আকাশপ্রদীপ জ্বলে

‘মেস্টর, ও মেস্টর!’

‘কী বলবি বল।’

‘গাঁজা আফিমের দোকানটা কি তবে উঠেই গেল একেবারে?’

সে প্রশ্নের উত্তর এলো না কোনো। আরও কি জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থমকে গেল ভূষণ। মেস্টর বেউলোতে কী একটা সুর বাজাচ্ছে। সুরটা যেন ফেলে আসা শত শত জন্মের কান্না উথলে উথলে তুলছে ভেতর থেকে। ভারি কান্না পেয়ে গেল ভূষণের। সন্ধ্যেবেলাটা তার কিছু করার থাকে না বলে সে এই মেস্টরের বাইরের ঘরে এসে বসে থাকে। মেস্টর মানে পড়ালেখার মাস্টার নয়, গানের মাস্টার। গান শেখায়। এ তল্লাটে গানের মাস্টার ছিল না একটাও। একটা কীর্তনের দল ছিল, আলুর বেপারি জলধরের। শ্যাম-রাই সংকীর্তনের দল। সেখানে হাটের যত ছোট ব্যবসাদার, মাতাল আর উড়ুঞ্চুড়ের ভিড়। কারও গলা কাটলেও একফোঁটা সুর বেরোবে না। তবু কি আশ্চর্য, এই দল আশপাশের গাঁ থেকে বেশ ডাক পায়। তবে সত্যিকারের গান যাকে বলে, তা নিয়ে এলো মেস্টর। ভূষণ চাষাভুষো লোক হলেও ধরতে পারে সেটা। সে সুর শুনলে বুকের মধ্যে কেমন উথাল-পাথাল করে।

এক এক সন্ধ্যেবেলা মেস্টর বসে বসে বাঁশি বাজায়, ভূষণ বুঝতে পারে, কেন বাঁশির ডাকে রাধা পাগল হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেত। আচ্ছা, মেস্টর একসঙ্গে কত কী বাজায়! বেউলো, বাঁশি, হারমনি। কত সময় বাঁশি বাজাতে বাজাতে পা দিয়ে হারমনির বেলো করে। কী আশ্চর্য লাগে দেখতে।

তবে মেস্টর কটা সন্ধ্যেবেলা আর বাড়ি থাকে? কুলপি, করণজলি, শ্যাম বোসের চক-কত জায়গায় সে যায় গান শেখাতে। সকালে সে বড় একটা বাইরে যায় না, ব্যাচ কে ব্যাচ গান শিখতে আসে সেই ভোর থেকে। এইরকম চলে বেলা বারোটা অব্দি। তারপর উঠোনে বসে মেস্টর তেল মাখে। কী গরম, কী শীত- সারাবছর। সে তেল মাখা একটা দেখবার মতো জিনিস। একটা খাটো ধুতি ল্যাঙটের মতো করে পরা। মেস্টর সারা গায়ে থাবড়ে থাবড়ে তেল মাখে। কালো পাথরে কোঁদা শরীর, তেল আর রোদ মেখে চকচক করে সোনার মতো। মেস্টর কালো। আর কালো অঙ্গে কী রূপ, মরি মরি! সবাই বলে এই রূপের টানেই আশপাশের গাঁ ভেঙে এত মেয়ে গান শিখতে আসে তার কাছে। গান ভালোবেসে আসে নাকি? বোঝে কজন গান? চাষার বাড়ি সব, লাঙল চষা রক্তে সুর কই? সাত মাস গলা সেধেও গলার আড় ভাঙে না। বাপ মা এসে ধরে পড়ে ‘অ মেস্টর, একটা সিনিমার গান বলাও না, সামনের রোববার দেখতে আসবে গো পাত্রপক্ষ।’

মেস্টর আগে ভাগিয়ে দিত। ‘যা যা, ওসব সিনেমার গান টান হবে না এখানে। হাজিপুর টাউনে যা, সেখানে মেলা মাস্টার পাবি।’ আজকাল ওসব বলে না। খোকা হয়েছে। সংসার তো বাড়ছে। রাক্ষসের হাঁ তার। সারা পৃথিবীর খাবার এনেও বোজানো যাবে না হাঁ। তাই মেস্টর কথা না বাড়িয়ে শেখায় ‘ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে আমি বনফুল গো।’

পাত্রের বাবা, মেসো, জেঠা চোখ বুজে মাথা নেড়ে নেড়ে শোনে মেয়ের গান, মেয়ে হারমনি বাজিয়ে গাইতে পারে-ভাবা যায়! ভূষণ জানে এ মেয়ের শ্বশুরকুলের ইতিহাসে ভাবী পুত্রবধূর হারমুনি বাজিয়ে গান করাটি একটি এভারেস্ট জয়ী মুহূর্তের মতো হয়ে থাকবে, সেটা বারবার বিভিন্ন পারিবারিক উৎসবে, মোচ্ছবে স্মরণ করা হবে, ‘জানো আমাদের ঝন্টুর বউ হারমুনি বাইজে গান করতি পারে!’ অথচ হারমুনি তো দূরের কথা, খালি গলায় গান গাইতেও ঝন্টুর বউকে কেউ কখনো শোনেনি, ঝন্টুর বউ হয়ে আসা মেয়েটিও জানে, গান ছিল তার বিয়ের পারানি, বিয়ে হয়ে গেছে, গানের প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। এটাই তো হয়, হয়ে আসছে। তার বেলা কি নিয়ম উলটে যাবে? কে কোথায় শুনেছে গাঁ ঘরে বউ মানুষ গান করছে গলা খুলে? তবু, তবু একেক দিন কাজ সেরে দুপুরবেলা, যখন খিড়কি পুকুরের ধার থেকে ঘুঘুর ডাক ভেসে আসে, বড্ড মা-বাপের কথা মনে পড়ে, আর মাস্টার মশাইয়ের কথা, মনটা যেন আছাড়িপিছাড়ি খায়।

ভূষণের হঠাৎ মনে হলো মেস্টরের বেউলোতে আজ সেই গান ভুলে যাওয়া মেয়েগুলোর বুকের উথাল-পাথাল ব্যথাগুলো উঠে আসছে।

আজকে মেস্টর ঘরে আছে, সন্ধে নেমেছে। মেস্টর ঘরে আছে বলেই ভেতরবাড়িটা এই সন্ধ্যেবেলাতেও নিঝুম। মেস্টরের ভাইগুলো অন্যদিন চেল্লামেল্লি করে, ইচ্ছেমতো বেরোয় আর ঢোকে। আজ মেস্টর ঘরে আছে বলে সবাই চুপ মেরে আছে। গুনগুন করে পড়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে শুধু। মেজ আর ন ভাইয়ের পড়ালেখার মাথা খুব, সেজ তত সরেস নয়, তবে চেষ্টা করে। হবে না কিছু শুধু ছোটটার। আজ মেস্টরের ভয়েও তাকে বাড়িতে বেঁধে রাখা যায়নি। ব্যবসায়ী সমিতির পালাঘরে গিয়ে বসে আছে নির্ঘাত। মদ-গাঁজাও খেতে শিখেছে এই বয়সেই। মেস্টর বার কয়েক চোরের মার দিয়েছে; কিন্তু লাভ হয়নি। হবে কোত্থেকে? মেস্টর যতই শাসন করতে চাক, পেছন থেকে তার মাথা খাওয়ার লোক ঘরেই মজুদ। মেস্টরের মা আর বউ। ছোট ছেলেকে কিছু বললেই তারা কান্নাকাটি, উপোস এসব করে সব ভণ্ডুল করে দেয়। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেও গুনু ঠিক খিড়কি দরজা দিয়ে ঢুকে বাড়া ভাত পেয়ে যায়। ডায়মন্ড টকিজে সিনেমা দেখার জন্য সান্টু একবার মেস্টরের পয়সা চুরি করেছিল। জানতে পেরে মেস্টর চেঁচাচ্ছিল ‘দেখি মা আর বউদি মিলে কত দিন আঁচলচাপা দিয়ে রাখতে পারে? এবার তো পুলিশ এসে কোমরে দড়ি পরিয়ে নিয়ে যাবে।’

এমন এমন পরিস্থিতিতে মেস্টরের মা ঠোঁট টিপে ডালবাটা ফেটাতে বসে যায়। ডালবাটার মতোই রঙ গায়ের, তেমন মুখ চোখ। অপরূপ গড়নপিটনের এই নারী যে মেস্টরের নিজের মা নন, তা অন্ধ লোকও বলবে। নিজের মা যখন পাঁচটি ছেলে ফেলে অকালে সগগে গেলেন, তখন মেস্টরের বয়স ১৫ আর সবার ছোট সান্টু হামা টানছে। ছেলেদের দেখাশোনার জন্য মেস্টরের বাপ কলকাতার বালিগঞ্জের বড় ঘরের এই মেয়েটিকে ঘরে আনলেন, মেয়েটির বয়স তখন ১৪।

তার বড়ছেলে সে মেয়ের চেয়ে এক বছরের বড়। সেই চোদ্দ বছরের কিশোরী কি আশ্চর্য কৌশলে এই ১৫ বছরের ছেলের মা হয়ে উঠল কে জানে! কিন্তু সত্যি তো, মেস্টর কখনো এই নারীটিকে মা ছাড়া ডাকেনি, শুভকাজে বেরনোর সময় বরাবর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে গেছে। আর জীবনের সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকারসেও তো এই মায়ের কথায়। সে কথা মেস্টর বলতে চায় না নিজের মুখে, বলতে গেলে এত বছর পরেও তার বুকে ব্যথা বাজে।

তখন বয়স আরও একটু কম, বিয়ে হয়নি। কলকাতায় বড়লোক বাড়িতে ঘরোয়া আসরের চল খুব সে সময়। সেরকম আসর প্রায় বসে লেবুতলা পার্কে মিত্তিরদের বাড়ি, সন্ধ্যে থেকে শুরু আসর শেষ হতে ভোর গড়িয়ে যায়। কে আসে না সেখানে? কৃষ্ণ চন্দ্র দে, ডি.ভি. পালুস্কর, ভি.জি. যোগ, আনোখি লাল, পঙ্কজ মল্লিক... সেখানে মাঝে মাঝে যেত মেস্টর। কালো পাথর কোঁদা চেহারাটি যেন সাক্ষাৎ কেষ্ট ঠাকুর। আর তেমনি গানের গলা। বাড়ির কর্তার নজরে পড়ে গেল। একদিন সন্ধ্যেয় এসেছেন স্বয়ং রাইচাঁদ ঘোষাল। বিখ্যাত ধ্রুপদিয়া লালচাঁদ বড়ালের ছোট ছেলে। গায়ক, সুরকার আরও কত কী। রামপুর মাহাসয়ান ঘরানার শিল্পী উস্তাদ মুস্তাক খানের শিষ্য , তবলা শিখেছেন মসিত খানের কাছ থেকে। সরোদে নাড়া বাঁধা উস্তাদ হাফিজ খানের কাছে। ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানির তখন আদিযুগ, সেই ১৯২৭ সালে সেখানে যোগ দিলেন তিনি, তারপর চলে এলেন নিউ থিয়েটারে সংগীত বিভাগের দায়িত্বে। তার সঙ্গে কে? না পঙ্কজ মল্লিক। সেই রাইচাঁদ বড়ালের চোখে পড়ে গেল ছেলেটা, শিবেন্দ্র ভট্টাচার্য। এই বয়সেই কী গায়কী! শুনলে আমির খাঁর কথা মনে পড়ে। সেই রকম দাপট। কথা বলে জানতে পারলেন ওর শিরায় বিষ্ণুপুর ঘরানার রক্ত বইছে। যদু ভট্টের বংশ। বাবা এক্সাইজ ইন্সপেক্টর ছিল। মারা গেছে। বিধবা মা, চারটি ভাই নিয়ে সংসারটির দায়িত্ব ঘাড়ে। আয়ের সংস্থান বলতে একটি আবগারি দোকান। লোকে বলে গাঁজা আফিমের দোকান। সরকার বাহাদুর সেই দোকানটি আবার দিয়েছে কোথায় না কোথায় একেবারে অজ পাড়াগাঁয়ে। হাজিপুর থেকে আট মাইল ভেতরে যেতে হয়। গাঁয়ের নামটি কী, মনেই করতে পারল না শিবেন্দ্র। সেখানে যাবার নামেই এত অনীহা তার। ওই অজ পাড়াগাঁয়ে গিয়ে একবার পড়লে কি তার গান ধরে রাখতে পারবে সে? রাইচাঁদ খানিকটা ভর্ৎসনার সুরে বললেন, ‘এই রকম গান ছেড়ে শেষে গাঁজা আফিমের দোকান খুলবে ছোকরা? ভেবে দেখো, বুঝলে ভেবে দেখো ভালো করে।’

শিবেন্দ্র অসহায় মুখে বলল, ‘কিন্তু আমার ওপর যে একটি বৃহৎ সংসারের ভার।’

‘শোন হে ছোকরা, এখন গান গেয়েও সংসার চালানো যায়। গান কি আর শুধু বড়লোক বাড়ির আসরে আটকে আছে হে? টকিতেও গান লাগে। একদিন দেখবে এই টকির গানই সবার মুখে মুখে ঘুরবে। নিউ থিয়েটার্সের নাম শুনেছ তো? যদি গান গেয়ে খেতে চাও তবে নিউ থিয়েটার্সে এসো একদিন। ওখানে আমি মিউজিকটা দেখি।’

‘কোথায় যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ?’

চমকে তাকাল শিবেন্দ্র। রাইচাঁদ বড়ালের কথাগুলো শরীরে মনে কেমন ঘোর তৈরি করেছে। সেই ঘোর ছিঁড়ে গেল তীক্ষ্ণ গলার চিৎকারে। কে বলল কথাটা? মিত্তির বাড়ির দোতলার আসর থেকে নেমে নিচে উঠোনে সবে পা রেখেছে। চমকে গিয়ে দেখল একটা প্রকাণ্ড সাদা কাকাতুয়া দাঁড়ে বসে। কাকাতুয়াটাই বলেছে এ কথা। লেবুতলা পার্ক থেকে শিয়ালদা স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শিবেন্দ্র নিজেকে প্রশ্ন করল, ‘কোথায় যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ?’

বাবা মারা যাবার পর আপাতত তারা আছে বারুইপুরে জ্ঞাতি কাকার আশ্রয়ে। বারুইপুর জায়গাটি বর্ধিষ্ণু। এখানকার জমিদাররা নাকি বেহালার সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারের একটি শাখা। শত শত বছরের প্রাচীন। এদের রথ, রাস, দোল বিখ্যাত। এখানেই আটিসারা গ্রামে অনন্ত সাধুর ভিটেয় নাকি চৈতন্য মহাপ্রভু ছত্রভোগ যাবার পথে একটি রাত কাটিয়েছেন। মহাপ্রভুর স্মৃতিতে সংলগ্ন শ্মশানটির নাম হয়ে গেছে কীর্তনখোলা। তার খড়ম নিয়ে একটি মহাপ্রভুতলা আছে। একদিকে পানের বরজের মালিক অতি সম্পন্ন বারুজীবী সম্প্রদায়, যাদের নামে নাকি বারুইপুর, অন্যদিকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের বাস। এখানে বাস করতে পারলে সব দিক থেকে ভালো হতো। কারণ কলকাতা এত কাছে। ট্রেনে চাপলেই হলো। কিন্তু কাকার আশ্রয়ে কত দিন থাকা যায়? যদিও শিবেন্দ্র শুনেছে বাস্তু বাটিটি তার ঠাকুর্দা নির্মাণ করেছিলেন, এতে তাদের সম্পূর্ণ অধিকার আছে; কিন্তু শিবেন্দ্র মরে গেলেও সে কথা কাকাকে বলতে পারবে না। তা ছাড়া কাকিমা তাদের থাকাটা আদৌ সুনজরে দেখছেন না। খুড়তুতো ভাইগুলো গোল্লায় গেছে। ওদের সঙ্গে মিশলে তার ভাইগুলোও মানুষ হবে না। মাও কয়েক দিন ধরে বলছেন ‘বাবা, যেখানে ওর নামে দোকানঘর বরাদ্দ করেছে, চলো সেখানে চলে যাই। ওখানেই আমাদের উন্নতি হবে।’

মা এমনিতে বেশি কথা বলেন না, নিজের কোনো অসুবিধার কথা কখনোই তার মুখ দিয়ে বেরোয় না; কিন্তু শিবেন্দ্র বেশ বুঝতে পারছে কাকিমা এমন কিছু কটুবাক্য বলেছেন মাকে, এমন কিছু আচরণ করেছেন যে মা আর একমুহূর্তও এখানে থাকতে চাইছেন না। শিবেন্দ্র কী করবে তাহলে? মাকে গিয়ে বলবে, ‘মা গাঁজা আফিমের দোকানে আমি বসতে পারব না, আমি শিল্পী হব। টকিতে আমার গান বাজবে। স্টুডিওপাড়া থেকে ডাকছে আমাকে?’ শিবেন্দ্র ভাবল, আচ্ছা, তার মতো সমস্যায় কেউ পড়েছে কখনো?

ভূষণ জানে, সেদিন ফিরে সত্যি সত্যি মেস্টর বলেছিল ওই কথা তার বিমাতাকে। আর সেই শুনে মেস্টরের মা, মানে স্মৃতিকণা দেব্যা যা বলেছিলেন, তা মেস্টরের জীবনটাকেই বদলে দিয়েছিল। শিবেন্দ্রর এক বছরের ছোট মা, স্মৃতিকণা একটুও না ভেবে শান্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘বাবা শিবেন, তুমি আমার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর, জীবনে কখনো ওই স্টুডিওপাড়ায় যাবে না, আর টকিতে গান দেবে না। যত শীঘ্র পারো, রাজারামপুর চলো। ওখানে আবগারি দোকানটি খুলে বসো। ওখানেই তোমার পিতৃদেবের আশীর্বাদ আছে।’

স্মৃতিকণার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা মানে স্বপ্নের বাড়িটি নিজের হাতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া। তার সামনে পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসছিল। তবু সে চমকে উঠে বলল, ‘রাজারামপুর! সেটা আবার কোথায়?’

শিবেন্দ্রর থেকে এক বছরের ছোট স্মৃতিকণা একই রকম অনুত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘রাজারামপুরেই তো আবগারি দোকানটি দিয়েছেন সরকার বাহাদুর। এই রেলপথে হাজিপুরে নেমে যেতে হয়। আমি ঠাকুরপোর কাছে সব খোঁজ নিয়েছি। তুমি আগে একদিন গিয়ে একটি বাসা ভাড়া করে এসো। তারপর যত শীগগির সম্ভব সবাই যাব।’

শিবেন্দ্রর মাথায় কিছু ঢুকছিল না। সে শুধু দেখছিল দুধসাদা গাড়ি চড়ে রাইচাঁদ চলে যাচ্ছেন আর টকিতে গান গাওয়ার স্বপ্ন গাড়ির ধোঁয়ার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।

ভূষণ যে ঠিক এতটাই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঘটনাটা শুনেছিল তা নয়। এবং পুরোটা মেস্টরের মুখ থেকেও শোনেনি। মেস্টর কেমন একটু ভেতরগোঁজা লোক, সহজে পেটের কথা বাইরে বার করে না। এ কথা সে শুনেছে কিছুটা স্মৃতিকণা দেব্যা আর কিছুটা মেস্টরের মেজ ভাই উপেন্দ্রর মুখ থেকে। উপেন্দ্র, উপীন বলেছিল রাম পিতৃসত্য পালন করতে ১৪ বছর বনবাসে গেছিল, বড়দা মাতৃসত্য পালন করতে আজীবন বনবাসে চলে এলো। তা সত্যি, রাজারামপুর বনবাস ছাড়া কী? বিশেষ করে যারা একবার কলকাতার স্বাদ পেয়েছে তাদের কাছে।

মেস্টর হঠাৎ বেউলো থামিয়ে ভূষণকে বলল, ‘যা তো, ভেতরে একটু চা বলে আয় তো। আর বলে দে রাত্তিরে আমি পরোটা খাব।’

মাঘ মাস। কাঁপিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। জানলার ফাঁক ফোকরে কাগজ গুঁজেও হাওয়া আটকানো যাচ্ছে না। একটু গরম চা হলে বড় ভালো হতো। ভূষণের প্রাণটাও এতক্ষণ চায়ের জন্য আনচান করছিল। বলার সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে দাঁড়াল। টানা লম্বা বাইরের ঘরটি, এখানেই গান বাজনার সব সরঞ্জাম, হারমনিয়াম, বেউলো, ডুগি তবলা, বাঁশি। গানের শতরঞ্জিতে না হবে তো অন্তত ১৫ জন ছাত্রছাত্রী বসতে পারবে। তারপরও অনেকখানি জায়গাজুড়ে দুখানা তক্তপোশ। মেঝে তক্তপোশ মিলে আট দশ জন স্বাচ্ছন্দ্যে শুতে পারে। 

ভেতরবাড়ি আর বাইরের ঘরের মাঝে সবুজ ক্যাম্বিসের পর্দা ঝুলছে। তার আগে মাটির দেয়ালে একটা বিশাল তেলরঙে আঁকা ছবি। কোনো গাছপালা, নদী পাহাড় নয়, একজন মানুষের ছবি। আগে ভূষণ ভাবত, এই সুন্দর মানুষটি বুঝি মেস্টরের বাবা; কিন্তু উপীন বলল এর নাম রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, বিরাট গাইয়ে। হবেও বা, এই চাষাগাঁয়ে কেই বা ওসব খবর রাখে? মেস্টর আসার আগে সে তো চা-ও খেতে শেখেনি। এখন এই চায়ের লোভে লোভে অনেকেই ভটচায্যি বাড়িতে এসে জোটে সকাল সন্ধ্যে। মানুষটাকে না চিনুক, যতবার এই ছবি পেরিয়ে ভেতরবাড়ি যায় ভূষণ, ততবার কেন জানি ওর ভারি প্রণাম করতে ইচ্ছে করে ছবির মানুষটাকে।

ভেতরবাড়ির পরিবেশটা আজ যেন কেমন থমথমে। অন্যদিন ছেলেদের পড়ার শব্দ, বিশেষ করে খুব নিচু ভলিউমে রেডিও শোনার আওয়াজ পাওয়া যায়, মেস্টরের ছোট ভাইটা রেডিওর পোকা। এ বাড়ির দৌলতে এ যন্ত্রটা চোখে দেখল ভূষণ। চোঙাওলা রেডিও, ক্রিস্টাল রেডিও এসব অবশ্য সে দেখেনি।

পর্দাটা সরাবার আগে একটু থমকাল ভূষণ। ভেতরে কেমন একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না? সে একটু ত্রস্ত পায়ে ভেতরে এসে দেখল, টানা বারান্দায় পাতা মাদুরে মেস্টরের পরিবার শুয়ে ছটকাচ্ছে আর পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করছেন স্মৃতিকণা দেব্যা। তার মুখে চোখে উদ্বেগ। হারিকেনগুলো জ্বালানো হয়েছে; কিন্তু এখনো ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়নি। উঠোনে উনুনের আঁচ পড়েছে। ভূষণকে আসতে দেখে স্মৃতিকণা কুটো আঁকড়ে ধরার মতো করে বললেন, ‘চা দেব ভূষণ। তার আগে তুই চট করে সুধা দাইকে খবর দিয়ে আয় তো। থুতু ফেলে যাবি আর থুতু ফেলে আসবি। বলবি বউমার ব্যথা উঠেছে, দেরি করে না যেন।’ 

দুই

গোলাপ বাগানের মাটি নিড়োতে নিড়োতে কোমরটা একটু ছাড়াতে উঠল লখা। তখনি সে দেখল খাদি মন্দিরের বাখারির গেট ঠেলে কে যেন আসছে। এতদূর থেকে ঠিক ঠাহর করতে পারল না। তারপর মাঘের বেলার রোদ তার চোখে কেমন ঝিলমিলি কেটে সব আবছা করে দিল। সে শুধু বুঝতে পারল সাদা ধবধবে ধুতি আর ঘিয়ে শাল জড়ানো বাবু মানুষ কেউ আসছে। একটু অবাকই হলো লখা, মানে লখিন্দর কাওরা। আগে এই গ্রামে নন্দীদের জমিদারি ছিল, তাদের পালকি টানত লখার ঠাকুরদা, পো ঠাকুরদারা। পালকিবাহককে বলা হতো কাহার। সেই কাহার থেকে কাওরা। এখন আর পালকিও নেই, টানার লোকেরও দরকার নেই। মেয়েমানুষরা একা একা বেরোতে শিখেছে। গান্ধীবাবা মেয়েদের রাস্তায় নামিয়েছেন। তারা মিছিলে হাঁটে, সভা করে, এমনকি বক্তিমেও দেয়। কে ভাবতে পেরেছিল, পতিতপাবন দাসের কুচকুচে কালো মেয়েটা, জীবনে যার বিয়ে হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না, বাড়ি বসে বসে থুবড়ি হতো আর ভাইপো ভাইঝির দেখাশোনা আর বউদিদের ফাইফরমাশ খেটে খেটে হাতে পায়ে হাজা পড়ে যেত, সেই শ্যামা, গুজরাটে গান্ধীবাবার আশ্রমে একা একা যায় আসে। এখানে যখন থাকে, তার দম ফেলার ফুরসত নেই। কখনো হোটরে নয়ী তালিম ইস্কুলের দেখভাল, কখনো খাদি মন্দিরের চরকা কাটার ট্রেনিং দেওয়া, বাড়ি বাড়ি ঘুরে মেয়েদের ডাক দেওয়া। বিয়ে যে হয়নি তা নিয়ে কোনো আফসোস নেই চোখমুখে। কী আশ্চর্য! তাহলে রাজারামপুরে আর পালকির দরকারটাই বা কী? তাই বাধ্য হয়ে তাদের ঘরের মেয়েরা চলে গেল বাবুমানুষের বাড়ি ঝি খাটতে, আর ছেলেরা জনমজুরের কাজে। তবে সবাই কি কাজ পেল? যারা পেল না, তারা চুরিচামারি ডাকাতির দলে নাম লেখাল, যেমন লখা। দু-দুবার জেল খেটে দাগি কয়েদির তকমা আঁটা লখা কোনো কাজই পাচ্ছিল না আর। না খেয়েই মরতে হতো, যদি না গান্ধীবাবা হাতটা বাড়িয়ে দিতেন। না, না, গান্ধীবাবাকে সে কোনোদিন দেখেনি। একটা কথা আছে না, ভগবান সবসময় নিজে আসেন না, দূত পাঠান? বিনয় কাঁড়ার হচ্ছেন সেই দূত, যিনি হাত না বাড়িয়ে দিলে কোথায় যে ভেসে যেত লখা। কাওরার ছেলে বলে গ্রামের বাবুসমাজ তো উঠোনেও ঢুকতে দেয়নি কোনোদিন, সেই লখাকে খাদি মন্দিরে গোলাপ বাগানে কাজ দিয়েছেন বিনয় ঠাকুর। এই নামেই চেনে এ তল্লাটের মানুষ ওকে।

শীতটা এবার যাই যাই করেও যাচ্ছে না। গোলাপ বাগানের ঝরে পড়া পাতাগুলো সরাতে সরাতে ভাবল লখা। বেলা প্রায় বারোটা বাজে। তবু জাড় ভাঙে না গায়ের। গায়ের চাদরটা আর একটু টেনে উঠে দাঁড়িয়ে পিঠটা ছাড়াল সে। অমনি দেখতে পেল বাখারির গেট ঠেলে ঢুকে আসছে একটা বাবুলোক। বিনয় ঠাকুরের কাছে আসছে নিশ্চয়। বিনয় ঠাকুরকে কেউ কেউ ছোট গান্ধী বলেও ডাকে। লখা দেখল ছোট গান্ধী এই মুহূর্তে ওদিকের বড় বারান্দায় রোদে বসে গায়ে তেল মাখছেন। লখা কতবার বলেছে একটু পায়ে তেল লাগিয়ে দেবে তাকে; কিন্তু ছোট গান্ধী কারও সেবা নেওয়া পছন্দ করেন না, নিজের সব কাজ তিনি নিজে হাতে করবেন। এই তেল মেখে তিনি স্নানে যাবেন। তার মানে এখনো বেলা বারোটা বাজেনি। সবাই বলে ওনাকে দেখে ঘড়ি মেলানো যায়। তা লখা তো ঘড়ি দেখতেই জানে না। ওকে দেখেই সে সময় ঠিক করে। ভোর চারটেয় উঠে ইস্তক চরকির মতো কাজ করে চলেন ছোট গান্ধী। লোক আসার তো অন্ত নেই। আশপাশের দশটা গাঁ থেকে রোগীর পর রোগী। আবার আইন আদালতের পরামর্শ নেবার জন্যও আসে কত লোক। গরিবগুর্বো লোক সব, মামলা লড়ার টাকা নেই ট্যাঁকে। লোকজন বিদেয় হলে তিনি সটান চলে যাবেন পাশের গ্রাম ধনবেড়ে, রাস্তার দুপাশে মানুষের মল পরিষ্কার করতে। লখা কাওরার ছেলে হলেও যা করতে ঘেন্না পায়।

লখা ভাবল, এই মানুষটা তাকে উদ্ধার না করলে তার তো এখন তাড়ির ঠেকে পড়ে থাকার কথা। এই মানুষটা তাকে পাঁক থেকে তুলে গোলাপবাগানের কাজ দিয়েছেন। ভাবতেই চোখে জল এলো তার। ঝাপসা চোখে সে দেখল খাদি মন্দিরের গেট ঠেলে লম্বা, সাদা ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি পরা এক মানুষ ভেতরে আসছেন।

এই রকমের সাজপোশাকের মানুষ তো শহর থেকে আসে। আর তারা তো এ সময় আসে না। তারা আসে বিকেলে। সকাল থেকে ছোট গান্ধীর কাছে শুধু হাটুরে লোকের আনাগোনা। তাহলে ইনি কে? আরেকটু কাছে এলে লখা বুঝতে পারল, আরে গেঁজার বেপারি শিবেন মেস্টর যে! গান আবার লোককে শেখাতে হয়, তা এই মেস্টরকে না দেখলে জানতে পারত না লখা। চালের খড় ছাইতে ছাইতে, নৌকো বাইতে বাইতে, পুকুরে জাল ফেলতে ফেলতে ভেতর থেকে গেয়ে ওঠা গান, সে তো শুনে শুনে শেখা। কখনো কারও মুখে শোনা কিংবা যাত্রাপালা বা মাইকে বাজা সিনিমার গান-এভাবেই তো গান গেয়ে এসেছে তারা আজীবন। কজন জুটল, তো খোল করতাল বাজিয়ে একটু গান হলো, এই যা। সেখানে এই বামুনের ঘরের ছেলে গান শেখায়, যাকে বলে টিপুশনি। ছেলেরা তো বটেই, মেয়েরা অব্দি আসে এর কাছে গান শিখতে। অবশ্য মেয়েদের বেশি বাড়ি গিয়েই গান শেখান উনি। কিন্তু এখানে কী মনে করে? কৌতূহল হচ্ছিল লখার।

কিন্তু খাদি মন্দিরে ঢোকার সময় রাগ, হিংসা-দ্বেষের সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহল জিনিসটাও বাইরে ফেলে আসতে হয়েছে। ছোট গান্ধী তাকে এখানে নেবার সময়ই বলেছিলেন এ কথা, ‘বুঝলি লখা, বাইরের সংসারের নিয়মগুলো ভুলতে পারলে তবেই তোর এখানে থাকা চলবে। এখানে কিন্তু কেউ কিছু পেতে আসে না, দিতে আসে। পায় ঠিকই, তবে সেটা টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি নয়, অন্য কিছু। থাকতে থাকতে তুই একদিন সেটা নিশ্চয় বুঝতে পারবি। সেটা যদি মেনে নিতে পারিস, তবেই আয়। আর মনে রাখিস, এখানে তোর গোলাপবাগানের কাজ যেমন একটা কাজ, তেমনি আরও অনেক কাজ পাশাপাশি চলছে, যেগুলোর সঙ্গে সারা দেশের অনেক বড় বড় মানুষ জড়িয়ে আছেন। অনেক কথা তোর কানে ভেসে আসবে, সেসব তুই নিজের ভেতরে রাখবি, পাঁচকান করতে পারবি না। আর এসব নিয়ে কৌতূহলও দেখাতে পারবি না।’

সে সময় লখার মাথায় এসব কথার অর্থ কিছু ঢোকেনি। দুবেলা দুমুঠো ভাত আর একটু সম্মানের কোনো কাজ যাতে তার ছেলেকে কেউ ডাকাতের ব্যাটা বলে ডাকতে না পারে। সেটুকু পাওয়ার জন্যে সে সব ছাড়তে রাজি। কিন্তু এখানে থাকতে থাকতে সে সেদিনের কথাগুলোর অর্থ বুঝতে পেরেছে। তাই শিবেন মেস্টরকে ঢুকতে দেখে তার খুব কৌতূহল হলেও সে জানে এসব তার সীমানার বাইরের ব্যাপার। সে একটু দাঁড়িয়ে কোমর ছাড়িয়ে নিতে নিতে শুনল ছোট গান্ধী তেল মাখতে মাখতে বলছেন, ‘আসুন আসুন মাস্টারমশাই, কৃষি ও শিল্প প্রদর্শনী নিয়ে আপনার প্রস্তাবটি খুবই ভালো। সে ব্যাপারে আমাদের খাদি মন্দিরের পক্ষ থেকে যতটা সাহায্য করার করব। কিন্তু অন্য একটা ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই মাস্টারমশাই।’

শিবেন মাস্টার ততক্ষণে বারান্দায় মোড়া টেনে বসে পড়েছেন। লখা দেখল বসার ভঙ্গিটিও ভারি ঋজু মেস্টরের। কোলের ওপর রাখা বাঁ হাত স্থির কিন্তু ডান হাতটি নড়ছে, যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো কোনো সুর ধরে চলেছে অবিরত। বিনয় ঠাকুরের সঙ্গে কথা কইতে কইতেও নিজের অন্তরের সুরটিকে হারাতে দিচ্ছেন না যেন। লখার মনে হলো, সুর জিনিসটি ছটফটে এক পক্ষীর মতো। তাকে ধরা কঠিন, ধরে রাখা আরও কঠিন।

ডান হাতে দেশ রাগের পকড়টাকে ধরতে ধরতে শিবেন মাস্টার তখন বিনয় ঠাকুরকে বলছিলেন-

‘আপনার কোনো কাজে আসতে পারলে তো নিজেকে ধন্য মনে করব। মাঝে মাঝে মনে হয় দেশের জন্য কী আর করলাম। আমরা যারা গান গাই, ছবি আঁকি, লিখি, তারা কীভাবে দেশের কাজে লাগতে পারে?’

‘লাগতে পারে মাস্টারমশাই আর সেই কারণেই আপনাকে ডাকা। আপনি শুনলে খুশি হবেন গান্ধীবাবা এখানে আসছেন।’

‘এখানে মানে এই রাজারামপুর গ্রামে?’ আনন্দে অস্থির হয়ে ওঠেন শিবেন মাস্টার।

‘এখানে বা বাহিরসোনা গ্রামে যে কোনো একজায়গার খাদিমন্দিরেই তার আসার কথা ছিল। কিন্তু রাস্তা খুব খারাপ এই অজুহাতে পুলিশ অনুমতি দেয়নি। তিনি তাই হাজিপুরে আসবেন। আর তারিখটিও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ২৫ ডিসেম্বর।’

‘এত বড় ঘটনা এ তল্লাটে আর ঘটেছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু আমাকে কী করতে হবে?’

‘আপনি উদ্বোধনী সংগীত করবেন।’

শিবেন মাস্টারকে চিন্তাচ্ছন্ন দেখাল। কী গান করবেন তিনি গান্ধীবাবার সামনে? সেটা লক্ষ্য করেই বিনয় ঠাকুর বলেন, ‘আপনি সুরের সাগর। এত কী ভাবছেন? গান্ধীবাবার প্রিয় গান গেয়ে দেবেন, রামধুন, তা হলেই হলো।’

শিবেনের চোখের সামনে এক জনসমুদ্র ভেসে ওঠে। গান্ধীবাবা এলে কী পরিমাণ লোকের সমাগম হতে পারে তা তার আন্দাজ আছে। সেখানে মানুষ আসবে তাদের স্বপ্নের নেতার মুখের দুটো কথা শুনতে। সেখানে তার গান শোনার ধৈর্য কারও থাকবে না। এর আগে রাজনৈতিক সভা সমাবেশে গিয়ে তার তিক্ত অভিজ্ঞতাই হয়েছে। উদ্বোধনী সংগীত বলে যে বস্তুটি এ দেশে চালু হয়েছে, তার চেয়ে বিড়ম্বনা আর কিছু হয় না। প্রথম কথা তো হাটুরে মেঠো লোক বক্তৃতা শুনে হাততালি দিয়ে তৃপ্ত হয়ে বাড়ি যায়, তাদের গান শুনতে বলা এক ধরনের অত্যাচার। গানের মাঝখানেই তারা চেঁচাতে শুরু করে, ‘এ শালা আর কতক্ষণ প্যাঁ পোঁ করবে বল দিনি! মাঠের কাজবাজ ফেলে এলুম।’ আর দ্বিতীয় কথা ওই প্যাঁ পোঁ যন্ত্রটি, মানে হারমোনিয়াম বলে যেটি রাখা থাকে, প্রায়শই তার ভাঙা রিড, বেলো কাজ করে না। সেই হারমোনিয়ামে গান করা পৃথিবীর সব থেকে কঠিন কাজ। আর তৃতীয় আর সবচেয়ে বড় বাধা তো তিনি নিজে। সমুদ্রকে কি একটা কাপের মধ্যে ধরা যায়? সারারাত ধ্রুপদী গানের শিল্পী তিনি, তিনি কীভাবে চার-ছয় মিনিটের চপল তরল গান শোনাবেন? কিন্তু গ্রামদেশে গানের টিউশনি করে খেতে গেলে এসব ধরে বসে থাকলে চলে না। রাজনৈতিক মঞ্চে দেখলে বরং লোকে সম্ভ্রম করে, পরের দিনই মেয়েকে গান শেখাবার অনুরোধ নিয়ে এসে হাজির হয়। সংসার দিন দিন বড় হচ্ছে। বড় মেয়ে হওয়ার পর সম্প্রতি আর একটি পুত্রসন্তানের মুখ দেখেছেন শিবেন। মেজ ভাই ভালো চাকরি পেয়ে এখান থেকে চলে গেছে। তার অফিস কলকাতা, সিঙ্গল লাইনের ট্রেনের ভরসায় তার চাকরি করা চলে না। চাকরি পাওয়ার পর মিষ্টি এবং মা আর বউদির দুটি শাড়ি কিনে দেওয়া ছাড়া, সে আর একটি পয়সাও ঠেকায়নি। সেজটার পড়াশোনা হবে না; কিন্তু তাকে জামাই করার জন্য নদীর ওপারে কুঁকড়োহাটির এক সম্পন্ন ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে সম্বন্ধ আসছে, ভদ্রলোকের ছেলে নেই, অনেক জমিজমা। জামাইকেই সেসবের দায়িত্ব নিতে হবে। মানে ঘরজামাই সোজা কথায়। এভাবে বাকি ভাইগুলোও একে একে এ সংসার থেকে চলে যাবে আর ফিরেও তাকাবে না। কত কষ্টের উপার্জনে তিনি ওদের মানুষ করেছেন মনেও রাখবে না। মাকে তিনি একটা কথা প্রায়ই বলতে শোনেন ‘খাই দাই পাখিটি, বনের দিকে আঁখিটি।’

ভাইগুলো তেমনিই। তবু ভালো নিজেদের রাস্তা নিজেরাই খুঁজে নিচ্ছে, তার বোঝা বাড়াচ্ছে না। চিন্তা ছোটটাকে নিয়ে। অভিনয়ের নেশা তাকে পাগল করে তুলেছে। নেহাত গ্রাম্য সব পালায় অভিনয় করে বেড়ায় আর এ বয়সে যা হয়, আনুষঙ্গিক নেশা ভাঙও ধরেছে। অর্ধেক দিন বাড়িই ফেরে না। মারধর করতেন আগে, এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ওর মাথায় দুই মূর্তিমতী করুণার হাত, তিনি সেখানে অসহায়।

তার মাথায় আরও একটা প্রশ্ন এলো। সেটা করতে গিয়েও করলেন না তক্ষুনি। খাদি মন্দিরের পরিবেশটি বড় মনোরম। শীতের রোদ পড়েছে গোলাপের ওপর। গোলাপবাগানে কে কাজ করছে ওটা? কাওরাদের লখা না?

‘আপনি তো অসাধ্য সাধন করেছেন। একটা জেলখাটা ডাকাতকে দিয়ে এমন ফুল ফুটিয়েছেন।’

‘লখার কথা বলছেন? ও খাদি মন্দিরের একটা সম্পদ।’

শিবেন কথাটা যেন শুনেও শুনলেন না। তার মাথায় তখন অন্যকথা ঘুরছে। যাকে শোনাতে বলা হচ্ছে, তিনিও কি শোনার অবস্থায় থাকবেন? গান শোনার জন্য কান যেমন চাই, তেমনি চাই মন। কান আর মন একজায়গায় হলে তবেই গান শোনা যায়। গান্ধীবাবা তো কত জায়গায় জনসভা করতে করতে আসবেন, রাজ্যের লোকের আবেদনে নিবেদনে মন ভারাক্রান্ত থাকবে, তারপর তো ব্রিটিশ পুলিশ কড়া নজর রেখেছে তার প্রতিটি চলাফেরার ওপর। কখন যে জেলে ঢুকিয়ে দেবে কে জানে।

তিনি বললেন ‘রামধুন গাইব? বেশ তো। তবে আজ সকালে একটা নতুন গান বাঁধলাম। দেশ রাগের ওপর, শুনবেন একটু?’

বিনয় ঠাকুর মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। এসব শিল্পী মানুষকে নিয়ে এই হচ্ছে মুশকিল। কাজের সময় অসময় বোঝে না। যখন তখন কবিতার খাতা নিয়ে, গান নিয়ে এসে হাজির হবে। শোনাতে চাইবে, প্রশংসা চাইবে। তিনি এদিকে কাজ ছাড়া কিছু বোঝেন না, দেশ আর দেশের এই অগণিত খাদ্যহীন বস্ত্রহীন শিক্ষাহীন লোক তার ধ্যান জ্ঞান। এর বাইরে কিছু দরকার নেই তার।

তিনি খানিকটা বিব্রত মুখে বললেন, ‘মাস্টারমশাই, আপনি বেঁধেছেন যখন, সে আমি না শুনেও বুঝতে পারছি অতি উত্তম হবে। আমাকে আবার স্নান আহার ছেড়েই বাহিরসোনা গ্রামে ছুটতে হবে। ওখানে একটি নারী শিক্ষা শিবিরের কথা চলছে।’

বলতে বলতেই উঠে পড়েন বিনয় ঠাকুর, গামছাটা টেনে নেন, স্নানে যাবেন। শিবেনও ওঠেন। নমস্কার করে চলে আসার আগে একবার গোলাপ বাগানের দিকে চান, লখা তখনো সেখানে কাজ করছে। কী যেন মনে পড়ে গেছে এইভাবে বলেন, ‘আজ সকালে যখন গানটা বাঁধছি, তখন দেখি আমার কন্যা এসে মুগ্ধ হয়ে শুনছে, এই তিন বছর হলো বুঝলেন। আরও ছোটবেলায় যখন কাঁদত, মনে হতো ভৈরবীতে আলাপ করছে। ওকে আমি কী বলে ডাকি জানেন? সুরদেবী। গ্রামের লোকে সেটাকে দেবী করে নিয়েছে।’

বিনয় বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন শিবেন মেস্টরের দিকে।

তিন

শ্রী পঞ্চমী তিথিতে অন্য অন্য বার শীত কমে যায়। হলুদ শাড়িতে সেজে ওঠা মেয়েদের আঁচলে উড়তে থাকে প্রায় এসে পড়া বসন্তের বিজয় ধ্বজা। এ বছর শীত কমার কোনো লক্ষণ নেই। ভোর বেলা পলাশের কুঁড়ি সংগ্রহে গিয়ে খালেদ টের পেয়েছে শীত কাকে বলে। প্রতিবছর মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির সরস্বতী পূজায় পলাশ কুঁড়ি জোগাড়ের ভার তার ওপর থাকে। প্রথম এই ভারটা পেয়ে এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিল যে তার মুখে কথা সরেনি। দেবী সরস্বতীর পূজা হবে তার হাতের ছোঁয়া লাগা ফুল দিয়ে? এও কি সম্ভব? মাস্টারমশাই তার কথা বুঝেই বোধহয় বলেছিলেন, ‘তুই এত ভালো বাঁশি বাজাস, সুরের দেবীর পুজোর ফুল সংগ্রহের ভার আর আমি কাকে দেব বল? তোর থেকে বেশি যোগ্য কে?’

খালেদ তবু কথা বলতে পারেনি। সে ভালো বাঁশি বাজায়, এটাই তার যোগ্যতা! আর সে যে মুসলমান, এটা কোনো বাধা নয়? হিন্দুদের ঠাকুরের ফুল ছোঁবে সে? এমন অদ্ভুত কথা সে আগে কখনো শোনেনি।

খালেদ কেন, গোটা রাজারামপুর গ্রামেই এমন কথা কে কবে শুনেছে? গ্রামে তো আরও দু-ঘর বামুন আছে, চক্রবর্তী, একজন না হয় পুজুরি বামুন, আরেকজন তো রাজারামপুর হাই স্কুলে পড়ায়, তাদের ঘরে এমন অশৈল কাণ্ড হয় না তো। মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রী আর মা শুনে বেঁকে বসেছিল। এই পূজায় তারা থাকবে না। মাস্টারমশাই হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে সে কথা। বলেছে, ‘অশিক্ষিত বামুন ডেকে অং বং চং করতে দেব না বলেই আমি নিজে পুজো করি। বাকদেবী সুরদেবীর পূজায় আমার মন্ত্র-আমার সুর, আমার কথা। আর আমার তন্ত্রধারক এই খালেদ, যার বাঁশির সুর স্বর্গ অব্দি পৌঁছায়।’

ব্যস, কেউ মানুক না মানুক সে পুজো, মাস্টার মশাইয়ের কিছু এসে যায় না। আর স্ত্রী আর মায়ের সাহায্য তো তার দরকার নেই। খালেদ যেমন পলাশ কুঁড়ি আনে, সুশীলকাকা নিয়ে আসে সোনামুগ আর গোবিন্দভোগ চাল আর কুল। জয়া, শ্যামলী ফল কাটে, আলপনা দেয়। ভেতরবাড়ি থেকে কারও হাত লাগানোর অপেক্ষায় কিছু আটকে থাকে না। পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া ছাড়া কারও কোনো কাজ থাকে না। তবে পূজোর যেটা মুখ্য আকর্ষণ-সেটার আয়োজনে কোনো ত্রুটি রাখেন না স্মৃতিকণা আর তার বউমা বিজয়া। গোবিন্দভোগ চালে সোনা মুগ আর প্রচুর কড়াইশুঁটি, বাদাম, নারকেল কুচি ছড়ানো ঘিয়ের গন্ধে ভরপুর খিচুড়ি, ছোট আলুর কষা, ফুলকপির ডালনা, পাঁচরকম ভাজা, টোপা কুলের অম্বল আর পায়েস। যারা মুসলমানের ছোঁয়া ফুলের পুজো বলে নাক সিটকোয়, তাদের অনেকেই দুপুরের এই খাবারের আকর্ষণ এড়াতে পারে না। তাই ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে গোটা পঞ্চাশ জন তো হয়েই যায়। এসব রান্না করেন স্মৃতিকণা আর তার বউমা বিজয়া দুজনে মিলে। স্মৃতিকণা বালিগঞ্জের ধনীগৃহের কন্যা। তার হাতে অল্প কিছু ওঠে না। সেটাকে পুষিয়ে দেন নৈহাটির গরিফা থেকে আসা বিজয়া। শিক্ষিত পরিবার তাদের, কিন্তু স্কুল শিক্ষক বাবার সংসারে কখনো ম সচ্ছলতা ছিল না। দুই মেয়ে, পাঁচ ছেলের বড় সংসার। ছেলেগুলো বেশির ভাগই জুটমিলে ঢুকে গেছে। তার মধ্যে উচ্চপদে আছে মেজ। নীলগঞ্জে গঙ্গার ধারে তার মস্ত কোয়ার্টার। বাবার মৃত্যুর পর মাকে আর ছোট বোন বিজয়াকে সে অবশ্য নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মা যায়নি, বাকি ছেলেদের ফেলে। গরিফায় ভাঙা বাড়িতেই থেকে গেছে। বাড়িটি ভাঙা হলেও গরিফার ইতিহাস কিন্তু ভাঙা নয়। এর শিক্ষা সংস্কৃতির গরিমার জন্যে বাসিন্দারা আদর করে একে বলত ছোট বিলাত। এর আদি নাম গৌরীভা। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলে গৌরীভার উল্লেখ আছে। চণ্ডীমঙ্গলের রচনাকাল ১৪৯৫ শতাব্দ। তখন থেকেই এটি জলপথের একটি স্টেশন। কথিত আছে মঙ্গল কাব্যের নায়ক গৌরী ভক্ত শ্রীমন্ত এর নামকরণ করেন গৌরীভা।

কে থাকেননি এখানে? শ্রী গৌরাঙ্গের অন্যতম প্রিয় পার্ষদ শ্রীকান্ত সেন আর বল্লভ সেন-তারা তো এখানকার মানুষ। চৈতন্য চরিতামৃতে আছে-

‘শ্রী বল্লভ সেন নাম আর শ্রীকান্ত

শিবানন্দ সম্বন্ধে প্রভুর ভক্ত একান্ত।’

এই শিবানন্দ আদতে কাঞ্চনপল্লীর লোক, যার নাম এখন কাঁচরাপাড়া। এরকম জায়গায় জন্মে পড়াশোনার জন্য কঠিন লড়াই করতে হয়েছিল বিজয়াকে। অথচ মজার কথা, তার দিদি সুজয়া প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা। সেটা অবশ্য স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হয়নি। জামাইবাবুর আকালমৃত্যু এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। সেই সময় দিদির শিক্ষাটা কাজে এসেছে। ছোট ছোট দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে দিদি যখন অকূল পাথারে পড়েছিল, সেই সময় তার পাশে এসে দাঁড়ান নগুদিদি। এই মহীয়সী নারী সারাজীবন সমাজের গরিব মানুষগুলোর জন্যে কাজ করে গেছেন। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের অক্ষর পরিচয় করানো, অসুখে সেবা করা, চা বাগানের শ্রমিকদের জন্যেও তার কত ভাবনা। সেই মানুষটি মেয়েদের জন্যে একটা স্কুল খুলেছিলেন, তাতেই পড়ানোর কাজে ডেকে নিয়েছিলেন সুজয়াকে। সুজয়া কালোকোলো মোটাসোটা, দেখতে তেমন ভালো নয় বলে ক্লাস এইট অব্দি পড়ানো হয়েছিল, সেটা কাজে এসে গেল। বিজয়া সেই সুবিধেটা পেলেন না। তার চমৎকার গড়ন পেটন, রংটা ফরসা, ক্লাস ফোরে উঠতেই তার পড়া বন্ধ হয়ে গেল।

অবশ্য বাবা নেই, কেই বা মেয়েমানুষের পড়ার খরচ জোগাবে? মাও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, রান্নাবান্নার বেশিরভাগ বিজয়াই করতেন। দাদারা জলখাবারে আবার রাতেও রুটি বা পরোটা খেত বলে, তার হাতের আটা ময়দার খাবার দারুণ খোলে। তার ভাঁজে ভাঁজে খুলে যাওয়া পরোটা খেয়ে মুগ্ধ হয়নি এমন লোক কম আছে। সেই পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে কেউ কি টের পেয়েছে এর মধ্যে একটা স্কুলছুট বালিকার কান্না মিশে আছে? ক্লাস ফোরে বৃত্তি পেয়েছিলেন বিজয়া; কিন্তু তারপর আর পড়া হয়নি। ঘরের কাজের ফাঁকে এদিক ওদিক থেকে জোগাড় করা বই পড়তেন লুকিয়ে। ভাইয়েরা দেখতে পেলেই কেড়ে নিত। বিশেষ করে ইংরেজি বই। ইংরেজি শিখলে মেয়েমানুষ নাকি বিধবা হয়, তার জাজ্বল্য প্রমাণ বড়দি। বিজয়া তাই বইগুলো চালের ড্রামে লুকিয়ে রাখতেন। অক্ষরও তো শস্য।

সেই পড়ার আকাঙ্ক্ষাটা রয়ে গেছে বিজয়ারও। তাই প্রথম মেয়ের হাতেখড়ি নিয়ে তার এত উৎসাহ। এবার তিনি আর খালেদের ছোঁয়া পলাশ নিয়ে বেশি কিছু বলেননি। বরঞ্চ দু-একবার এসে প্রতিমা কেমন সাজানো হলো পর্দার ফাঁক থেকে দেখে গেছেন। দেবীকে স্নান করিয়ে তৈরি করাতে হবে। একবিন্দু সময় নেই তার। দেবী বড্ড চঞ্চল। বড় ছেলে আবার খুব শান্ত, যেখানে বসিয়ে দেবে, সেখানে বসে থাকবে। দেবী ঠিক তার দাদার উল্টো। তাকে কেউ কখনো এক জায়গায় বসে থাকতে দেখবে না। সারাক্ষণই সে কিছু না কিছু করে বেড়াচ্ছে। তার হাত পায়ে কাটা ছড়ার দাগ বারো মাস। বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলটা দেখলে এখনো ভয় করে বিজয়ার। মেয়েমানুষ হাজার হোক, একটা খুঁত হয়ে রইল। হালদারদের মেয়ে ছবি নিয়ে গিয়েছিল বিকেলে বেড়াতে। খাদি মন্দিরের দিকটায় বেশি যায় পাড়ার মেয়েরা বেড়াতে, যারা আর একটু সাহসী, বাস রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে গাববেড়িয়া অব্দি চলে যায়। বিজয়া পইপই করে বলে দিয়েছিলেন দেবীকে নিয়ে যেন বাস রাস্তায় না যায়, যা দুরন্ত বাচ্চা। ছবি বলেছিল, ‘না গো কাকী, তুমি চিন্তা করুনি কো। নোনোকে নিয়ে আমি মন্দিরের মদ্দি থাকব।’ এই অঞ্চলের লোকজন বাচ্চাদের নোনো বলে ডাকে। শুনতে একটুও ভালো লাগে না বিজয়ার। তবে ছবি মেয়েটা ভালো। দেবীকে খুব ভালোবাসে, প্রাণ দিয়ে আগলে রাখে। তাই বিজয়া তাকে বিশ্বাস করে তার কাছে ছাড়েন দেবীকে। না ছেড়েই বা উপায় কী? বাচ্চাদের তো একটু খোলা জায়গায় খেলতে দিতে হবে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা অবশ্য সারাক্ষণই কাদা মাটি মেখে খেলে বেড়াচ্ছে, তাদের বেশিরভাগ বাড়িতেই ভাত নেই, বাবা-মা বছর বছর বাচ্চা বিইয়ে ধর্মের নামে ছেড়ে রেখেছে। সেসব কাওরা হাড়ির ছেলেপুলেদের সঙ্গে ছেলেমেয়েকে মিশতে দিতে ভীষণ আপত্তি বিজয়ার। আর কিছু না হোক, চাড্ডি গালাগাল শিখে আসবে। তবে এ ব্যাপারে কাওরা আর বামুনের ঘরে কোনো তফাত নেই। গ্রামে আর যে দু ঘর বামুন আছে, তাদের পেটে ভাত আছে, কালিও আছে, তবু আচার ব্যবহারে ভাষায় শিক্ষার কোনো ছাপ দেখা যায় না। তাদের ছেলেপুলেগুলো এই বয়সেই বাংলা মদ খায় আরও কত কুৎসিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে-সেসব ভাবলেই ঘৃণায় শিউরে ওঠেন বিজয়া। সেসব ছোঁয়া বাঁচিয়ে ছেলেমেয়েকে কীভাবে মানুষ করবেন এ এক বড় চিন্তা তার। ওদের সুস্থভাবে একটু বেড়িয়ে আনাও তো দরকার। এদিকে দেওররা তো সব এক এক করে চলে গেছে। ছোট দেওর এখনো আছে বটে, তবে সে বেশিরভাগই যাত্রা দলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। এমন কেউ নেই যে একটু দেবীকে ঘুরতে নিয়ে যায়, বড়বাবুর তো এসব দিকে কোনো মন নেই। সকালে উঠে বাচ্চাদের ডেকে তিনি ওদের মুখে মাখা সন্দেশ তুলে দেন, ব্যস এইটুকুই যা সম্পর্ক। আর একটু বড় হলে পুকুরে সাঁতার শেখাবার চেষ্টা করেন। তাই ছবি যখন যেচে আসে তাকে তিনি না করেন কীভাবে? রোজই নিয়ে যায় ছবি, দেবীকে ছেড়ে দেয় খাদি মন্দিরের বাগানে, ওরা মন্দিরের সামনের টিউব অয়েল থেকে কলসিতে জল ভরে। পাড়ার সব মেয়ে বউ এই জল আনার উপলক্ষে এক জায়গায় হয় বিকেলবেলা। সেদিনও নিয়ে গিয়েছিল ছবি, দিব্যি ভালো মেয়ে গেল, আর একটু পরে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এলো ছবির কোলে চড়ে। ছবিও কাঁদছে, ভয়ে। দেবীর বাঁ-পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটা তো ঝুলছে আর রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে অনর্গল। বিজয়া ঠান্ডা মাথার মানুষ। তিনি সেই মুহূর্তে কেঁদে কেটে বা ছবির ওপর রাগ করে অনর্থ করলেন না। বরং সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরঘর থেকে পরিষ্কার সাদা কাপড় দেবীর নখটা চেপে বাঁধলেন আর ছবিকে পাঠালেন বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতাপ ডাক্তারকে এখুনি ডেকে আনতে। লোকে বলে প্রতাপ ডাক্তারের সব জল মেশানো ওষুধ, কিন্তু মানুষটাকে তো ডাকতে হাঁকতে পাওয়া যায়। এই গ্রামে আর ডাক্তার বলতে দ্বিতীয় কেউ নেই। বিনয় ঠাকুর বই পড়ে কাজ চালানোর মতো চিকিৎসা করতে পারেন, গরিবগুর্বো মানুষের কিছুটা কাজ হয় তাতে। কিন্তু তার ওপর ভরসা করতে পারেন না গেরস্ত মানুষ। কারণ তিনি দেশের নানা প্রান্তে চরকির মতো ঘুরে বেড়ান, কোনো নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে তাকে পাওয়ার উপায় নেই। এই সমস্যার কথা ভেবে বিনয় ঠাকুর প্রতি রবিবার একটা দাতব্য চিকিৎসালয় খোলার চেষ্টা করেছেন, যেখানে একজন সত্যিকারের ডাক্তার আসবেন শহর থেকে। দু-একজন এলেও কেউ বেশিদিন টেকেনি। ফলে রাজারামপুর গ্রামের মানুষের কোনো সুরাহা হয়নি, প্রতাপ ডাক্তারই ভরসা। আর প্রতাপ ডাক্তার এই পরিবারটিকে বিশেষ সম্ভ্রমের চোখে দেখেন। তা শুধু শিবেন মাস্টারের সঙ্গীত প্রতিভার জন্যেই নয়, বিজয়ার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে সজাগ মনোভাবের কারণেও। প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যাপারটা বিজয়া খুব ভালোই বোঝেন। কেটে ছড়ে গেলে, পুড়ে বা জলে ডুবে গেলে, অন্য গ্রাম্য মেয়েদের মতো চিৎকার বা কান্নাকাটি না করে তিনি প্রথম ধাক্কাটুকু সামলে দিতে পারেন, তাতে ডাক্তারের কাজ আরও সহজ হয়ে যায়। তাছাড়া প্রতাপ ডাক্তার আরও অবাক হয়ে যান ছোটখাটো চেহারার এই নারীর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দেখে। গানের টিউশনি নির্ভর সংসারে অভাব তো নিত্যসঙ্গী; কিন্তু  বাড়ি দেখে কেউ কিছু বুঝতেও পারবে না। জানলায় পর্দা গ্রামে কারও বাড়িতে নেই। বিজয়া পুরনো কাপড় দিয়ে প্রতিটি জানালায় পর্দা টাঙিয়ে রেখেছেন। তার ছেলেমেয়েদের গায়ে তার বানানো জামা, দামি না হলেও পরিচ্ছন্ন। বালিশের ওয়ারে তার হাতের সুতোর কাজ, রান্নাঘরে তাকে তাকে সাজানো কৌটো, বয়াম ভরতি ডাল তেল আটা ময়দা। উঠোন তকতক করে ঝাঁট দেওয়া। তুলসী মঞ্চের সামনে সুন্দর করে আলপনা দেওয়া। বড় বাবুর কোনো ছাত্রী দিয়েছে। কে, সর্বাণী? সর্বাণীর কথা ভাবলেই বুকের মধ্যে কেমন টনটনে ব্যথা করে উঠল। বড়বাবুর সব ছাত্রীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী। আসে বেড়ান্দলি থেকে, বাবার বিরাট অবস্থা। তিন ছেলের পরে এই এক মেয়ে। তার সব আবদারই বাবা রাখে। মেয়ের শখ হয়েছে গান শেখার, বাবা তাই শেখাচ্ছে; কিন্তু ও মেয়ের গলা কাটলেও সুর বেরোবে না; কিন্তু মেয়ের অন্য গুণ আছে। কাজে কর্মে দক্ষ। সরস্বতী পূজার আলপনা, ফল কাটা, ঠাকুর সাজানো সব তো একা হাতেই করে। বড়বাবু এমনিতে কম কথা বলেন, কিন্তু এই মেয়েটির কাছে তিনি কেমন প্রগলভ হয়ে ওঠেন। বড়বাবুর ‘সর্বাণী সর্বাণী’ ডাক শুনলে বুকের ভেতরে ঢেঁকির পাড় পড়ে যেন। আলপনা দেখে মনটা ভার হয়ে গেল বিজয়ার। পর মুহূর্তেই মনটাকে শক্ত করলেন তিনি। আজ তার বড় আদরের দেবীর হাতেখড়ি। আজ কিছুতেই মন খারাপ করা চলবে না।

চার 

রুটি ছিঁড়ে নলেন গুড়ে ডোবাতে ডোবাতে কী যেন মনে পড়ে গেল শিবেন্দ্রের। ‘ও,হ্যাঁ জয়া, আমি কাল কলকাতা যাব। আমার ধুতি জামা গুছিয়ে রেখ।’

রাজারামপুর গ্রাম থেকে কলকাতা যাওয়া এক পর্ব। এখান থেকে ডায়মন্ডহারবার যেতেই এক ঘণ্টা। কীসে যাবে সেও এক সমস্যা। বাস আছে, এক ঘণ্টা অন্তর, ফেল করলে বাসস্ট্যান্ডে বসে থাকতে হবে। আর আছে ভ্যান। তারা অত দূর যেতে রাজি না। খুব সকালের দিকে কিছু সওয়ারি পাওয়া যায়, যারা ডায়মন্ডহারবারে গিয়ে গাড়ি ধরে কলকাতা অফিস করে। তাই কোনো কাজে কলকাতা যেতে হলে ভোর ভোর বেরিয়ে পড়াই ভালো। তাহলে বড়বাবু কি খুব ভোরেই রওনা হবেন? ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন বিজয়া। কারণ যে মানুষটি সকালে বেরোবে সারাদিনের মতো, তাকে শুধু মুখে বিদায় করা চলে না। আবার অত সকালে ভাত একেবারেই খেতে চান না মানুষটি। সকালে ভাত খাওয়ার অসুবিধেও আছে। ব্রাহ্মণ সন্তান এক সূর্যে দুবার ভাত খায় না। সকালে ভাত খেয়ে বেরোলে আর অন্নগ্রহণ করতে পারবেন না। সারাদিন ক্ষুৎকাতর হয়ে থাকবেন, কাজে মন বসাতে পারবেন না। বড়বাবু ক্বচিৎ কখনো কলকাতা যান, কিন্তু যখনি যান, এসব আতান্তর বিজয়ার মধ্যে কাজ করে। এবার তো আরও বেশি। কারণ কাল যে ভাতের বদলে খান চারেক পরোটা করে দেবেন, ময়দা কোথায়? আর পরোটা করলে যে একজনের মতো করা যাবে না এ সংসারে, তা তার চেয়ে বেশি কে জানে? খোকা আছে, দেবী আছে, ছোট দেওর পরশু কোথা থেকে উদয় হয়েছে আবার, যাত্রাদলের একটি মেয়েকে পছন্দ হয়েছে, তাকে বিয়ে করবে, বড়দার অনুমতি আদায়ের জন্যে সে তার মাথা খেয়ে ফেলছে। তাছাড়া গ্রামে তার বাড়িতেই মুড়ি বা ভাত ছাড়া অন্য জলখাবারের পাট আছে বলে রোজ সকালেই দু-তিনজন নানান ছুতোয় উপস্থিত থাকে, তাদের না দিয়ে কোনো কিছুই মুখে তুলতে পারেন না বিজয়া। আর তার শাশুড়ি মা, সম্পূর্ণ নিরামিষাশী নিষ্ঠাভরে বৈধব্য পালন করা মানুষটি? তাকে তো ভালো মিষ্টি ফল কিছুই দিতে পারেন না। ভাবতে ভাবতেই তার দৃষ্টি গেল বড়বাবুর থালার পাশে রাখা ছোট্ট কাঁসার বাটির দিকে। ঝকঝকে বাটিতে সোনালি রঙের এই গুড়টুকু কত কষ্টে যে বড়বাবুর জন্যে সরিয়ে রাখেন তিনি। শাশুড়ি মা রাতে বেশিরভাগ রুটি দুধ খান। বিজয়ার মনে হয় সে সময় একটু গুড় যদি ওকে দেওয়া যেত! উনি তো মুখ ফুটে কিছু চান না। নিজের সঞ্চয় থেকে বাতাসা আনিয়ে রাখেন খোকাকে দিয়ে। খোকাকে হাটে পাঠানো অবশ্য এক ঝকমারি। যেখানে যাবে, দু-ঘণ্টা কাটিয়ে আসবে। বিশেষত বাতাসা কিনতে পাঠালে তো আর কথাই নেই। রাসু ময়রার বাতাসা তৈরি একটা দেখার মতো জিনিস। তাই দেখবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ছোট ছেলে, বিশেষ করে মেস্টরের ছেলে বলে তার হাতে রাসু ধরিয়ে দেবে চারখানা ফাউ বাতাসা। সেই বাতাসা যখন দুধে দিয়ে খান শাশুড়ি মা, খুব কষ্ট হয় বিজয়ার। তিনি মাঝে মাঝে ভাবেন, বড়বাবু তো কখনো জিগ্যেস করেন না, তারা কে কী খান। তিনি না হয় পরের মেয়ে, ছেলে মেয়েগুলো, কিংবা বিধবা মা-এরা কী খায়, তার এই সামান্য টিউশনির রোজগারে এত বড় সংসারটা কীভাবে চলছে, তা কি কোনোদিন ভাবেন বড়বাবু? গোটা শীতকাল তার রাতে শেষ পাতে গুড় চাইই চাই। গড় কুলেগাছি থেকে সুশীলদা এনে দিয়েছিল আর কিছুটা শাশুড়ি মা কাকে বলে যেন সংগ্রহ করেছিলেন, সেই চলছে।

একটা কথা মনে পড়ে মন ভালো হয়ে গেল। বসন্ত এসে গেছে। কদিনের মধ্যে দোল। আর রাতে গুড় খেতে চাইবেন না বড়বাবু। দিলেও সরিয়ে দেবেন, বলবেন অসময়ের জিনিসে আর তার নেই। সে না হয় হলো। কিন্তু ময়দা? বড়বাবু এমনি। কিছু আগে জানাবেন না। হঠাৎ হঠাৎ বলবেন কলকাতা যাব। আজ সকালেও জানতে পারলে জোগাড় করে রাখতেন। এখন এত রাতে কোনো দোকানই খোলা নেই, স্ট্যান্ডে থাকতে পারে, ছোট দেওর ঘরে থাকলে তাকে পাঠানো যেত; কিন্তু সে ঘরে থাকলে তবে তো। কয়েক দিনের ছুটি পেয়ে এসেছে বলছে, কিন্তু বিজয়া বুঝতে পেরেছেন, এ দলটার সঙ্গেও ওর বনিবনা হয়নি, দল ছেড়েই এসেছে ও, প্রতিবার দল ছেড়ে নতুন দলে ঢোকার আগে গুনু মানে গুণেন্দ্র একবার এসে মা আর বড় বউদিকে দেখে যায়। বিশেষ করে বড়বউদিকে বেশিদিন না দেখে সে থাকতে পারে না। কিন্তু এসে সে ঘরে থাকে কতক্ষণ! এখানে তার পুরনো বন্ধুরা তো থেকে গেছে। আর এমন সব বন্ধু, কেউ চাকরি বাকরি পেয়ে শহরে চলে যাওয়ার মতো নয়। গেঁজেল মাতাল সব, কেউ পুরো বাউন্ডুলে, কেউ ছোটখাটো দোকান-টোকান চালায়। কাওরা পাড়ার বিন্দে মানে বৃন্দাবনের ঘরে ওদের অনেকেই যায়, গানের থেকেও বেশি আকর্ষণ বিন্দার বউ সনকা। সনকা কিছুদিন এ বাড়ি ঠিকে কাজ করেছিল, তাকে খুব চেনেন বিজয়া। কালো সাপের মতো চেহারা তার, তেমন ঢলানি স্বভাব। কয়েক দিন কাজ করার পরই বুঝে গেছিলেন বিজয়া, এক মাসের মাইনে আর একটা পুরনো শাড়ি দিয়ে পত্রপাঠ বিদায় করেছেন তাকে। সেই সনকার বাড়ি গিয়ে আসর জমায় ভাই, এ খবর বড়বাবুর কানে এখনো ওঠেনি, উঠলে কী হবে কে জানে। আর কোনোদিন এ বাড়িতে ঢুকতেই পারবে না সে; কিন্তু বিজয়া গুনুকে বিশ্বাস করেন। সে বিন্দের ঘরে যায় বটে, একটু আধটু মদও খায়, কিন্তু গান আর আড্ডাই তার যাওয়ার মুখ্য আকর্ষণ। সনকার দিকে সে ফিরেও দেখে না। আর মদ সে নিত্যদিন খায়ও না। তার ওপর বিজয়ার কড়া নির্দেশ আছে, ওসব ছাইপাঁশ যেদিন খাবে, সেদিন যেন বাড়িতে না ঢোকে গুনু। আজ মনে হয় গুনু ফিরবে না, ময়দা কেনার কোনো আশা নেই।

শিবেন্দ্র খাওয়া শেষ করে কাঁসার গ্লাস থেকে আলগোছে জল খান, তারপর পাশে রাখা খড়ম পরে উঠোনে নেমে যান। উঠোনের এক কোণে বালতি রাখা, সেখানে মুখ ধুয়ে পেয়ারাতলায় বসেন অনেকক্ষণ। বেশিক্ষণ বসলে বুঝতে হবে বড়বাবু আজ বিজয়াকে চান, তার হেঁশেল সারার অপেক্ষা করছেন। সবাইকে খেতে দিয়ে বিজয়া দেখলেন বড়বাবু উঠোনে বসে সুর ভাঁজছেন। একটু খেয়াল করে শুনে বুঝলেন গৌড় সারং। বড্ড মিষ্টি লাগে আবার কেমন একটা কষ্ট হয়। গরিফার কথা মনে পড়ে যায়। ছোট ভাইটা কী করছে কে জানে। আর কারও জন্যে অত কষ্ট হয় না। সবাই নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছে। এইটাই বাউন্ডুলেপনা করে বেড়ায়। জুট মিলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাকি ভাইদের মতো, সে চাকরি রাখতে পারেনি। কারও বাড়িতে বিয়ে থাকলে সে সাদরে বুকোকে ডেকে নিয়ে যায়। ভিয়েন সামলানো, কোমরে গামছা বেঁধে পরিবেশন, বিয়ের পিঁড়ি ধরা থেকে বাসরে গান গেয়ে সবাইকে মাতিয়ে দেওয়া-এসব কাজে কোনো জুড়ি নেই বুকোর। কিন্তু পড়ালেখায় কোনোদিন মন ছিল না, যেমন এখন নেই চাকরিবাকরিতে, ওর কী হবে ভাবলেও বুক কাঁপে বিজয়ার। এদিকে যেমন গুনু, ওদিকে তেমন বুকো, দুটোকে নিয়ে তার জ্বালার শেষ নেই। এই যে এখনো গুনু এলো না, কী যে হবে। নির্ঘাত আজ ওইসব গেলার সাঁট আছে। হেঁশেলের পাট সেরে রান্নাঘরে তালা দিয়ে বড় ঘরে আসেন বিজয়া। তক্তপোশের এক কোণে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে মেয়েটা। দেখে মায়া হলো বিজয়ার। অস্বস্তিও হলো। এই মেয়েকে পাশে রেখেই বড়বাবুকে গ্রহণ করতে হবে শরীরে। বড়বাবুর ইচ্ছে হয়েছে আজ। নইলে খেয়ে উঠেই তিনি বাইরে গানের ঘরে চলে যান, সেখানে অনেকক্ষণ বেহালা বা বাঁশি বাজান, অথবা ডায়েরি লেখেন গলায় সুর ভাঁজতে ভাঁজতে, কিংবা কিছু পড়েন। সেই রাতগুলো ভালো লাগে বিজয়ার। বড়বাবুর বাঁশির সুর ছড়িয়ে পড়ে নিঝুম চরাচরে, মনে হয় স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বাঁশি বাজাচ্ছেন, যা শুনে ঘরে থাকতে পারছে না গোপিনীরা, ছটফট করে বেরিয়ে পড়েছে। তিনিও খোকা দেবীর মা নন, নন সারাদিন ধোঁয়া আর উনুনতাতে ফুরিয়ে যাওয়া এক ঘরের বউ, যাকে নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসারে অবিরাম জাদু দেখিয়ে যেতে হয়। চিনি নেই যেখানে চিনি, ময়দা নেই যেখানে ময়দা, হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে ছু মন্তরে হাজির করতে হয়। তিনি হয়ে যান শ্রী রাধিকা, যে বাঁশির সুরে ঘর ছেড়ে অভিসারে চলেছে, পরনে নীল শাড়ি, আওয়াজ হওয়ার ভয়ে পায়ের নূপুর খুলে রেখেছে, অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে, ঘোর আকাশ চিরে চিরে দিচ্ছে নীল বিদ্যুৎ রেখা, তবু রাধা অবিচল পায়ে ছুটে চলেছে সেই বাঁশির সুর অনুসরণ করে, তার দয়িতের কাছে। যেদিন বেহালা বাজান, সেদিন আরও আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। ভেতরটা যেন নিংড়ে শত শত জন্মের কান্না বেরিয়ে আসে। মনে হয় তার এই ক্ষুদ্র সামান্য জীবন সত্যি সত্যি সামান্য নয়, সারা পৃথিবীর সব যুগের, সব কালের মানুষের বেদনায় তার বেদনা মিশে আছে। রান্নাঘরে সকড়ি পাড়তে পাড়তে, পরের দিনের তেল মসলা গুছিয়ে রাখতে রাখতে মনটা যেন কত উঁচুতে চলে যায়। মনে হয়, পৃথিবীতে পবিত্র এক জলধারা বয়ে চলেছে, তা গরিব-বড়লোক, নারী-পুরুষ বিচার করে না, তা আসলে অনুভবী মানুষের কান্না।

কিন্তু যেদিন বড়বাবু খেয়ে উঠে গানের ঘরে যান না, তাদের ঘরে শুতে আসেন সে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //