কয়েকজনের গল্প

এক

সনাতন গ্রামের অন্য সব মানুষের মতো মেহেরুন্নেছা বেওয়া বয়স জিজ্ঞাসা করলে তিনি কোনো সংখ্যা না বলে উল্লেখ করেন কোনো বড় ঝড়ের অথবা বন্যার কথা। কিংবা আকালের সময় যখন অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, তার কথা। সেকেলে গ্রামের মানুষ বংশ পরম্পরায় শোনা স্মৃতিতে রক্ষিত সেই ঘটনা দিয়ে স্মরণ করে তাদের জন্মের সময় এবং বয়স। সেই বর্ণনা দিয়ে শ্রোতারা মেহেরুন্নেছার বয়স সঠিক নির্ণয় করতে না পারলেও তিনি যে এখানে আসার অনেক আগেই বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন তাকে দেখে এ বিষয়ে ওল্ড হোমের কারও মনে সংশয় নেই; কিন্তু বয়স হলে হবে কী তার যেমন স্মরণ শক্তি তেমনি কথা বলার ক্ষমতা। একবার শুরু করলে তিনি আর থামতে চান না। এতে তাকে নিয়ে অনেকে মজা করেন, কথা বলতে দিয়ে শুনতে শুনতে সময় কাটান। কেউ যদি বিরক্ত হন, উঠে গিয়ে টেলিভিশন দেখেন কিংবা প্রবাসে থাকা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেন। জোর করে তার কথা শোনাতে চান না মেহেরুন্নেছা। তার সম্ভ্রম এবং আত্মমর্যাদাবোধ এখনো প্রখর।

মেহেরুন্নেছা স্বামীর মৃত্যুর পর গ্রামের অন্য বিধবার মতো বেওয়া অন্তক্ষর নিয়ে সবার কাছে পরিচিত হয়েছিলেন সেই স্বাধীনের লড়াইয়ের পর থেকে। তার স্বামী মুক্তিযুদ্ধে যাননি; কিন্তু গ্রামে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়সহ নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। হাটে গিয়ে মিলিটারির গুলিতে মারা যান তিনি। তার লাশ পাওয়া যায়নি। যেহেতু হাট থেকে বাড়িতে ফেরেননি সেই জন্য ধরে নেওয়া হয়েছে তিনি শহীদ হয়েছেন।

তাদের নিজেদের সন্তান-সন্ততি ছিল না। ইন্ডিয়ার বর্ডারের কাছে হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অচিরেই নদীতীরে মেহেরুন্নেছা আর তার স্বামীর বাড়ি হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রানজিট পয়েন্ট। তারা অপারেশনের আগে সেখানে এসে থাকত। অপারেশন শেষ করে আবার তাদের বাড়িতে কদিন থেকে চলে যেত শহরে যার যার ঠিকানায়। এভাবে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছেলের সঙ্গে তাদের দুজনের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেখানে দেশপ্রেমের সঙ্গে মিশে ছিল অপত্য-স্নেহ। দুজনই সেই সব মুক্তিযোদ্ধাকে সাগ্রহে আশ্রয় দিয়েছিলেন আপন সন্তানের মতো। তাদের কাছে মাঝে মাঝেই তারা আক্ষেপ করে বলতেন, আহা আমাদের একটাও ছেলে নেই। থাকলি তারে কতাম তোমাদের লাহান মুক্তিযোদ্ধা হতি। এই গ্রামের কত পোলা মুক্তিযোদ্ধা হুইছে বলি হুনছি।

শুনে মুক্তিযোদ্ধা ছেলেরা বলেছে, ছেলে নেই তাতে কী? আপনারা দুজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গিয়েছেন।

শুনে মেহেরুন্নেছা আর তার স্বামী ভেবেছে ছেলেরা বুঝি ঠাট্টা করছে। বুঝতে পেরে মুক্তিযোদ্ধারা বলেছে, এই যে আপনারা আমাদের এভাবে সাহায্য করছেন, সেটাও তো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া। পাক বাহিনী জানতে পারলে আপনাদের গুলি করে মারবে, যেমন মারে মুক্তিযোদ্ধাদের।

শুনে ভয় পায় না স্বামী-স্ত্রী দুজনের কেউ। খুশি হয়ে বলে, সত্যি কইতেছ তোমরা? আমরাও মুক্তিযুদ্ধে আছি?

অবশ্যই আছেন। মুক্তিযুদ্ধ কি শুধু রাইফেল, গ্রেনেড দিয়ে হয়? এর জন্য যাতায়াত করতে হয়, নিরাপদ জায়গায় থেকে অপারেশনে যেতে হয়। সে সব সুবিধা দিচ্ছেন আপনেরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। একজন তাদের বলে।

আরেকজন বলে, যারা কোনো না কোনোভাবে আমাদের সাহায্য করছে তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা।

শুনে মেহেরুন্নেছা আর তার স্বামীর গর্বে বুক ফুলে যায়।

মেহেরুন্নেছা বেওয়া ওল্ড হোমের বাসিন্দাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনিয়েছেন আসার পর থেকে। একেবারে প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা। প্রথম যখন শুনেছেন খুব মনোযোগ আর আগ্রহ ছিল তাদের। এখনো শোনেন কিন্তু মেহেরুন্নেছা তো নিত্য নতুন গল্প বলতে পারেন না, একই কথা বলেন। সেই জন্য তারা শোনার ভান করেন কিংবা খানিকটা শুনে অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করেন। এই সব গল্পের প্রথম থেকে শেষ তাদের জানা হতে সময় নেয়নি। মেহেরুন্নেছা যখন বলে যান তার কথা পুরনো রেকর্ডের মতো শোনায়। এখন অবশ্য রেকর্ড প্লেয়ার নেই। ডিভিডি, সিডি সে সবও কবে উঠে গিয়েছে।

ওল্ড হোমের বাসিন্দারা প্রায় সবই এক সময়ে শহরের বাসিন্দা ছিলেন। ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে অথবা ঢাকায় থাকলেও তাদের দেখাশোনার জন্য সময় দিতে পারে না বলে অনেক বলে কয়ে বাবাকে ওল্ড হোমে রেখেছে। বিদেশে যারা থাকে তারা বছরে দু-তিনবার এসে দেখে যায়। আসার সময় চকলেট আর বিস্কিট নিয়ে আসে। যাদের পড়ার অভ্যাস তারা ছেলে, ছেলের বউয়ের কাছ থেকে বই-পত্র পান। পড়া হলে সে সব অন্যদের পড়ার জন্য হোমের লাইব্রেরিতে দান করেন। যাদের ছেলেমেয়ে ঢাকায় থাকে তাদের ছেলেমেয়ে মাসে একবার আসে। তারাও সঙ্গে করে খাবার নিয়ে আসে, সেই সঙ্গে কাপড়-চোপড়।

মেহেরুন্নেছা বেওয়ার ছেলে-মেয়ে নেই। আছে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় যে আবার এক রাজনৈতিক দলের নেতা। তিনিই তাকে এই ওল্ড হোমে এনে রেখেছেন খুব উৎসাহ দেখিয়ে। গ্রামে একা থাকছিলেন তিনি। অবশ্য তাকে দেখাশোনার জন্য লোক রেখেছিলেন ক’জন। তারা বেশ যত্নে রেখেছিল তাকে। শুধু অসুখ-বিসুখ হলে সমস্যা দেখা দিত মাঝে মঝে। সে কথা এবং তার বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘরের কথা বলে তার সেই দূর সম্পর্কের আত্মীয় তাকে ঢাকায় এই ওল্ড হোমে এনে রেখেছেন। তিনি তার দশ ছেলেকে ছেড়ে ঢাকা, আসতে চাননি, এ কথা বলেছেন আসার পর। দশ ছেলের কথা শুনে বেশ অবাক জয়েছেন ওল্ড হোমের বাসিন্দারা। সেই নিয়ে রহস্য দূর হয়েছে পরে।

মেহেরুন্নেছা বেওয়ার দূর সম্পর্কের আত্মীয়, যার নাম কলিমুল্লাহ, তিনি তাকে বলেছেন, এ আর কত দূর? যখন চাইবেন গাড়িতে করে নিয়ে যাব গ্রামে। ছেলেদের সঙ্গে দেখা করে চলে আসবেন। বেশ বেড়ানোও হবে। নদীর বাতাস খেয়ে ফুসফুস পরিষ্কার করে আসবেন।

তবু ইতস্তত করেছেন মেহেরুন্নেছা বেওয়া। কলিমুল্লাহকে বলেছেন, সারাজীবন গ্রামে কাটাইছি। এহন এই বয়সে শহরে গিয়া থাকতে পারুম? তা ছাড়া এদের ছাইড়া যামু, এইডা ভাবতে কেমুন লাগতিছে।

খুব পারবেন। তা ছাড়া আমি আছি না? প্রায়ই গিয়ে দেখা করব। ফোনে কথা বলবেন আমার সঙ্গে। আর এখানে যখন গ্রামে আসতে চাইবেন নিয়ে আসা হবে।

ফোন? আমি ওইডা শিখি নাই। দেখছি গ্রামের অনেকে ব্যবহার করে। আমি করি নাই। দরকার পড়ে নাই। মেহেরুন্নেছা বলেছেন কলিমুল্লাহকে।

কলিমুল্লাহ বলেছেন, আপনাকে শিখতে হবে না। আমার নাম্বার ভিতরে লেখা থাকবে। হোমের কাউকে বললেই লাগিয়ে দেবে আমার সঙ্গে। আপনি কথা বলে রেখে দেবেন।

মেহেরুন্নেছা বলেছেন, থাকা খাওনের লাগি টাকা লাগবো না?

কলিমুল্লাহ বলেছে, প্রকল্প থেকে টাকা দেয়া হবে। আপনার পাওনা টাকা ব্যাংকে রেখে দেবো। এমন ব্যবস্থা করবো যে প্রতি মাসের খরচ আপনা আপনি চলে আসবে ওল্ড হোমের ঠিকানায়।

শুনে নিশ্চিন্ত হয়েছেন মেহেরুন্নেছা বেওয়া। ছেলেবেলা থেকেই কলিমুল্লাহ তার খুব ন্যাওটা ছিল। প্রায়ই এসে থাকতো তার সঙ্গে। বলতো, আপনে একা থাকেন, গল্প কওয়ার কেউ নাই। তাই আইলাম।

কলিমুল্লা ছোট থাকতে গ্রামের মানুষের ভাষা ব্যবহার করতেন। শহরে আসার পর থেকে শহুরে ভাষায় কথা বলেন। তা বলুক, মেহেরুন্নেছার বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে কলিমুল্লাহ আগের মতো বেশি সময় কাটাতে পারেন না গ্রামে এসে। তার অধিকাংশ কাজ এখন শহরে, সেখানকার মানুষের সঙ্গে বেশি ওঠা-বসা। একটা রাজনৈতিক দলে যোগ দেয়ার পর তার ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছে।

দুই

কাসেম মোল্লা রাজাকার দলের নেতা হয়েছে। গ্রামে এখন তার খুব দাপট। মাঝে মাঝেই তার দলের ছেলেদের নিয়ে সে থানায় ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা করতে যায়। একদিন সকালে সেখানে গিয়ে খুব বকা খেল সে ক্যাপ্টেনের কাছে। ক্যাপ্টেন তার বাপ-মা তুলে গাল দিলো। উল্লুকা বাচ্চা বললো কয়েকবার। রাগের মাথায় একবার চামড়ার খাপ থেকে পিস্তলও বের করেছিল। বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল কাসেম মোল্লা, কেননা সে জানে ক্যাপ্টেন কেমন ঠান্ডা মাথায় গুলি করে। মাথা গরম হলে যে কী করবে তা ভেবে শিউরে ওঠে সে।

থানা থেকে কোনো রকমে জান বাঁচিয়ে ফিরে আসার পর সে দলবল নিয়ে সে সোজা চলে গিয়েছিল মেহেরুন্নেছা আর তার স্বামী জাফর আলির বাড়ি। নদীর কাছে অনেকটা জমি নিয়ে চৌচালা ঘর তুলেছে তারা। অবস্থাপন্ন কৃষক জাফর আলি। তাদের একটাই দুঃখ কোনো ছেলে-মেয়ে হয়নি বিয়ের পর। পুরুষের জন্য এ আবার সমস্যা নাকি? জাফর আলিকে বলেছে পাড়া প্রতিবেশী। একটা শাদি করেছো, আরো তিনটা করতে পারো।

শুনে জিভ কেটেছে সে দাঁত দিয়ে। শরিয়ত অনুযায়ী সে আরও তিনটা বিয়ে করতে পারে কিন্তু তার আগেই মেহেরুন্নেছা তার কল্লা কেটে নদীতে ফেলে দেবে। মেহেরুন্নেছার মেজাজ কেমন গরম তা সে যেমন জানে অন্যেরা জানে না বলেই এমন শলা-পরামর্শ দেয়, ভাবে সে।

কাসেম মোল্লা যখন রাজাকারের দল নিয়ে তাদের বাড়ি পৌঁছাল জাফর আলি সেই সময় মেহেরুন্নেছার বাজারের ফর্দ মন দিয়ে শুনছে। মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের খাবার কিনতে বাজারে যেতে হবে তাকে। কাসেম মোল্লাকে দেখে স্বামী-স্ত্রী দুজন সাবধান হয়ে গেল। ক্ষেত-খামারের কথা বলতে শুরু করল দুজন। কাসেম মোল্লাকে দেখে মাথায় ঘোমটা তুলে মেহেরুন্নেসা বললেন, আসেন, আসেন। কী ভাগ্যি আমাদের। আপনার লাহান মাইনষের পায়ের ধুলা পড়িছে বাড়িতে।

কাসেম মোল্লা রাগের মেজাজে বসে না। দাঁড়িয়ে থেকেই জানিয়ে দেয় ক্যাপ্টেন বলেছে তাদের বাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। খুব নির্ভর‍যোগ্য সূত্রে খবর পেয়েছে তারা। তাদের এ বাড়ি তল্লাশি করতে বলেছে ক্যাপ্টেন। তার রাজাকার বাহিনী বাড়ির সব তন্ন তন্ন করে দেখবে এখন।

তল্লাশির পর একজোড়া কাদামাখা কেম্বিসের জুতা আর একটা ময়লা জাঙ্গিয়া খুঁজে পায় তারা। কাসেম মোল্লা দেখে বলে, এই জুতা পরো নাকি জাফর মিয়া? কোনোদিন দেহি নাই।

জাফর আলি বলে, এইডা পরি জমির চাষ দেখতে যাই। আমার পায়ে ঘা হইছে তো। দ্যাহেন না কেমুন কাদা মাখা জুতা দুইটা।

কাসেম মোল্লা বলে, জুতা দুইটা পইরা হাঁটো দেহি।

জাফর আলি দুরুদুরু বুকে জুতা পরে হাঁটে। জুতা দুটোর ভিতর তার পা মাপ মতো ঢুকে যায়। সে বেশ লাজুক হয়ে হাঁটে কাসেম মোল্লার সামনে।

কাসেম মোল্লা জাঙ্গিয়া দেখিয়ে বলে, এইডা?

মুখ লজ্জায় লাল করে জাফর আলি বলে, এইডাও পিনতে হইবো নাকি মিয়াভাই?

কাসেম মেহেরুন্নেছার দিকে তাকিয়ে নিয়ে জাফরকে বলে, আগে বলো দেহি এইডা পিন্দো ক্যান? গ্রামের মানুষ এই সব পিন্দে না।

জাফর আলি মুখ নিচু করে বলে, ডাক্তারে কয়িছে পিন্দিতে।

ক্যান, ডাক্তারে পিন্দিতে কবে ক্যান?

জাফির আলি ইতস্তত করে বলে, আমার কোড়ল হইছে। হের লাগি।

শুনে রাজাকার ছেলেরা ‘বিচি’, ‘বিচি’ করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে।

কাসেম মোল্লা গম্ভীর হয়ে জাফর আলি আর মেহেরুন্নেছাকে বলে, সাবধান হইয়া যাও। এহন থে তোমাদের উপর নজরদারি রাখা হইবো। ধরা পড়লি উপায় নাই। তোমরা দুইজন সুদ্ধা শেষ। মনে থাকে য্যান।

কাসেম মোল্লা দলবল নিয়ে চলে যাবার পর জাফর আলি স্ত্রীকে বলে, এহন কী করবা? হ্যারা মনে হয় জাইনা ফ্যালাইছে।

মেহেরুন্নেছা গম্ভীর হয়ে বলেন, জানুক। আমরা যা করতিছি তাই কইরা যামু। তবে সাবধানে করতে হইবো। তাদের কোনো নিশানা রাখা যাইবো না। যেমুন দশটা থালা না রাইখা কলাপাতায় খাইতে দিমু।

তিন

রাস্তায় গাড়ি রেখে শহরের মানুষ ক’জন মেহেরুন্নেছার বাড়িতে আসে। মেহেরুন্নেছা তখন উঠানে মুরগিদের খাওয়ানো দেখছিলেন। বাদী জয়গুন মাথায় ঘোমটা দিয়ে এসে বললো, হেই সাহেবরা আবার আইছে।

মেহেরুন্নেছা অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে এসে বলেন, আবার আইছেন আপনারা? কইলাম না আমি বাঁচি থাকতি এই জমিতে দালান-কোঠা কিছু হইতে দিমু না। আমার পোলারা শান্তিতে থাহুক।

রিয়েল এস্টেটের পরিচালক খুব অমায়িক হয়ে বলেন, এবারে আরো ভালো অফার নিয়ে এসেছি। এতে আপনার ছেলেদের কোনো ক্ষতি হবে না। তারা শান্তিতেই থাকবে। একবার শুধু আমাদের নতুন প্ল্যানটা দেখুন। আমাদের আর্কিটেক্ট আমেরিকা থেকে পাস করে এসেছে। এই সব প্রকল্প সম্বন্ধে খুব ভালো অভিজ্ঞতা আছে তার। সে সব খুলে বলবে আপনাকে। তার আগে আমাদের কোম্পানির পক্ষ থেকে এই সামান্য উপহার গ্রহণ করুন।

পরিচালকের গাড়ির ড্রাইভার কয়েক প্যাকেট মিষ্টি আর দুটো শাড়ির প্যাকেট বাইরের ঘরের বারান্দায় রেখে সালাম দিয়ে সরে দাঁড়ায়।

মেহেরুন্নেছা প্যাকেটগুলো দেখে বলেন, এই সব ক্যান আনেন? যান, নিয়া যান। আমি জমি দিমু না। বাঁইচা থাকতে না।

পরিচালক বিনয়ের সঙ্গে বলেন, আপনি খুব ভুল করছেন। আপনি একা মানুষ। চলে যাওয়ার পর এই জমি বারো ভূতে খাবে। তার চেয়ে বেঁচে থাকতেই একটা সুন্দর ব্যবস্থা করলে ভালো হয় না? রিসোর্ট থাকবে, পাশে তারা দশজনও থাকবে। একবার মডেলটা দেখেন আপনি। সম্মতি এখন না হয় না-ই দিলেন। সেটা না হয় ভেবে-চিন্তে পরে দেবেন।

তার কথার মধ্যেই আর্কিটেক্ট বারান্দায় বাক্স থেকে খুলে রিসোর্টের মডেল রেখে দেন। সেখানে রোদ পড়েছে, খুব ঝকঝকে দেখাচ্ছে। বাচ্চাদের খেলনার মতো মনে হচ্ছে। মেহেরুন্নেছা বেশ কিছুক্ষণ দেখে বললেন, খুব সুন্দর।

পরিচালক হাসি মুখে বললেন, পছন্দ হয়েছে আপনার? জানতাম দেখার পর পছন্দ না করে পারবেন না। দেখতে হবে তো কে করেছে? আমেরিকা ফেরত আর্কিটেক্ট।

মেহেরুন্নেছা বলেন, যত সুন্দরই হোক। আমি জমি দিমু না।

তা হলে এই মূল্যবান জমির কী হবে? পরিচালক প্রায় মাথার চুল ছেঁড়েন।

আমি ওয়াকফ কইরা দিমু ঠিক করিছি। সময় নষ্ট না কইরা আপনারা মডেল নিয়া যান গিয়া।

চার

মেহেরুন্নেছা ওল্ড হোমে আসার পর থেকে সেখানকার পুরনো বাসিন্দাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যান নাই, তার স্বামী জাফর আলিও যায় নাই; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের যে সব গল্প তিনি বলেন, সব সত্যি ঘটনা। কী করে জানেন তিনি এই সব যুদ্ধের কথা? যে সব মুক্তিযোদ্ধা ছেলে অপারেশন শেষে নদীতীরে তাদের বাড়িতে ফিরে আসত তারাই কলাপাতায় ভাত খেতে খেতে বলত তাকে আর জাফর আলিকে। তারা দুজন অবাক হয়ে শুনতেন এই সব বাচ্চা ছেলের অসীম সাহসের কাহিনি। শুনতে গিয়ে তাদের রোমকূপ দাঁড়িয়ে যেত।

আবার এমনও হয়েছে যে সব মুক্তিযোদ্ধা অপারেশনে গিয়েছে তাদের কেউ কেউ ফিরে আসেনি। তাদের কথা শুনে মেহেরুন্নেছা কেঁদেছেন। আহা! বাছারা ব্যস্ততায় ভালোভাবে খেয়েও যেতে পারেনি। তাদের মুখ ভেসে উঠেছে মেহেরুন্নেছার চোখের সামনে। তিনি কান্নাভেজা চোখে তাদের মুখ ঝাপসা দেখেছেন। জাফর আলি কাঁদেনি, কিন্তু তার চোখ ভিজে গিয়েছে।

সেই সব মুক্তিযোদ্ধার গল্প বলার জন্যই যেন মেহেরুন্নেছা এখনো বেঁচে রয়েছেন। ওল্ড হোমের বাসিন্দাদের তিনি তার চেনা মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প বলতেই থাকেন। তার বলা শেষ হয় না। কেউ শুনুক বা শুনুক তাতে তার যেন কিছু আসে যায় না। তিনি যত দিন বেঁচে আছেন তাকে তাদের গল্প বলে যেতেই হবে। বারবার বলবেন তিনি। এ ছাড়া তার জীবনে বলবার মতো বড় কিছু নেই।

পাঁচ

এক সময় গরু-ছাগল চরার মাঠ ছিল এটা। মেহেরুন্নেছা খোলা মাঠটাকে বাগান করেছেন। শুধুই গোলাপ। লাল, সাদা এমনকি কালো গোলাপ। শেষেরটা তাকে শহর থেকে এনে দিয়েছে কলিমুল্লাহ। গোলাপের সৌন্দর্য আছে; কিন্তু শুধু সে জন্য নয়, তিনি গোলাপ দিয়েই বাগান করেছেন এই জন্য যে এই ফুল সারা বছরই হয়। তবে এর জন্য বেশ যত্ন করতে হয়। এক এক মৌসুমে তার যত্নের রকমফের হয়। বছরের পর বছর বাগান করতে গিয়ে মেহেরুন্নেছা বেওয়ার সব জানা হয়ে গিয়েছে। শহর থেকে ক্যামেরা নিয়ে লোক আসে তার এই বাগানের ছবি তুলতে। বিজয় দিবসে আসে অনেকে, হাতে ফুল নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এই বাড়ি আর বাগান বড় প্রিয় আর শ্রদ্ধার স্থান। এখান থেকে সেই সময় শুরু হয়েছে এই এলাকায় দুশমন খান সেনাদের খতম করার জন্য অনেক অপারেশন। এখানে শুয়ে আছে তাদের দশজন। গোলাপ বাগান তাদের জন্যই তৈরি করেছেন মেহেরুন্নেছা। গোলাপ গাছের যত্ন করা মানে তাদেরকে যত্ন করা বলে মনে করেন তিনি। খুব মমতা দিয়ে গড়ে তুলেছেন এই বাগান নিজ হাত দিয়ে, অন্য কাউকে হাত দিতে দেননি।

মাঠে চোরকাঁটা হয়েছে অনেক, আগেও হতো। এগুলো তুলে ফেলার জন্য অবশ্য কাজের মানুষ লাগানো হয়। চোরকাঁটা তার শাড়িতে আটকে থাকে ছাড়াও দেখতে খারাপ, বাগানের সৌন্দর্য বেশ নষ্ট করে দেয়। আজ কাজের মানুষ দুজন চোরকাঁটা তুলছে। মেহেরুন্নেছা এক পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মাঠ পরিষ্কার করা দেখছেন। সকালবেলা, চৈত্রের রোদ এখনো নরম, গা পোড়ায় না। ঘাম ঝরায় না। তা ছাড়া নদীটা দক্ষিণে, বাতাস এলে শরীর জুড়িয়ে যায়।

মেহেরুন্নেছা বাগান পরিষ্কার করার কাজ দেখছেন এই সময় কাজের বুয়া জইগুন এসে বললো, কলিমুল্লাহ চাচা আইছেন।

বাড়ির বারান্দায় কলিমুল্লাহ একটা মোড়ায় বসে ছিল। মেহেরুন্নেছাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। তার হাতে ফলের প্যাকেট। দেখে একটু অবাক হলেন মেহেরুন্নেছা। সাধারণত কলিমুল্লাহ খালি হাতে আসে। কুশল জিজ্ঞাসার পর কলিমুল্লাহ বললো, একটা জরুরি আলাপ করতে এলাম খালা।

কী বিষয়ে আলাপ? মেহেরুন্নেছা শোনার জন্য উৎসুক হলেন।

খলিলুল্লাহ বলল, এই বাড়ি আর সাথের জমি নিয়ে।

মেহেরুন্নেছা বললেন, গোলাপ বাগান নিয়ে?

জি, ওটাও আলাপের বিষয়।

বেশ বলো শুনি। মেহেরুন্নেছা তাকিয়ে থাকেন।

কলিমুল্লাহ বলেন, ঢাকায় এক অফিসে একটা প্রকল্প দেখলাম। সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প। এই বাড়ি আর জমির ওপর দিয়ে সড়ক বড় করা হবে।

শুনে বেশ অবাক হলেন মেহেরুন্নেছা। বললেন, কিন্তু এখানে কবর আছে। একটা না, দশ দশটা। কবরস্থান কইতে পারো। কবর ভাইঙ্গা রাস্তা করা হবে?

না। তা করবে না। তবে এই মাঠ আর বাগান থাকবে না বলে শুনেছি। রাস্তার মাঝখানে রেখে সামনে এগোবে। এই বাড়ি পড়বে রাস্তায়, এটাও থাকবে না। মেহেরুন্নেছা হতভম্ব হয়ে বলেন, তুমি কি শুধু এই দুঃসংবাদ দিতে আইছো?

কলিমুল্লাহ বললো, একটা উপায় আছে। হেইডা কইতে আইছি। (কলিমুল্লাহ এখন গ্রামের ভাষায় কথা বলছে)।

কও শুনি। মেহেরুন্নেছা মনোযোগ দিয়ে শোনার অপেক্ষা, করেন।

কলিমুল্লাহ বলে, এহানে এখনই একটা প্রকল্প করা যায়। হেইডা হইলে সড়কের লাগি জমি নিতে পারব না।

কী প্রকল্প?

মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর। আপনের এই বাড়ি থাইকা অনেক অপারেশন হইছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। তার স্মরণে হইবো এই জাদুঘর। কবরস্থান থাকবো পাশে, এখন যেমুন আছে। তবে বাড়িটা জাদুঘরের মধ্যে পড়বো। হেইখানেই তো হইবো জাদুঘরের মূল দালান।

মেহেরুন্নেছা চিন্তা করেন। তারপর বলেন, আমি যামু কই?

ঢাকায়। প্রকল্পের খরচে ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করা হইবো। আপনার জমি তো এমনি নিতে পারে না। ক্ষতিপূরণ হিসাবে যত দিন বাঁইচা থাকবেন প্রকল্প থাইকা ভরণ-পোষণের খরচ দেয়া হইবো আপনারে। তারপর কলিমুল্লাহ উৎসাহের সঙ্গে বলে, মাঝে মাঝে ঢাকা থাইকা আপনেরে লইয়া আইবো এইহানে। যহন আপনার মন চায়।

তুমি এই খবর ঠিক হুনছো?

ঠিক না হুইনা কি দৌড়াইয়া আইছি। আমি দল করি। ভিতরের খবর পাইতে আমার সময় নেয় না। বুঝলেন খালা এইডাই আপনার জমি, বাড়ি আর গোলাপ বাগান বাঁচানের এক মাত্র উপায়।

মেহেরুন্নেছা কিছুক্ষণ চিন্তা করেন। তারপর বলেন, দেখি চিন্তা কইরা। লগে লগে রাজি হওন যায় না। কঠিন কাজ।

চিন্তা করেন; কিন্তু বেশি সময় নিয়েন না। সময় কম। চিঠি আইয়া পড়লে আর করনের কিছু থাকবো না।

মেহেরুন্নেছা গোলাপ বাগানের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কের মতো বলেন, হুঁ।

ছয়

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। হারিকেনের আলোয় তারা মেঝেতে মাদুরের ওপর লাইন দিয়ে বসে দশ জন ভাত খাচ্ছে। তাদের খুব চঞ্চল দেখাচ্ছে। অপারেশনে যাওয়ার আগে তাদের এমন দেখায়। মেহেরুন্নেছা তাদের এই ভাব আগেও দেখেছেন।

বলে লাভ নেই, তাও তিনি বলেন, এত তাড়াহুড়া কিসের? এট্টু মন দিয়া খাও। কত মেন্নত কইরা যাইবা। কত কষ্ট কইরা যুদ্ধ করবা। ভালো কইরা খাও।

দশজনের একজন বলে, চাচা গেল কই?

মেহেরুন্নেছা বলেন, চানখাঁর হাটে গেছে।

শুনে দশজন খাওয়া বন্ধ করে। একজন ত্রস্তে বলে, সর্বনাশ! আইজ চানখাঁর হাটে মিলিটারি অপারেশন হইছে।

দশজনকে খুব চিন্তিত দেখায়। দেখে মেহেরুন্নেছা শান্ত করার জন্য বলেন, কিছু হইবো না তার। আইয়া পড়বো। তোমরা মন দিয়া খাও দেহি।

এই সময় বাইরে অনেকের পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। দশজন ত্বরিতে উঠে রাইফেল ধরতে যায়। তার সময় পায় না তারা। প্রচণ্ড শব্দ করে বুলেট আসতে থাকে ভিতরে। দশজন রক্তাক্ত দেহে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে এক সঙ্গে। তাদের নিচে চাপা পড়ে মেহেরুন্নেছা। তিনি তাদের রক্ষা করতে উঠে গিয়েছিলেন।

ক্যাপ্টেন ঘরে ঢুকে দশজনের লাশ দেখে অট্টহাসি দিয়ে বলে, খানা খাও। জি ভড়কে খানা খাও। তারপর দশজনের নিচে পড়ে থাকা মেহেরুন্নেছাকে দেখিয়ে বলে, ইয়ে হ্যায় উয়ো বুডধি?

পিছন থেকে কাসেম মোল্লা বলে, জি স্যার।

ক্যাপ্টেন হেসে বলে, উসকা আখেরি মেহমানদারি হো গেয়ি।

বলে সে পিছন ফিরে কাসেম মোল্লার পিঠ চাপড়ে বলে, ভেরি গুড। গুড ওয়ার্ক।

সাত

কলিমুল্লাহ অনেক দিন হলো ওল্ড হোমে আসে না। মেহেরুন্নেছা ফোন করলে বলে, আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?

মেহেরুন্নেছা বলেন, অসুবিধা হইতাছে না; কিন্তু তুমি আও না ক্যান? অনেক দিন হইলো আইয়ো নাই।

কলিমুল্লাহ বলে, খুব ব্যস্ত আছি। সেই জন্য আসতে পারি না।

মেহেরুন্নেছা বলেন, আমাদের মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের কী হইলো? আমারে নিয়া যাও না ক্যান?

কলিমুল্লাহ তাড়াতাড়ি বলে, প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। নিয়ে যাবো একদিন। আমার ব্যস্ততা কমুক। আচ্ছা রাখি এখন।

ফোনে এই আলাপ হওয়ার পর প্রায় ছয় মাস চলে গিয়েছে। কলিমুল্লাহ মেহেরুন্নেছাকে দেখতে আসে নাই। তাকে মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘর দেখাতে গ্রামে নিয়ে যায় নাই। কয়েকবার ফোন করে ব্যস্ত পাওয়া গিয়েছে তার ফোন। ফলে ফোনেও কথা হয়নি। তার কি কোনো অসুখ হইছে, ভাবেন মেহেরুন্নেছা। কিংবা, অন্য কোনো কারণে আসছে না সে? চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে তার।

ওল্ড হোমের পুরনো বাসিন্দাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ জাফর সাহেব মেহেরুন্নেছাকে বলেন, এত দিন শুধু দশজনকে নিয়ে আপনার গল্প শুনে এলাম। দশজন যেখানে আছে, সেই গোলাপ বাগান এখনো দেখা হলো না। সেখানে যে মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘর হয়েছে সেটা দেখাবেন বলেছেন; কিন্তু এখনো যাওয়া হলো না।

শুনে মেহেরুন্নেছা বেশ বিব্রত বোধ করেন। আমতা আমতা করে বলেন, কলিমুল্লার কথা ছিল আমারে লইয়া যাইব। মনে হয় হে অহন খুব ব্যস্ত। তাই আইতে পারতিছে না। আইয়া পড়ব।

তার আসার কী দরকার? আমরাই মাইক্রোবাস ভাড়া করে যেতে পারি। বড় রাস্তার পাশেই তো জায়গাটা। ড্রাইভারকে জায়গাটার নাম বললে, সোজা নিয়ে যাবে। আজকাল মোবাইলেই সব ঠিকানা দেখা যায়। চলেন আমরা এই শনিবার যাই সেখানে। অনেক দিন যাওয়া হয় না। নদীর পাড়ের তাজা হাওয়া ফুসফুসে নিয়ে দুপুরের লাঞ্চ করা যাবে। প্যাকেট লাঞ্চ।

শুনে উৎসাহীরা বলেন, খুব ভালো কথা। এত দিন মেহেরুন্নেছা আমাদের খালি তার গোলাপ বাগান আর দশজনের কথা বলে এসেছেন। এখন গিয়ে নিজ চোখে দেখে আসি।

শুনে মেহেরুন্নেছা দুর্বল স্বরে বলেন, এহন থাক। শরীরডা ভালা না। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //