বাংলাদেশের পাখি: পল থমসন

এই নিবন্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাখির গত সাড়ে তিন দশকের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে।

একজন ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের পাখি নিয়ে আমি আলোচনা করি কীভাবে! এটুকু বলতে পারি যে আমার পঞ্চম জন্মদিনে প্রথম একটি পাখির বই উপহার পাই, তখন থেকেই এই প্রাণীর প্রতি আগ্রহী হই এবং একজন নিয়মিত পাখি পর্যবেক্ষক হয়ে যাই। এভাবেই পাখি হয়ে যায় আমার গভীর আগ্রহের একটি প্রাণী। তবে তা হবি বা নেশা হিসেবে।

খয়রা-কাস্তেচরা।

আমি প্রথম দু মাসের জন্য বাংলাদেশ ভ্রমণ করি ১৯৮৬ সালে, এরপর পাঁচ মাসের জন্য ১৯৮৭-৮৮ সালে এবং তারপর ১৯৯১ সাল থেকে টানা ২০২০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় দীর্ঘদিনের জন্য অবস্থান করি। এই ৩০ বছর প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। তবে আমার অবসর সময়ের সিংহভাগ কেটেছে পাখি পর্যবেক্ষণে। 

পাখি পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে পূর্বের সঙ্গে বর্তমানের বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। আগে পাখি দেখার জন্য আদর্শ স্থানগুলোর বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য ছিল না, যা এখন বেশ সহজলভ্য। কারণ কয়েক দশক আগে পাখি পর্যবেক্ষকদের সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় অনেক কম ছিল। অন্যদিকে কিছু স্পট পূর্বে যতটা প্রাচুর্যময় ছিল, এখন ততটা নয়। পাখি দেখার কাজটিও ছিল ভিন্ন। মৌলিকভাবে শুধু নির্মল আনন্দ লাভের জন্য যে কেউ এই কাজটি করতে পারে শুধু চোখে দেখে বা কানে শুনে। 

লাল ঝুঁটি-ভুতিহাঁস।

তবে বর্তমানে আরও ভালোভাবে দেখার জন্য অনেকেই বাইনোকুলার ব্যবহার করেন, ক্ষেত্রবিশেষে টেলিস্কোপও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। দূরের জলচর পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য এই যন্ত্রগুলো বেশ উপযোগী। আগের দিনগুলোতে আমি ও আরও কিছু পর্যবেক্ষক এভাবেই পাখি দেখতাম। তখনকার দিনে ফিল্ম ক্যামেরাগুলো বেশ উচ্চমূল্যের ছিল এবং সেগুলো দিয়ে খুব ভালো ফলাফল পাওয়া যেত না। তাই আমরা ছবি তোলায় মনোযোগ দেইনি; বরং যা দেখতাম ও খেয়াল করতাম তা লিপিবদ্ধ করে নিতাম।

এগুলো পরে ফিল্ড গাইড ও বড় রেফারেন্স বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে নিতাম। তুলনামূলকভাবে আজকাল ডিজিটাল ক্যামেরায় হাজার হাজার ছবি ধারণ করা যায়। সেই সঙ্গে অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করার শিল্পটি হারিয়ে গেছে; এমনকি অনেকে বাইনোকুলার ব্যবহার করাও প্রয়োজন মনে করেন না। একইভাবে বর্তমান প্রজন্ম ছবি তুলে সেগুলো সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করে থাকে এবং সেগুলোতে  অন্য আলোকচিত্রীরা প্রতিক্রিয়া জানতেই ব্যতিব্যস্ত। অথচ বর্তমানে প্রাপ্য উন্নতমানের ফিল্ড গাইডগুলোর রেফারেন্সের শরণাপন্ন হতে তাদের তেমন আগ্রহ নেই। 

এখন বাংলাদেশের পাখি সম্পদ, প্রাপ্তিস্থান ও তাদের উপস্থিতির চিত্রটি দেখা যাক। পল্লী অঞ্চলের পাখিদের পরিবর্তন বিষয়ে বিশদ বলা মুশকিল। পরিচিত যে পাখিগুলো আগে লোকালয়ে ও বনাঞ্চলে দেখা যেত, সেগুলো এখনো দেখা যায়। তবে আমার ধারণা তারা সংখ্যায় হ্রাস পেয়েছে, বিশেষ করে বাংলা শকুন। মানুষের জন্য এই বিশেষ উপকারী পাখিটি ক্ষতিকর ব্যথানাশক ওষুধ ডাইক্লোফেনাকের কারণে সংখ্যায় ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়ে প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে। তবে আশার কথা এই যে, তাদের শেষ কলোনিগুলো রক্ষার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা চলছে। 

এই নিবন্ধের বাকি অংশে আমার নিয়মিত দেখা পাখির নিবাসগুলোর পরিবর্তন তুলে ধরার চেষ্টা করব। আশি ও নব্বই দশকে ঢাকা ও এর আশেপাশের স্থানগুলোর মধ্যে চিড়িয়াখানা ছিল পাখি দেখার একটি প্রধান স্থান। এর ভেতরের লেকগুলোতে শীতকালে প্রচুর সংখ্যায় বুনো হাঁস দেখা যেত। স্থানীয় পাতি-শরালির বড় ঝাঁক তো দেখা যেতই, সেগুলোর মধ্যে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আসা উত্তুরে-ল্যাঞ্জাহাঁস এবং পাতি-তিলিহাঁসও থাকত। এমনকি বিরল প্রজাতির বেয়ারের-ভুতিহাঁস এবং বৈকাল-তিলিহাঁসও দেখা যেত। 

দুঃখজনকভাবে ঢাকার বৃহত্তর উন্নয়ন, মানুষের চাপ ও চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এই বুনো হাঁসদের আগমন বন্ধ হয়ে গেছে। আগে লেকগুলোর কাছে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ ছিল, যা সেই হাঁসগুলোকে শান্তিতে থাকতে সহায়তা করতো। সংলগ্ন বোটানিক্যাল গার্ডেনটি পাখির চমৎকার আবাসস্থল ছিল, যা আজো আছে। তবে সেখানকার বাঁশঝাড়গুলো আরও বড় ছিল, বাগানগুলোর কোনা আরেকটু অবিন্যস্ত ছিল এবং কিছু খোলা মাঠ ছিল। 

ব্লাইদের-নলফুটকি।

আরও ছিল কিছু অনুন্নত জমি। বেশ কিছু আবাসিক পাখি আগের মতোই আছে। তবে আগে কিছু খুদে পরিযায়ী পাখির দেখা মিলতো, যেমন-ব্লাইদের-নলফুটকি ও বাচাল-নলফুটকি। আরও ছিল তাইগা-চুটকি ও নীলগলা-নীলচুটকি। অন্যদিকে ঢাকার প্রান্তে যেসব জমিগুলো এখন উঁচু করে আবাসভূমি তৈরি করা হচ্ছে (যেমন পূর্বাচল), সেগুলো পাখি দেখার জন্য উপযোগী কিনা তা আমরা খুঁজে দেখিনি বা জানাও ছিল না। 

ঢাকার উত্তরের শালবনগুলোর ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, তার প্রভাব পাখি সম্পদের উপরও পড়েছে। পূর্বে মধুপুর জাতীয় উদ্যান একটি চমৎকার পাখি দেখার স্থান ছিল, বিশেষ করে প্যাঁচার জন্য। সেখানে শীতের রাতে গাছের উপর নিয়মিত প্যাঁচাদের ডাক শোনা যেত, বিশেষ করে খয়রা-গাছপ্যাঁচা, মেটে-হুতমপ্যাঁচা ও দাগি-ঈগলপ্যাঁচা। দিবাকালীন পাখি দেখাও আনন্দের ছিল; কারণ তখন দেখা মিলত টিকেলের-দামা, কালাবুক-দামা ও ধলাভ্রু-চুটকির মতো অনিন্দ্যসুন্দর পাখি। কিন্তু এখন সেই বড় গাছগুলো অস্তিত্বহীন হয়ে যাওয়ায় পাখি পর্যবেক্ষকরা সেখানে কচাচিৎ ভ্রমণ করেন।  

আশির দশকে প্রথম অনুসন্ধানমূলক গবেষণা চালানোর সময় উপকূলের কাদাচরগুলো জলচর পাখিদের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি এই অববাহিকায় এমনই একটি 

প্রাকৃতিক পরিবেশ, যা ঝড় ও পাড় ভেঙে যাওয়ার কারণে নিয়মিত পরিবর্তনশীল। এখানে পাখি দেখা ছিল একটি চ্যালেঞ্জ, কেননা নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। আগের মতো এখন খোলা নৌকা নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে সন্দীপ যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া উচিত নয়। আগে সেখানে দেশি গাংচষার বড় ঝাঁক ও চামচঠুঁটো বাটান একশটির উপর দেখা যেত। সার্বিকভাবে সে পাখিগুলো এখনো উপস্থিত আছে, তবে আকারে ও সংখ্যায় অনেক কমে গেছে।

বড়-গুটিঈগল।

পাখি দেখার আরও একটি মনোরম স্পট ছিল, যেখানে যাওয়া সহজ ছিল কিন্তু সে স্থানটি এখন হারিয়ে গেছে। সে স্থানটি হচ্ছে পতেঙ্গা। শীতে পাখির পরিযায়নকালে ডেভ জনসন (আমার পুরনো পাখি দেখার সঙ্গী) এবং আমি রাতের ট্রেনে স্লিপার কোচে রওনা হয়ে ভোরে গিয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছতাম। তারপর একটি বেবি ট্যাক্সি নিয়ে স্টিল মিল কলোনিতে গিয়ে নেমে পায়ে হেঁটে পতেঙ্গা সমুদ্রতীরে গিয়ে হাজির হতাম। ৯০ দশকে জনসংখ্যা কম ছিল, সুন্দর বাঁধানো সমুদ্র সৈকত এবং সেটির উপর ছোট ছোট গাছ ও ঝোপঝাড় ছিল।

সেখানে দেখা পেয়েছিলাম ইউরেশীয়-ঘাড়ব্যথার এবং একটি বিরল পুবের ফুটকি। সেখানে আরও ছিল কিছু ঘাসাচ্ছাদিত জায়গা ও বালুতট। সেখানে জোয়ার-ভাটার সঙ্গে সৈকত পাখি এবং পানির পাখির দেখা মিলত। ১৯৯২ সালের আগস্ট মাসের একটি ভ্রমণ বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। সেদিন জোয়ারের সময় সৈকত ও পানির পাখিদের চমৎকার বিশ্রামাগার দেখেছিলাম। সেখানে দেখেছিলাম একটি চামচঠুঁটো-বাটান এবং ১২০টি বড়-নট। ১৯৯৪ সালের নভেম্বরের স্মরণীয় দৃশ্য মনে গেঁথে আছে-সৈকতে দুটি নর্ডম্যান-সবুজপা’র পানির কিনার ঘেঁষে আহার করা এবং কাছাকাছি অবস্থানরত পাতি-সবুজপা’র সঙ্গে যা চমৎকার সাদৃশ্য তৈরি করেছিল। 

১৯৯৭ সালের মধ্যে পরিস্থিতি বেশ পরিবর্তিত হয়ে এসেছিল। কয়েকটি চিংড়ি খামার তৈরি হয়েছিল যেগুলোর পাড় জোয়ারের সময় পাখিদের বিশ্রামাগারে পরিণত হয়। কয়েক বছর এই স্পটগুলো এপ্রিল-মে মাসে আমাদের দুই সপ্তাহের জন্য পাখি দেখার তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল। সেখানে দেখা পেতাম গ্রে টেইলড ট্যাটলার, যা কিছুটা সবুজ-বাটানের মতো দেখতে। আরও থাকত ধুলজিরিয়ার ঝাঁক এবং বিভিন্ন সৈকত পাখি। তারা ছিল বসন্তের পরিযায়ী এবং অনেকেই থাকত আকর্ষণীয় প্রজনন পালকে। ২০০১ সালে আমার সর্বশেষ ভ্রমণকালে দুঃখজনকভাবে স্থানটি অবনতির দিকে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। এখন আর সেখানে পাখি-সম্পদের অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। ১৮৯ প্রজাতির পাখির একটি মনোরম আবাসের করুণ পরিসমাপ্তি। 

উপকূলীয় এলাকার মধ্যে কক্সবাজার একটি উৎকৃষ্ট পাখি দেখার স্থান, যেটি অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। ১৯৮৮ সালে সেখানে প্রথম ভ্রমণের সময় আমার সোনাদিয়া দ্বীপ এবং সেখানে পাখির উপস্থিতির সম্ভাবনা বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না। তবে কক্সবাজার শহরটি ছিল নিরিবিলি এবং কোলাহলমুক্ত, তখন সেখানে অগণিত ভ্রমণকারী দেখা যেত না। শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে রিকশায় করে সৈকতের দক্ষিণ প্রান্তে চলে যাওয়া যেত।

পাতি-তিলিহাঁস।

তারপরে তৃপ্তির সঙ্গে ছোট পাহাড়গুলোর ভেতর হেঁটে যাওয়া যেত; যেটি এখন হিমছড়ি ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে পরিচিত। যদিও বনাঞ্চল কমে গিয়েছিল, তারপরও সেখানে কিছু বড় গাছ ও ছায়াঘেরা কিছু জলপ্রবাহ ছিল এবং যেগুলোর কিনার ধরে হাঁটা যেত। এই অগভীর জলপ্রবাহের ভেতর হাঁটার সময় দেখা পেতাম পরিবারসহ কালাপিঠ-চেরালেজ, বন-খঞ্জন, নীলকান-মাছরাঙা, লালমাথা-কুচকুচি এবং বিভিন্ন ধরনের চেনা পাখির। দুপুরের রোদে জলপ্রবাহের ভেতর পা ডুবিয়ে বসে বিশেষ প্রশান্তি পেতাম এবং সেই সঙ্গে পাখিরাও আমার কাছে আসত। তখন দেখা যেত ছাতারে, বুলবুল ও বিভিন্ন প্রজাতির চুটকি।

এরা আসত পানি পান ও গোসল করতে। আশা করতাম ধলাভ্রু-কাস্তেছাতারে আসবে, কিন্তু প্রবাহের বাঁকে দেখা পেয়েছিলাম তিলাবুক-কাস্তেছাতারের; যা এদেশে এখন পর্যন্ত একমাত্র রেকর্ড। এই অঞ্চলে এখনো আকর্ষণীয় পাখি দেখতে পাওয়া যায়। তবে উন্নয়ন নামক কর্মকাণ্ড ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। দুঃখজনকভাবে নগরায়ণের উদ্দেশ্যে বনের অনেকখানি এবং সংলগ্ন ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। স্থানীয় ও উদ্বাস্তুরাও স্থানটির বেশ ক্ষতি করেছে। নতুন রাস্তা কক্সবাজার ও টেকনাফ উপকূলকে বেষ্টন করে ফেলেছে, জলপ্রবাহগুলো এখন আর পাখিদের এবং পাখি পর্যবেক্ষকদের শান্তিপূর্ণ বিশ্রামস্থল নয়। আর সৈকতও থাকে ভ্রমণকারীদের কোলাহলে পূর্ণ। 

আমার পাখি দেখার সবচেয়ে প্রিয় স্থান ছিল দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল, যেখানে আমি সিংহভাগ সময় কাটিয়েছি। তবে সেখানেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। ৯০ দশকে সেখানে অনেকগুলো হাওর ও জলাশয় ছিল, যেখানে শীত কাটাতে আসত অসংখ্য জলজ পাখি। স্পটগুলো ছিল-পাশুয়া বিল, আইলা বিল, মাটিয়ান হাওর ও হালির হাওর।

পরিষ্কার মনে আছে, ১৯৯৩ সালের শীতকালে পাশুয়া হাওরে দেখেছিলাম আনুমানিক দুই লাখ বুনো হাঁস সাঁতরে চলেছে। মনে হয়েছিল যেন পানির উপর তেল ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৯৫ সালে হালির হাওরে নৌকা নিয়ে ডুবুরি হাঁসের ঝাঁকের কাছে গিয়ে একমাত্র স্মিউ হাঁস দেখেছিলাম। সেই হাওরগুলো এখন শুকিয়ে গিয়ে চাষের জমিতে পরিণত হয়েছে। শীতের পরিযায়ী পাখিদের এখন একমাত্র আশ্রয়স্থল হচ্ছে টাঙ্গুয়া ও হাকালুকি হাওর, যেখানে তাদের কিছুটা নিরাপত্তা রয়েছে।

আমার পাখি দেখা জীবনের দীর্ঘতম সময় অতিবাহিত করেছি শ্রীমঙ্গলে। ১৯৮৬ সালে এদেশে পাখি দেখার স্থানের ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা ছিল না। প্রফেসর কাজী জাকের হোসেন আমাকে শ্রীমঙ্গল ঘুরে দেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন আমার সামান্যই ধারণা ছিল যে, এখানে আমি বারবার আসব এবং সব মিলিয়ে মোট ৩০০ দিন সেখানেই কাটাব। তখন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পরিণত হয়নি এবং কোনো ভ্রমণকারী ধূলিময় কাঁচা রাস্তা ধরে সেখানে বেড়াতে যেত না। তখন শুধু কয়েকটি কাটা গাছ বহন করার ট্রাক দেখা যেত। তখন সেখানে পাখিও বেশি দেখা যেত। আমার নোট বলে দেয়, সেই বনে প্রথম দিনেই ৫৬ প্রজাতির পাখি দেখেছিলাম।

পিয়াং-হাঁস।

মেটেমাথা-হরিয়াল, বাংলা-শকুন ও সরুঠুঁটি-শকুন দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। পরবর্তী এক দশকে অসংখ্য পাখি দেখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল নেপালি-ফালভেটা, খয়রাগাল-ফালভেটা, মেটেগলা-ছাতারে, খয়রাবুক-ছাতারে এবং লালকপাল-ছাতারে। দুঃখজনকভাবে এই ছাতারেগুলো এখন লাউয়াছড়া থেকে হারিয়ে গেছে। এমনকি নিয়মিত দেখা পাওয়া ছোট-মালাপেঙ্গা ও বড়-মালাপেঙ্গাও সংখ্যায় কমে এসেছে। 

হাইল হাওরের কাহিনিটি কিছুটা ভিন্ন। ৮০ ও ৯০ দশকে পাখি দেখার সময় শুকনা মৌসুমে আমরা খোলা মাঠে এবং যেসব নদীর পানি হাওরে ঢুকছে সেগুলোর ক‚ল ঘেঁষে পাখি দেখতে পেতাম। কখনো কখনো বর্ষা মৌসুমে নৌকায় চেপে পাকরা-কাপাসি ও বড়-গুটিঈগলের দেখা পেতাম। তবে কোনো বুনো হাঁস ছিল না।

২০০৩ সালে বাইক্কা বিল জলাশয় ও সংলগ্ন বনানীর সংরক্ষিত সত্তা ঘোষণার পর, এই স্থানটি ত্বরিত পাখি দেখার চমৎকার কেন্দ্রে পরিণত হয়। সেখানে দেখা পাখিদের তালিকা তৈরি করা, ব্যবস্থাপনা বিষয়ক পরামর্শ দেওয়া এবং জলজ পাখি গণনা আমি খুবই উপভোগ করেছি। সন্ধ্যাবেলা দেখেছি শালিক ও বকেরা রাতের বিশ্রাম নিতে এসেছে।

যেখানে আদৌ কোনো পাখি ছিল না, সেখানে অজস্র বিভিন্ন প্রজাতির জলজ পাখির আগমন ঘটেছে। তাদের মধ্যে আছে-রাজ-শরালি, পাতি-তিলিহাঁস, খয়রা-কাস্তেচরা, সৈকত পাখি, গেওয়ালা-বাটান। বিল সংলগ্ন বনে দেখা যায় চাইনিজ-চুনিকণ্ঠি এবং বিভিন্ন ধরনের ফুটকি। হাইল হাওরে এসব পাখি আশির দশকে অকল্পনীয় ছিল।   

সার্বিকভাবে গত কয়েক দশকে পাখিসম্পদ ও তাদের আবাসস্থলের ক্ষতি হয়েছে। তবে আশির দশকে দেখা পাখিগুলো বাংলাদেশে কোথাও না কোথাও দেখতে পাওয়া যায়। তবে সব স্থানেই তাদের আবাসস্থল ও সংখ্যা কমে গিয়েছে। তারপরও পাখি নিয়ে মানুষের আগ্রহের কারণে প্রতিবছরই নতুন নতুন প্রজাতি দেশের মোট পাখির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। এদের বেশিরভাগই ভবঘুরে ও শীতের বিরল পরিযায়ী পাখি।

যখন আমি প্রথম পাখি দেখতে যাই তখন বুঝিনি যে পাখি দেখা এত জনপ্রিয় হবে। এও বুঝিনি যে এত পরিবর্তনের সঙ্গে আমি যুক্ত হবো-যার মধ্যে রয়েছে স্থানীয়দের সঙ্গে মিলিত হয়ে হাইল হাওরে অভয়ারণ্য সৃষ্টির মতো কাজ। পাখির আবাসস্থল শুধু সদিচ্ছার ভিত্তিতে এবং সবার সহযোগিতায় সংরক্ষণ করা সম্ভব। সরকার ও স্থানীয় সমাজের এই উদ্যোগ বাংলাদেশে পাখি সংরক্ষণে আশা জোগাচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //