আমি বিজ্ঞানটাই যা বুঝি, লিঙ্গ নিয়ে ভেদাভেদ বুঝি না

আন্দ্রে গেজ। নোবেলজয়ী জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী। ছায়াপথের কেন্দ্রে মহাভরের কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব শুধু অনুমানের বিষয় নয় বরং বাস্তবিক, মহাশূন্য থেকে সেই সত্য পেড়ে এনেছেন তিনি। এরই স্বীকৃতি মেলে ২০২০ সালে। ১২২ বছরের ইতিহাসে পদার্থবিজ্ঞানে মোটে চারজন নারী ব্যক্তিত্ব নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তিনি চতুর্থ ও সর্বশেষ।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলসের পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার অধ্যাপক। জন্ম ১৯৬৫ সালের ১৬ জুন, নিউইয়র্কে। তার শৈশব, শিক্ষাজীবন, কৃষ্ণগহ্বর গবেষণা ও নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি প্রসঙ্গে নানা প্রশ্ন নিয়ে ইমেইলে মুখোমুখি হয়েছিলেন বিজ্ঞান লেখক জাহাঙ্গীর সুর। এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তার মা-বাবা ও শিক্ষকদের থেকে পাওয়া প্রেরণা ও শিক্ষার কথা, তার তরফে আছে তরুণ বিজ্ঞানীদের জন্য উপদেশও।

‘অভিনন্দন, আপনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, পদার্থবিজ্ঞানে’-কমিটির পক্ষ থেকে ভোররাতে ফোনযোগে এমন উষ্ণ অভিবাদন পাওয়ার পর আপনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? 

অবিশ্বাস্য। কথাই আটকে গিয়েছিল আমার। অবারিত আনন্দ ছুঁয়ে দিয়েছিল মনটাকে। টানা কয়েক দিন আমি যেন ঘোরাচ্ছন্ন ছিলাম। সবচেয়ে আনন্দদায়ক হলো, এই স্বীকৃতি আমি পেয়েছি করোনা ভাইরাস মহামারির সময়।

পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী প্রথম নারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন মেরি কুরি। ২০২২ সাল পর্যন্ত এ শাখায় স্বীকৃতি পাওয়া মোট চার নারীর আপনি সর্বশেষ খেতাবজয়ী। নিজেকে কীভাবে দেখেন? 

আমি নিজেকে সর্বাগ্রে একজন বিজ্ঞানী হিসেবেই বিবেচনা করি। আমি বিজ্ঞানটাই যা বুঝি, লিঙ্গ নিয়ে ভেদাভেদ বুঝি না। এ কারণে, চতুর্থ নারী হিসেবে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পাওয়ার বিষয়টি আমার কাছে বিশেষ কিছু নয়। তবে, হ্যাঁ, এ কথা আমাকে বলতেই হবে-আমি এই সময়ের এই লোকসমাজের মানুষ হিসেবে গর্ব বোধ করি। এখন এই সমাজ নারীদের পেশাজীবনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। পদার্থবিদ্যায় নোবেলের মতো সম্মাননা পাওয়ার মধ্য দিয়ে আমি যদি দখিন-দুয়ার খোলায় অগ্রণী ভূমিকা রাখি, তাহলে আমি সত্যিই গর্বিত। 

নিশ্চয়ই অনেক নারী আপনাকে তাদের আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করছেন। এটা ভাবতে কেমন লাগে?

আমিও মানি, তরুণ বিজ্ঞানীদের জন্য আদর্শ অনুসরণীয় (রোল মডেল) থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন আমি ছোট ছিলাম, আমারও আদর্শ ব্যক্তিত্ব ছিল যাদের জীবনের কাহিনি আমাকে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা জোগাত। এদের একজন মেরি কুরি। আমার মনে আছে, ছোটবেলায় মেরি কুরির জীবনী পড়েছিলাম। আমাকে উৎসাহিত করার জন্য তার জীবনী পড়তে দিয়েছিলেন আমার মা-বাবা। পড়ে যখন জানতে পারলাম, একজন নারী পরিবার সামলেও এতকাল আগেই তার কাজের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, যথাসম্মান পেয়েছিলেন-এটা আমাকে বেশ উদ্দীপ্ত করেছিল।

আমার তো মনে হয়, মেরি কুরির জীবন এক অবিশ্বাস্য আখ্যান, যা আমার মতো অনেককেই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। কাজের উচ্চতায় নারীদের মধ্যে তিনি দীর্ঘদিন একক তারকা ছিলেন। একই উচ্চতার কাজ ও এর স্বীকৃতি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পরবর্তী ঢেউয়ের একজন নারী হিসেবে আমি সত্যিই গৌরব বোধ করছি। অনেকেই মেরি কুরিকে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসেবে মনে করতেন। কিন্তু আমি মনে করি না, বিজ্ঞানে অবদান রাখার জন্য নর-নারীতে তফাত আছে এতটুকু।

তবে পরিবার সামলানোর প্রশ্ন আসলে পুরুষ হোক আর নারী হোক, তখন কিন্তু ফারাক ঠিকই থাকে। এক্ষেত্রে স্বীকার করতেই হবে, পুরোপুরি পেশাজীবনে মনোনিবেশ করবে নাকি ঘর-সংসার সামলাবে-একটা পর্যায়ে গিয়ে নারীরা এখনো এমন পরিস্থিতির মুখে পড়ে। নারীদের সত্যিকারের সফল দেখতে চাইলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রধানত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। 

আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে মহাভরের কৃষ্ণগহ্বর আছে। এই সত্য উন্মোচন করার স্বীকৃতি স্বরূপ আপনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। মানুষ যা চোখে দেখতে পায় না, টেলিস্কোপের চোখে যা ধরা পড়ে না, এমন কিছু কীভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন?

কৃষ্ণগহ্বর (ব্ল্যাক হোল) অনুসন্ধানে ও অধ্যয়নে আগ্রহী যে কারও জন্য এটি একটি মৌলিক জিজ্ঞাসা। কৃষ্ণগহ্বর এমন বস্তু যার মাধ্যাকর্ষণ টান এতটাই প্রবল যে, কোনো কিছুই তা এড়াতে পারে না, এমনকি আলোও নয়। আর এ কারণেই কৃষ্ণগহ্বরকে সরাসরি দেখতে পারা যায় না। নাক্ষত্রিক ভরের কৃষ্ণগহ্বরগুলো দীর্ঘকাল ধরে তাত্ত্বিক ধারণার মধ্যেই ছিল। কিন্তু এখন আমাদের কাছে এদের বাস্তবিক অস্তিত্বের শক্তিশালী পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ রয়েছে। প্রায় ৫০ বছর আগে, বিজ্ঞানীরা ধারণা দিয়েছিলেন, মহাবিশ্বের সব ছায়াপথে (গ্যালাক্সি) অতিভরের কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে। এদের ভর সূর্যের ভরের ১০ লাখ থেকে একশ কোটি গুণ পর্যন্ত হতে পারে। এরা ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত। 

আমাদের ছায়াপথের নাম আমরা রেখেছি আকাশঙ্গা ছায়াপথ (মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি)। এর কেন্দ্রে অত্যন্ত ছোট্ট আয়তনে ‘অতিভরের’ কৃষ্ণগহ্বর কি সত্যিই রয়েছে, এর উত্তর জানার জন্য অনেক আগে থেকেই আমার ‘মাথার  ভেতরে/স্বপ্ন নয়,  এক বোধ কাজ করে।’ এর উত্তর বের করতে পারলে একই সঙ্গে বৃহৎ অর্থে বড় একটা মীমাংসা হয়ে যায়-আদৌ এ ধরনের বস্তু মহাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিনা। আর যদি থেকেই থাকে, তা হলে এটি আমাদের বোঝার সুযোগ দেয় যে, কীভাবে এই অতিভরের 

কৃষ্ণগহ্বরগুলো তাদের পরিপার্শ্বে সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে, এবং তারা যে ছায়াপথগুলোর মধ্যে থাকে তাদের গঠন ও বিবর্তনকে তারা কীভাবে প্রভাবিত করে।

কৃষ্ণগহ্বর গবেষণার জন্য কেন আমাদের নিজস্ব ছায়াপথকে বেছে নিয়েছিলেন?

আমাদের নিজস্ব ছায়াপথকে অধ্যয়ন করার প্রকৃত সুবিধা হলো নৈকট্যের সুবিধা। ছায়াপথের কেন্দ্রের কোনো কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা করলে আমাদের নিজেদের ছায়াপথের কেন্দ্রই তো সবচেয়ে কাছের উদাহরণ। আমাদের পরে নিকটতম ছায়াপথটিও এই কেন্দ্রের থেকে শতগুণ দূরে। ফলে অন্য যে কোনো ছায়াপথে চোখ রাখার চেয়ে আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে আলোকপাত করলে আমরা অনেক বেশি বিস্তারিত ছবি দেখতে পারি, সেই সম্ভাবনা বেশি। 

অনেক কম আয়তনের ভেতর অতিবেশি ভর আছে, আমরা কীভাবে তা বুঝতে পারি?

এক্ষেত্রে একটা বিকল্প কৌশল আছে-কৃষ্ণগহ্বরকে প্রদক্ষিণ করা নক্ষত্রের কক্ষপথ পর্যবেক্ষণ করা। মহাকর্ষীয় টানের কারণে গ্রহগুলো যেভাবে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, কৃষ্ণগহ্বর থাকলে নক্ষত্ররা একইভাবে তাকে প্রদক্ষিণ করবে। যদি কোনো অতিভরের বস্তু না থাকে তবে নক্ষত্ররা ছিটকে যাবে, কিংবা অনেক ধীর গতিতে প্রদক্ষিণ করবে। মহাশূন্যে কোনো গ্রহ বা নক্ষত্র কীভাবে পাক খায় তা নির্ধারণ করে দেয় গ্রহটি বা নক্ষত্রটির কক্ষপথের ভেতরে থাকা ভরের পরিমাণ।

যদি আমরা জানতে পারি, কোনো নক্ষত্র কত দ্রুত প্রদক্ষিণ করে, তা হলে আমরা জানতে পারব যাকে কেন্দ্র করে নক্ষত্রটি প্রদক্ষিণ করছে, তার ভর কতখানি। যদি আমরা নক্ষত্রের কক্ষপথ সম্পর্কে জানি, এর মানে ব্যাসার্ধ আমাদের জানা। গবেষণার সময় আমি ছায়াপথের কেন্দ্রের যতটা সম্ভব কাছাকাছি নক্ষত্রদের প্রদক্ষিণ পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছি। কারণ আমি দেখতে চেয়েছিলাম, অসম্ভব ছোট্ট আয়তনের ভেতর অসীমপ্রায় ভর থাকে কিনা। 

যেমনটা আমি নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলাম-আমার বিশ্বাস, সবাইকে আমি বিশ্বাস করাতে পেরেছি যে, আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রে একটি অতিভরের কৃষ্ণগহ্বর থাকার উল্লেখযোগ্য প্রমাণাদি আমাদের হাতে রয়েছে। কৃষ্ণগহ্বর থাকার বিষয়টি এখন আর সম্ভাবনার বিষয় নয়, এটি এখন সুনিশ্চিত বিষয়। বলা বাহুল্য যে, কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের বোধগম্যতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি বিশাল ভূমিকা রেখেছে। 


বিজ্ঞানের বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের জন্য বোধগম্য করে তুলতে যোগাযোগ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

এ কথা সত্য যে, অনেক বৌদ্ধিক কাজই একজন বিজ্ঞানীর একাকী সাধনা। যারা নিজের মতো করে চিন্তাভাবনা করতে ভালোবাসেন, নিঃসন্দেহে তেমন ব্যক্তিত্ব এই ক্ষেত্রে বেশ উপভোগ করেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, এটি অনেক বেশি সামাজিক ও সামগ্রিক ব্যাপার, ফলে আমাদের সাধনার বিষয়টি জনগণের কাছেও বোধগম্য হওয়া চাই। সত্যি বলতে কী, আমাদের উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সামাজিক হওয়া উচিত এবং আমাদের যথাযথ যোগাযোগ দক্ষতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

শিক্ষার্থীরা যেমনটা শেখে-কীভাবে লিখতে হয়, কীভাবে যোগাযোগ করতে হয়, কীভাবে নিজের কাজ সম্পর্কে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সামনে তুলে ধরতে হয়। একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, কলেজে আমরা শিক্ষার্থীদের শেখাই তারা কীভাবে সুসংজ্ঞায়িত প্রশ্নের উত্তর দেবে; এরপর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আমরা শিক্ষার্থীদের শেখায় কীভাবে সঠিক প্রশ্নটি করা যায়। এটা একটা বড় বাঁকবদল।

আমরা যা করি তা কেন গুরুত্বপূর্ণ, এর প্রাসঙ্গিকতা কী-তা অন্যদের কাছে স্পষ্ট করে তোলা আবশ্যক। আর এ কারণেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করতে হবে। যখন আমরা এরকম যোগাযোগ করতে বাধ্য হই, তখন একটি সুবিধাও আমরা পাই-এটি আমাদের চিন্তা করতে সাহায্য করে যে, আসলেই কি গুরুত্বপূর্ণ, কোনটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, আমরা যা করি তাকে কীভাবে বিস্মৃত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করব ইত্যাদি। 

শৈশবে আপনি কী হতে চেয়েছিলেন?

ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বলা সহজ-ওটা এরকম ছিল, ওরকম হতে পারত। আমরা যা করি তার প্রতি আমাদের আগ্রহের উৎস নিয়ে কথা বলা তেমনই সহজই বটে। আমি নোবেল কমিটিকে যেমনটা বলেছিলাম, আমার মনে হয়, চাঁদে অবতরণের সেই বাঁকবদলের মুহূর্তই আমাকে বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তুলেছিল। তখন আমার বয়স মাত্র ৪ বছর।

কিন্তু তখনই ওই ঘটনা মহাশূন্য ও মহাকাশের বিশালতা সম্পর্কে আমার মনে গভীর ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। পাশাপাশি এ কথা বলে দেওয়া উচিত যে, আমি তখন একজন মহাকাশচারী হতে চেয়েছিলাম এবং একই সময়ে একজন ব্যালে নৃত্যশিল্পী হতে চেয়েছিলাম। সুতরাং শিশু হিসেবে আমি সত্যিই বিজ্ঞানকে আমার আগ্রহের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম, এটা বলা যায় না আদতে।

তবে একটা বিষয় সত্যি-ওই সময় থেকেই আমি ধাঁধা পছন্দ করতাম। জিগস পাজল, ক্রসওয়ার্ড পাজল, সুডোকু-সব ধরনের ধাঁধা। আমার তো মনে হয়, বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার আগে একজনকে মৌলিকভাবে ধাঁধা সমাধানকারী হিসেবে পটু হতে হবে। টুকরোগুলো একত্র করা, প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা করা বা বড় ছবি দেখার চেষ্টা করা-এসব দক্ষতা খুব দরকার। 

বিজ্ঞানের প্রতি আপনি কখন থেকে আগ্রহী হয়ে ওঠেন?

আমি যখন কলেজে উঠলাম, তখন বুঝতে পারলাম, গণিত ও বিজ্ঞানে আমি আগ্রহী। আমি এমআইটিতে যেতে চেয়েছিলাম। মানে, আমি স্বপ্ন নিয়েই সেদিকে ধাবিত হচ্ছিলাম। আমি কলেজে পড়েছি গণিতকে প্রধান বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু মহাশূন্য নিয়ে আমার অনেক চিন্তাভাবনা ছিল। মহাকাশের ভাবনা কত রাত যে আমাকে জাগিয়ে রাখত! মহাকাশের কী বিশালতা। আর আমরা কত ক্ষুদ্র, কত তুচ্ছ। মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশ ও কাল এত নগণ্য। ভাবলেই ভড়কে যাই, আবার ভাবলে রোমাঞ্চিত হই। আমার মনে হয়, আমি যখন ছোট ছিলাম, এই দুটি দিকই আমাকে (বিজ্ঞানের পথে) তাড়িত করেছিল। 

শিক্ষাজীবনে পরিবার থেকে কতটা অনুপ্রেরণা ও সমর্থন পেয়েছিলেন? 

বলতে পারেন, আমি খুব ভাগ্যবান ছিলাম। আমার জীবনে গর্ব করার মতো বেশ কয়েকজন আদর্শ মানুষ ছিলেন। একেকজন একেক কারণে আমার কাছে আদর্শ অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সবার আগে মা-বাবার কথা বলতে চাই। তারা ছিলেন মহৎ, অবশ্যই অনুসরণীয়। বাবা অধ্যাপক ছিলেন, সে সুবাদে বিদ্যায়তনিক জগতের ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম প্রথম থেকেই। একজন অধ্যাপকের জীবন কেমন, কী অনুভ‚তি তাকে জাগিয়ে রাখে-বাবাকে দেখে আমি অনুভব করতে পারতাম। তিনি সবসময় আমার কৌত‚হলকে উৎসাহিত করতেন। 

আর আমার মা ছিলেন সমসাময়িক এক চিত্রশালার পরিচালক। ফলে নারীরা ঘরের বাইরে যাবে, নেতৃত্ব দেবে-এসব আমি ছোটবেলা থেকেই শিখেছিলাম। আমার সামনে মা ছিলেন সাক্ষাৎ দৃষ্টান্ত। 

আমার এক কাকা ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী। আমার এখনো মনে পড়ে, খাবার টেবিলে কাকা ও বাবার সঙ্গে বসে থাকতাম, তারা আলোচনা করতেন-আদি গ্রিকরা কীভাবে সব কিছু শিখেছিল, তারা কীভাবে সমস্যার সমাধান বের করতে জেনেছিল। আদিকালে কোনো কিছু বোঝার প্রক্রিয়া এবং গ্রিকদের আবিষ্কারের সৌন্দর্য বা তাদের যুক্তির নান্দনিকতা, আমাকে অভিভূত করেছিল। এজন্য আমি বলব, কাকা আমার শৈশবের একজন অন্যতম বড় আদর্শ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। 

আমি পরিবারের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। সবার কাছেই কিছু না কিছু শেখার থাকে। আমার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা এরকম-‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র।’ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার সক্ষমতা মানবচরিত্রের খুবই তাৎপর্যবহ দিক। কারণ মানুষের সঙ্গে মিশলে নানা বিষয় সম্পর্কে জানা যায়, কত কিছুই শেখা যায়। যেমন আমার মা বলতেন, ‘করব করব বলে কোনো কিছু ফেলে রেখ না। তা করে ফেল।’ 

শিক্ষকদের কাছ থেকে কেমন স্নেহ ও উৎসাহ পেয়েছিলেন?

কয়েকজন শিক্ষকের কথা স্মরণ করি শ্রদ্ধাভরে। আমার শিক্ষাজীবনের শুরুর দিকে রসায়ন যার কাছে শিখেছি, সেই শিক্ষিকা আমাকে খুবই উৎসাহ জোগাতেন। একার্থে আমি তো বলব, আমি খুব ভাগ্যবান ছিলাম। কারণ শিক্ষাজীবনের পরবর্তী ধাপে আমি খুব বেশি নারী বিজ্ঞান শিক্ষক পাইনি। ওই শিক্ষিকাই ছিলেন আমার জীবনের অন্যতম প্রেরণাদায়ী ও উৎসাহ জোগানো ব্যক্তিত্ব। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে আমি হেল ব্র্যাটের সঙ্গে কাজ করেছি। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কাজ করেছি গেরি নিউগেবুরের সঙ্গে, পাশাপাশি দ্বিতীয় পরামর্শক হিসেবে পেয়েছিলাম অ্যানিলা সার্জেন্টকে। আমি সত্যিই ভাগ্যবান ছিলাম। এরা এমন মানুষ, যারা আশ্চর্যজনকভাবে উৎসাহদাতা ছিলেন। আমি সত্যিই 

কৃতজ্ঞ। আমি মনে করি, কীভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়, চ্যালেঞ্জকে কীভাবে সুযোগে রূপান্তর করতে হয়, তা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ শিক্ষা আমি পেয়েছিলাম অ্যানিলার কাছে। তিনি আমাকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একবার বিশেষ মুহূর্তে পরামর্শ দিয়েছিলেন, প্রতিবন্ধকতাকে সুযোগে রূপান্তর করতে হবে। তিনি সেই পথও বাতলে দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন, কীভাবে লক্ষ্যে অবিচল থাকতে হয় এবং কীভাবে তা অর্জনের জন্য কাজে মনোনিবেশ করতে হয়। 


গবেষণায় তো নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। কীভাবে তা মোকাবিলা করা উচিত? 

গবেষণায় চ্যালেঞ্জ অনিবার্য বিষয়। এজন্য আমি মনে করি, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ক্ষমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যা জানি না এবং যে সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই, গবেষণায় আমরা তা অন্বেষণ করি। এই অন্বেষণ কখনোই মসৃণ ও সহজ নয়। মনে রাখতে হবে, কোনো কিছুই সহজ নয় বরং জটিল ও অগোছালো। একজন বিজ্ঞানীর কাজ হলো সমস্যাগুলোর কারণ খুঁজে বের করা। জটিলতা ও অগোছালোকে সহজ করা। এক্ষেত্রে গবেষণার সময় সবকিছুকে একত্রে দেখার চেষ্টা করতে হয়। 

কিংবা গবেষণা অনেকটা ধাঁধা মেলানোর মতোকোনটির সঙ্গে কোনটি যাবে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করার মতো। অনেক সময় সহজ চেষ্টায় ধাঁধা মেলে না। কিন্তু চেষ্টাকে ব্যর্থতা না বলে অগ্রগতি হিসেবে দেখা যেতে পারে। এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গি। কোনো কিছুকে একজন কীভাবে দেখছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। সবাইকে একই দৃষ্টিতে দেখতে হবে, তা নয়। যখন কোনো কিছু প্রত্যাশামাফিক হয় না, আমি মনে করি, তখনই নতুন কিছু আবিষ্কারের পথ খুলে যায়।      

গবেষণা করতে গিয়ে যখন এমন কিছুর সন্ধান মেলে যা আমাদের পূর্বজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খায় না, তখন আমরা এভাবেও ভাবতে পারি, ‘বেশ তো। দারুণ ব্যাপার বটে! নিশ্চয়ই আরও কিছু আবিষ্কার হওয়ার অপেক্ষায় আছে।’ আপনি একার্থে, এ ধরনের ঘটনাকে তত্তে¡র ব্যর্থতা বলতে পারেন। কিন্তু আমি বলব, এ হলো নতুন কিছু আবিষ্কারের ও অচেনাকে জানাবোঝার বিশাল সুযোগ। সুতরাং যদি কখনো কিছু প্রত্যাশ্যামতো না ঘটে, একে বরং আলিঙ্গন করা উচিত, এতে নতুন কিছু শেখা যাবে।

জড়তা ও ভীতি কাটিয়ে সাফল্য অর্জনে অধ্যবসায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

কোনো বিষয় যা জানা নেই কিংবা যা ভয় জাগায়, তাও যে চেষ্টা করা উচিত-এ বিষয়ে একটি উদাহরণ দিতে চেয়েছিলাম। আমার জীবনের উদাহরণ। আমি মানুষের সামনে কথা বলতে ভয় পেতাম। এখন তো আমি দিব্যি কথা চালিয়ে যেতে পারি, কিন্তু স্কুলে আমি কথা বলতে ভয় পেতাম। এতটাই ভয় পেতাম যে, পোস্ট-গ্রাজুয়েট  পর্যায়ে এমন স্কুল বেছে নিয়েছিলাম, যেখানে আমাকে অন্যদের পড়াতে হবে না। আমার মনে পড়ছে, যখন আমি আমার প্রথম গবেষণার সেমিনারে কথা বলেছিলাম, মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত কাঁপছিল। আমি খুব নার্ভাস ছিলাম।

আমার পিএইচডি উপদেষ্টা গেরি নিউগেবুর তখন বলেছিলেন, ‘দেখ, তোমাকে তো অন্যকে শেখাতে হবে, তাই এই ভয় অতিক্রম করতেই হবে।’ এরপর আমি শিক্ষকতা করেছি। আমি আবিষ্কার করেছি, আমি সত্যিই এটি উপভোগ করেছি। আমি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি পদার্থবিদ্যার বুনিয়াদি পাঠ শিক্ষার্থীদের শেখাতে চাই, কারণ এ বিষয়ে খুব কম নারী শিক্ষক ছিলেন। মানে, আমি এমন কিছু বেছি নিয়েছিলাম, যা ছিল আমার পছন্দের। এটা বেশ বড় অভিজ্ঞতা ছিল। আমি মনে করি, গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষকতার প্রতি আমার যে আগ্রহ আছে, তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। 

বিজ্ঞানী হতে আগ্রহী তরুণদের জন্য আপনার প্রধান উপদেশ কী?

আমি প্রায়ই আমার শিক্ষার্থীদের বলি, স্কুল-কলেজে তোমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ কর, তা নির্ভর করে তোমাদের শিক্ষাগুরু কে ছিলেন, বা কার সঙ্গে তুমি কাজ কর, তাদের গুণাবলির ওপর; তোমাদের পেশাজীবনের বিকাশে তাদের ভ‚মিকা গুরুত্বপূর্ণ। তুমি নিশ্চয়ই এমন মানুষের সঙ্গে কাজ করতে চাও, যিনি তোমার জীবনে ছায়া হয়ে থাকেন, যিনি সত্যিই একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তোমার বিকাশকে উৎসাহিত করতে ও লালন করতে চান। আমি আমার গ্রুপের তরুণ বিজ্ঞানীদের কিংবা অন্য কোথাও তরুণ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলার সময় একটা কথা প্রায়ই বলি। তাদের বলি, কয়েক বছর পর পর তিনটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে, নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দিতে। 

এক: তুমি কী করতে ভালোবাসো, কীসে তুমি আনন্দ পাও? কী তোমাকে কৌতূহলী করে তোলে?

দুই: তুমি ঠিক কী অন্বেষণ করতে চাও? মন যা চায়, সেই বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ চেষ্টা না করা অব্দি তুমি বলতে পার না, তুমি এটা উপভোগ করবে কি করবে না। একটু পর আমার নিজের জীবনের একটা উদাহরণ দেব, যা থেকে আমি এ বিষয়টি শিখেছি।

তিন: তুমি সমাজকে ফিরতি হিসেবে কী সেবা দেবে, কীভাবে অন্যদের জন্য সেই পথ অবারিত করবে যাতে তারা বুঝতে পারে, কীসে তারা আনন্দ পায়? বিজ্ঞদের থেকে তুমি উপকৃত হয়েছ, তুমি কীভাবে অন্যকে উপকৃত করবে?

আমি মনে করি, এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর কয়েক বছর পর পর ঝালিয়ে নেওয়া দরকারি। কারণ সময় যত গড়ায়, মানুষ যত বড় হয়, উত্তরগুলো পাল্টে যায়, বদলাতেই থাকে।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //