সৌন্দর্য মানে ফর্সা ত্বক নয়

নারীর সৌন্দর্য বলতে অনেকেই মনে করেন ‘ফর্সা সুন্দর ত্বক’ মানেই সুন্দর। কোনো অনুষ্ঠান, পার্টি বা পথ চলতে ফর্সা মেয়ে দেখলে তারা বলেন, দেখ মেয়েটি কী সুন্দর! এখানে ত্বকের ফর্সা রঙই যেন হয়ে উঠেছে সৌন্দর্যের নিয়ামক। ফলে প্রসাধনের বিজ্ঞাপনে শ্যামলা বা কালো মেয়ে দেখা যায় না বললেই চলে।

যে কারণে এই উপমহাদেশে রঙ ফর্সাকারী ক্রিম বা প্রসাধনীর বেশ কদর। সবাই ফর্সা বা ‘সুন্দর’ হতে চায়। বিয়ের বাজারের কথাতো না বললেই নয় সেখানে ফর্সা মেয়ের যে কী কদর তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি একটি শিশু যে কিনা সদ্য ভ‚মিষ্ট হলো, সেও কালো ও ফর্সা- এই বিচারের বাইরে নয়। 

বৈবাহিক ক্ষেত্রে পরিবার, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অন্যান্য গুণ থাকা সত্ত্বেও শুধু কালো বা শ্যামবর্ণের বলে একটি মেয়ে বাতিল হয়ে যায়। আবার শুধু ফর্সা বলে সমাজের অনেক তথাকথিত বড় ঘরের ছেলে নিচু ঘরের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। সেখানে একটি মেয়ের যোগ্যতা বা গুণ সবই কত যে ম্লান! এত গেল বিয়ের কথা। চাকরি, ক্লাসরুম বা পরিবার, সেখানেও ফর্সা মানুষগুলো তুলনামূলক বেশি মনোযোগ পেয়ে থাকে।

তবে গায়ের ত্বকের কালো বা ফর্সা এই বিষয়টির চর্চা কেবল এখনকার নয়, সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকেই আমাদের সামাজে চলে আসছে। তখন বরং আরও শোচনীয় অবস্থা ছিল, কালোরা ভৃত্য বা দাস আর ফর্সারা প্রভু। সেই সাদা চামড়ার ভূত আজও মানুষের ঘাড় থেকে নামেনি। দিন বদলেছে।

এখন সুন্দর মানেই ফর্সা নয়। সুন্দর ফর্সা হয়, শ্যামলা হয়, আবার কালোও হয়। এটি বিজ্ঞাপনেরই কথা। এখন বিশ্বসুন্দরী কালো মেয়েও হয়। ইতিমধ্যে অনেক দেশ ফেয়ারনেস ক্রিম নিষিদ্ধ করেছে।

কেননা ফেয়ারনেস ক্রিম বা প্রসাধন দ্রব্যের বেশিরভাগের মধ্যেই রয়েছে হাইড্রোকুইনোন, যা হতে পারে ক্যান্সারের কারণ। তাছাড়া ডিজিটাল এই বিশ্বে গায়ের বর্ণ নিয়ে এই বৈষম্য বড্ডো বেমানান। ফর্সা আর কালোর বিচারে একটি মানুষের মনের সৌন্দর্য কেউ খোঁজে না। মনের ঔজ্জ্বল্য এখানে ভীষণ ম্লান হয়ে পড়ে। 

তাই বলে বাহ্যিক সৌন্দর্যের গুরুত্ব নেই এমনটাও নয়। ত্বক ফর্সা বা কালো সেই বিচারে না গিয়ে দেখুন তার ত্বকের কোমলতা, মসৃণতা আর পরিপাট্য। কালো ত্বকের একজন মানুষও দেখতে অসাধারণ হতে পারেন। আবার ফর্সা কারও মুখ যদি অমসৃণ ও দাগযুক্ত হয় তবে আর যাই হোক তাকে সুন্দর বলা যাবে না।

রবীন্দ্রনাথতো শ্যামা মেয়ের কালো হরিণ চোখেই সব সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছেন। তবে ত্বকের রঙ যা-ই হোক না কেন নিদাগ, মসৃণ আর কোমল ত্বকই হলো প্রকৃত সুন্দর। তাই ফর্সা হওয়ার জন্য চেষ্টা না করে নজর দিতে হবে কীভাবে ত্বক মসৃণ ও কোমল করে তোলা যায়।

খাবার

প্রথমে আসা যাক খাবারে। খাবারের সরাসরি প্রভাব পড়ে মানুষের শরীরে, বিশেষ করে ত্বকে। যে কারণে ঠিকঠাক ডায়েট গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তাই খাদ্য তালিকায় রাখুন মৌসুমি ফল, সবুজ ফল ও শাক-সবজি। এগুলোতে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে বেশ কার্যকর। এ ছাড়া ডেইরি খাবার যেমন, দুধ, মিষ্টান্ন, মাখন এমন খাবারগুলোও রাখা চাই। জাঙ্কফুড একেবারেই না। এমন কোনো খাবার খাওয়া যাবে না যা হজমে গণ্ডগোল পাকাবে। এর প্রভাব মুখে পড়বে।

কেননা হজমের সমস্যা হলে মুখে ব্রণসহ নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে। চিনি খাওয়া কমিয়ে দিন। এটি ত্বকে কোলাজেনের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এতে ত্বক তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যায় ও রোদ ও দূষণে সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচেয়ে জরুরি হলো খাবার সময়মতো খাওয়া এবং হাইজেনিক খাবার গ্রহণ করা। প্রচুর পানি পান করুন। মনে রাখতে হবে, শরীরের অন্য অর্গানগুলোর মতো পানি ত্বকের কোষগুলোকেও সচল রাখে। এতে ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। 

সঠিক যত্ন

ত্বক শরীরের এমন একটি অংশ, যা অযত্নে একবার বিগড়ে গেলে ঠিকঠাক করে নেওয়া বেশ কঠিন। অনেক সময় পুরোপুরি ঠিকও হয় না। তাই নষ্ট হওয়ার আগেই এর সঠিক যত্ন নেওয়াটা জরুরি। অনেকে ত্বক কালো বলে ভাবেন যে যত্ন নিয়ে কী হবে? এ তো আর ফর্সা হবে না। আবার অনেকে যত্ন নিতে চান ফর্সা হওয়ার জন্য। কিন্তু যত্ন নেওয়ার উদ্দেশ্য শুধু যে ফর্সা হওয়া, তা কিন্তু নয়। বরং ত্বক ব্রণহীন, দাগহীন হওয়াটাই আসল কথা। ফর্সা ত্বকে ব্রণ, দাগ বা বলিরেখা থাকলে তা অবশ্যই দেখতে ভালো দেখাবে না। তাই রঙ যা-ই হোক না কেন মনোযোগ দিন ত্বকের স্বাস্থ্যের দিকে। আর নিজের ত্বকের ধরন বুঝে সঠিক স্কিন প্রোডাক্ট বেছে নেওয়াটা জরুরি। 

বাইরে থেকে এসে ফেসওয়াশ দিয়ে ভালো করে মুখ ধুয়ে নেবেন। ক্ষারমুক্ত ফেসওয়াশ হওয়া চাই। তৈলাক্ত ত্বকেও বেশি ক্ষারযুক্ত সাবান বা ফেসওয়াশ ব্যবহার করা উচিত নয়। এক্ষেত্রে ঘরে তৈরি কোনো প্যাক দিয়েও মুখ ও হাত ক্লিন করে নিতে পারেন। এ ছাড়া ক্লিনজার ভালো কাজ দেবে। আর কিছু না হোক শুধু ক্লিনজারে মুখ পরিষ্কার করে ঘুমাতে যাওয়া উচিত। মেকআপও সময়মতো তুলে নেবেন। না হলে মেকআপের কারণে দীর্ঘসময় রোমকূপ বন্ধ থাকার কারণে ব্রণসহ অন্যান্য সমস্যা তৈরি হতে পারে।

তবে মেকআপ তোলার উপকরণও অ্যালকোহল ফ্রি হওয়া চাই। সপ্তাহে অন্তত দু’দিন স্ক্রাব করে নিন। এতে ত্বকের মৃতকোষ ও জমে থাকা ময়লা, ব্ল্যাক হেডস দূর হবে। এ ছাড়া স্ক্রাব করে নিলে এক্সফোলিয়েশনের কাজটাও হয়ে যায়। হোক শীত কিংবা গ্রীষ্ম বাইরে যেতে অবশ্যই সানস্ক্রিন লাগিয়ে বের হবেন। এমনকি বর্ষার সময়ও। সপ্তাহে অন্তত একদিন মুখে অয়েল ম্যাসাজ করুন। ত্বকে ব্ল্যাড সার্কুলেশন বাড়বে, রুক্ষতা দূর হবে এবং ত্বক মসৃণ হবে। 

ত্বকে ভাঁজ সমস্যা

বিভিন্ন কারণে ত্বকে ভাঁজ বা বলিরেখা পড়তে পারে। হাসার সময় বা কথা বলার সময় অনেকের কপাল, চোখ কুচকে কথা বলার বদঅভ্যাস আছে। এতে ত্বকে ভাঁজ পড়ে যায়। বয়সজনিত কারণতো আছেই। এ ছাড়া সান ড্যামেজেও ত্বকে রিংকেল বা ভাঁজ পড়তে পারে। এ জন্য চোখ-মুখ বা কপাল কুচকানোর অভ্যাস ত্যাগ করা, ম্যাসাজ ও রোদে খুব বেশি সময় না থাকা ও সানস্ক্রিন ব্যবহার করা।

আর যদি পড়েই যায় তবে ত্বক মেরামত করে নিতে প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাবার আগে অলিভ অয়েল বৃত্তাকারে বা ভাঁজের বিপরীতে ম্যাসাজ করে নিতে হবে। তবে নারকেল তেল এই ম্যাসাজের জন্য দারুণ কার্যকর। এতে ধীরে ধীরে রিংকেল বা ভাঁজ মিলিয়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে ত্বকও বেশ মসৃণ হবে। আলু ও অ্যালোভেরার প্যাক এক্ষেত্রে ভালো কাজ দেবে। এগুলো ত্বকের ইলাস্টিসিটি বাড়ায়। মাঝে মাঝে ক্যাস্টর অয়েল ব্যবহার করুন। রাতে আলতো করে বলিরেখার ওপর ম্যাসাজ করে নিন। রাতভর রেখে সকালে ফেসওয়াশ দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এর স্কিন কন্ডিশনিং ক্ষমতা ত্বকের বলিরেখা দূর করে। 

হাত-পায়ের যত্ন

নিয়ম করে হাত ও পায়ের যত্ন নিন। এই দুটি অংশ বেশ অবহেলিত থাকে। একটি মাইল্ড বডি ওয়াশ হালকা গরম পানিতে দিয়ে তাতে পা ডুবিয়ে রাখুন। কিছুসময় পর পুরনো টুথব্রাশ বা পিউবিক স্টোন দিয়ে পায়ের গোড়ালি ঘষে নিতে হবে। পা ধুয়ে মুছে নেওয়ার পর অলিভ অয়েল বা কোনো বেবি অয়েল লাগিয়ে নিন। এতে হাত-পা মসৃণ থাকবে। সপ্তাহে দু’দিন এই নিয়মে হাত ও পায়ের যত্ন নিলে ত্বক মসৃণ ও কোমল থাকবে। 

বাহ্যিক পরিচর্যার পাশাপাশি আরও কিছু সুঅভ্যাস যে কারো সৌন্দর্য বড়িয়ে দেয় বহুগুণ। রাত না জাগা, তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়া, তাড়াতাড়ি ওঠা ইত্যাদি। এতে শরীর যেমন ভালো থাকবে তেমনি পর্যাপ্ত ঘুম লুকে প্রশান্তিভাব এনে দেবে। দুশ্চিন্তামুক্ত যাপন চোখের নিচে ডার্ক সার্কেলসহ ক্লান্তিহীন মুখত্বক নিশ্চিত করবে।

আরেকটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ, ত্বকের ঔজ্জল্য বাড়ানোর চাইতে নিজের ব্যক্তিত্বের দ্যুতি বাড়ানোটা বেশি প্রয়োজন। সবসময় হাসিখুশি থাকা, হেল্পফুল থাকা, সৃজনশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা এমন সুন্দর যাপন যদি অভ্যেসে থাকে তবে ত্বক উজ্জ্বল করে তুলতে ফেয়ারনেস ক্রিমের দরকার হবে না, মনের সৌন্দর্য এমনিতেই চেহারায় দীপ্তি ছড়াবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //