নির্বাচনি আচরণবিধি মানছেন না প্রার্থীরা

সিটি নির্বাচন যতোই ঘনিয়ে আসছে, প্রার্থীদের প্রচারণাও বাড়ছে জোরেশোরে। নির্বাচনি প্রচারণার বিধিমালাও মানছেন না অনেক প্রার্থী। প্রচারণায় মোট শোভাযাত্রা ও যানবাহনের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা তা মানছেন না। ফলে প্রতিদিনই যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

গত কয়েক দিনের সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রচারণার কারণে পথচারীরাও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। আবার অনেক পথচারী জানান, তারা ভোট দিতে পারবেন কি-না, তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। গত নির্বাচনেও তাদের অনেকেই ভোট দিতে পারেননি। তাই তারা প্রশ্ন করেছেন, ‘জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলা এই প্রচারণার মানে কি?’ শুধু পথচারীই নয়, নির্বাচনি প্রচারণার ধরণ দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এসএসসি পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সবার প্রশ্ন, নির্বাচনি প্রচারণার কোনো বিধিমালায় জনদুর্ভোগের কথা সত্যিই আছে কিনা? যদি থেকে থাকে, তাহলে নির্বাচন কমিশন কেনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না?

সকাল ১১টা, ১৯ জানুয়ারি। মতিঝিল থেকে টিকাটুলি পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট। প্রায় প্রতিদিনই যানজট থাকে কমবেশি। কিন্তু ওই দিনের যানজটের কারণ- সরকারি দলের মেয়র প্রার্থী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস নির্বাচনি প্রচারণায় নেমেছিলেন। তাই সব গাড়ি আটকে রেখেছে ট্রাফিক পুলিশ। মেয়র প্রার্থীর এতো বড় শোডাউনে আর গান বাজনার শব্দে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন মিরপুরগামী ট্রান্স সিলভা বাসের কয়েকজন যাত্রী। 

এসএসসি পরীক্ষার্থী লাবণী পুরান ঢাকার লালবাগের বাসিন্দা। গত কয়েকদিন ধরে ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারছে না। সে জানায়, ‘দিনের বেলায় তো মাইকে প্রচারণা চলেই। রাত ১০টার পরও সাউন্ড বক্স ও মাইকে নির্বাচনি প্রচারণা চালাচ্ছেন প্রার্থীরা। এতে করে পড়াশোনা করতে পারছি না। অথচ আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি পরীক্ষার। পরীক্ষার ফল খারাপ হলে কি বিষয়টা তারা দেখবেন? তারা তো নির্বাচিত হতে পারলেই শেষ।’

গত শনিবার রাত ১০টার দিকে সদরঘাটের ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে কানফাটা আওয়াজে চলছিলো নির্বাচনি প্রচারণার গান। এতে বিরক্ত পথচারীরা। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন শামসুদ্দিন আহমেদ। তার সঙ্গে চায়ের দোকানে এ প্রসঙ্গে কথা বললে তিনি ঘড়ি দেখে বলেন, ‘এখন বাজে রাত ১১টা। এখনো এতো জোরে মাইক বাজানোর কোনো মানেই হয় না। এগুলো দেখার কি কেউ আছে?’ 

শুধু লাবণী-শামসুদ্দিনই নয়, এমন আরো কয়েকজন পরীক্ষার্থী ও পথচারী জানান, প্রচারণার নির্ধারিত সময় আছে। রাত ৮টা পর প্রচারণা চালানো নিষেধ। কিন্তু কেউ তা মানছেন না। প্রতিদিন রাত ১০-১১টা পর্যন্ত প্রচারণা চলছে। 

নির্বাচন সংক্রান্ত বিধিমালার ২১ ধারার ১নং উপধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী বা তাহার পক্ষে কোনো রাজনৈতিক দল ও অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একটি ওয়ার্ডে নির্বাচনি প্রচারণার কাজে একের অধিক মাইক্রোফোন বা শব্দের মাত্রা বর্ধণকারী অন্যকোনো যন্ত্র ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ প্রচারণার সময়ের প্রসঙ্গে ২নং উপধারায় বলা হয়েছে, ‘মাইক্রোফোন বা শব্দের মাত্রা বর্ধণকারি অন্যবিধ যন্ত্রের ব্যবহার দুপুর ২টার পূর্বে এবং রাত ৮টার পরে ব্যবহার করা যাইবে না।’ 

কিন্তু নির্বাচনি এই বিধিমালা উপেক্ষা করে চলেছেন প্রার্থীরা। গত ১৮ জানুয়ারি (শনিবার) রাত ১০টা ১৫ মিনিটে গেন্ডারিয়া থানা সংলগ্ন এলাকায় একটি পিকআপ ভ্যানে বড় দুটি সাউন্ড বক্স নিয়ে প্রচারণা চলছিলো। এটি শুধু গেন্ডারিয়াই নয়। ঢাকা সিটির সব জায়গাতেই হচ্ছে। দিন থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত দলীয় থিম সং বাজছে।

এর পর দিন রাত ৮টা ৩০ মিনিটের দিকে শান্তিনগর এলাকায় ১৫টির অধিক মোটরসাইকেল নিয়ে প্রচারণায় দেখা গেছে এক কাউন্সিলর প্রার্থীর। তার কর্মিরা রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন। স্থানীয় এক দোকানদারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানালেন, ‘প্রচারণায় মোটরসাইকেল তো নিষেধ।’ শোডাউনের সময় এক কর্মি কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সে হেসে বললেন, ‘এটা নতুন আইন, আমরা বানিয়েছি। আমাদের প্রচারণায় মোটরসাইকেল থাকবেই।’

আচরণবিধির ৭-এর ‘খ’ ধারায় রয়েছে, ‘কোনো প্রার্থী পথসভা ও ঘরোয়া সভা করতে চাইলে প্রস্তাবিত সময়ের ২৪ ঘণ্টা আগে তাহার স্থান এবং সময় সম্পর্কে স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। যাতে ওই স্থানে চলাচল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে চলছে তার উল্টো। প্রতিদিনই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চার মেয়র প্রার্থী গণসংযোগকালে একাধিক পথসভা করছেন। রাস্তা বন্ধ করে এসব পথসভা করায় আশপাশের এলাকায় দেখা দিচ্ছে দীর্ঘ যানজটের। কিন্তু এসব দেখতে নির্বাচন কমিশনের কোনো কর্মকর্তাকে মাঠে দেখা যাচ্ছে না।

সরকারি দলের প্রার্থীদের নির্বাচনি আচরণ বিধি ভঙ্গের প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন দুই সিটি করপোরেশনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরা। উত্তরের তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘ইসির কাছে আমরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তারপরও কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আমাদের বিপক্ষের প্রর্থীরা প্রতিদিনই আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন। আমাদের কর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।’

দক্ষিণে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন বলেন, ‘আমরা আচরণবিধি মেনেই গণসংযোগ চালাচ্ছি। সব পর্যায়ের নেতা-কর্মিদের এমন নির্দেশনা দেওয়া আছে।’ উত্তরের আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলামও প্রায় একই সুরে কথা বলেন। তিনি জানান, ‘আচরণবিধি মেনেই আমরা প্রচারণা চালাচ্ছি।’ 

তবে দক্ষিণের সরকারি দলের মেয়র প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের দিকেই অভিযোগের তীর বেশি। গত কয়েকদিন ধরে গুলিস্তানের আশপাশের এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। শেখ ফজলে নূর তাপস জানান, ‘আমার নির্বাচনি প্রচারণায় জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এ কারণে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে আমি নেতা-কর্মি ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটিকে বলে দিয়েছি, তারা যেনো নির্বাচনি আচরণবিধি মেনে চলেন।’ তবে রাতের বেলায় মাইকের ব্যবহারসহ শোডাউনের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, তিনি কিছু বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।

২০ জানুয়ারি পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে দুই রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে ৬৩টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবদুল বাতেন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা ৪৩টি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পেয়েছি। ব্যবস্থা নিচ্ছি আমরা। বাকি দিনগুলোতে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আমাদের কর্মকর্তারা।’ 

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবুল কাশেম বলেন, ‘আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে আর তা জানার পরও ব্যবস্থা নিচ্ছি না- এমন অভিযোগ সত্য নয়। কিছু জায়গায় লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ পাওয়ার পরই তা ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে পাঠানো হচ্ছে। আমি নিজেও সরেজমিন পরিদর্শন করছি।’

আচরণবিধির ৮ ধারায় উল্লেখ আছে, প্রার্থীদের পোস্টার সাদাকালো হতে হবে এবং এর আয়তন ৬০ঢ৪০ সেন্টিমিটারের অধিক হতে পারবে না। কিন্তু অনেক প্রার্থীই এ বিধি মানছেন না। নির্ধারিত আয়তনের পাশাপাশি অনেকে বড় আকারের ব্যানার ফেস্টুনও টানিয়েছেন। একই ধারার ৫নং উপধারায় বলা আছে, নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো প্রার্থী নিজ ছবি ও প্রতীক ছাড়া অন্য কারো নাম, ছবি বা প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না। তবে প্রার্থী কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনীত হলে সেক্ষেত্রে তার দলের বর্তমান প্রধানের ছবি পোস্টারে বা লিফলেটে ছাপাতে পারবেন। এ বিধানও মানা হচ্ছে না। দুই সিটির মেয়র প্রার্থীরা দলীয় মনোনীত। কিন্তু কাউন্সিলরা মনোনীত নন। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, অনেক কাউন্সিলর প্রার্থী তাদের পোস্টারে নিজ নিজ দলের মনোনীত বলে পোস্টারে তা লিখেছেন। 

আচরণবিধির ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সড়ক কিংবা জনগণের চলাচল ও সাধারণ ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত স্থানে নির্বাচনি ক্যাম্প বা অফিস স্থাপন করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবচিত্র পুরো উল্টো। এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বেশিরভাগ কাউন্সিলর প্রার্থী ফুটপাত, এমনকি অনেক জায়গায় রাস্তা দখল করে নির্বাচনি ক্যাম্প স্থাপন করেছেন।

আচরণবিধির ২০ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা তাহার পক্ষে কোনো রাজনৈতিক দল, অন্য কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান মসজিদ, মন্দির, গির্জা বা অন্য কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ে কোনো প্রকার নির্বাচনি প্রচারণা চালাতে পারবেন না। এ বিধিও মানছেন না প্রার্থীরা। শুক্রবার জুমার নামাজের শেষে প্রায় প্রত্যেক প্রার্থীই মসজিদের ভেতর প্রচারণা চালান। ভোটারদের সঙ্গে কোলাকুলিসহ তাদের কাছে ভোট চান। 

সিটি নির্বাচনে আচরণবিধি অমান্য করলে প্রার্থী বা তার সমর্থকের সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডের বিধান রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রার্থিতা বাতিলসহ নিবন্ধিত দলকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার করারও বিধান করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে জেল-জরিমানা করার ক্ষমতা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না। 

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দুই সিটির প্রার্থীরা প্রতিনিয়ত আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন কমিশনকে এখন পর্যন্ত কোনো তৎপরতা বা হস্তক্ষেপ দেখিনি। আসলে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় কিনা, তাদের সদিচ্ছা আছে কিনা- তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আচরণবিধি মেনে চলতে প্রার্থীদের বাধ্য করতে ইসির ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া আছে। এখনই যদি প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলতে বাধ্য করা না যায় তাহলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। যার ফলে নির্বাচনি পরিবেশ অশান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //