আমির আল হুসাইন
[লেখক পরিচিতি : আমির আল হুসাইন একজন সিরিয়ান কুর্দি কবি। তিনি কুর্দি ও আরবি উভয় ভাষায় লেখেন। সিরিয়ায় তার মাতৃভাষা নিষিদ্ধকারী শাসনের অধীনে একজন কুর্দি হিসেবে বেড়ে ওঠার কারণে তিনি কোনো সহায়তা পাননি। তথাপি কোনো প্রতিষ্ঠান ছাড়াই নিজে নিজে কুর্দি ভাষায় লিখতে শিখেছিলেন। তিনি তরুণ কবিদের একটি দলের অংশ ছিলেন যারা সিরিয়ায় কুর্দি ও আরবি কবিতা পত্রিকা ইনফার্নো প্রকাশ করেছিলেন। যেটা পরে নিষিদ্ধ করা হয়। তিনি এখন ইরাকি কুর্দিস্তানে শরণার্থী হিসেবে ইরাকের ইরবিলে বসবাস করেন। তিনি সেখানে বিভিন্ন আরবি সংবাদপত্রের জন্য লেখেন ও অনুবাদ করেন। এখানে তার ‘আল ফিরাশাতু বাগজারা’ কবিতার অনুবাদ পেশ করা হলো। কবিতার ভেতরে মানবতাকে উচ্চকিত করতে রূপকের সাহায্যে অনেক কথা বলা হয়েছে। কবিতায় স্বৈরাচারীর চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে ]
প্রজাপতি ঝাঁকে ঝাঁকে
এটা সেই জায়গা যেখানে
একটি গাছ আছে
(ওপরে ওঠার মই নেই)
একজন মানুষ আছে। তাকে
খুব ঘনিষ্ঠ মনে হচ্ছে।
আমি তার সাহায্যের হাত দেখেছি।
তার পাপড়ি বন্ধ।
তাকে একের পর এক স্বীকার করার
অথবা অন্যদের জন্য কান্নার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
আমি বলি না ‘পাপড়ি অকার্যকর ডানা তৈরি করে’।
সে বলে না ‘আমি শুধু একটি ক্ষত হাচড়াচ্ছি।’
সে বলে না ‘আমি শুধু একটি ক্ষত বের করছি।’
এটা সেই জায়গা
(যেখানে বৃষ্টির রশি বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো হয়ে আছে)
প্রভুর মতো
সে অপেক্ষা করছে বা বিভ্রান্ত বলে মনে হচ্ছে না।
আমি বলি না ‘তোমার জুতার ফিতা দুর্বলভাবে বাধা।’
সে বলে না ‘আমার জুতা খুব টাইট।’
আমি মেয়েটিকে দেখি,
তার হাতের ভেতরটা নরম তুলতুলে
আর আমি,
আমি যেন গলা,
তার হলকুমে আমাকে ঝুলানো হয়েছিল।
সে কোনো দূরের নির্জন দ্বীপবাসী নয়,
তাই আমি অনুমান করতে পারি সে দিন গুনছে।
আমি বলি না ‘তারকারা আমাদের তালাকপ্রাপ্ত মা
আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ভয় পাই।’
সে বলে না ‘প্রতিটা তারকা পক্ষাঘাতগ্রস্ত।’
মানুষটি
সেখানে
হিংসার চোখে
তার লম্বা চুল দিয়ে
ছায়াময় করে আছে।
কিন্তু গোলাপ ভুলে যায় না
সেখানে তার ঘ্রাণ দিতে
যেখানে একটা ছোট্ট গাছ আছে
(যা কোনো পাখির কথা বলে না)
আর একজন মানুষ আছে যে বিশ্বের
একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখ
বাদশাহ
আমি ঘরের বাদশাহ
আমার মুকুট সকালের ধুলো
আর পৃথিবী আমার প্রাসাদ
আমি ঘরের বাদশাহ,
পুরস্কারদাতা, বই আমার সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারে না
কোট স্ট্যান্ডের মতো খাড়া,
স্থায়ী, দেয়ালে স্যাঁতসেঁতে
আমার দিনগুলো জানালা
আর আমার চেয়ার একটি পঙ্গু ঘোড়া
আমি বাদশাহদের বাদশাহ!
টেবিল ছাড়া কিছুই নেই
আর নোটবুক যেজ্জএটি মিথ্যায় ঠাসা
আঙুলের স্নিগ্ধতা ছাড়া আর কিছুই নেই
আমি যেটুকুর মালিক তা ছাড়া আর কিছুই নেই
আমি দরজার বাদশাহ আর ক্ষতবিক্ষত কাপড়,
দেয়ালের সাথে টাঙানো ছবি
উড়তে উড়তে শব্দের বাদশাহ
ঠান্ডার বাদশাহ
আর আহত একাকী
কাশির বাদশাহ
আর পচা দাঁত
ধার করা সময়ের বাদশাহ
যারা মাঝে মাঝে নড়বড়ে হয়ে যায়
আমি একজন ফ্যাকাসে বাদশাহ
একজন ছোট বাদশাহ
একজন বাদশাহ নামদার।
আলেপ্পো ডায়েরি
এক
লেখার অপর নাম ব্যথা।
আর পর্দার নিচে যে রক্ত পড়ে তা
আবহাওয়া দূষিত করে শুকনো কফির
মতো দেখতে পালঙ্কে দাগ দেওয়া, যা
আমরা কাঁপা আঙুল দিয়ে স্পর্শ করি
যাতে আমরা সংক্রমিত না হই।
আমরা ভাঙা পিঠ দিয়ে এমনভাবে
পরিচালনা করি যেন গাঢ় লাল দেখে
নরকে যাচ্ছিজ্জনা, বাদামিওজ্জযা আত্মায়
মরিচার মতো অবশিষ্টাংশ জমা করে।
আমাদের মাথার পুরনো স্ট্রোকের ধকলে
একপাশে শুই, চোখ থেকে ঝরে অশ্রুমালা
যারা রাস্তা থেকে পর্দায় উঁকি দেয় তারা
ট্রেসকাগজের উপর সবুজ চিহ্ন রেখে যায়
যা তুলসীর ঝোপে দৃশ্যমান, তারা আমাদের
দিকে একটি ফুল ছোড়ে আর আমাদের
লজ্জা বাঁচাতে তাড়াহুড়ো করে মরে যায়।
এখন তুমি পবিত্র উপত্যকায় প্রবেশ করেছ,
তোমার জুতা খুলে ফেল আর ভাঙা কাচের
ওপর দিয়ে হাঁট।
দুই
পড়তে পড়তে কমরেডরা ঘুমিয়ে পড়েছে।
বইয়ের স্তূপের মধ্যে দিয়ে তুমি একা ঘুরে বেড়াও
প্রত্যাবর্তনের কোনো চিহ্ন ছাড়াই।
ডানদিকে তৃতীয় তাক থেকে একটি হাহাকার আসেজ্জ
একটি উপন্যাস থেকে বাতিল একটি পুরো অধ্যায়।
করুণ শিরোনামে হাসি
দর্শনের একটি বইয়ের জন্য।
রাজনীতি কফের মতো বয়ে যায় এক তাক থেকে
অন্য তাকে। মহাকাব্যের জন্য কোনো সময় নেই
আনন্দ ও অন্তরঙ্গতা বইয়ের জন্য
মাচাদো বইয়ের কভার খুলতে সহজ হয়
আলতোভাবে, যাতে অলঙ্কার নষ্ট না হয়।
আমরা বইয়ের মতন-
অনুচ্ছেদ পূর্ণ করতে পরিমার্জন প্রয়োজন।
তিন
আমি বারান্দায় বসে আছি। আলেপ্পো আমার
সামনে কালো ও নির্জন হয়ে ছড়িয়ে আছে।
অন্ধকারে ক্রোকারিজের কোলাহল মানেই
জীবন চলমান। কোথাও থেকে বিক্ষিপ্ত
গোলাগুলি ছাড়া কোনো শব্দ নেই, একটি অদ্ভুত
বাঁশির আগে তারপর আবার একটি শেল।
শুকনো গলা নিয়ে কেউ এই গ্রহ ছেড়ে চলে
যাচ্ছে। আলেপ্পো আমার আগে কালো আর
এখনও। এই বিশাল ছায়াগুলি হতে পারে
গাছ বা শৈশবের ভূত বা কালো ধোঁয়া
হতে পারেজ্জযারা একটি সংবাদ প্রতিবেদনে
ইতোমধ্যেই সংখ্যায় থাকা শিশুদের জন্য
অপেক্ষারত মহিলারা নিশ্বাস ত্যাগ করে।
আলেপ্পো। কোনো ওড বাজছে না। লাল
নীল ঝুলনো আবছা আলো নেই।
নাইটিংগেল বারে কোনো পানীয় নেই।
মদ্যপানকারী নেই। গান নেই।
একটার পর একটা
অন্ধকারের জানোয়ার
তারা জাগ্রত হয়।
চার
মেরিনা শিহওয়ারো
আমি মেরিনা কনস্টানটাইন
পুরোহিত জর্জ শিহওয়ারোর বিধবা
মার্সেলের সঙ্গী যখন আমরা হাঁটছি,
গভীর রাতে, আমাদের বাড়িতে;
আমি সে, পবিত্র গির্জার গোপনীয়তায় সমৃদ্ধ,
এক গ্লাস লিকারের নিচে চেরিসহ,
পঞ্চাশ বছর বয়সে হাসিতে ব্যস্ত,
চুলের বিনুনি ড্রয়ারের পুরনো বুকে ভুলে গেছে।
...
আমি মেরিনাজ্জ
কার্লটন থেকে ফিরে,
যেখানে জীবন সঙ্গীতকে আঁকড়ে ধরে
আর লোবানের মতো ঘন হয়
অবাধে আমি লবণ ছড়িয়ে দিই
যদিও আমি জানি যে মাংস নষ্ট হবে না
আমি আমার হৃদয়কে আনন্দ দিতে
ওয়াইনে আঙুল ডুবিয়ে রাখি।
...
আমি মেরিনাজ্জ
যে ভুল মোড়ে আছে,
জাদুকরের টুপিতে দুর্গটি অদৃশ্য হওয়ার আগে
হাতের মুঠো থেকে ঘামের গন্ধ টের পাচ্ছি
ভয়ের গন্ধ হয়ে সিসার মতো বাতাস ভেদ করছে।
..
আমি মেরিনাজ্জ
যে জানত না সে মারা গেছে,
যতক্ষণ না, সাদা পরিহিত হাজার হাজার
গোলাপের পাশাপাশি, তিনি শুনেছেনজ্জ
হযরত ইলিয়াসের প্রার্থনালয়ের প্রধানের কথা :
হে প্রিয়জন, আসুন বিনীতচিত্তে
আমরা সবাই প্রভুর হাতে জপ করি
আমাদের মেয়ের আত্মার শান্তির জন্য
যিনি স্বর্গে আছেন তার কাছে পুষ্পস্তবক বহন করছি...
...
আমীন।
ফুয়াদ মোহাম্মদ ফুয়াদ
[লেখক পরিচিতি : ফুয়াদ মোহাম্মদ ফুয়াদ একজন সিরিয়ান চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য গবেষক ও কবি। তিনি ১৯৬১ সালে আলেপ্পোতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালে ফুয়াদ আলেপ্পো ইউনিভার্সিটি কনফারেন্স আয়োজনে অংশ নেওয়া তরুণ সিরীয় লেখকদের একটি গ্রুপের সদস্য ছিলেন। আর এমন একটি দল যারা সিরিয়া ও আরব অঞ্চলে আধুনিক কবিতায় অভিনব অবদান রেখেছিল।
তিনি বেশ কয়েকটি কবিতার সংকলন প্রকাশ করেছেন : তাগুত আল-কালাম (দ্য আইডল অব স্পিচ, ১৯৯০), মাতরুক জানিবান (বাম পাশে, ১৯৯৮), কাল বায়দাবা (বায়দাবা সাইদ, ২০০৪) এবং আজজা। তার কবিতায় চিকিৎসা বিষয়ক অনেক পরিভাষা বিদ্যমান। তার পেশাগত অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে কবিতার পরতে পরতে ]
বারান্দা
বারান্দা (একটি বারান্দা যা আলেপ্পোতে একটি
হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের দিকে নিয়ে যায়)
বারান্দায় নেকড়েজ্জ
বিপথগামী আত্মার মতো
পুনরুদ্ধারের ঘরে
যেখানে অ্যান্টিসেপটিক কাজ করে না
আর পথচারীরা
শুধু মাথা নত করে পাশ কাটিয়ে যাও
বিশ্রামাগারে ব্যান্ডেজ রোল খুলে ফেলা যাক
রক্তের ফোঁটা অনুসরণ কর
তারা নির্দয়তায় অসুস্থ
বিছানায় র্যানসিড ফ্যাট
বারান্দায় নেকড়েজ্জ
দেয়ালে তার ছায়া
ছোট মেয়ে ও দাদিকে আহত করে
একটি ময়লা জামায় তোমার মাথা রেখে বিশ্রাম করবে না
জিজ্ঞাসা কর না কেন মহিলাটি দরজার পিছনে কাঁদছে
বারান্দায় নেকড়েজ্জ
গান বন্ধ কর
...
...
সে মারা যাচ্ছে
ভূমিকা ও অনুবাদ : মহিউদ্দীন মোহাম্মদ
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh