তাঁতির আঙুল কর্তন বিসম্বাদ

‘কেন শুধু মসলিন মসলিন বলে কেঁদে উঠি বুকের ভেতরে?
ভাঙা ইট, ওই হাড় ও-তো শুধু বেদনার ব্যর্থ অবশেষ,
আমি তবু সেই ধুলো খুঁড়ে খুঁড়ে শুঁকে দেখি ভেতরের মাটি।
কেন দেখি?
কেন সেই শিল্পীর কাটা আঙুল খুঁজে পেতে চাই?
পেতে চাই তাঁতের হৃদয় থেকে বেজে-ওঠা শ্রমের সংগীত’

সমৃদ্ধিশালী বাংলার কারিগর ঐতিহ্যের সবচেয়ে গৌরবের ইতিহাস রচনা করেছিল ‘মসলিন’ নামের বস্ত্র। এই বস্ত্র নির্মাতা তন্তুবায়দের আঙুল কর্তনের নির্মমতাও সেই ইতিহাসেরই অংশ। আজও দুনিয়াজুড়ে খ্যাত এই বস্ত্রের আঁতুড়ঘরের গর্বিত বাংলাবাসী-ভাষী হিসেবে আমরা যতন করি অতীত ইতিহাসের প্রিয়-অপ্রিয় সব অধ্যায়। চলুন পাঠ করা যাক সেই ‘তাঁতির আঙুল কর্তিত-কর্তনের সমাচার’।

তাঁতির আঙুল ২। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, আমরা ইতিহাস পড়ি, কিন্তু যে ইতিহাস দেশের জনপ্রবাহকে অবলম্বন করিয়া প্রস্তুত হইয়া উঠিয়াছে, যাহার নানা লক্ষণ, নানা স্মৃতি আমাদের ঘরে-বাইরে নানা স্থানে প্রত্যক্ষ হইয়া আছে, তাহা আমরা আলোচনা করি না বলিয়া ইতিহাস যে কী জিনিষ, তাহার উজ্জ্বল ধারণা আমাদের হইতে পারে না।

‘ইতিহাসের লক্ষ্নী ওঠেন
এই জীবনের সিন্ধু-তীরে,-
বিস্মরণের স্মরণীতেই
তাঁর নিলয়ে চলেন ফিরে।
মিলিয়ে গেল রথখানা তাঁর
মহাকালের ঘরে টানা;
চাকার আঁকা দাগ দেখে আজ
মিলবে কি তার ঠিক ঠিকানা?’

ইতিহাসকে পড়া, বোঝা এককথায় নয়া বোঝাপড়া তৈরি করতে হলে, কোন ধরনের উপাত্ত, কোন চিন্তার, কোন পদ্ধতির, কোন পক্ষপাত তৈরি হচ্ছে সে সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার থাকতে হবে। কেননা, জারি থাকা চিন্তার বাইরে আরও স্বচ্ছ চিন্তার জন্য ভাবনাটা জরুরি।

তাঁতির আঙুল  ৩। 

‘ভারতের অতীত ইতিহাসের পাতায় পাতায় দেশের শিল্পের, বিশেষভাবে বস্ত্র শিল্পের করুণ কাহিনি জড়াইয়া আছে। সে কাহিনি একদিকে যেমন অশ্রæজলে ধোয়া অন্যদিকে আবার তেমনি হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতায় পরিপূর্ণ।

বাণিজ্যের জন্য বণিকেরা সে যুগে বাংলার ব্যবসায়ীদের উপর যে অত্যাচার করিয়াছে হৃদয়হীনতার দিক দিয়া কোথাও আর তাহার জোড়া মেলে না। অত্যাচারের আগুন জ্বলিলে কোনো শিল্পী বাঁচিতে পারে না। বিদেশি বণিকদের অত্যাচারেই ভারতের তুলা এবং রেশমের বিখ্যাত শিল্পও ধীরে ধীরে নষ্ট হইয়া গিয়াছে।’

আলোচ্য নিবন্ধকে সেই ‘নষ্ট’ হয়ে যাওয়া বস্ত্রশিল্প তথা শিল্পী-তাঁতি-কারিগরদের আঙুল কেটে দেওয়ার মতো ব্রিটিশ নিষ্ঠুরতা যা ইতিহাসের করুণ অধ্যায় তার একটি নির্মোহ পাঠ, অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের কোশেশ বলা যেতে পারে।

শুরুর কথা, ফিরে দেখা
নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ থেকে ওম প্রকাশ, সুশীল চৌধুরীসহ অনেকের গবেষণাতেই ১৮ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার শ্রীবৃদ্ধি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। ঠিক তেমনই সুবিদিত ওই শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার অবক্ষয়ের কাহিনি। এখানে বিশেষভাবে স্মর্তব্য-এ বক্তব্য শুধু এখনকার ঐতিহাসিকদের নয়, তদানীন্তন বাংলায় অবস্থিত কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস, হ্যারি ভেরেলস্ট, লিউক স্ক্র্যাফটন প্রমুখেরও। তারা স্পষ্টভাবে ও নির্দ্বিধায় লিখে গেছেন যে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা ছিল খুবই সমৃদ্ধ, কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে, কোম্পানির আমলে, বাংলার দুর্দশার শুরু। এ প্রসঙ্গে উঠে আসে কোম্পানির রাজত্বে বাংলার বস্ত্রশিল্পের অবক্ষয়ের কথা। 

উইলিয়াম বোল্ট

বাংলার তাঁতি ও অন্য কারিগরদের ওপর কোম্পানির কর্মচারী ও গোমস্তাদের অমানুষিক অত্যাচারের কথা ইংরেজ লেখকদের পান্ডুলিপিতে বিশদভাবে বলা আছে। সেসবে একেবারে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যে, কোম্পানির শাসনে বাংলার তাঁতিরা ক্রীতদাসে পরিণত হয়। তাদের অবস্থা ছিল ক্রীতদাসেরও অধম। এই অত্যাচার যে বাংলার বস্ত্রশিল্পের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

বাংলায় বস্ত্রশিল্পের অবক্ষয়ের ফলে তখন অন্তত ৬০ লাখ লোক কর্মহীন হয়ে পড়ে। সেটা নিঃসন্দেহে বাংলার অধঃগতির লক্ষণ। বাংলার বস্ত্রশিল্পে অবক্ষয়ের জন্য বাংলার বিশিল্পায়নে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের শুল্কনীতি যেমন দায়ী, তেমনই দায়ী তাঁতি-কারিগরদের ওপর বহুবিধ কায়দায় অমানুষিক অত্যাচার। 

ইংরেজ কোম্পানি বাংলায় ক্ষমতা দখলের পরে পরিকল্পিতভাবে আস্তে আস্তে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপীয়দের এবং এশীয়-ভারতীয় বড় বড় ব্যবসায়ীকে বাংলার বাজার থেকে বলপূর্বক হটিয়ে দেয়। ১৭৭০-এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে (অনাহার সৃষ্ট হত্যাকান্ড) বাংলার লোকসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়। ফলে সে সময় বাংলার লোকসংখ্যা অনেক কমে যায়, আর স্বাভাবিকভাবেই কাপড়ের অভ্যন্তরীণ বাজার, চাহিদাও সংকুচিত হয়ে পড়ে।

‘ইংরেজদের দেওয়ানী লাভ বাংলা বিহারের জনজীবনে তথা কারিগর, শিল্পী ইত্যাদি সকল শ্রেণির শ্রমজীবী মানুষেরই জীবনে বয়ে এনেছিল বিষময় ফল। বণিকের মানদন্ড যখন রাজদন্ডের ছত্রছায়ায় এসে দাঁড়াল, তখন তারা বিকিকিনির হাতে নেমে ব্যবসায়ের নামে যে লুণ্ঠন-অত্যাচার-উৎপীড়ন শুরু করল-তাতে বাংলা ও বিহারের শিল্প-শ্রমিক শ্রেণি শুধু বিপর্যস্তই নয়, একেবারে ধ্বংসের মুখেও পড়ল। এদেশের রেশম ও সুতিবস্ত্রের শিল্পীদের নানা ধরনের চুক্তির নিগড়ে ফেলে সম্পূর্ণ পদানত করবার জন্য চলত অকথ্য নির্যাতন। কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা প্রথম প্রথম এদেশের রেশম ও সুতিবস্ত্র ইউরোপের বাজারে চালান দিয়ে প্রচুর মুনাফা লাভ করত। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে এই লাভজনক ব্যবসায়ে একটা প্রবল অসুবিধা দেখা দিল। ইংল্যান্ডের তাঁতশিল্পী ও বস্ত্রব্যবসায়ীরা বাংলার উন্নতমানের রেশমবস্ত্রের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে থাকায়, আন্দোলন দেখা দিল সেখানেও। এই সময় ইংল্যান্ডে ভারতের রেশমশিল্প সম্পর্কে যে অসন্তোষ দেখা দেয়, তা নিম্নোদ্ধৃত কবিতাটিতে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে:

“The silk-worms from the wardrobe’s gaudz pride;
How rich the vest which Indian looms provide,
Yet let me hear the British Nymphs advise
To hide these foreign spoils from native eyes
Lest rival artists, murmuring for employ,
With savage rage the envied work destroy”

মহুয়াডারের ভূমানচিত্র (ইংরেজ কর্তৃক নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পর)

এরই ফলে পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের ডিরেক্টররা বাংলার প্রতিনিধিদের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কড়া নির্দেশ দেয় যার মূল বক্তব্য হলো, ‘তারা যেন এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করে যাতে বাংলার শিল্পীরা আর রেশমবস্ত্র তৈরি করতে না পারে। তারা কেবল কাঁচা রেশম উৎপাদনের ক্ষেত্রে উৎসাহ দেবেন। আর দেখবেন, রেশমগুটি থেকে যে-সকল কর্মী সুতো তৈরি করে, আর যারা সুতো থেকে বস্ত্র তৈরি করে এই উভয় শ্রেণির কর্মীই যেন ঘরে বসে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে। সেজন্য এদের কোম্পানির কারখানায় কাজ করার জন্য বাধ্য করতে হবে। যার সোজা অর্থ সামরিক শক্তির প্রয়োগ, জুলুম, অত্যাচার ইত্যাদিও কার্যসিদ্ধির জন্য অবাধে চালাতে হবে। এককথায় রেশমবস্ত্র তৈরি না করতে বাধ্য করা এবং রেশম উৎপাদনে উৎসাহদান করতে হবে যে-কোনো উপায়ে।’

‘এই নীতির ফলে রেশমবস্ত্রের তাঁতিদের একটা বড় অংশ স্থায়ী বেকারে পরিণত হয় এবং জীবনধারণের জন্য কেবলমাত্র কৃষির ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়। যদিও সেখানেও তখন কায়ক্লেশে দিনযাপনের দিনও গতপ্রায়। কোম্পানির নির্দয় নীতিতেই 

শ্রমিক-শিল্পীর রুজি-রোজগার বন্ধ হলো-টান পড়ল কৃষকের পেটের অন্নে।’

তাঁতি উৎপীড়নের কতিপয় ভাষ্য
তাঁতি-শিল্পী-করিগরের ইংরেজ ইচ্ছে নিরপেক্ষ স্থানে, সময়ে, বয়নে-ধরনে বাধ্যবাধকতা, নির্মমতার সঙ্গে সাধারণ চরকাপ্রতি কর ধার্যের মতো কানুন বাস্তবায়ন করতে তাঁতিদের বাড়ি বাড়ি অন্দরে হানা দিয়ে চরকা, তাঁত শুমারির পর কর ধার্য করে তা আদায়ের নিমিত্তে যাবতীয় কৌশল ও প্রয়োগ অনাচার ছিল কেবল ইংরেজ বীভৎসতারই সমার্থক।

ঢাকায় বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত তাঁতি কারিগররা নানা রকম উৎপীড়নের শিকার হতেন মর্মে নানা প্রকাশনায় উল্লেখ আছে। বিশেষত ঐতিহাসিক গবেষকদের অনুসন্ধানে নানাবিধ তথ্যসূত্র মারফত বর্ণিত হয়েছে। এসব অত্যাচার নির্যাতনের সামগ্রিক তথ্য হয়তো প্রকাশিত বই পুস্তক দলিল দস্তাবেজে অন্তর্ভুক্তই হয়নি। এই না হওয়ার একটা বাস্তব কারণ মূলত নির্দিষ্ট এই বিষয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণা হিসেবে গ্রহণ না করা, অনেক কিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া, আবার করলেও একচেটিয়া শাসকদের ঔপনিবেশিক বয়ানেরই বিস্তার পরিলক্ষিত হওয়া।

ফলে এ বিষয়ে তথ্য, পরিসংখ্যান, সত্য-মিথ্যা, গ্রহণযোগ্যতার নিরিখেও মতবিরোধ থাকা স্বাভাবিক। আবার পক্ষে বিপক্ষে নানা মতামতও বিদ্যমান। তৎকালীন সময় ও সমাজ তথা শাসনচরিত্র বিবেচনায় রেখে সে সম্পর্কে এই বিষয়ে বিশ্লেষণ, বয়ানও হাল আমলে বেশ চর্চিত হচ্ছে। সামগ্রিক অর্থে বিষয় বিবেচনায় দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। এমতাবস্থায় ঢাকায় তন্তুবায় তথা তৎকালীন ভারতীয় কারিগরদের প্রতি অত্যাচার, উৎপীড়ন, নির্যাতনের কতিপয় উল্লেখ প্রথমে সন্নিবেশ করা যাক। 

‘মলবুস খাস কুঠিতে নথিবদ্ধ তাঁতি অনুপস্থিত হলে পিওন পাঠিয়ে তাদের ধরে আনা হতো। আর তারা যদি ফেরার হওয়ার চেষ্টা করত তাহলে তাদের যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা হতো। এ প্রসঙ্গে জন টেলরের মন্তব্য, এসব তাঁতি স্বেচ্ছায় মলবুস খাস কুঠিতে কাজ করতে চাইত না কারণ ওখানে কাজ করে তারা যা উপার্জন করত তা মোটেই সন্তোষজনক ছিল না।’

‘১৭৬৭ খৃস্টাব্দে ঢাকাস্থ ইংরেজ তত্ত্বাবধায়ক (supervisor) কেলসাল ইংরেজ কোম্পানিকে কাপড় সরবরাহ না করার অভিযোগে তাঁতিদের ডেকে এনে বেদম প্রহার করে।’

‘যে সমস্ত তন্তুবায় চুক্তিপত্র অনুযায়ী মাল সরবরাহ করিতে অসমর্থ হইত, তাহাদিগের গৃহ ও গৃহজাত অন্যান্য দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া ক্ষতিপূরণ লওয়া হইত। অনন্যোপায় হইয়া এই সময়ে বহুশিল্পী স্বীয় বৃদ্ধাঙ্গুলি কর্তন করিয়া কার্যে অক্ষমতাজ্ঞাপনপূর্বক আত্মরক্ষা ও সম্পত্তি রক্ষা করিতে সচেষ্ট হইত। এইরূপে অনেক শ্রেষ্ঠ শিল্পী বৃদ্ধাঙ্গুলি কর্তন করিয়া চিরকালের জন্য মসলিনের ব্যবসায় পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিল।’

Historically specific, myth about the British, who treated the weavers in Bengal so cruelly (there is abundant testimony about this).’ That they were widely believed, apparently on no evidence, to have cut off the weaver’s thumbs, or on the basis of evidence, to have so persecuted the winders of silk that they cut of their own thumbs in protest. 

‘তাই বলিরে ঘোর কলি, ভারতের কি দশা কল্লি, পুরাবৃত্ত নষ্ট করলি তুই।
জাতিবৃত্ত ধর্ম্ম কর্ম্ম, ছিন্ন ভিন্ন এ ব্রহ্মাণ্ড, পূর্ব্বেকার কর্ম্ম কাণ্ড রাখিলি না কিছুই 
শোন কলিরাজ বলি তোরে, দেশের দ্রব্য দেশান্তরে, বিদেশের দ্রব্য দেশে আনলি।
পশমিরে সমি কাঁচ কাপাসে, বোকা বানায়ে দিয়ে দেশে, টাকা কড়ি নিয়ে দেশে চল্লি।’ 

ÒAccording to popular legend, the British cut off the thumbs of the weavers in order to destroy their craft. The decimation of local industry brought great hardship to Bengali people. In 1834-35 the Governor General of the East India Company reported to London: ‘The misery hardly finds in the history of commerce. The bones of the cotton-weavers are bleaching the plains of India’. The population of eastern Bengal’s cities declined as the weavers were thrown back to the land. sir Charles Trevelyan of the east India company filed this report in 1840:

The peculiar kind of silky cotton formerly grown in Bengal, from which the fine Dacca muslins used to be made, is hardly ever seen; the population of the town of Dacca has fallen from 150,000 to 30,000 or 40,000, and the jungle and malaria are fast encroaching upon the town......Dacca, which used to be Manchester of India, has fallen off from a flourishing town to a very poor and small one.” 

কলকাতা থেকে প্রকাশিত টেলিগ্রাফের নিবন্ধে উল্লেখিত হয়েছে-“A 2008 article in the Calcutta Telegraph attributes the 1857 uprising to the anger formented by such stories of British atrocities: ‘The British had chopped off their forefathers’ hands in Bengal a generation ago, so the weavers of Mahua Dabar in Awadh cut off a few British heads during the turmoil of 1857.”

কোম্পানি আমলে নানাবিধ প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রাতিষ্ঠানিক নানা অপরাধের বিচার বা প্রতিকারের ক্ষেত্রে ছিল তাদের দ্বৈতনীতি। কোম্পানি কর্মচারী ও ক্ষমতা সংশ্লিষ্টরা যে তাদের অপরাধের জন্য বিশেষ রেয়াত পেত তা বলাই বহুল। তার নমুনা, ‘নীলকর উইলিয়াম ওরবে হান্টারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে তিন পরিচারিকার নাক কান ছিঁড়ে দেওয়া, চুল কেটে দেওয়া, যৌনাঙ্গ বিকৃত করা এবং লোহার শৃঙ্খল দিয়ে পা বেঁধে রাখার অভিযোগ আনা হলো। হান্টারকে তুচ্ছ পরিমাণ আর্থিক জরিমানা করে সুপ্রিম কোর্ট রেহাই দেয়।’

‘বহুল প্রচলিত ধারণা আছে যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের দ্বারা ঢাকার তাঁতিদের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দেওয়ার ফলে মসলিন শিল্পের অবলুপ্তি ঘটে। ১৯২২ সালের ৩০ জানুয়ারি মাদ্রাজের একটি দৈনিক খবরের কাগজে গুন্টুর শহরে দুইজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার এবং একজন কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে নিম্নরূপ কথোপকথনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

ডি. আই. জি.: তোমার পরনের কাপড়  কোথা থেকে পেয়েছ? কাপড় কি মোটা নয়?
স্বেচ্ছাসেবক: আমাদের চরকায় কাটা সুতা দিয়ে এই কাপড় বুনানো হয়েছে।
ডি. আই. জি.: এ কাপড়গুলো ভালো নয়। বিদেশি কাপড় ভালো এবং অনেক হালকা নয় কি?
স্বেচ্ছাসেবক: তোমাদের লোকেরা আমাদের তাঁতিদের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে না দিলে আমাদের কাপড় ভালো ও হালকা হতো।
ডি. আই. জি.: (পুলিশ সুপারের দিকে ফিরে) এটা কি সত্য?
পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট : ইতিহাসে তাই লেখা আছে। এটা সত্য।’

কন্সিডারেশন ও ইন্ডিয়া এফেয়ার্স বইয়ের প্রচ্ছদ

লক্ষণীয় লন্ডন থেকে বাংলায় বিশিল্পায়নের যে নির্দেশনামা নাজিল হতো তার নমুনা-“ম্যানচেস্টারে নতুন করে মসলিন উৎপাদনের প্রেক্ষিতে কোর্ট অব ডাইরেক্টরের ১ মার্চ ১৭৮০-তে লেখা চিঠির উদ্ধৃতি থেকে দেখা যায় যে ‘বঙ্গদেশে মসলিন তৈরির প্রতি তারা শুধু মনোযোগী হতে বলেননি, তার উৎকর্ষ ও দাম কমানোর দিকে নজর রাখতেও বলেছেন। কারণ তাদের উন্নতির ভবিষ্যৎ এই দ্রব্যের উপর নির্ভরশীল।” 

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ নিক রবিন্স তার ‘হিডেন ওন্ড’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছে, ‘It is difficult to imagine the scale of economic violence required to force skilled workers to harm themselves in this way. Apart from bolts, however, no other evidence exists for this or similar incidents. This has not stopped it achieving apocryphal status as a symbol of physical and psychological pain inflicted by the company’s takeover of Bengal. Indeed, the image remains alive in popular memory across the subcontinent, as poet Aga Shahid Ali express in his 1980 poem, Dacca Gauzes’:

‘ইতিহাস থেকে জেনেছি আমরা: তাঁতিদের হাত
বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল,
বাংলার তাঁতগুলো হয়েছিল নিথর,
আর কাঁচা তুলো
চালান হলো বিলেতে।’

লন্ডন থেকে প্রকাশিত মডার্ন রিভিউতে আঙুল কাটার বিষয়ে উল্লেখিত হয়- The East India Company can be accused not only for the negligence towards the promotion of the industries but also for imposing abominable hardships on the efficient craftsmen by levying even corporal penalties of which the most detested one was the cutting of the thumbs of the efficient muslin weavers of Dacca who were prohibited from weaving the muslin except for the Company and in the factories of the East India Company.

সহজ হিসেবে ভাবতে গেলে এই উৎকর্ষের জন্য তাঁতির প্রতি সময় মনোযোগ যেমন দিতে হবে তেমনি তার উৎপাদিত মসলিনের মূল্যও বাড়াতে হবে। অথচ এই পত্রাদেশের প্রপঞ্চ হলো, অধিক মুনাফার স্বার্থে দাম কমাতে হবে! ফলে তাঁতির উপর অত্যাচার আর নির্যাতনের পক্ষে কোর্ট অব ডাইরেক্টরদের অবস্থান তো স্পষ্টই বোঝা যায়। ‘ঢাকার সমৃদ্ধির সময়ে ঢাকা শহর ১৫ মাইল ব্যাপিয়া ছিল।

১৮০০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল দুই লক্ষ, ১৮৩৮ সালে ব্যবসায় বন্ধ হওয়ায় হইয়া ছিল মোটে ৬৮ হাজার, (মতান্তরে ১৭৬০ সালে কয়েক লাখ জনসংখ্যা থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ হাজারে নেমে আসে।-লেখক) আঙুল কাটা তাঁতিরা অকর্ম্মণ্য হইয়া চাষে মন দিল, মাকু ছাড়িয়া লাঙ্গল ধরিল। ইংরেজ গোড়া কাটিয়া আগে জল ঢালিতে মজবুত; ঢাকার বস্ত্র ব্যবসায় নষ্ট করিয়া ঢাকায় দুইবার মার্কিনের তুলা চাষের চেষ্টা হইয়াছিল, চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। এই সমস্ত হইতে ঢাকার বস্ত্র ব্যবসায়ের অবনতির সূত্রপাত ১৭৭৩ সাল হইতে ধরা যাইতে পারে, সেই সময় ইংল্যান্ডে কলের তাঁত প্রচলিত হয়।’

‘কোন ব্যক্তি ইংরেজদিগের নিষেধ অমান্য করিয়া ফরাসী কিম্বা ওলন্দাজদিগের নিকট বস্ত্র ক্রয় করিলে ইংরেজদিগের ফেক্টরীর সাহেব ও গোমস্তাগণ তাহার প্রতি গুরুতর দন্ড বিধান করিতেন। কখন কখন তাহাদের বাড়ী লুঠ করিতেন, কখন কখন তাহাদের স্ত্রীলোকদিগকেও অপমানিত করিতেন। এইরূপে অনেকানেক তাঁতীকে জাতিভ্রষ্ট হইতে হইল। তখন তাহারা মস্তক মুণ্ডনপূর্বক বৈরাগী হইতে লাগিল এবং তন্তুবায়ের ব্যবসা একেবারে পরিত্যাগ করিল।’

লন্ডন থেকে প্রকাশিত গার্ডিয়ানের একটি নিবন্ধে এ বিষয়ে লিখিত, “Bengal produced some of the world’s most desirable fabrics, especially the fine muslins, light as ‘woven air’, that were in such demand for dressmaking and so cheap that Britain’s own cloth manufacturers conspired to cut off the fingers of Bengali weavers and break their looms.”

এক কথায় ‘বাণিজ্য দ্বারা যে কোনো প্রকারের অধিক লাভ করাই কোম্পানির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল; আবার সুবাদারের অত্যাচার উৎপীড়নে ও শোণিত শোষণে জনসাধারণ একরূপ ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া উঠিয়াছিল। এতৎ সম্বন্ধে জেনারেল বর্জায়ন সাহেবের উক্তির উল্লেখ করিলেই এ স্থলে যথেষ্ট হইবে। পার্লামেন্টের কমন্স সভা ১৭৭২ অব্দে ভারতের অবস্থা বিষয়ে অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত যে কমিটি নিযুক্ত করেন, এই মহাত্মা তাহার চেয়ারম্যান অর্থৎ সভাপতি ও অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি বলিয়াছেন, পাপাচার, অর্থশোষণ ও অবিচারের এরূপ দৃশ্য, এরূপ অশ্রুতপূর্ব নিষ্ঠুরাচরণ, এবং নৈতিক সাধুতার প্রত্যেক নিয়মের, প্রত্যেক ধর্ম্মবন্ধনের ও শাসন প্রণালীর প্রত্যেক নীতির এরূপ প্রকাশ্য উল্লঙ্ঘন পূর্ব্বে আর কখনও দৃষ্ট হয় নাই, এরূপ বহু অপরাধ সর্ব্বদা ঘটিত, যাহা মানবপ্রকৃতির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ, এবং এমন বহু কার্য্য, ঘটিত, যাহা বিশ্বাসঘাতকতা ও নরহত্যা দ্বারা সংসাধন করা হইত।’

“হেস্টিংসের ইমপিচমেন্ট প্রস্তাবে ‘ভারতবন্ধু’ এডমন্ড বার্ক এবং মুক্ত বাজারের প্রবক্তাদের গুরুঠাকুর এডাম স্মিথ নিয়ম করে পার্লামেন্ট, চটি বই আর খবরের কাগজে কোম্পানির লুঠ, খুন অত্যাচার নিয়ে কামান দাগছেন। কেল্টি, কুৎসিত, অশিক্ষিত ভারতবর্ষীয়রা যে কোম্পানির দেবশিশুর মত আমলাদের বদ সঙ্গ করে দুর্নীতিগ্রস্ত বানাচ্ছে, কোম্পানিও গোমস্তা ইত্যাদিদের পাল্লায় পড়ে বদ হয়ে গেছে এটাও একটা যুক্তি।

কোম্পানি তার আগে মেট্রোপলিটনে সভ্যতার রপ্তানিকারক ইমেজ খাড়া করেছিল ঠিকই, কিন্তু টিপু সুলতানের পতনের পরে কোম্পানির পক্ষে এই চাপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তারা ঠগী, সতী ইত্যাদি সামনে রেখে সভ্যতা প্রচারে নামল।”

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকেদের করা দৈহিক নির্যাতন বা শাস্তি সম্পর্কে বার্ক বলেন-“My Lords, they began winding cords round the fingers for unhappy freeholders of those provinces until they clung to and were almost incorporated with one another and then they hammered wedges of iron between them, until regardless of the cries of the suffers, they had bruised pieces and for ever crippled those poor, honest innocent, laborious hands which never been raised to their mouths ...”

দৈহিক নিপীড়নের দৃষ্টান্ত আরও সবিস্তারে তুলে ধরার জন্য বার্ক পার্লামেন্টে উচ্চকণ্ঠে বলেছিল, “I am next to open your Lordship, what I am, hereafter to prove that most substantial and wading yeomen the responsible farmers, the parochial magistrates and clits of villages were tied to and to by cheeks the legs together and their tormentors, throwing them with their heads downwards over a bar beat them on the shores of the feet with ratans until the nails fell from the toes and then attacking them at their head, as they hung downwards as before at their feet, they beat them with their sticks and other instruments of blind fury, until the blood gushed out their eyes, mouth and noses.” 

ভারতীয় তাঁতশিল্পী ও কৃষকদের ওপর কিরূপ ভয়াবহ অত্যাচার করা হয়েছিল এডমন্ড বার্ক তার নিজ স্বদেশবাসী ইংরেজদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করেন। হতভাগ্য মানুষগুলোকে বিচুটি গাছ দিয়ে পেটানো হতো। বিচুটি গাছ সম্পর্কে তিনি যা জানতেন তা হলো অত্যন্ত বিষাক্ত এবং তীব্র ক্ষয়কারক এক ধরনের গাছ। সেই গাছের ডাল কেটে তা দিয়ে প্রহার করা হলে ক্ষতস্থানে মারাত্মক পুঁজ বা দূষিত রক্ত জমে যায়, গ্যাংরিন হয়ে যায় অবশেষে জীবন সংশয় হয়ে ওঠে।

অত্যাচারিত শ্রেণির মানুষগুলোর ওপর রাত্রিকালে বা শীতের রাত্রেও নির্যাতন করা হতো নিষ্ঠুরতম পদ্ধতি প্রয়োগ করে। কুঠিয়াল, আড়ংগুলোর মালিক, মহাজন, গোমস্তারা অতিরিক্ত ধনলিপ্সার টানে জোর জুলুম চালাতে থাকে বিনা বাধায়। বন্দিদের অন্ধকার কুঠিতে নিক্ষেপ করা হতো, তিনবার পরপর চাবুক মারা হতো, মধ্যবর্তী সময়ে কিছুটা বিশ্রাম দিয়ে পুনরায় মানসিক এবং দৈহিক নিপীড়ন শুরু হতো। অসহ্য শীতের রাত্রে রক্তাক্ত থেঁতলানো আহত দেহগুলোকে জোর করে টেনে টেনে জলভর্তি গভীর গর্তে ছুঁড়ে ফেলে দিত।’

ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার কোনো সীমা নেই। বিদেশি দখলদারত্ব এদেশের মানুষের এমন দুর্দশা ডেকে এনেছে।

আরেক ব্রিটিশ লেখক Andrew Brooks তার Clothing Poverty: The Hidden World of Fast Fashion and second-hand clothes বইতে বলেন, “British business had even conspired with the colonial authorities to cut off the fingers of Bengal weavers and broken their looms to create captive markets.”

তাঁতির আঙুল কাটা, অত্যাচার ও নির্মমতা নিয়ে দেশ-বিদেশের বহু ঐতিহাসিক গবেষক, লেখকদের অভিমতের বহুল উদ্ধৃতি পরিহার করা সঙ্গত এই নিবন্ধের কলেবর বিস্তৃতির লাগাম টানার নিমিত্তে। ফলে এক্ষণে আমরা এ বিষয়ে যুক্তি, তর্ক, বাহাসের কতিপয় নমুনার দিকে মনোযোগ নিবিষ্ট করতে পারি।

খোঁড়া যুক্তির থোড়া নমুনা! যুক্তি বুদ্ধির ঠিকুজি
‘আড়াইশ বছরের দাসত্ব-নেশা রক্তকে মাতাল ক’রে, মাথাকে ভোঁতা করে, রক্তক্ষরণ ঘটায়, আর মাথা মুড়িয়ে সামাজিক ভদ্রবিত্ত করে তোলে।’

কতিপয় বিশ্লেষণের অজুহাতে বলেন যে, দাদা ভাই নওরোজির ৬১৭ পৃষ্ঠার বই ‘Poverty And Under British Rule In India’তে কোনো তাঁতির হাতের আঙুল কেটে নেওয়ার কোনো উল্লেখ নেই। তাদের ভাষায়, কীভাবে সম্ভব যে এরকম পরিশ্রমী একজন গ্রন্থকার এ বিষয়ে যদি কোনো নথি থেকে থাকে তবে তা তিনি উল্লেখ করতে ভুল করবেন? তাদের মতে, এই হলো আঙুল না কাটা সম্পর্কে জোরালো যুক্তি। না কি কু-যুক্তি? 

তার আগে চলেন দেখা যাক দাদা ভাইয়ের ঠিকুজি! উনার জন্ম ১৮২৫। ‘Grand Old Man of India’ অভিধা তাকে কে দিয়েছিল? তিনি যুক্তরাজ্যের হাউজ অব কমন্সে ১৮৯২-৯৫ পর্যন্ত এমপি ছিলেন। অফিসিয়াল অ্যাম্বাসেডর ছিলেন ভারতে। গুজরাটি ভাষী পরিবারে তার জন্ম। দেওয়ান ছিলেন মহারাজার। ফলত তার ব্রিটিশবান্ধব ভারতীয়র সদ্ভাব দৃষ্ট হলেই ‘আঙ্গুল কাটার’ বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট হতেও পারে। যা ‘ও-ব্রিটিশ’ দৃষ্টিভঙ্গিতেই কেবল দৃষ্ট!

আনুমানিক ৩৪০-২৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ছিল মৌর্য সাম্রাজ্য কাল। “চন্দ্রগুপ্তের শাসনাধীনে পাটলিপুত্রের অন্তঃশাসন কি রূপ ছিল, তাহার একটা সংক্ষিপ্ত আভাস পাওয়া গিয়াছে। কার্য্যরে সৌকর্য্যরে জন্য তাহারাও এই অন্তঃশাসন বিভাগের ছয়টি উপবিভাগ করিয়াছিলেন। প্রতি উপবিভাগের উপর পাঁচজন করিয়া সচিব কর্তৃত্ব করিতেন।

প্রথম উপবিভাগ-শিল্পাদি সম্বন্ধীয় যাবতীয় ব্যাপারে তত্ত্বাবধান করিতেন। যাহাতে শিল্পজাত পণ্যে কোনরূপ ‘ভেজাল’ না দেওয়া হয় তৎপ্রতি লক্ষ্য রাখা এই উপবিভাগের অন্যতম কর্তব্য ছিল। শিল্পীদের রক্ষার ভার ও ইহার কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। কোনো ব্যক্তি শিল্পীর হস্ত কিংবা চক্ষু নষ্ট করিয়া দিলে, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হইত।”

আর ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পরের ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাংলার শিল্পী কারিগর, কৃষকের উপর দখলদার ঔপনিবেশিকদের দ্বারা সংঘটিত অগুনতি অপরাধের দণ্ড তামাদি হয়েই রইল। 

স্বদেশী আন্দোলনের মহাত্মা গান্ধী কি বলেছেন এই মর্মে? তার একটি উদ্ধৃতি সন্নিবেশিত হলো, “.... The labour of these artisans was so cruelly suppressed that they were obliged to cut off their own thumbs in order to avoid imprisonment. Many speakers mix up facts and say that the Company’s servants cut off the thumbs of artisans. In my opinion, such cutting off would be less cruel than the terrorism which resulted in self-mutilation.”

ভারতের জাতির জনকই নয় কেবল ভারত, বাংলাদেশে ও বিদেশি ইতিহাস গবেষকদের অনেকের লেখাতেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে তাঁতিদের আঙুল কাটার দায়মুক্তি দিতে উৎসাহী হিসেবে দেখা যায়। বাংলাভাষী গবেষক, লেখক, ইতিহাসবিদও সহজেই মিলবে যারা ইংরেজ শাসনকে ‘আঙুল কাটা’ প্রসঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ করতেও গররাজি। যেমনটা অনেকগুলো অনাহারী মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে তারা আমলে না নিয়ে দুর্ভিক্ষ, অন্নকষ্ট, অনাবৃষ্টি, মন্বন্তর বলে বড়জোর, হত্যাকাণ্ড নয় কস্মিনকালেও। 

যোগেশচন্দ্র সিংহ স্বীকার করছেন, ‘ঢাকার কিছু পুরনো তাঁতি ও বর্তমানে মসলিন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্ররা পর্যন্ত আঙুল কাটার এই কাহিনি সত্য বলে বিশ্বাস করত। ছাত্ররা আমাকে বলেছিল যে, কয়েক বছর আগে এখানে এক প্রদর্শনীতে তারা তাঁতিদের আঙুল কাটার ছবি প্রদর্শিত হতে দেখেছিলেন।’ তবে তার যুক্তির খাতিরে তিনি বলেন, ‘কিন্তু সেই প্রদর্শনী ও তার পক্ষে কোনো প্রমাণ বা তথ্য খুঁজে আমি ব্যর্থ হয়েছি। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাচীন দলিল দস্তাবেজ ও সমসাময়িক প্রকাশনা যেটুকু আমার পক্ষে পর্যালোচনা সম্ভব হয়েছিল তা থেকে এ ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করা যায়নি।’ এরপরই তিনি সাফাই করছেন এই বলে যে, ‘অবশ্য এই নেতিবাচক প্রমাণের কোনো মূল্য নেই, কারণ এই তথ্য স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে গণ্য করা যায়। কিন্তু আমি তাঁতিদের আঙুল কেটে দেওয়ার গল্প বিশ্বাস করতে পারি না শুধু একটি সাধারণ কারণে, তা হলো ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের স্বার্থের জন্যই আমাদের দেশের তাঁতিদের অঙ্গচ্ছেদ না করার সম্ভাবনা বেশি ছিল। কোম্পানির লোকজন তাঁতিদের প্রতি অনেক অত্যাচার করতে পারে, কিন্তু ইংরেজরা অত বোকা নয় যে তাদের জন্য যে রাজহাঁস সোনার ডিম দেয় সেটিকে তারা বধ করবে।... এ সব প্রমাণের আলোকে কোম্পানি কর্তৃক তাঁতিদের আঙ্গুল কাটা সম্ভব ছিল না।’

যোগেশচন্দ্র সিংহ বাবুর কাছে সোনার ডিম দেয়া রাজহাঁসকে অত্যাচার করা স্বাভাবিক কিন্তু তাদের বধ করা ইংরেজদের বোকামি! অত্যাচারের মাত্রা যে বধ পর্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা ইতিহাস কি তার সামনে সে সাক্ষ্য হাজির করেছে? না কি উপনিবেশের এসব অন্যায়ের প্রতি নমনীয় মাত্রার যুক্তির থোড়া নমুনা?

এখানেই শেষ নয়, অন্যত্র বলছেন, ‘এটা সত্য যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম দিকে বাংলার তাঁতিদের উপর যথেষ্ট অত্যাচার হয়েছিল, কিন্তু সে অত্যাচার প্রাচীন তাঁত শিল্পকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে করা হয়নি। বরং কোম্পানি যাতে সস্তা মূল্যে অধিক পরিমাণ হাতে বুনন বস্ত্র খরিদ করতে পারে, সেই দুর্ভাবনা থেকেই তাঁতিরা অত্যাচারিত হয়েছিল।’

‘জাহাজ ভর্তি ম্যানচেস্টারের কাপড় আসে দেশে
অস্ত্র দেখিয়ে বিলিতি কাপড় পরালো তারা শেষে।’

লক্ষ করুন ঐতিহাসিকের কেমন সাফাই ঔপনিবেশিক অত্যাচারের প্রতি! তাঁতিদের উপর বহুপদের অত্যাচার, পীড়ন যে তাদের পেশাচ্যুতির তথা এই শিল্প ধ্বংসের নিমিত্ত হয়ে উঠছে তা আড়াল করতে কু-যুক্তি হাজির করছেন এই বলে যে ‘কিন্তু সে অত্যাচার প্রাচীন তাঁত শিল্পকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে করা হয়নি।’ সত্যি, কতটা মোলায়েম করেই না অত্যাচারিতের অত্যাচারকে উত্থাপিত করার কোশেশ!

তাঁতিদের আঙুল কাটার বিষয়ে বোধকরি প্রথম অথেন্টিক লিখিত আলোচনা সন্নিবেশিত হয় একদা কোম্পানি কর্মকর্তা/কর্মচারী স্বভাবতই কার্যসূত্রে প্রত্যক্ষদর্শী উইলিয়াম বোল্টস কর্তৃক লিখিত কন্সিডারেশন অন ইন্ডিয়া এফেয়ার্স গ্রন্থে। এবার দেখা যাক এই গ্রন্থ ও গ্রন্থকারের বিরুদ্ধেও তারা কতটা সোচ্চার। 

“উইলিয়াম বোল্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন অধস্তন কর্মচারী। ১৭৬০ সালে তিনি বঙ্গদেশে আসেন এবং ১৭৬৬ সালে চাকরি ত্যাগ করেন। সেই ছয় বছরে শুল্কমুক্ত দেশীয় পণ্যের ব্যবসা দ্বারা যথেষ্ট টাকা উপার্জন করে তার ভাগ্য খুলে যায় এবং তাকে ১৭৬৮ সালে বিলাতে ফেরত পাঠান হয়। এর চার বৎসর পর ‘কন্সিডারেশন অন ইন্ডিয়া এফেয়ার্স’ শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান।”

এই আপাত নিরীহ উল্লেখে মনে হবে একমাত্র বোল্টই ‘যথেষ্ট টাকা উপার্জন’ করেছেন। এবং তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর জন্য উদ্দেশ্যমূলক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন! উল্লেখ্য যে বোল্ট অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রথম কোম্পানির কর্মচারী যিনি বাংলা শিখেছিলেন এবং কোম্পানির কর্মকর্তা হয়েছিলেন। 

বোল্টের বই প্রকাশিত হওয়ার ১০৪ বছর পর ১৯০৮ সালে জনৈক লেখক নিম্নে উল্লেখিত কথা বলছেন-‘কুঠিয়ালদের অত্যাচার কাহিনী সকলেই অল্প বিস্তর পরিজ্ঞাত আছেন, তাহার বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। আজ কাল লাট মিন্টোর জবরদস্তি আইনের আমলে সত্য কথা প্রকাশ নিষেধ। অতএব ইঙ্গিতে ইংরাজের অত্যাচার বুঝিতে হইবে-সাধু সাবধান!’ 

কেউ কেউ ঘুরিয়ে অন্যভাবেও বলেন, ‘ইংরাজ বণিকদিগের চুক্তির শর্তপালনের দায় হইতে অব্যাহতি পাইবার জন্য তন্তুবায়গণ আপনাদের হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কাটিয়া ফেলিয়াছিল; এমন কথাও শুনা গিয়াছে।’

‘তাঁতিদের আঙুল কাটা সম্পর্কে প্রচলিত বয়ানটির দুটি সংস্করণ আছে। একটি হলো-কোম্পানির চাকরেরা ব্রিটিশদের উৎপাদিত বস্ত্র পণ্যগুলোকে বাংলায় বাজারজাতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে দেশীয় তাঁতিদের বুড়ো আঙুল কেটে দেয়, যাতে তারা তাঁতশিল্পের কাজের জন্য স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে পড়ে। অন্যটি হলো-কোম্পানির কাজ করার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাঁতিরা নিজেরাই তাদের বুড়ো আঙুল কেটে ফেলে।

প্রথমটি অবিশ্বাস্য হিসেবে অবিলম্বে প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে। কোম্পানি বাংলায় তুলা উৎপাদনে নিরুৎসাহিত না করে বরং খুচরা-মালের জন্য প্রস্তুতকারকদের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করে। দ্বিতীয়টি-যেমন ড. জে. সি. সিনহা অনুমান করেছেন (পৃষ্ঠা. ৮৪-৮৫), বোল্টসের বিবেচনায় লিখিত অনুচ্ছেদের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যে কাঁচা সিল্কের তাঁতিদের বাধ্যতামূলক তাঁতের কাজ এড়াতে তাদের আঙুল কেটে ফেলে। কিন্তু অন্য কোনো সমসাময়িক রেফারেন্সের অনুপস্থিতিতে সিনহার মতবাদকে সঠিক বলে গ্রহণ করা যেতে পারে।’

ইংরেজ উপনিবেশপ্রেমীরা ঔপনিবেশিক অত্যাচার, হিংসা, অপশাসন, দখলদারির সমালোচনায় কথায় কথায় প্রমাণের ধুয়া তোলে। মৌখিক, লিখিত প্রমাণের তুলনায় সাক্ষী সাবুদ তাদের সাকিন, মৌজা খতিয়ানসহ মানে তথাকথিত বৈজ্ঞানিক, দৈহিক, সরেজমিন বাস্তবিক প্রমাণ গুরুত্বে এনে তর্কে জুড়ে দিয়ে সে অভিযোগ বাতিল করতে চায়! ঔপনিবেশিক প্রভুত্বকে তাদের অপকর্মকে আড়াল করতে চায়। এটাই মূলত ঔপনিবেশিক চিন্তাতাড়িত, ঔপনিবেশিক চিন্তা কাঠামো।

“ঔপনিবেশিক প্রশাসকদের পক্ষ থেকে ঊনবিংশ শতকে ভারতীয়দের থেকে প্রাপ্ত সত্যকে (বয়ান) অবিশ্বাস করা হতে থাকল কেননা উপনিবেশের পেশাদারেরা মনে করত ভারতীয়রা বাস্তবে গল্পের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। বিভিন্ন তথাকথিত অনির্ভর মানুষদের বয়ান থেকে সত্য নিরূপণের জন্যে বিচারিক শপথ, ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রমাণনির্ভর বিচার এবং মেডিকো-লিগ্যাল পেশাদার ইত্যাদিদের ব্যবহার করে নানান রকমের সত্য প্রযুক্তি বিকাশের চেষ্টা করা হলো।

‘বৈজ্ঞানিক তথ্য অসীমভাবে নির্ভরযোগ্য’ এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর দিয়ে আইনে বিজ্ঞানের ব্যবহার অসীমভাবে গুরুত্ব পেল ঔপনিবেশিক ফৌজদারি তদন্ত কার্যক্রমে এবং যে কোনো শারীরিক প্রমাণ দিয়ে মৌখিক প্রমাণ নস্যাৎ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো।
ভারতীয় জনগণ, তাদের দেহ এবং কৃষ্টি বিষয়ে ঔপনিবেশিক ধারণা নির্ভর করে গড়ে উঠল মেডিকো-লিগ্যাল লেখাপত্র জাতিবাদী লব্জ ব্যবহার করে, যা আদতে নৈর্ব্যক্তিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দাবির বিরোধী। হিংস্র শ্বেতাঙ্গদের মামলার ওপর এই পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ল কারণ ভারতীয়দের দেহ বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু সমস্যা নিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার আড়াল অবলম্বন করে ইউরোপীয় খুনিরা পার পেয়ে যেতে লাগল।’

অত্যাচার লুণ্ঠনের দায়ে লর্ড সভায় হেস্টিংসের বিরুদ্ধে অভিযোগে এডমন্ড বার্ক বলেন যে, ‘কোম্পানির লোকেরা ভারতীয় শিল্পীদের হাতের আঙুলগুলি এরূপ নিষ্ঠুরভাবে দড়ি জড়াইয়া বাঁধিত যে, প্রত্যেকের হাতের মাংসগুলি একত্রিত হইয়া দৃঢ়ভাবে সংলগ্ন ও সংবদ্ধ হইয়া যাইত। তৎপর উহারা কাষ্ঠের বা লোহার গোঁজ বা হাতুড়ি দ্বারা ঐ আঙুলগুলির মধ্যে বিদ্ধ করিয়া দিত। নিষ্পেষিত হইয়া হাতগুলি এরূপ বিকলত্ব প্রাপ্ত হইত যে হতভাগ্য নিরীহ এবং শ্রমশীল তাঁতিরা আর ইহজীবনে ঐ হাত দ্বারা কোনো কিছু ধরিয়া মুখে তুলিতেও সমর্থ হইত না।’

‘তাঁতি জোলারা বুনতো কাপড় বেচতো দেশের হাটে
আঙুল কেটে দিয়েছে তাদের কান্নায় বুক ফাটে।’ 

এডমন্ড বার্ক

বোল্টস বিদ্বেষপ্রসূতভাবে অতিরঞ্জিত কিছু না বলে এবং সত্যিকারের অবস্থাটাই বর্ণনা করতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন লেখক গভর্নর ভেরেস্টের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেকর্ড থেকে তাঁতিদের উপর অত্যাচারের ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। জেমস ওয়াইজ তার নোটস অব দি রেসেস, কাস্টস এন্ড ট্রেডস অব ইস্টার্ণ বেঙ্গলে ১৭৬৭ সালে ঢাকার কিছু ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, তা থেকে তৎকালীন অবস্থার সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।

‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকাস্থ প্রধান মি. টমাস কেলসল একজন সন্দেহভাজন তাঁতিকে ফরাসিদের ফ্যাক্টরীতে কাপড় বিক্রয়ের অপরাধে গ্রেফতারের আদেশ দিলে, সে ফরাসীদের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে। তখন তার আত্মীয়স্বজনদের আটক করে প্রহার করা হয় এবং ঘরবাড়ী লুণ্ঠন করা হয়। এমতাবস্থায় তাঁতি দেওয়ানের নিকট আত্মসমর্পণ করলেও তাকে ১১ দিন কারখানায় আটক রাখা হয়। মি. টমাস কেলসলের নির্দেশে তাকে মাথা ন্যাড়া করে মুখে চুন কালী দিয়ে নওয়াবপুরের রাস্তা প্রদক্ষিণ শেষে নবাবের নিকট বিচারের উদ্দেশ্যে পাঠান হয়। নবাব তাঁতির কোনো দোষ না পাওয়ায় তাকে মুক্তি দেন।’

অথচ নিরপরাধ তাঁতির মুক্তির আগেই তার আত্মীয়-স্বজনের আটক, প্রহার, নিজের ১১ দিনের আটক থাকা, মাথা ন্যাড়া করে দিয়ে মুখে চুনকালি মেখে রাস্তায় ঘুরানো সবই কোম্পানি কর্তাদের মর্জিমাফিক ঘটে যায়।

“এটা কোনো সময় অস্বীকার করা যাবে না যে কোম্পানির আমলে তাঁতিদের উপর অত্যাচার করা হয়নি। বার্ণিয়ার এবং এবরেনাল-এর লেখায় প্রমাণ পাওয়া যায় যে ব্রিটিশ আমলের পূর্বেও ঢাকার সবচেয়ে দক্ষ তাঁতিদের অবস্থা ছিল ক্রীতদাসের মতো। একজন ফরাসী ধর্মযাজক ইংরেজ কোম্পানি সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ঢাকার নিপুণ তাঁতিদের জন্য এটা দুর্ভাগ্য যে তাদেরকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে শুধু সরকারের জন্য কাজ করতে বাধ্য হতো এবং এরকম বন্দি দশায় রেখে অসুস্থ বানানো হতো।’ 

তৎকালীন ভারতে ব্রিটিশের পরিকাঠামো উন্নয়ন, ভারতের পশ্চাৎপদ উৎপাদন ব্যবস্থা ইত্যাদি বারবার না কপচালে ঔপনিবেশিক স্বার্থ হাসিল হয় না, সেই সব গবেষক সমর্থকের উপনিবেশের কেবল সদাচার দেখে-দেখিয়ে দিতে উৎসাহী হয়ে মুখিয়ে থাকেন আর তাদের টিকি গচ্ছিত থাকে ঔপনিবেশিকদের স্বার্থ রক্ষার কাজে, সেখানে আলোচ্য অত্যাচার উৎপীড়ন সেই মিথ ও মিথ্যার বেসাতিকেই উন্মোচণ করে।

মনে রাখা দরকার বোল্টের পুস্তক প্রকাশের পর ইংরেজ তার দখলদারির শাসন বজায় রেখেছিল আরও ১৭৫ বছর। ফলে এই আঙুল কাটার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া কিংবা বলা যায় তার বিরুদ্ধমত প্রতিষ্ঠার পৌনঃপুনিক চেষ্টার সুযোগ তাদের ঔপনিবেশিক সব সম্ভাব্য কার্যকলাপ দিয়ে যথেচ্ছই কাজে লাগিয়ে থাকবে। বলা বাহুল্য সেই থেকে ২৫৫ বছর পর আজকেও ঔপনিবেশিক বয়ানে এই দায় গ্রহণে তাদের অসম্মতির লক্ষণ স্পষ্ট। অন্যদিকে বাংলার জনৈতিহাসের পরম্পরায় এই নির্মম ও দুঃখজনক ঘটনার স্মৃতিসংরক্ষণ করে।

তাঁতিদের আঙুল কাটা, মিথ মিথ্যার বয়ান না বাস্তবতা?
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁতিদের আঙুল কাটার জন্য দায়ী? না কি উইলিয়াম বোল্টের ১৭৭২ সালে উত্থাপিত অভিযোগটি নিছক গল্প, বা ঘটনার বিকৃতি? নাকি মিথ্যা? এ সংক্রান্ত আর কী কী 

প্রাথমিক তথ্য উৎস বিদ্যমান তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে।

এডমন্ড বার্কের একইরকম অভিযোগও মিথ্যা? উপনিবেশ উত্তর জ্ঞান ভাবনাধারীদের বার্কের অবস্থানের সমালোচনা করা হয়, “ব্রিটিশদের ভাবতে তাদের শাসন ব্যবস্থার উন্নতির চেয়ে ভারত ত্যাগ না করে তাদের দখলদারির অস্তিত্ব আরও দীর্ঘায়িত করার পক্ষেই কি তাঁর অবস্থান ছিল? যেভাবে আঙুল কাটা অভিযোগের প্রমাণাদির পক্ষে ওকালতি করা হয় তাতে আঙুল কাটার বিষয়ে ‘প্রমাণাদির তদন্তের মত’ যেন প্রত্নতাত্ত্বিক খননে উদ্ধারকৃত জীবাশ্ম নিরীক্ষার ফলাফলে আস্থা বা রহমত প্রত্যাশী।”

ইংরেজ লিপিবদ্ধকৃত হাজারো তথ্য, ঘটনা, বিবরণীর বয়ানকে যদি আমাদের সত্য বলে মেনে নিতে অসুবিধা না হয় তাহলে আঙুল কাটা বিষয়ে একাধিক ইংরেজ প্রশাসক তথা দায়িত্বশীলদের ঘটনার বিবরণে আস্থা না রাখতে পারার কারণ কী? ওজর আপত্তির নানাবিধ কুশলতা আশ্রয় কেন?

১৮ শতকের ভারতের একাধিক জায়গায় এ সংক্রান্ত ঘটনার ‘শ্রুতি’ তথা জন আস্থাপরম্পরা আঙুল কাটা ঘটনার বাস্তব সম্ভাবনাকেই প্রতিষ্ঠা করে। শুধু তাই নয়, আঙুল কাটার অভিযোগকে প্রথম পুস্তকে সন্নিবেশিত করে উপস্থাপনের জন্য বোল্টকে আমলে নিতেও ঔপনিবেশিকদের আপত্তি। কিন্তু কেন? এই বোল্টই তো কোম্পানি আমলে কাশিমবাজারের ফ্যাক্টরির প্রধান অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি জজের পদেও আসীন হন। ‘বোল্টস সাহেবের সময়ে মুর্শিদাবাদ হইতে অনেক তন্তুবায় স্বীয় স্বীয় ঘরবাড়ি পরিত্যাগপূর্বক স্থানান্তরে পলায়ন করিয়াছিল। কাশিমবাজারের চতুঃপার্শ্বে অসংখ্য অসংখ্য তন্তুবায় বাস করিত। কিন্তু এরূপ প্রবাদ আছে যে, মিরকাসিমের সিংহাসনচ্যুতির পর ১৭৭৬ সালে এই প্রদেশ হইতে একরাত্রে সাত শত তন্তুবায় গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে পলায়ন করিয়াছিল।’

ব্রিটিশ লেখক Jeremy Seabrook-এর মতো কেউ কেউ বাংলার তাঁতির আঙুল কাটাকে হিন্দু মিথ মহাভারতের চরিত্র একলব্যের গুরুদক্ষিণা হিসেবে আঙুল কাটা মিথের প্রসঙ্গের অবতারণা করে এবং তাঁতির আঙুল কর্তনকে মিথ বলে চালিয়ে দেওয়ার অপপ্রয়াস পেয়েছে। তারা এ ঘটনাকে অসত্য রূপক বলে দাগিয়ে দিতে ‘নাটকীয় গল্প’ রচনার জন্য উইলিয়াম বোল্টকে দায়ী করে, তার এ দাবিকে নস্যাৎ করতে চায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্রোণাচার্য্যরে ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়ে দুর্বল বস্ত্র উৎপাদক ম্যানচেস্টারের বস্ত্র মানে অর্জুনকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য বাংলার তাঁতিদের প্রতিভা নিরপেক্ষ আঙুলকে দক্ষিণা হিসাবে রূপকায়িত করতে উৎসাহী! যা এক ঔপনিবেশিক বিকার বটে!

ওয়ারেন হেস্টিংস

পলাশীপূর্ব ইংরেজ বণিকগোষ্ঠীর দস্যুতায় হুগলি দখল ও লুটে গণহত্যা ও নৃশংসতা তৎপরবর্তীতে পলাশীর যুদ্ধমত্ততা ও হত্যালীলা ও কী সামান্য (!) আঙুল কাটার অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততাকে বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে পরীক্ষাগারে প্রত্ন নিদর্শনের নিরীক্ষাস্বরূপ ফলাফল প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা দস্তুর!

বাংলার কোনো এক বাউল কবির একটি গানে উঠে এসেছে-
‘নীল বানরে সোনার বাংলা করলে এবার ছারখার,
অসময়ে হরিশ মলো লঙ-এর হলো কারাগার।’ 

বাংলাদেশে সাধারণ লোকের বদ্ধমূল ধারণা যে ব্রিটিশ দখলদারদের দুষ্কৃতির ফলেই মসলিন শিল্প ধ্বংস হয়। সোনারগাঁওয়ের লোকেরা এখনো একটি পুকুর দেখায় যেখানে মসলিন শিল্পীদের কাটা আঙুল নিক্ষেপিত হয়েছিল বলে কথিত।

‘এছাড়া ইংরেজ কোম্পানির অত্যাচার। এ অত্যাচারের কথা আগেও কিছুটা বলেছি। পুরোনো আমলের লোকজন বলতেন, ইংরেজ কোম্পানি, ব্যবসায়ী, গোমস্তাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেকে নিজ গ্রাম ছেড়ে চলে যেতেন; যাতে তারা আর তার খোঁজ না পায়। অনেকে তাঁতের কাজ ছেড়ে অন্য কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁতের কাজ যাতে করতে না হয় সেজন্য অনেকে হাতের আঙুল কেটে ফেলেছিলেন। অনেকে আবার বলেন, ইংরেজরাই তাঁতিদের আঙুল কেটে ফেলতেন যাতে তারা আর জগৎ বিখ্যাত মসলিন তৈরি করতে না পারেন।

কৃষক, তাঁতিদের ওপর যে অত্যাচার করা হতো এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে, আধুনিক ঐতিহাসিকরা বলছেন, ইংরেজরা তাঁতিদের আঙুল কেটে ফেলতো এমন কোনো তথ্য তারা পাননি।’

স্থানীয় জনশ্রুতি বলে এই ঘটনাকে অপ্রমাণিত ঠাহর করা ও করানোর মতলব আসলে এই ঘটনাকে আড়াল করারই অপচেষ্টা হতে পারে।

‘আর দেশ যাও যুগী ঘরে ঘরে খায় মাগি
প্রাণ লইয়া যায় পলাইয়া।
কাটিমু যে চিকন সুত দেখিবা যে অদভুত
আপনি বুনিবা দিব্য ধূতি।
তোরে লৈয়া যাইমু হাটে পথে বহির হবে ঘাটে
বেচিয়া আসিমু শীঘ্রগতি।’ 

তথ্য বলতে যা বুঝি তা এ বিষয়ে প্রথম জারি করেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পদস্থ কর্মচারী উইলিয়াম বোল্ট। কিন্তু এই অভিযোগ, তথ্যের এভিডেন্স বা প্রমাণ চাইছেন ‘আধুনিক ঐতিহাসিকরা’! তা বলছিলাম কি, একজন কোম্পানির কাজে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লেখককে কি এভিডেন্স দিয়ে তা প্রমাণ করতে হবে? ঢাকা, ধামরাই, জঙ্গলবাড়ির কোনো সুতা কাটনি এত সূক্ষ্ণ সুতা কাটত তার প্রমাণ কী? আছে কোনো নাম ধাম? ছবি, সাকিন? তা বিশ্বাসযোগ্য হলো কেমন করে? অগুনতি ইংরেজ সাহেবরা যে স্মৃতিকথা, ইতিহাস লিখেছেন সেসব আমলে নিচ্ছি তো নাকি?

কিন্তু এই আঙুল কাটার বিষয়ে সাদা সাহেবের হাতে লিখিত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে নাকচ করতে প্রমাণ চাওয়ার আগ্রহ মাত্রাতিরিক্ত! এর কারণ? ঔপনিবেশিক প্রভুদের নৃশংসতাকে আমলে না আনা। কেউ কেউ আবার মৃদুস্বরে কেবল তাঁতিরা নিজেরাই তাদের আঙুল কেটেছিল গোছের তথ্য হাজির করে, এই কেটে ফেলায় বিদ্রোহ ও প্রতিবাদের প্রকাশ আছে বলে মনে করে।

কিন্তু একবার তো ভাবাই যায় যে, কেউ কি সুস্থ মস্তিষ্কে চায় যে তার কোনো অঙ্গহানি হোক? বিশেষত একজন হস্তশিল্পীর দুই চোখ আর হাতজোড়ার চেয়ে বড় সম্পদ কী আছে? যা দিয়ে শিল্পকাজ তথা কারিগরি পেশায় খেটে পরিবারের সবার মুখে অন্ন সংস্থান করার উপায়! 

মুর্শিদাবাদের তাঁতি

এসব কথাই সত্য, কিন্তু তবু তারা মসলিন শিল্পীদের হাত বা আঙুল কেটে ফেলবে একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ মসলিন শিল্পীরাই ছিল ইংরেজদের ব্যবসার প্রাণ। তাঁতিরা বা ঢাকার তাঁতশিল্প ধ্বংস হলে ইংরেজদের ঢাকার ব্যবসাও বন্ধ হওয়ার কথা। তাঁতশিল্প সমূলে ধ্বংস করা ইংরেজদের লক্ষ্য ছিল না, তাদের নীতি ছিল তাঁতিদের নিংড়ে নিঃশেষে তাদের রস বের করে নেওয়া।’

শ্রদ্ধেয় আব্দুল করিমের যুক্তি খণ্ডনে বলা যায়, তাঁতশিল্পীরাই যদি তখনো ব্যবসার প্রাণ থাকবে তাহলে কেন ইংরেজদের অত্যাচারে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে? যে সময়ের এ ঘটনা বলে আনুমানিক উল্লেখিত তখন পলাশী কাণ্ড ঘটে গেছে। ব্রিটিশদের তখন বাংলার সর্বময় দখল পেতে ব্যবসা বাণিজ্য প্লাস প্রশাসন করায়ত্ত করার তোড়জোড়। মনে রাখা কর্তব্য, এসব ঘটনার সময়। তখন কী কী ঘটছে। ইংরেজরা ঢাকায় বস্ত্র ছাড়াও আরও পণ্যের ব্যবসা করছে, এবং দ্রুতই উল্টো ব্যবস্থায় ঢাকায় উৎপাদন নয় ম্যানচেস্টারে উৎপাদিত বস্ত্রপণ্য বিশেষত সুতা বাংলায় আমদানি ও বিক্রয় করবে। 

‘ভারতবর্ষে ব্যবসা চালাতে চেষ্টার ছিল না শেষ,
দেড়শ বছর ইংরেজ জাতি লুটে খেয়েছে বেশ।
ইংরেজ গেলেও কুশিক্ষা তাদের ভরে আছে এই দেশে
চোর দস্যু তৈরি হয়েছে ঘুষখোর সর্বনেশে।’

জুলুমের নথি-দলিল ও তাঁতির আঙুল কাটার দায়
ইংরেজ অনাচার, অত্যাচার, জুলুমে, নির্যাতিত, ত্যক্ত শিল্পী কারিগরদের মানসিক বিরক্তির বর্ণনা উঠে আসে এই পুঁথির ভাষায়-

‘তাঁতি বলছে বল্লি ভালো, মোদের সব ব্যবসা গেল
কলের কাপড়ে মুলুক জুড়িল ভাই।
তাঁত দিয়েছি জলে ফেলে, ইংরেজি পড়ুক ছেলে পিলে,
তাহলে আর দুঃখ থাকবে নাই।
ইংরেজি প্রবল হলো, জাতিবৃত্ত উঠে গেল,
দেশের দুর্দশা হলো শেষে।
কলিকালে হয় অনিষ্ট, অনেকেরই বৃত্ত নষ্ট,
মনকষ্ট ভাবিছে তারা বসে।’

তাঁতিরা নিজেরাই তাদের হাতের আঙুল কেটেছে? এর সম্ভাব্যতা ও সত্যতা সম্পর্কে মনে প্রশ্ন জাগে। এটা বিশ্বাস করা সহজ নয় যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তাঁতি এমনটি নিজের ইচ্ছায় করতে পারেন। সত্যিকার অর্থে নিজের বুড়ো আঙুল কেটে ফেলতে সক্ষম কতজন? আর যদি হয়েও থাকে তার আগে যে পীড়ন মোকাবেলা করতে হয়েছে তাতে তাদের পরিবারগুলোকে প্রথমে দূরে পাঠানো এবং তারপরে নিজেরা চলে যাওয়া এবং ফিরে না আসার সম্ভাবনাকেই বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। নিরুদ্দেশ হওয়া কিংবা আঙুল বলি দেওয়া এসব অভিযুক্তদের হিংস্র দাপটের প্ররোচনায় ঘটে থাকবে এই বাস্তবতাও হিসাবে রাখতে হবে!

ব্রিটিশবিরোধী প্রচারণা পোস্টারে তঁ

‘কেউ কি ইচ্ছা করিয়া নিজের চৌদ্দ পুরুষের ভিটামাটি ছাড়িতে পারে? আজ খুবই কষ্ট পাইলাম। কারণ তাঁতী পাড়ার লোকরা সরিয়া যাইতেছে শুনিলাম, তাঁতীপাড়া গিয়া লোকদের সাহস দিয়া আসিলাম কিন্তু শেষ রক্ষা হইবে কি না বুঝিতে পারিতেছি না।’ 

আর এ সংক্রান্ত প্রমাণ সংরক্ষণ করা বা হওয়ার দায় নিশ্চয়ই ঘটনার বা ভুক্তভোগীর নয়! তা সম্ভবও ছিল কি? আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে অনুমান করা সম্ভব যে বিদেশি শ্বেতাঙ্গ দখলদার অত্যাচারিতের পক্ষে ঠিক কতটা হিংস্রতা আরোপ হয়েছিল সে সময়? তার সময় ছিল কয়েক শ বছর! ইংরেজ কেন তাদের কৃত এমন রক্তাক্ত ইতিহাসের দলিলপত্র রাখবে? তাঁতি হত্যার নথি-দলিলে কোন ইংরেজের হাতে হত্যা হয়েছে সেসব নির্মোহ লিখে রাখতে যাবে? অতীত ইতিহাস জুলুমের অপকর্মের সামান্যই মাত্র তার প্রমাণাদিসহ উপস্থিত, তাই নয় কি?

তাঁতিদের আঙুল কর্তন করা হয়েছে নাকি তাঁতিরা নিজেরাই তাদের আঙুল কেটেছিল-ইনিয়ে বিনিয়ে এইরকম প্রশ্ন হাজির করে ধোঁয়াশা তৈরি করে বিশ্বাসযোগ্যতায় চিড় ধরাবার অপচেষ্টাটি লক্ষণীয়। আজকের অনেক ‘আধুনিক ঐতিহাসিকদের’ই সংগৃহীত তথ্যাদি ইংরেজদের লিখিত, রচিত, রক্ষিত দলিল-দস্তাবেজ, বা তাদের লিখিত ইতিহাস অবলম্বন করেই চর্চিত। ইংরেজ প্রশাসনিকরা এরূপ দুষ্কৃতির জন্য দায়ী হলেও তারা তা লিখে রাখতে যাবে কেন? সুতরাং নেতিবাচক কর্মের প্রমাণের উপর জোর দিয়ে বলা যায় না যে তারা তা করেনি।

মহুয়া ডাবর, আঙুল কাটা তাঁতির স্মৃতি বিস্মৃতির তাঁতবসতি
১৮ শতকের শেষের দিকে মহুয়া ডাবরের আক্রমণ সেখানকার তাঁতিদের পূর্বপুরুষদের অঙ্গহানি করার প্রতিশোধ ছিল। আবার মহুয়া ডাবরে গণহত্যা ছিল ইংরেজদের প্রতিশোধ, যাদের আঙুল কেটেছে তাদের বংশধরদের উপর বর্বর প্রতিশোধ। ১৮৫৭ সালের মে মাসে যখন ভারত জুড়ে সিপাহি বিদ্রোহ তখন তার মাত্র মাসাধিককালের মধ্যেই বাংলার এক তাঁতির উত্তর প্রজন্ম জাফর আলীর মন অশান্ত হয়ে ওঠে। তার একশো বছর আগে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের পলাশী কাণ্ডের পর আরেকটি ঘটনা তখন ঘটবার অপেক্ষা কেবল। ৫ জুন ইংরেজ কর্তৃক মৌলভী আহমদ উল্লাহ খুনের বদলা নিতে ২৩ জুনের মাত্র ১৪ দিন আগে মানে ৬ জুন তাঁতি সন্তান জাফর আলীর নেতৃত্বে তন্তুবায় শহর মহুয়া ডাবরে ছয়জন ইংরেজ সৈন্য নিহত হয়। 

১৯ শতকের শুরুতে বাঙলার মুর্শিদাবাদ, ঢাকা ও নদীয়া থেকে তাঁতিদের আঙুলকাটা ও নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হয়ে অভিবাসিত বা স্থানান্তরিত হয়েছিল মহুয়া ডাবর নামক শহরে। যার অবস্থান উত্তর প্রদেশের লখনৌও থেকে ২১০ কিলোমিটার, বাস্তি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে। ইংরেজ সৈন্য হত্যার প্রতিশোধ নিতে ঘটনার দু’সপ্তাহ পর ৪ হাজার সৈন্যের বাহিনীর আক্রমণে গণজবাই, অগ্নিসংযোগ করে হত্যালীলা চালায়। 

২০ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত টানা এ কদিন ব্রিটিশ বাহিনী ৫ হাজার জনসংখ্যার শহরটিকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। পরবর্তীকালে ইংরেজ প্রশাসন তখনকার ভূমি মানচিত্র থেকেও মহুয়া ডাবরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। শুধু তাই নয় প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বাস্তি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে মহুয়া ডাবরের নামে আরেকটি নকল গ্রামের নাম ভূমি মানচিত্রের খতিয়ানে চিহ্নিত করে। মনোরমা নদীর তীরের আসল মহুয়া ডাবর ক্রমেই কৃষি জমিতে পরিণত হয়। 

ইংরেজ প্রশাসন মহুয়া ডাবর গ্রামের সব জমিকে (“gair chiragi’ a Basti-area variant on “bechiragi” or “na chiragi,” meaning “no lamps” and signifzing ‘cultivated but not inhabited’) অবাসযোগ্য এলাকা হিসেবে ফরমান জারি করে। তার ১৫০ বছর পর ২০০৭ সালে মহুয়া ডাবর থেকে বিতাড়িত হওয়া তাঁতির উত্তর প্রজন্মের আব্দুল লতিফ আনসারীর অক্লান্ত পরিশ্রমে ও আগ্রহে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে, বাংলা থেকে অভিবাসী পূর্বপ্রজন্মের স্মৃতির তাঁতবসতি মহুয়া ডাবরকে নতুন করে আবিষ্কার করেন।

ব্রিটিশবিরোধী প্রচারণার পোস্টারে তাঁতি নিগ্রহ

বিশ্বাসের তাঁতে বোনা জীবনের দগ্ধ মসলিন
‘ইংরেজরা মসলিন তাঁতিদের আঙুল কেটে ফেলত-সেই কাটা আঙুলের ওপর জন্ম নিয়েছে ম্যানচেস্টারের কাপড় শিল্প। আবার এও শোনা যায় যে-তাঁতিরা নিজেরাই নাকি নিজেদের আঙুল কেটে ফেলত, যাতে কম পারিশ্রমিকের কাজে তাদের বাধ্য না করা হয়। কার্পাস কৃষক আর তাঁতিদের উপর কোম্পানি, ব্যবসায়ী, গোমস্তা আর পাইকাররা যে অমানুষিক অত্যাচার চালাত সেটি জাজ্বল্যমান সত্যি। আমাদের গর্বের এই মসলিনের সঙ্গে কালিমার মতো লেপ্টে আছে এই রূঢ় সত্যটাও।’

আলোচ্য নিবন্ধে নানা পক্ষের মতামত তুলে এনে তার যে বিশ্লেষণ হাজির করা হলো তা বাংলার ঐতিহ্যের তাঁতশিল্পের গুণী তাঁতিদের সঙ্গে যুক্ত দুঃখজনক ঘটনার যে বীভৎসতা তাকে কোনোভাবেই সরিয়ে রেখে এই আলোচনায়, ঘটনার সত্যাসত্য নিরূপণে নিজেকে নিয়োজিত করা সম্ভব নয়। আমরা কি বাংলার তাঁত তাঁতি সময় ও সমাজ সংশ্লিষ্ট অনেক হায়িয়ে যাওয়া বা অপ্রকাশিত কথা নিদর্শন খুঁজতে পারি না? মহুয়া ডাবরের জাফর আলী, ঢাকা তিতাবাদীর বোষ্টম দাসেরা কীভাবে তাঁতির আঙুল কাটার কাল পেরিয়ে আমাদের বাংলার বস্ত্র ঐতিহ্যের ইতিহাসে প্রাসঙ্গিক তা জানব না? জানাব না?

ঢাকার তাঁতি তিতাবাদীর শহীদ বোষ্টম দাস, পুনিরাম পাল, হুগলির নয়ননন্দী, শান্তিপুরের বিজয়রাম, লোচন দালাল, রামহরি দালাল, কৃষ্ণচন্দ্র বড়াল, রামরাম দাস, কুমারখালীর বলাই, ভিখিরি, দুনি, ফকির চাঁদ, মহুয়া ডাবরের মৌলভী আহমেদ উল্লাহ, জাফর আলীসহ নাম না জানা, হত্যাকাণ্ডে নিহতদের ও নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া জনপদের ভাগ্য বিড়ম্বিতদেরসহ ভারত, বাংলার অসংখ্য অজানা প্রতিবাদী, সংগ্রামী, ত্যাগী ও নির্যাতিত তাঁত শিল্পীদের হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলে বলা সম্ভব যে তাঁতির হাতের আঙুল কাটা ইংরেজদের পক্ষে অসম্ভব? তাদের স্মৃতির পাশাপাশি এখনো দূর্বাঘাসের মতো বেয়ারা বাংলার তাঁত শিল্পী কারিগরদের টিকে থাকার অদম্যতাকে কুর্নিশ জানিয়ে তাদের করকমলে উৎসর্গকৃত এই শব্দবোনা ‘রূঢ় আলেখ্য’।

তাঁতির ‘আঙুল কর্তন’ ঢাকা, সোনারগাঁ, মাদ্রাজের গুনতোর, মুর্শিদাবাদ, কাশিমবাজার, অযোধ্যার মহুয়া ডাবর, লন্ডন সর্বত্রই বিশ্বাসযোগ্য, বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত সর্বজনকথা, জনশ্রুতি, কিংবদন্তি যা-ই বলা হোক না কেন তা বাংলার তাঁতিদের সঙ্গে ইংরেজদের কিঞ্চিৎ ‘আমলনামা’ বলেই চিহ্নিত। বহুযুগ ধরে বহু মাত্রায়, বহু পর্যায়ে কৃত তাদের অসংখ্য নথিভুক্ত ও নথি বহিভর্‚ত হিংস্র অনাচারই তাদের ‘আঙুল কর্তন আমলনামা’ প্রতিষ্ঠার মূলে। ‘তাঁতির আঙুল কর্তন বিসম্বাদ’ {বিসম্বাদ, বিশঙ্‌বাদ্}-এর বাংলা অর্থ-বিরোধ; ঝগড়া; কলহ, অমিল; বৈলক্ষণ্য, তর্ক-বিতর্ক, বাদ-বিবাদ, সওয়াল-জবাব, মতানৈক্য; মতভেদ, বিসংবাদিত, বিবাদিত; বিরোচিত; বিতর্কিত, কোনো পক্ষ খণ্ডন ও মণ্ডনের জন্য হওয়া কথাবার্তা)-এর আপাতত এখানেই ইতি।

‘রেশমের তন্তু-মুগ্ধ এক নোতুন আঙুল
বিশ্বাসের তাঁতে আজ আবার বুনতে চাই জীবনের দগ্ধ মসলিন।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //