বিপর্যস্ত নির্বাচন ব্যবস্থা প্রয়োজন সংস্কার

বিদ্যমান নির্বাচনী আইন বাস্তবায়ন না হওয়া ও এ ব্যবস্থার সংস্কার না হওয়ায় এর গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে। 

বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি রয়েছে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার না হলে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। 

আর এসব নিয়ে খোদ বর্তমান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন বিশ্লেষকরা তাদের মতামত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার না হলে এখন যে ধরনের নির্বাচন হচ্ছে, তার মান আরো নিম্নগামী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও), স্থানীয় সরকার নির্বাচনী আইনগুলো এমনভাবে সংস্কার করা উচিত, যাতে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্যতা পায় নির্বাচনগুলো। 

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংখ্যার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও এত সংখ্যায় ভোটারবিহীনভাবে নির্বাচিত ঘোষিত হওয়া কতখানি নৈতিক, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এ ধরনের একতরফা নির্বাচন দেশের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায়- ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতির যাতে উদ্ভব না হয়, তার জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের আলোচিত ধারায় সর্বোচ্চ সংখ্যা বেঁধে দেয়া যায় কি-না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। একইসঙ্গে ‘উপরের কাহাকেও নহে’ বা ‘নো’ ভোটের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করার যৌক্তিকতা অনুধাবন করা উচিত। বছরখানেক আগে ভারতীয় সর্বোচ্চ আদালত এক আদেশে সে দেশের সব নির্বাচনে এই বিধান যুক্ত করেছে। ভারতীয় ‘সুপ্রিম কোর্ট’ এই বিধানকে একজন ভোটারের গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করে বলেছে, ‘কোনো প্রার্থীকে নির্বাচিত করার অধিকার যেমন আছে, তেমনিভাবে প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করার অধিকারও একজন ভোটারের রয়েছে’। 

নব্বইয়ের দশকে ও ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত কয়েকটি সংসদ নির্বাচন ছাড়া স্বাধীনতার পাঁচ দশকে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। এসব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কোনো দলীয় সরকার পরাজিত হয়নি। জাতীয় নির্বাচনের আচড় পড়েছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনের ওপরও। নির্বাচন ব্যবস্থা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কার্যকর ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়নি। ফলে প্রয়োজন ও জরুরি হয়ে পড়েছে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের। 

গত এক দশকে ভোটারদের ভোট দিতে না পারাসহ নানা অনিয়মের কারণে দেশের সাধারণ মানুষ ভোট প্রদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। জাতীয় নির্বাচন, উপ-নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে খুব স্বল্পসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারপরেও এসব নির্বাচনের ফলাফলে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছে। যা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে ন্যূনতম ভোটের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করা দরকার হয়ে পড়েছে।

আইন সংস্কারের বিষয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মধ্যে ভিন্ন মত রয়েছে। নির্বাচনী আইন সংস্কার প্রয়োজন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নাম-পদবি পরিবর্তন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশকে আইনে প্রতিস্থাপন, প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা থেকে সরে আসার বিষয়ে ভিন্ন মত রয়েছে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের। তিনি তিনটি বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রদান করেন।

মাহবুব তালুকদারের মতে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো, মেয়াদকাল ইত্যাদি পরিবর্তন নির্বাচন কমিশনের কর্তব্য নয়। বিশেষত স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদ ও পদবি পরিবর্তন নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার নয়। 

তিনি আরো বলেন, নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন পরিচালনা আইনের যে সংস্কারের প্রস্তাব করেছে, আমি তার সঙ্গেও একমত নই। কেবল নির্বাচন পরিচালনার জন্য ভিন্ন আইন হতে পারে না, তা সর্বজনীন হতে হবে। তিনি ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’ রহিতপূর্বক সংশোধনসহ ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আইন, ২০২০’ প্রতিস্থাপনের উদ্যোগের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেন কমিশনের সঙ্গে। 

তার মতে, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের তৃতীয় অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’ প্রণয়ন ও জারি করেন। এটি একটি ঐতিহাসিক আইনগত দলিল, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনন্য স্মারক। কী কারণে বা কোন যুক্তিতে এই পরিবর্তন প্রয়োজন, তা আমার বোধগম্য নয়। তবে প্রার্থিতা বাতিলে ইসির সরাসরি ক্ষমতার বিলোপ সাধনের বিষয়ে তার আপত্তি। কারণ এটি নির্বাচন কমিশনের একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। আর এতে নির্বাচন কমিশন নখদন্তহীন বাঘ নয়, বিড়ালে পরিণত হবে।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের সম্প্রতি সংসদে আলোচনায় বলেন, বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি রয়েছে। সে কারণে নির্বাচন সুসংহত করতে সংখ্যানুপাতিক ভোট ব্যবস্থা, অর্থাৎ যে দল যে পরিমাণ ভোট পাবে, সে দল সে অনুপাতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন, এমন ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। 

তিনি আরো বলেন, বহু দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে। সংসদ নির্বাচনে কোনো দল যদি মোট ভোটের ২০ শতাংশ ভোট পায়, তাহলে সংসদের মোট আসনের ২০ শতাংশ আসনও তাদের দখলে আসবে। তাহলে দেশের ছোটখাটো দলগুলোরও সংসদে প্রতিনিধিত্ব বাড়বে। 

ইসির জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, আমি মনে করি, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার না হলে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। আজও এই কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাই। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সংস্কার না হলে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সংশ্লিষ্ট সব মহলের ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার না হলে এখন যে ধরনের নির্বাচন হচ্ছে, তার মান আরো নিম্নগামী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর মাহবুব তালুকদার বলেন, নির্বাচনবিমুখতা গণতন্ত্রহীনতার নামান্তর। এই নির্বাচনে ভোটের প্রতি জনগণের অনীহা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, জাতি কি ক্রমান্বয়ে গণতন্ত্রহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? ভোটকেন্দ্রে বিরোধীপক্ষের দৃশ্যমান অনুপস্থিতি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

সাবেক সচিব ও কলাম লেখক আবদুল লতিফ মণ্ডলের মতে, গত পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্বাচন কমিশন অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ক্ষমতা প্রয়োগে আগ্রহী হয়নি, যার ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারেনি। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও) এর ৯১-ই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি নির্বাচন কমিশনের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, কোনো প্রার্থী বা তার এজেন্ট আরপিও বা বিধিমালা বা আচরণ বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করেছেন বা লঙ্ঘনের চেষ্টা করছেন, তবে কমিশন কতিপয় শর্ত পালন সাপেক্ষে ওই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবেন। গত প্রায় পাঁচ দশকের নির্বাচনের ইতিহাসে কমিশন তার এ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে বলে মনে পড়ে না।

তার বিশ্লেষণ, গণপ্রতিনিধি আদেশে একজন প্রার্থীর ব্যয়সীমা ২৫ লাখ টাকা নির্ধারিত হলেও অধিকাংশ প্রার্থী এ ব্যয়সীমার অনেকগুণ বেশি টাকা নির্বাচনে খরচ করেন। নির্বাচনী প্রচারণাকালে একজন প্রার্থী নির্ধারিত ব্যয়সীমার অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করলেও নির্বাচন কমিশন তার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে বা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের জন্য তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে আগ্রহ দেখায় না। ফলে নির্বাচনে পেশিশক্তি ও কালো টাকার প্রভাব অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলেছে। যা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করে ফেলছে।

সুজন সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই অকার্যকর হয়ে পড়ে। বর্তমানে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়া মানে হলো, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //