দুটি গল্প

মায়া বিভ্রমের ঘুরপাকে

সেই কবে পথে বেরিয়েছি, মনে করতে পারি না, দিনের পরে দিন ট্রেন, বাস পথে হেঁটে যাচ্ছি, একটা উন্মাদনা নিয়ে আমি আমার বালিকা বেলায় হারিয়ে যাওয়া যমজ বোনটিকে দেখতে পাব। তার মিষ্টি কচি ডাবের মতো মুখ, তিরতিরে নাকমুখ, বাতাস চুরমার করা হাসি, আহা! কত দিন দেখিনি, যত বার আমার জুতোর তলা ক্ষয়ে যেতে থাকে, ততবারই আমি সেই মুখটি দেখার উন্মাদনায় জোরে পা চালাই। ডাকে চিঠি পেলাম কারও, বহুদিন ধরে।

একসময় পরিশ্রান্ত আমি রাস্তাটার মোড়ে দাঁড়িয়ে একে ওকে প্রশ্ন করি, এই নম্বরের বাড়িটি কোথায়? টুনিদের বাড়ি? কেউ চেনে না। নম্বর খুঁজে হয়রান হচ্ছি যখন, কপালে ঘাম জমছে, একজন বলে, ওই যে সামনের আকাশি বাড়ি ওটাই, নম্বর ঠিক আছে, কিন্তু ওখানে একজন বয়স্কা বিধবা নারী থাকেন। বয়স্কা বিধবা আবার কে? পরক্ষণেই মনে হয়, তার কাছেই হয়তো বড় হচ্ছে টুনি। হনহনিয়ে এগিয়ে গিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অনুভব করি উত্তেজনা, আমার পুরো অস্তিত্ব কাঁপছে। বৃদ্ধা দরজা খুলে গভীরভাবে আমাকে নিরীক্ষণ করতে থাকে। 

তাকে সালাম দিয়ে ছটফট করতে থাকি, টুনি কই? সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধা আমাকে হতবাক করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, পঞ্চাশ বছর আগে তোকে চিঠি পাঠিয়েছিলাম, এদ্দিনে তুই এলি ভাই? পুরো রক্তে ঝিম মেরে যায়, আমিও গভীরভাবে তার মুখ দেখতে থাকি, নাহ! কোথাও টুনি নেই। তার মানে আমিও কোথাও নেই? যে আমরা বালক বয়সে ছিলাম? আমার হতাশাকে যত আমার ঘৃণা লাগতে শুরু করে, ততই সহোদরার আকুল কান্না প্রলম্বিত হয়, আমার কী ভাগ্য ভাই, মৃত্যুর আগে তোকে পেলাম। একা একা বাঁচতে বাঁচতে হয়রান হয়ে গেছি ভাই। ততক্ষণে আমার চারপাশে বর্তমান-ভবিষ্যৎ দিন-রাত্রি অদ্ভুত বিভ্রম ছড়িয়ে ছড়িয়ে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। একটা আয়না দেখার ভয়ে আমার গলা ছেড়ে আমার কাঁদতে ইচ্ছে করে। 

অসুখ 

রাতে বিছানার সঙ্গে লটকে-পটকে নিজের শরীরকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলাম, শিমুল ফুল তোমার ঘ্রাণ কই? এই তো আঁচল উপুড় করে বসে আছি। ফাল্গুন তুমি আসছ না কেন? এই তো দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, তুমি খুলছ না। বইমেলা? কবে তোমার শুরু? সপ্তাহ পেরিয়ে যাচ্ছে, তুমি কোন ঘোরে আছ হে? ফাল্গুনে এবার শিমুল বাগানে যাওয়ার পাকা প্রোগ্রাম করেছিলাম।

প্রতিবার হেমন্ত আর ফাল্গুনকে প্রতি স্নায়ু দিয়ে দিয়ে অনুভব করি আমি। কিন্তু কদিন ধরেই ঠান্ডা লেগে শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। এর মধ্যে এক রাতে মশারির নিচের অন্ধকারে হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। এর মধ্যেই অনুভব করি স্বপ্ন জাগরণের মধ্যে যে শরীর ভেতর থেকে আমার মাথার খুলির মধ্যে কেউ বাড়ি মারতে শুরু করেছে। হুড়োহুড়ি করে ঘুম ভাঙতেই মাথা চেপে উঠে বসি। ফের যেন পেরেক ঠুকছে আর পুরো মাথা চিলিক দেয়া ব্যথায় চৌচির হয়ে যাচ্ছে। 

ভোরের আজান শোনা যাচ্ছে। আমি প্রচুর কষ্টেও রাতে সহসা কাউকে ডাকি না। কিন্তু সেদিন দিক হারিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকি, প্লিজ কেউ আমার মাথায় বরফের ডিব্বা ঢেলে দাও। কিছুক্ষণ পরে অনুভব করি হাজব্যান্ড চেপে চেপে বরফ দিয়ে যাচ্ছে পুরো মাথায়। একসময় হালকা লাগে। শীত মাথা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। বেলা বাড়লে ফের ঘুম ভাঙলে অনুভব করি ঘাড় নাড়াতে পারছি না। আস্তে আস্তে গলার চারপাশে হাত বুলাই, আরে! ঘাড়ের দুদিকের রগ ফুলে টনটন করছে।

আমাদের বাড়িতে নিজে নিজে ডাক্তারিতে একেকজন ওস্তাদ। বছর আগে ফিজিওথেরাপিস্টের কাছ থেকে কতগুলো ব্যাপার না জানলে হয়তো আমি গরম সেঁক দেওয়া শুরু করতাম। সে বলেছে, নতুন ব্যথা হলে বরফ দিতে। ফলে ধীরে ধীরে উঠে ঘাড়ের দুপাশে চেপে চেপে ফের বরফ দিয়ে কন্যা এসে গলায় লটকে দেয় কলারবন। ধীরে ধীরে জানালা খুলি, যেন অস্বস্তির কোষে সহসা ফাল্গুনের বাতাস খেলে গিয়েই তা কাশির সিরাপের গন্ধ হয়ে আমাকে কুঁকড়ে দেয়। 

টিভি ছেড়ে বইমেলা দেখি। প্রতিবছর বাপ-বেটিসহ মেলায় গিয়ে প্রিয় লেখকের বই কিনি। নইলে ফেব্রুয়ারি সার্থক হয় না। কিন্তু আমার ডাক্তার বন্ধু কড়া নিষেধ করেছে। বলেছে, এ অবস্থায় মেলার ধুলো আর কুয়াশা তোর অবস্থা ভয়ংকর করে তুলবে। মিনমিন করে বলি, আমার এসব ইচ্ছে মরে গেছে। শীতের মধ্যে পর পর দুবার বরফের এই মহামারি কাণ্ডের পরে ভয়াবহ ইনফেকশন, টনসিল জ্বরে গত ১০/১২ দিন ধরে আমার দেহশক্তি, আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

সারাক্ষণ মাথা ঝিম ঝিম করে। ডাক্তারের কাছে গেলেই ১০ রকমের টেস্ট অ্যান্টিবায়োটিকসহ আর আট রকমের ওষুধ দিয়ে দেয়। এমনিতেই দিনে কমপক্ষে ২০টা ওষুধ খাই, এক রোগের জন্য পাঁচ রকমের ওষুধ। ফলে, দুর্মর জেদে ডাক্তার দেখাতে যাই না। আমাকে সবচেয়ে দুর্বল করে ফেলে ভয়াবহ কাশি। কাশি, টনসিল পেইন, জ্বর-সব রাতে বিছানায় শুয়ে গায়ে কম্বল তুললেই এগিয়ে আসে। হাজব্যান্ড বিচলিত, তোমাকে কাল বেঁধে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। আমাকে ফেসবুকে অ্যাক্টিভ দেখে চারপাশের মানুষজনের শুরু হয় ভুল বোঝা। শীতে বিয়ে থেকে শুরু করে একটা না একটা প্রোগ্রাম লেগেই থাকে।

সব প্রোগ্রাম যত ক্যানসেল করি, তত চাপাচাপি করে, বুঝতে থাকি, আমার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না। মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকলেও যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের অজান্তেই কীভাবে থাকে-এটা কোন যুক্তি দিয়ে বোঝাই? স্বপ্নের বিছানা এখন আতঙ্কের নাম হয়ে গেছে। তারপরও ভয়ে ভয়ে কম্বল টানি, হাজব্যান্ড ঘুমিয়ে পড়েছে। সহসা নিজের ওপর ক্ষোভ অদ্ভুত এক সাহস দেয় আমাকে, আমি ডাকতে থাকি কী রে জ্বর, কই গেলি? আয় বাবা লক্ষ্মী, কাশি? টনসিল পেইন? আয় তোরা লক্ষ্মীরা, আমাকে চারপাশ থেকে চেপে ধর। এ বছর শিমুল বাগান, বইমেলা তো লাটে উঠেছে, বাকি জীবনের জন্য যে গুহাবাসী হয়ে যাই, সেই ব্যবস্থা কর। 

হাসপাতালে ঘুম ভাঙে। ডাক্তার হাসতে হাসতে বলেন, আপনি চিরকালই বাহাদুর। অসুখের উপর রাগ করা আপনাকে মানায়? জানেন, প্রেসার হঠাৎ বেড়ে কি সাংঘাতিক হাই হয়েছিল? জানতে চাই না, কিচ্ছু না বলে ফের অবসাদে বালিশে আঁকড়ে চোখ বন্ধ করি। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //