যেভাবে অনুবাদে এলাম

এক

আমার একটা কাজ ছিল ক্লাস সিক্স-সেভেন থেকে, সেটা হচ্ছে অনুবাদ করা। অবজার্ভার পত্রিকার কোনো একটা খবর বা প্যারাগ্রাফ আমাকে দেওয়া হতো আর বলা হতো এটা অনুবাদ কর। এসব করতে গিয়ে খবরের প্রতি আগ্রহ বা খবর কীভাবে লিখতে হয় সেটা আমার জানা হয়ে যায়। আমার প্রথম লেখা ক্লাস ফাইভে, স্কুল ম্যাগাজিনে। ওই ম্যগাজিনে ওটাই আমার শেষ লেখাও।

কারণ ওটাই ছিল স্কুল ম্যাগাজিনের প্রথম ও শেষ প্রকাশ। মানে আমরা স্কুলে থাকাকালে। যথারীতি বন্ধুরা বলাবলি শুরু করল, লেখাটা ওর বাপ লিখে দিয়েছে। তো বাবার অনুজপ্রতিম বন্ধু, ফওজুল করিম তারা, যাকে আমি ডাকতাম তারাকাকু বলে, গল্পটা দেখে বলেছিলেন আমার লেখালেখি চর্চা করা উচিত। আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম ভাই। উনিও আমাকে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। 

সিরিয়াসলি আমার লেখালেখির শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়ার সময়ে, সম্ভবত মাস্টার্সে। সেটা ৭৮ কি ৭৯ সাল হবে। দৈনিক বার্তায় বেরিয়েছিল। শুরুতে লিখতাম খেলাধুলা বিষয়ে, আর কিছু ছিল সাহিত্য নিয়েও। ত্রিশোত্তর কবিদের উপরে লিখেছিলাম। বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়তাম বলে ডিরাইভেটিভ গোছের পাকামি করেছিলাম কিছু। পুরোদস্তুর অনুবাদক বনে যাই ১৯৮৫ সালে, সেবা প্রকাশনীর জন্য লিখতে গিয়ে। 

ছেলেবেলায় প্রচুর বাংলা পড়তাম। ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ার সময় শরৎচন্দ্র পড়েছিলাম। না, আগে বঙ্কিমচন্দ্র এবং পরে শরৎবাবু। তখন ভেতরের ব্যাপারগুলো বুঝেছিলাম একথা বলব না, ওই গল্পটা পড়া আরকি। যদিও তখন আমাকে বলা হতো এগুলো তুমি এখন বুঝবে না, তুমি অন্যকিছু পড়ো। প্রচুর রোমাঞ্চ-রহস্যের অনুবাদ, বিশ্ব-ক্ল্যাসিকের বই আমাদের বাসায় ছিল। সেগুলো তো পড়েছি, এর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় আশুতোষ, বনফুল, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

এরপর ক্লাস এইটে যখন পড়ি, তখন পথের পাঁচালী, আরণ্যক এভাবে পড়তে পড়তে গিয়েছি এবং আমার পড়াটা ধারাবাহিকভাবে এগিয়েছিল। এদের মধ্যে আমি বলব যে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল বিভূতিভূষণ, পথের পাঁচালীর চেয়েও আরণ্যক বেশি করে। বড় বয়সেও মনে হয়েছে তার গদ্যশৈলী যদি অনুকরণ করতে পারতাম। 

এরপরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে আমাকে আকৃষ্ট করে প্রবন্ধ। আমার উপর প্রভাব রয়েছে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ আকরম হোসেন স্যারের। অনার্স প্রথম বর্ষে স্যারের কাছে দুটি বিষয় পড়েছিলাম। বাংলা বানানের জন্য যতটুকু সতর্কতা আছে আমার মধ্যে সেটা স্যারের জন্যই। আমাদের প্রথম পরীক্ষা যেটা উনি নিয়েছিলেন সেটা আমার আজও মনে আছে। মেঘনাদবধ কাব্যের শব্দার্থ ও টীকা-টিপ্পনী।

স্যার বানান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন, যা আমাকে পরে বানানের ব্যাপারে সচেতন করেছে। স্যার আমাদের রসতত্ত্ব-রূপতত্ত্বও পড়িয়েছিলেন, যেটা আজও মাথার মধ্যে আছে। যারা স্যারকে জানেন, বিশেষ করে আমরা যারা তার ছাত্র, তারা সকলেই কমবেশি তার গদ্যভঙ্গিতে আকৃষ্ট হয়েছিলাম ওই বয়সে, খানিকটা অনুকরণ করার চেষ্টাও করেছি। ছাত্রবয়সে যা হয় আরকি। পরবর্তীকালে ‘সেবা প্রকাশনী’তে এসে সহজ গদ্য লিখতে শুরু করি।

কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব, কাজীদা, সর্বজনের জন্য লেখা পছন্দ করতেন, সহজ লেখা পছন্দ করতেন। ফলে আমি প্রবন্ধগন্ধি গদ্যের ধারা থেকে সরে আসি। তারপরও এখনো, আমার অনুবাদিত কোনো বইয়ের ভূমিকা লিখবার সময় পুরনো স্টাইল কিছুটা হলেও চলেই আসে। 

দুই

আমার লেখালেখির সবচেয়ে বড় অংশ হলো সেবা প্রকাশনীকেন্দ্রিক। কাজীদার সঙ্গে পরিচয় আমার লেখালেখির সূত্রে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, ৭৭-৭৯ সালের দিকে, নিয়মিত প্রেসক্লাবে যেতাম আমার বাবার সূত্রে। টেবিল টেনিস-ব্যাডমিন্টন খেলতাম বড়দের সঙ্গে। কাজীদাও আসতেন। ওই সময়েই তার সঙ্গে পরিচয় হয়। 

দাগী আসামি-১ আমার প্রথম বই। এরও একটা মজার ইতিহাস রয়েছে, সেটা হচ্ছে-আমি প্রথম চ্যাপ্টার লিখে কাজীদাকে দেখানোর পর তিনি বললেন আরও চার চ্যাপ্টার লিখে একবারে পাঁচ চ্যাপ্টার নিয়ে এসো। আমি লিখে নিয়ে গেলাম। উনি লাল কালি দিয়ে রক্তাক্ত প্রান্তর করে দিলেন। বললেন, তোমার প্রথম চ্যাপ্টার দেখে আমি খুব আশান্বিত হয়েছিলাম এবং প্রচ্ছদও করে ফেলেছি এখন আমার ভয় হচ্ছে আদৌ বইটা করা যাবে কিনা।

আমার কিছু ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে, তবে ব্যবসায় তো লাভ-ক্ষতি আছেই। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। ধাক্কাটা আমার জন্য প্রবল ছিল। ওই পাঁচ চ্যাপ্টার তুলে নিলাম তার কাছ থেকে, বললাম ফের লিখে আনছি। বাসায় ফিরে ঘুমাতে পারিনি দু রাত। তারপর কেটেকুটে পাঁচ চ্যাপ্টারকে নামিয়ে আনলাম তিন চ্যাপ্টারে। কাজীদা সেটা দেখে বললেন, ‘বাকিটা লিখে ফেলো মিয়া।’

এক অর্থে ওই আমার কোনো পাণ্ডুলিপি তিনি প্রথম ও শেষ এডিট করলেন। তবে সব বইয়ের প্রিন্ট অর্ডার দেওয়ার আগে তিনি লেখায় একবার চোখ বোলাতেন। আর সেটা করতে গিয়ে এখানে-সেখানে হয়তো একটু কলম চালাতেন, অনেকটা সেতার বাজানোর সময় ওস্তাদ যেমন সেতারের কান মোচড়ান সেরকম। আর তাতেই একটা লেখা ঝলমল করে উঠত। এখন যখন আমি নিজে কারও লেখা এডিট করি তখন কাজীদার কাছে শেখা ওই রীতিটাই অনুসরণ করতে চেষ্টা করি। আর যদি মনে হয় একটা লেখা মানুষ করার দরকার পড়বে, তখন দায়িত্বটা লেখক/অনুবাদকের ওপরই ছেড়ে দিই। 

ওয়েস্টার্ন সিরিজ শুরু হয় মূলত কাজি মাহবুব হোসেনের হাত ধরে। সম্ভবত ‘আলেয়ার পিছে’ বইটার নাম। মাহবুব ভাই পরপর কয়েকটা ওয়েস্টার্ন লেখার পর আমি শুরু করি। কাজীদাকে একসময় কোনো পাঠক জিজ্ঞেস করেছিলেন ওয়েস্টার্ন সিরিজের জন্ম ইতিহাস। উনি বলেছিলেন, কাজি মাহবুব হোসেন হচ্ছেন ওয়েস্টার্ন সিরিজের বাবা আর আমি হচ্ছি দাদা। 

সে এক আনন্দময় স্বর্ণ সময় ছিল লেখার জন্য। ওয়েস্টার্ন সিরিজ ঝপাঝপ শেষ হয়ে যেত। প্রথমে ছাপা হতো ছয় হাজার কপি। অল্প কিছুদিনের মধ্যে বেড়ে হয়ে যায় ১২ হাজার। কাজীদার মডেলটা ছিল ভিন্ন। গুদামে কোনো বই রাখতেন না এবং নগদ টাকায় বই বিক্রি করতেন। বইয়ের দোকানে টাকা বাকি থাকে বলে বইয়ের দোকানে বই না দিয়ে বই দিতেন হকারদের। রেল স্টেশনে, বাস স্টেশনে বিক্রি করে এমন হকারদের। আর মফস্বলের বইয়ের দোকানগুলোতে। তবে সবই নগদ টাকায়। বুক পোস্টে পাঠাতেন। 

সেবার পাঠকের কথা যদি ধরি একটা বই চারজন বা তার বেশি লোকে পড়ছে তাহলে সংখ্যাটা কিন্তু বেশ বড়। অবশ্যই সেবা প্রকাশনীর বই, আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, রানা ছাড়া সেবা প্রকাশনীর সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক রকিব হাসান এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তিন গোয়েন্দা সিরিজ। তারপর ওয়েস্টার্ন এসেছে। যারা পড়তেন তাদের সংখ্যাটা বেশ বড় বলেই আমার ধারণা। চিঠিপত্রও পেয়েছি, অনেক গালমন্দও শুনেছি কখনো কখনো। কারণ আমি যেটা চাইতাম তা হচ্ছে ওই ধারাটা বাংলার ও বাঙালির মানসগঠনের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে। ফলে দুই-একজন গালমন্দ করত। যখন লিখেছি ‘আমার মা যেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা’ তখন সেগুলো নিয়ে গালাগাল হতো। 

তিন

এরপর তো ৯৪ সালে আমেরিকায় পাড়ি জমালাম। লেখালেখি থেকে দীর্ঘ পরবাস। বিদেশে থাকার সময় আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না দেশে কী ধরনের ওয়েস্টার্ন বা অন্য বই অনুবাদ হচ্ছে। কর্মব্যস্ততার জন্যও লেখার সময় পেতাম না। তাছাড়া সেখানকার স্থানীয় লাইব্রেরিতে ওয়েস্টার্ন খুব কমই মিলত। ওদের লাইব্রেরি অনেক সমৃদ্ধ, কিন্তু শেষমেশ পাঠক রুচির একটা ব্যাপার তো থেকেই যায়। মনে হতো ওখানে ওই ধারার বই কেউ পড়ছে না। এভাবে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। তারপর ২০১২ বা ২০১৩ সালের দিকে ফেসবুকে রাজীব নূরের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং মূলত একরকম তাগাদা দিয়েই দুটি ওয়েস্টার্ন লিখিয়ে নেন। এখন আর ওয়েস্টার্নের প্রতি আগ্রহ নেই, আমার পাঠরুচি বদলে গিয়েছে। এখন একটু সিরিয়াস লেখাপত্রের দিকে ঝোঁক।

আমেরিকায় থাকতে দুটো গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলাম। একটা চিনুয়া আচেবের বই প্রথমা থেকে বের হয়েছিল, এখন বাংলা গবেষণা থেকে আবার নতুন করে আসবে। আরেকটা দিব্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত মুরাকামির। সবসময় একটা জিনিস মেনে চলার চেষ্টা করি আমি, যে বইটা কেউ একবার অনুবাদ করে ফেলেছেন সেটা নতুন করে না করবার। এখন একটু সিরিয়াস ধারার কাজ করতে চেষ্টা করছি। জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক স্যারের বইটার বাংলা করছি। এটা যেহেতু বড় কাজ এবং যথেষ্ট সিরিয়াস কাজ, ফলে পুরো সময় দিয়ে এটাই করছি। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //