আজ থেকে ২০ বছর আগের কথা। আমি তখন যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির ছাত্র। ক্লাসে শিক্ষক জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করছেন, আমি শুনছি। আলোচনার এক পর্যায়ে শিক্ষক বললেন, ‘জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব তুলে ধরে এমন চমৎকার একটি উদাহরণ আছে বাংলাদেশে।’ সুদূর প্রবাসে নিজ দেশের নাম শুনে আগ্রহ নিয়ে শুনলাম সব কথা। ঘটনাটি আমার জানা ছিল, তবে সেই ঘটনা কেমব্রিজের একটি ক্লাসে শুনব ভাবিনি।
বাংলাদেশ থেকে এক সময় বৈধভাবে ব্যাঙের পা রপ্তানি করা হতো বিদেশে; ১৯৭০-এর দশক থেকে শুরু হয়ে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত চলে এই রপ্তানি। জলাভূমিসমৃদ্ধ বাংলাদেশে অনেক ব্যাঙ আছে, তাই সেই সময় নীতিনির্ধারকরা ভেবেছিলেন ব্যাঙের পা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হলে দেশ লাভবান হবে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল ব্যাঙ শিকারের মহাযজ্ঞ। এক শ্রেণির মানুষ ব্যাঙ শিকারকে পেশা হিসেবে নিলেন, লাভ তো বেশ ভালো।
কয়েক বছর ব্যাপক সংখ্যায় ব্যাঙ শিকারের ফলে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে ব্যাঙের সংখ্যা অনেক কমে গেল। ব্যাঙের প্রধান খাদ্য যেহেতু পোকামাকড়; ব্যাঙের সংখ্যা কমে যাওয়াতে ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় ব্যাপকভাবে বেড়ে গেল। শেষে এমন অবস্থা হলো যে ব্যাঙের পা রপ্তানি করে বছরে যত টাকা আয় হলো তার চেয়ে বেশি টাকা ব্যয় হলো বিদেশ থেকে অতিরিক্ত কীটনাশক আমদানি করে।
এই ঘটনায় আমরা বুঝতে পারলাম প্রকৃতিতে ব্যাঙ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা ব্যাঙের পা রপ্তানি বন্ধ করে দিলাম। অনুরূপ উদাহরণ দেওয়া যায় প্যাঁচা ও সাপ দিয়ে যারা ফসলের ক্ষতিকারক ইঁদুর দমন করে। আরও উদাহরণ দেওয়া যায় আবাবিল পাখি এবং চামবাদুড় দিয়ে যারা মানুষের জন্য ক্ষতিকারক মশা-মাছি দমন করে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
সহজ ভাষায় জীববৈচিত্র্য বলতে বোঝায় প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীবসহ সকল প্রকার জীবের বৈচিত্র্য। এর তিনটি স্তর আছে-১. জিনগত বৈচিত্র্য, যেটি একই প্রজাতির বিভিন্ন এককের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে। যেমন-সব আম গাছের আম এক রকম হয় না; ২. প্রজাতিগত বৈচিত্র্য, যেটি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মধ্যকার পার্থক্য নির্দেশ করে, যেমন-আম গাছ আর জাম গাছ এক রকম হয় না; ৩. বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য, ভিন্ন ভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের মধ্যকার পার্থক্য নির্দেশ করে, যেমন-সুন্দরবন আর মধুপুর বন এক রকম নয়। যে জায়গার জীববৈচিত্র্য যত বেশি সমৃদ্ধ সেই জায়গা তত বেশি উৎপাদনশীল, সেখান থেকে মানুষ নানাভাবে উপকৃত হয়। তবে শুধু বৈচিত্র্যের সমৃদ্ধি নয়, বিপন্ন জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের জন্য উপকারী জীববৈচিত্র্যকে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য খুবই সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের অবস্থান গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায়। এর উত্তরে সু-উচ্চ হিমালয় পর্বতমালা আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এর পূর্বে মালয় এলাকার জীববৈচিত্র্য এক রকম, আর পশ্চিমে ভারত এলাকার জীববৈচিত্র্য আরেক রকম। বাংলাদেশের অবস্থান মাঝামাঝিতে হওয়ায় উভয় এলাকার জীববৈচিত্র্য এখানে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ চশমাপরা হনুমান (Phayre's Langur) আর সাধারণ হনুমানের (Northern Plains Langur) কথা বলা যেতে পারে।
চশমাপরা হনুমান মালয় এলাকায় পাওয়া যায়, যেটির বিস্তৃতি পশ্চিমে বাংলাদেশ পর্যন্ত এসে শেষ হয়েছে। অপর দিকে সাধারণ হনুমান ভারত এলাকায় পাওয়া যায় যেটির বিস্তৃতি পূর্বে বাংলাদেশ পর্যন্ত এসে শেষ হয়েছে। সে কারণে চশমাপরা হনুমান ও সাধারণ হনুমান দুটি প্রজাতিই বাংলাদেশে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য কতটা সমৃদ্ধ সেটি ভালো বোঝা যায় অন্য এলাকার সঙ্গে তুলনা করলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বাংলাদেশে প্রাপ্ত পাখি প্রজাতির মোট সংখ্যা (৭০০-এর কিছু বেশি) পুরো ইউরোপ মহাদেশে প্রাপ্ত পাখি প্রজাতির মোট সংখ্যার সমান। উল্লেখ্য, আয়তনের দিক থেকে ইউরোপ বাংলাদেশের চেয়ে ৬৯ গুণ বড়।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের পুরোটা এখনো অজানা। প্রতিবছর নতুন নতুন প্রাণী ও উদ্ভিদ এ দেশে আবিষ্কৃত হয় যেগুলোর উপস্থিতি আগে জানা ছিল না। এমনকি এ দেশের গৃহপালিত পশু-পাখি এবং চাষ হয় এমন ফল-ফসলের বৈচিত্র্যও অনেক বেশি। বাংলাদেশে শুধু ধানের প্রকারভেদ ২০০০-এর বেশি। প্রজাতিগত বৈচিত্র্য সম্পর্কে আমাদের তুলনামূলকভাবে ভালো ধারণা রয়েছে। তথাপি বহু নিম্ন শ্রেণির প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজাতিগত বৈচিত্র্য সম্পর্কে সামান্য জানা আছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের জাতীয় সংরক্ষণ কৌশল (‘ন্যাশনাল কনজারভেশন স্ট্র্যাটেজি’) অনুযায়ী এ যাবৎ দেশে প্রাপ্ত বিভিন্ন দলভুক্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা নিম্নরূপ:
স্তন্যপায়ী ১৩৯ (যার ৯টি সামুদ্রিক), পাখি ৭০৩ (যার ২১১টি শীতের পরিযায়ী), সরীসৃপ ১৭২ (যার ১৬টি সামুদ্রিক), উভচর ৬৫, মাছ ৭৪২, সন্ধিপদী (পোকামাকড়) ৫০০০-এর বেশি, শামুক-ঝিনুক ৪৭৯, গুপ্তবীজী উদ্ভিদ ৩,৭২৩, নগ্নবীজী উদ্ভিদ ৭, ছত্রাক ২৭৫, শৈবাল ৩,৬০০।
জীববৈচিত্র্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো হলো-পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের মিশ্র চিরসবুজ বন, সুন্দরবন, টেকনাফ উপদ্বীপ, মধুপুর গড়, বৃহত্তর সিলেটের হাওর এলাকা, মেঘনা নদীর মোহনা এবং বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত অতলস্পর্শী (সোয়াচ অব নো-গ্রাউন্ড)। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ৩৬টি বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য ‘হটস্পট’-এর একটির পশ্চিম প্রান্তের অংশ যার নাম ‘ইন্দো-বার্মা বায়োডাইভার্সিটি হটস্পট’।
প্রকৃতি আমাদের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য উপহার দিলেও আমাদের অবিবেচনাপ্রসূত কার্যক্রমে তার বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যতটুকু আছে তার অবস্থাও ভালো নয়, কারণ জীববৈচিত্র্যের প্রকৃত গুরুত্ব এবং এর সঙ্গে মানুষের এই পৃথিবীতে টিকে থাকার যোগসূত্র আমরা অনুধাবন করতে পারিনি, এখনো পারছি না। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেলে টেকসই ও সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়।
আমরা গর্ব করে দেশের প্রজাতি সমৃদ্ধির কথা বলি, কিন্তু অনেকেই জানি না এ দেশ থেকে অন্তত ১৫ প্রজাতি বন্যপ্রাণী লুপ্ত হয়ে গিয়েছে, যাদের বেশিরভাগই ছিল বড় আকৃতির গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি। আজকাল খুব কম মানুষেরই বিশ্বাস হবে যে, আজ থেকে ১০০ বছর আগে বাংলাদেশে তিন প্রজাতির গণ্ডার ছিল। এছাড়া আরও ছিল-বুনো মহিষ, হায়েনা, নেকড়ে, বারসিঙ্গা হরিণ, নীলগাই, গোলাপি-শির হাঁস, ময়ূর, মিঠাপানির কুমির ইত্যাদি। আশঙ্কা করা হয় এ দেশ থেকে লুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রজাতির সংখ্যা বাস্তবে ১৫-এর কয়েক গুণ বেশি, কারণ অনেকগুলো প্রজাতি বিগত কয়েক দশকে দেখা যায়নি।
২০১৫ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশেল বিপন্ন প্রজাতির লাল তালিকা (রেড লিস্ট) অনুযায়ী বাংলাদেশের ২২ শতাংশ প্রাণী প্রজাতি বিপন্ন। এছাড়া ১৭ শতাংশ প্রাণী প্রজাতি সম্বন্ধে পর্যাপ্ত তথ্য নেই বিধায় এরা বিপন্ন নাকি বিপন্ন নয় তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আশঙ্কা করা হয় এদের বেশিরভাগই প্রকৃতপক্ষে বিপন্ন। মূলত আবাসস্থল ধ্বংস, জীববৈচিত্র্যের অতিরিক্ত ব্যবহার, আইনের অপর্যাপ্ত প্রয়োগ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসমর্থনের অভাব, বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতির সম্প্রসারণ, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকাকে রক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া মানুষের কার্যক্রমে হুমকির মুখে পড়া কিছু এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই সব এলাকা আইনগতভাবে সংরক্ষিত হলেও বাস্তবে সেখানকার জীববৈচিত্র্য পুরোপুরি সংরক্ষিত এটি বলার সুযোগ নেই। এছাড়া বেশ কিছু প্রজাতিকে বিপন্ন ও রক্ষিত ঘোষণা করে সেগুলোকে তাদের
প্রাকৃতিক আবাসস্থলে অথবা বন্দিদশায় প্রজননের মাধ্যমে সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কাজ করছে।
বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ চ্যালেঞ্জিং, তবে অসম্ভব নয়। এর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশের রক্ষিত এলাকার নেটওয়ার্ককে কার্যকর করা, যাতে সেখানে জীববৈচিত্র্য নিরাপদ থাকতে পারে। সেই সঙ্গে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ যে সব এলাকা রক্ষিত এলাকার নেটওয়ার্কের বাইরে রয়েছে সেগুলোকে রক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা প্রয়োজন।
এছাড়া ব্যাপক গণসচেতনতা বৃদ্ধি, আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা, গবেষণা বৃদ্ধি করা, জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, স্থানীয় জনগণের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা, বিদেশি প্রজাতি নিয়ন্ত্রণ করা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি কমিয়ে আনলে দেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিশ্চিত হবে। যথাযথ পদক্ষেপ নিলে ক্ষতিগ্রস্ত জীববৈচিত্র্যকে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব, শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিল যার উদাহরণ।
বন্দিদশায় প্রজননের মাধ্যমে কয়েকটি কাছিম প্রজাতিকে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বন্দিদশায় জন্ম নেওয়া কাছিমগুলোকে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এ দেশের গবেষকরাই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এমন কাজে সফলতা দেখিয়েছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ যত কঠিনই হোক না কেন, বাংলাদেশের মানুষের সৃষ্টিশীলতার বদৌলতে একদিন নিশ্চয় সেটি সফল হবে।
লেখক: বন্যপ্রাণী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : জীববৈচিত্র্য বাংলাদেশ প্রাণী উদ্ভিদ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি ব্যাঙ ঈদসংখ্যা ২০২৩ সাম্প্রতিক দেশকালের ঈদসংখ্যা
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh