১৬০ ইউপিতে ভোটগ্রহণ শেষ, নির্বাচনি সহিংসতায় নিহত ৩

১৬০টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ও ষষ্ঠ ধাপের ৯টি পৌরসভার ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। এর আগে সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীভাবে দেশের ৬টি জেলার ২৩টি উপজেলার ১৬০টি ইউনিয়নে ও আটটি জেলার নয়টি পৌরসভায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।

এদিকে, নির্বাচনী সহিংসতায় মহেশখালীতে নৌকা প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত ও ৪ জন আহত হয়েছেন। মোংলায় নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীদের সংঘর্ষে এক বৃদ্ধার মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া, ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মৃত্যু হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে হামলা ও হুমকি প্রদানের অভিযোগে নোয়াখালীতে ভোট বর্জন করেছেন সাত প্রার্থী।

যেসব জেলায় ইউপি নির্বাচন চলছে এর মধ্যে বাগেরহাটে ৬৬টি, খুলনায় ৩৪টি, সাতক্ষীরায় ২১টি, কক্সবাজারে ১৪টি, নোয়াখালীতে ১৩টি ও চট্টগ্রামে ১২টি ইউনিয়ন রয়েছে। পৌরসভাগুলোর মধ্যে রয়েছে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, যশোরের নওয়াপাড়া, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট, ফেনীর সোনাগাজী, নোয়াখালীর কবিরহাট, চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, কক্সবাজারের মহেশখালী ও চকরিয়া পৌরসভা।

কক্সবাজারে নির্বাচনি সহিংসতায় ২ জন নিহত
কক্সবাজারের মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলাকালে সহিংসতায় দুইজন নিহত হয়েছেন। আজ সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) ভোট চলাকালে এসব ঘটনা ঘটে। 

মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নে ভোটকেন্দ্রে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে আবুল কালাম নামে একজন নিহত ও আরো পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। আজ বেলা ১১টার দিকে কুতুবজোমের একটি ভোটকেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। 

কালাম স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মোশাররফ হোসেন খোকনের সমর্থক। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সংঘর্ষের কারণে দুই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকার প্রার্থী শেখ কামাল ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী চশমা প্রতীকের প্রার্থী মোশাররফ হোসেন খোকনের সমর্থকদের মধ্যে ভোট জালিয়তি নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়। পরে উভয়পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গুলি বিনিময় হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই আবুল কালাম (৪০) মারা যান।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান  বলেন, ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছি। যেখানে উত্তপ্ত হয়েছে সেখানের পরিস্থিতি স্বাভাবিকের পথে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে ভোটগ্রহণ শুরু হবে।

অপরদিকে কুতুবদিয়া বড়ঘোপ ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড়ের পিলটকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে আবদুল হালিম (৩০) নামে একজন নিহত হয়েছেন। 

হালিম বড়ঘোপ ইউনিয়নের গোলদারপাড়া এলাকার মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে এবং ৭নং ওয়ার্ড় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলে জানা গেছে। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কিছু লোক ভোটকেন্দ্রে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের চেষ্টা করছিল। এতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্যের গুলিতে আবদুল হালিম আহত হয়। তাকে উদ্ধার করে কুতুবদিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

কুতুবদিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ওমর হায়দার ভোটকেন্দ্রে গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টাকালে আবদুল হালিম নামে একজন নিহত হয়েছেন। নিহতের মরদেহ কুতুবদিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে। নিহত ব্যক্তি নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সমর্থক বলে জানান তিনি।

নোয়াখালীতে ৭ প্রার্থীর ভোট বর্জন
নোয়াখালীর কবিরহাট পৌরসভা, সুবর্ণচর ও হাতিয়া উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট গ্রহণ চলছে। এদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে হামলা, হুমকি প্রদানসহ নানা অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করেছেন আওয়ামী লীগের ২জনসহ ৫জন চেয়ারম্যান প্রার্থী। একই অভিযোগ এনে কবিরহাট পৌরসভায় ভোট বর্জন করেছে দুই কাউন্সিলর প্রার্থী।

সকাল থেকে কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, বৃষ্টি ও কাদামাটি উপেক্ষা করে কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে পুরুষের তুলনায় নারীদের উপস্থিতি বেশি। কেন্দ্রগুলোতে প্রশাসনের তৎপরতা রয়েছে। আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ প্রশাসনের লোকজন। টহলে রয়েছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, র‌্যাব পুলিশের মোবাইল টিম।

এদিকে কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে বুড়িরচর, চরঈশ্বর, সোনাদিয়া, জাহাজমারা ও নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের ৫জন চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং কবিরহাট পৌরসভার ৬ ও ৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ভোট বর্জন করেছেন।

সকাল ৯টার দিকে হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের নৌকার প্রার্থী এটিএম সিরাজউল্লা, বুড়িরচর ইউনিয়নের নৌকার প্রার্থী জিয়া আলী মোবারক কল্লোল, সোনাদিয়া ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরুল ইসলাম মালেশিয়া, চরঈশ্বর ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল হালিম আজাদ ও ভোট গ্রহণের আগের দিন নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী মেহরাজ উদ্দিন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।

বুড়িরচরের নৌকার প্রার্থী জিয়া আলী মোবারক কল্লোল অভিযোগ করে বলেন, "ভোটের আগের রাতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলীর সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ফখরুল ইসলামের অনুসারীরা আশেপাশে অবস্থান নেয়। ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে এজেন্টদের প্রবেশে বাধা প্রদান করে তারা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি বাধ্য হয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁডানোর সিদ্ধান্ত নেন।

সোনাদিয়া ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরুল ইসলাম মালেশিয়া বলেন, "১৩টি ভোটকেন্দ্রের প্রতিটিতে নৌকার প্রার্থীর লোকজন প্রভাব বিস্তারের কারণে আমার কোনো এজেন্ট কেন্দ্রে ঢুকতে পারেনি। তাই ভোটারদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সকাল ৯টায় নির্বাচন থেকে সরে দাড়াঁনোর ঘোষণা দিই।"

মোংলায় নির্বাচনী সহিংসতায় বৃদ্ধা নিহত
এদিকে, মোংলা উপজেলায় ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চাঁদপাই ইউনিয়নে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর লোকজনের সহিংসতায় এক বৃদ্ধা নিহত হয়েছেন। তার নাম ফাতেমা বেগম (৭০)। এ সময়  ইউপি নির্বাচনে মেম্বার প্রার্থী মতিয়ার রহমান মোড়ল ও তার দুই কর্মী গুরুতর আহত হন। মোংলা থানার ওসি মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ঘটনার তদন্ত চলছে। তবে বৃদ্ধা কীভাবে মারা গেছেন, সে বিষয়ে ডাক্তারই সব কিছু বলতে পারবেন বলে জানান তিনি।

প্রতক্ষ্যদর্শী মহাসিন ও মোয়াজ্জেম  বলেন, রবিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাত ৯টার দিকে চাঁদপাই মোড়ে বর্তমান ইউপি সদস্য ও প্রার্থী মতিয়ার রহমান মোড়ল ভোট চাইতে গেলে অপর প্রতিপক্ষ প্রার্থী শফিকুল ইসলাম তাতে বাধা দেয়। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন শফিকুলসহ তার দলবল। এসময় সংঘর্ষের আঘাত থেকে মেম্বার প্রার্থী ভাইর ছেলে মতি মোড়লকে ঠেকাতে এসে ফাতেমা বেগম নামে ওই বৃদ্ধা গুরুতর আহত হন। একই সময় আহত হন প্রার্থী মতিয়ার মোড়ল (৬০), বোরহান শেখ (৩৫) ও ইস্রাফিল (২৬)। 

তবে এদেরকে হাসপাতালে আনার সময় গুরুতর আহত ফাতেমা বেগম নামে ওই বৃদ্ধা পথেই মারা যান বলে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা: সিরাজুল ইসলাম নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, নিহতের মাথার পেছনে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। 

এদিকে খবর পেয়ে মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (মোংলা - রামপাল সার্কেল) মো. আসিফ ইকবাল ও মোংলা থানার ওসি মোহাম্মদ মনিরুল ইসলামসহ পুলিশের একটি দল। এ ব্যাপারে মেম্বার মতিয়ার রহমান মোড়ল সাংবাদিকদের বলেন, চাঁদপাই মোড়ে ভোট চাইতে গেলে প্রতিপক্ষ প্রার্থী শফিকুলসহ তার লোকজন তার ওপর হামলা চালায়। এছাড়া, আহতদের হাসপাতালে আনার পর শফিকুলের লোকজন মতি মোড়লের দোকান, অফিস ঘর ও ঘরে থাকা মালামাল ভাংচুরসহ লোকজনকে ধাওয়া দিয়ে তাড়িয়ে দেয়।

তবে শফিকুলের দাবি, মতিয়ার মোড়লের লোকজন তার ওপর প্রথমে হামলা চালায়।  সে সময় তিনি বাধা দিতে গেলে মতিয়ারসহ তার লোকজন হামলা চালায়। আর মৃত বৃদ্ধা স্ট্রোক করে মারা যান বলে দাবি করেন তিনি।

উল্লেখ্য, দেশে প্রায় সাড়ে চার হাজার ইউপিতে কয়েক ধাপে ভোটগ্রহণ হবে। গত ৩ মার্চ প্রথম ধাপে ৩৭১টি ইউপির ভোটের তফসিল ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। পরে করোনা পরিস্থিতির কারণে ভোট স্থগিত করা হয়। এরপর গত ২১ জুন ৩৭১টি ইউপিতে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও ওইদিন নির্বাচন হয় ২০৪টিতে।

তফসিলের পর সীমান্তবর্তী জেলায় করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় বাকি ১৬৭টি ইউপিতে নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে ইসি। স্থগিত হওয়া ১৬৭টি ইউপির মধ্যে আজ ১৬০টি ইউপিতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

এছাড়া, আজ অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ ধাপের নয়টি পৌরসভা নির্বাচনও হওয়ার কথা ছিল ২১ জুন। করোনা পরিস্থিতির কারণে ১০ জুন তা স্থগিত করা হয়েছিল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //