার ভাষার যে অনেক ব্যবধান, তা নয়। আমাদের এখানকার অতি-উৎসাহীরা ঢাকার উচ্চারণভঙ্গির প্রচলিত রূপগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে ব্যাপারগুলো হুবহু কলকাতা থেকে আমদানি করেই মূল সংকটটা তৈরি করেছেন। এর পেছনে যে দৃষ্টিভঙ্গিটা কাজ করেছে, তার স্বরূপ উপলব্ধির জন্য একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ১৯৮৮ সালে জাতীয় সম্প্রচার কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত উচ্চারণ অভিধান করেছেন প্রধানত নরেন বিশ্বাস, যদিও অন্য অনেকের নাম ছিল।

এ অভিধান এবং সংশ্লিষ্ট আরও কাজের জন্য সম্পাদনা পর্যদ একত্রে আনন্দ পুরস্কার পেয়েছিলেন। তো, এ অভিধানের একটা রিভিউ করেছিলেন হুমায়ুন আজাদ। হুমায়ুন আজাদের ‘সীমাবদ্ধতার সূত্র’ বইতে প্রবন্ধটি আছে, সম্ভবত ‘মান বাংলা উচ্চারণ’ নামে। খুব চমৎকার লম্বা প্রবন্ধ। প্রবন্ধের এক জায়গায় আজাদ লিখেছেন, বাংলাদেশের উচ্চশ্রেণি অসংস্কৃত, কাজেই তাদের উচ্চারণ অপ্রমিত। আমরা জানি, হুমায়ুন আজাদের কথার মধ্যে একটু বেশি পরিমাণে উন্নাসিকতা থাকত।

কিন্তু এখানে যা বলা হয়েছে, তা ঢাকার খুব বিরল মত নয়। প্রমিত রীতির যে সংজ্ঞায়ন করে আমরা আলাপ শুরু করেছিলাম, এই বাক্যের মধ্যে প্রকৃত প্রস্তাবে ওই আলাপের একদম বিপরীত কথা আছে। অনুমানটা অনেকটা এরকম : প্রমিত ভাষা বলে একটা আদর্শ ভাষা আছে। বাংলাদেশের ভদ্রলোকশ্রেণি অসংস্কৃত বলে সেটা অনুসরণ করতে পারছে না। কাজেই প্রমিত রীতির রূপ প্রণয়নে এ জনগোষ্ঠীর উচ্চারণ ও ব্যবহারভঙ্গিকে পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। 

আদতে কী হওয়া উচিত ছিল? বাংলাদেশের যে ভদ্রলোকশ্রেণি, তাদের ভাষাই হওয়া উচিত ছিল বাংলাদেশের প্রমিত বাংলা। তাতে আসলে কলকাতার প্রমিতের সঙ্গে এর খুব সামান্য পার্থক্য হতো। সেটুকু না করায় বাংলাদেশে প্রমিত বাংলার ধারণা নিয়ে ঘোরতর টেনশন তৈরি হয়েছে। তার পরিচয় অভিধানের মধ্যে আছে, প্রচারকেন্দ্রগুলোর মধ্যে আছে এবং লোকের ভাষা ব্যবহারের মধ্যেও আছে। একদিকে অনেকের মধ্যে প্রমিতকে নাকচ করার প্রবণতা প্রবল; অন্যদিকে অনেকে এমন ভঙ্গিতে কলকাতাই প্রমিত বাংলা রক্ষা করতে চায় যেন এটা একটা স্থির-পবিত্র ধারণা। দুই দৃষ্টিভঙ্গিই বাংলাদেশে খুব প্রবল। আমরা ঠিক এই মুহূর্তে টিএসসিতে আছি।

এখানে একসময় আবৃত্তি-সংগঠনগুলোর রমরমা ছিল। আর ওই আবৃত্তি-সংগঠনগুলোর প্রধান যে আকুতি, যে দাবি-উচ্চারণের শুদ্ধতা রক্ষা, এবং একইসঙ্গে অন্য উচ্চারণভঙ্গিগুলোকে ব্যাপকভাবে অপরায়ণের যে সংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রচণ্ডভাবে চালু ছিল ও আছে, এটা পর্যবেক্ষণ করলেই আমরা বাংলাদেশে ভদ্রলোকশ্রেণির মধ্যে বিদ্যমান প্রমিত ভাষার পবিত্রতার ধারণা এবং স্থিরতার ধারণা সম্পর্কে বুঝতে পারব। বলেছিলাম, ‘প্রমিত বাংলার ভবিষ্যৎ’ কথাটার মধ্যে একটা উদ্বেগের ধারণা আছে। প্রমিত বাংলা সংক্রান্ত বিদ্যমানতার যে পরিচয় দিলাম, এ উদ্বেগ সেখান থেকে এসেছে। এ উদ্বেগ, আমাদের মতে, অমূলক ও অসঙ্গত।

তবে অন্য একটা উদ্বেগ নিশ্চয়ই এ কথাটার মধ্যে আছে, এবং সেটা খুবই সঙ্গত। সে উদ্বেগটা হলো, প্রমিত বাংলা আমাদের যে যে কাজে লাগা উচিত, সে সে কাজে আমরা কি তা ব্যবহার করছি? আমি বেশ সরল করে বললেও কথাটা একদমই সরল নয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশে অনেক অকাজের ধারণা চালু আছে। লক্ষণ বিচারে মনে হয়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ লোকের প্রমিত বাংলা এবং প্রমিত বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের মূল জায়গা হলো, লোকে ঠিকমতো ক্রিয়াপদ উচ্চারণ করে না এবং কথাবার্তায় ইংরেজি শব্দ প্রচুর মেশায়। প্রকৃতপক্ষে এটা একটা গৌণ ব্যাপার মাত্র।

এটা ভাষার ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনাই না। সংকট হওয়া তো পরের কথা। মানুষ কথা বলার সময় ‘শুদ্ধ’ করে কথা বলে না, মানুষ কথা বলার সময় প্রচুর ইংরেজি শব্দ মেশায়-এটা ভাষার স্বভাব-বিচারে কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। ভাষার প্রমিত রূপ যে যে জায়গায় কাজ করার কথা, প্রমিত বাংলা যে সেসব জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে না, এটাই হওয়া উচিত প্রমিত বাংলা সম্পর্কিত আমাদের প্রধান উদ্বেগ। 

প্রশ্ন হলো, কোন কোন জায়গায় কাজ করা উচিত? প্রমিত রীতির কাজ করার জায়গা প্রধানত তিনটা। যে কোনো প্রমিত ভাষার ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। একটা হলো শিক্ষা, একটা অফিস বা আনুষ্ঠানিক ব্যবহার, আর তিন নম্বরটা হলো আইন বা আদালতের এলাকা। তার মধ্যে আবার প্রধান হলো শিক্ষা। শিক্ষার মধ্যে আবার প্রধান হলো উচ্চশিক্ষা। অনুমান করা যায়, বাংলাদেশে এসব ক্ষেত্রে, অন্তত অভিজাত এলাকায়, প্রমিত বাংলার ব্যবহার নেই বললেই চলে। 

সাধারণভাবে মনে হবে, লোকে তো দিব্যি বাংলায় কথাবার্তা বলছে। ফলে মনে হতে পারে যে, সব ঠিকঠাক আছে। এমনিতে ন্যাচারাল যে বাংলা ভাষা, সেটার সবই ঠিক আছে। সেটা নিয়ে উদ্বেগ অপ্রয়োজনীয়। লোকে ক্যামনে কথা বলছে, নতুন প্রজন্ম ঠিকমতো বাংলা বলছে কি না, এটা নিয়ে উদ্বেগ অপ্রয়োজনীয়। যেটা নিয়ে উদ্বেগ থাকা উচিত তা হলো, আমরা শিক্ষায় বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে পারছি কিনা। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায়। এক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার কিন্তু কার্যত শূন্য। বাংলায় অনেকে পড়াশোনা করে সত্য; কিন্তু যারা সক্ষমএকটা হলো ক্রয়মূলক সক্ষমতা, আরেকটা হলো মেধার সক্ষমতা-তারা সবাই উচ্চশিক্ষাটা ইংরেজিতেই করে। দেশে কিংবা বিদেশে। 

এই যে উচ্চশিক্ষায় ব্যবহৃত হয় না, প্রমিত বাংলা সংক্রান্ত যাবতীয় সংকট এখান থেকেই তৈরি হয়েছে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি-প্রতিবছরই ফেব্রুয়ারি মাস এলে আপনারা শুনবেন, লোকে আদালত সম্পর্কে বলে যে, উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় দেওয়া হয় না। তখন আদালতের লোকেরা করে কী, দুই-একটা রায় বাংলায় দেয় এবং সেটা বিরাট নিউজ হয়।

আমি আজ পর্যন্ত এ কথা বলতে শুনিনি, আসলে সমস্যাটা আদালতের রায়ে নয়, সমস্যাটা হলো উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসাবে আইন বিভাগে বাংলা ব্যবহৃত না হওয়া। যত দিন পর্যন্ত বাংলায় আইন শেখানোর বন্দোবস্ত হবে না, তত দিন প্রকৃতপক্ষে আদালতের লোকদের পক্ষে বাংলা ব্যবহার করা অসম্ভব। কারণ তারা তো আইন ও এর ব্যবহার শিখেছেন ইংরেজিতে।

ফলে ইংরেজিতে রায় লেখা তাদের পক্ষে অনেক সহজ। বাংলায় তিনি সেটা করতে পারবেন না। সব মিলিয়ে, আমরা যে বিপুল পরিমাণ এলাকায় প্রমিত বাংলা ব্যবহৃত হতে দেখছি না, তার প্রত্যেকটার গোড়া আছে উচ্চশিক্ষায় বাংলার ব্যবহার না হওয়ার মধ্যে। 

প্রশ্ন হলো এই, কেন আমাদের প্রমিত বাংলায় উচ্চশিক্ষা দিতে হবে, কিংবা আদালতে রায় লিখতে হবে। কিংবা অফিসে কেন প্রমিত বাংলা ব্যবহার করতে হবে। কারণ এই যে, মানুষ আজ পর্যন্ত যতটা জানতে-বুঝতে শিখেছে তাতে পরিষ্কার, যে ভাষাটি লোকে বেড়ে উঠতে উঠতে শেখে, তা মানুষ রপ্ত করে খুবই সহজে, অসচেতনভাবে। বেড়ে ওঠার সময়, তার ব্যক্তিত্ব গঠিত হওয়ার অংশ হিসেবে।

হেগেলীয় উদাহরণ ধার করে বলতে পারি, আল্লাহ আদমকে দুনিয়ায় পাঠানোর পরে প্রত্যেক জিনিসের নাম শিখিয়েছেন। গল্পটা সেমেটিক ধর্মের গ্রন্থগুলোতে আছে। হেগেলসহ ইউরোপীয় ভাষাতাত্ত্বিকের অনেকেই ধারণাটা ব্যবহার করেছেন। বলেছেন, আল্লাহ আদমকে জিনিসের নাম শিখিয়েছেন-এ কথার অর্থ হলো, নাম শেখানোর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সঙ্গে আদমের পরিচয় ঘটিয়েছেন।

ঠিক এ ধরনের ঘটনাই ঘটে যখন মানুষ বড় হয়, তার প্রথম ভাষা শেখে। ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ শেখার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সঙ্গে সে পরিচিত হয়। যখন মানুষ সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ শেখে তখন তার শেখার পদ্ধতি হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন; সে লেখা দেখে শেখে, চোখে দেখে শেখে, অন্যের সহায়তায় শেখে এবং সবক্ষেত্রেই সচেতনভাবে শেখে। এ জন্যই মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠিত হয় প্রথম ভাষায়-বেড়ে ওঠার কালে অচেতনভাবে শেখা ভাষায়। ফলে যদি মানুষের সাংস্কৃতিক কাজে তথা আনুষ্ঠানিক কাজে এই ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজের ব্যবহারটা অবারিত করা যায়, তাহলে তার কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা যে বাড়ে, সার্বিক জীবন-যাপনের সুখ যে বাড়ে, এটা প্রায় সব পরিসংখ্যানে ও গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে। 

দ্বিতীয় বা বহু ভাষা অর্জন করা সম্ভব, খুব ভালোভাবেই সম্ভব; কিন্তু আন্দাজ করা যায়, দ্বিতীয় একটি ভাষা শিখতে খুব বেশি শ্রম ও সময় লাগবে এবং প্রচুর টাকা লাগবে। এই জোগানের বন্দোবস্ত খুব কম মানুষের পক্ষেই করা সম্ভব। এ কারণেই সব মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন বিষয়গুলো, যেমন শিক্ষা কিংবা রাষ্ট্রীয় অফিস-আদালত দ্বিতীয় ভাষায় চলতে পারে না। অন্তত সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। এরকম সাফল্যের উদাহরণ দুনিয়ায় খুবই বিরল। 

ভাষার যেমন বিচিত্র রূপ আছে, তেমনি বহুমাত্রিক ব্যবহারও আছে। ভাষার সাহিত্যিক ব্যবহার তার একটা মাত্র। সাহিত্যিক ভাষার সঙ্গে প্রমিতের আবশ্যিক কোনো যোগ নেই। বরং ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধ আছে। প্রমিতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রধানত শাস্ত্রীয় চর্চার, বিজ্ঞানের ও দর্শনের। বিজ্ঞান ও দর্শনের ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যথাসম্ভব রেটরিকমুক্ত থেকে হুবহু কোনো একটা কথা প্রকাশ করতে পারার সক্ষমতা।

সাহিত্যের ভাষার লক্ষ্য এর প্রায় বিপরীত, যেখানে আড়াল করাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। প্রমিত বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা যদি উদ্বেগ প্রকাশ করেই থাকি, তাহলে আমাদের উদ্বেগের এলাকা কিছুতেই দৈনন্দিন কথোপকথন আর সাহিত্য-সংস্কৃতি হওয়ার কথা নয়। উদ্বেগটা হওয়া উচিত শাস্ত্রীয় চর্চায় এর অনুপস্থিতি দেখে। এ এলাকায় বাংলার চর্চা ভয়ঙ্কর রকমে পিছিয়ে আছে। এটাই প্রমিত বাংলার ভবিষ্যৎকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রেখেছে। 

আমরা এক বাজে শুদ্ধতার ধারণায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে এই প্রকৃত উদ্বেগের জায়গাটায় মনোযোগ দিতে পারছি না। এই শুদ্ধতার ধারণাই সম্পূর্ণ অন্যভাবে আমাদের শাস্ত্রীয় তথা ডিসিপ্লিনারি চর্চারও ক্ষতি করছে। আমরা যে কোনো শাস্ত্রের পরিভাষাগুলো বাংলায় অনুবাদ করে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছি। বাংলায় অনুবাদ না করে বাংলায় আমরা উচ্চশিক্ষা চালু করতে পারব না বলে জাতিগতভাবে ঠিক করে রেখেছি। পুরো ব্যাপারটাই বোগাস।

পরিভাষার ইংরেজি, সংস্কৃত, জার্মান বা ফরাসিয়ানা অতি গৌণ ব্যাপার। পরিভাষা হয় ডিসিপ্লিনের। সুতরাং পরিভাষার বাংলা করতে হবে-এই যে আবদার, এই যে দাবি, এটা আসলে মস্ত কুসংস্কার। শুদ্ধতার ধারণার এক অনমনীয় সংস্কার এ কুসংস্কারের অন্যতম উৎস। অন্য উৎস কলোনিয়াল আমলের জ্ঞানতত্ত্ব, যখন আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, জ্ঞানমাত্রই অনুবাদমূলক।

জ্ঞান যে চর্চার মধ্য দিয়ে উৎপন্ন হয়, এমনকি অনুবাদমূলক জ্ঞানও যে হয় আসলে ক্লাসরুমে-লেখায়-ল্যাবরেটরিতে চর্চার মধ্য দিয়ে, ভাষা থেকে ভাষায় অনুবাদের মধ্য দিয়ে নয়-সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় আমরা ‘প্রথমে অনুবাদ বই, তারপর উচ্চশিক্ষা’-এরকম এক অনন্ত শৃঙ্খলে দিনযাপন করছি। শাস্ত্রগুলো বাংলায় পড়ব, অর্থাৎ উচ্চশিক্ষায় বাংলার ব্যবহার শুরু করব-এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নিতে পারিনি। এটাই প্রমিত বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কার সবচেয়ে গুরুতর কারণ। 

তবে আশাবাদের কারণও আছে। একটা কারণ বলে এ আলোচনা শেষ করছি। প্রমিত বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো, বাংলা ভাষা প্রায় ২৫/৩০ কোটি মানুষের ভাষা। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার কথা বলব না-সিয়েরা লিয়নে বাংলা চালু হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে উদ্বিগ্ন বা উল্লসিত হওয়ার বিশেষ লাভক্ষতি নেই; কিন্তু বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও আশপাশের একটা বিরাট জায়গায় বহু মানুষ বাংলায় কথা বলে।

এই নিউ লিবারেল যুগে সবকিছুকে আমরা পণ্য হিসেবে দেখি। সবকিছু বাজারের ভাষায় কথা বলে। ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে গেলে মনে রাখতে হবে, এই ৩০ কোটি মানুষ বড় একটা শক্তি। একে যে কোনো সময়, যে কোনো পরিকল্পনায়, যে কোনো উদ্যোগে আমরা রীতিমতো টাকায় রূপান্তর করতে পারি। ৩০ কোটি মানুষের জন্য যদি বই লেখা হয়, তাহলে তার ভোক্তা হবে কী বিপুল! ৩০ কোটি মানুষের জন্য শুধু কোনো একটা পণ্যের ম্যানুয়াল বা কম্পিউটার প্রোগ্রাম যদি তৈরি করা হয়, তাহলে সেটার আর্থিক সম্ভাবনা কত বড় হবে!

ভাষাভাষীর সংখ্যার ভিত্তিতে নতুন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রমিত বাংলাকে আমরা যদি কল্পনা করতে পারি, আর কাজে লাগাতে পারি, আমরা যদি এটাকে রূপান্তর করতে পারি বাজারের ভাষায়, তাহলে প্রমিত বাংলা অবশ্যই অনেক শ্রদ্ধার সঙ্গে সারা পৃথিবীতে গৃহীত হবে। একমাত্র শাস্ত্রীয় চর্চায় বাংলার ব্যবহারের মধ্য দিয়েই আমরা অনুবাদমূলক বা মৌলিক জ্ঞান উৎপাদন করতে পারব; আর কেবল এভাবেই বাংলা ভাষা স্বদেশে এবং বিশ্ববাসীর কাছে কাজের জিনিস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই বাংলা আজকের মতো হবে না, হয়তো ৫০ বছর পরের মতো হবে। এতে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই; এটাই স্বাভাবিক। 

বলা যায়, প্রমিত বাংলার বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, তবে সেটা শুদ্ধতা রক্ষিত হচ্ছে না বলে নয়, কিংবা ভাষা-মিশ্রণ ঘটছে বলে নয়; আর এর ভবিষ্যৎ দারুণ আশাবাদের, যদি শাস্ত্রীয় চর্চায় তথা উচ্চশিক্ষায় একে ব্যবহার-উপযোগী করে তোলা যায়, ব্যবহারের সংস্কৃতি তৈরি করা যায়। 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //