বিতর্কের কেন্দ্রে ইভিএম

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে রাজনীতির মাঠে। নির্বাচন নিয়ে নানামুখী হিসাব কষতে শুরু করেছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। একই সাথে কার অধীনে হবে নির্বাচন? ভোট ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) না ব্যালটে হবে? নির্বাচন কতটা অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে এ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।

ইতোমধ্যেই ক্ষমতাসীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন ইঙ্গিত দিয়েছে সব আসনেই ইভিএমে ভোটগ্রহণ হবে। তবে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো ইভিএমের কড়া বিরোধিতা করছে। বিএনপি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনেই তারা যাবে না। ইভিএম তো পরের কথা। শিগগির ইভিএমের ‘ত্রুটি’ জাতির সামনে তুলে ধরবে বলেও জানিয়েছে বিএনপি। সরকারের আস্থাভাজন জাতীয় পার্টিও ইভিএমের মৌন বিরোধিতা করছে। তাই ইভিএমের প্রশ্নে সরকার অনড় অবস্থানে থেকে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে ইভিএম বিতর্ক দূর করতে চায়। ভোটাররা যাতে এই যন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল হয় সে জন্য সরকার, আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশন যৌথভাবে কাজও শুরু করেছে।।

গত ৭ মে সরকারি দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন ইভিএমেই হবে। তারপর থেকে বিএনপির ইভিএম বিরোধী অবস্থান আরো জোরালো হয়ে উঠেছে। আবার রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টি না হওয়ায় ইভিএম প্রশ্নে নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশন কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করেছে। 

গত ২ মে দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসেনি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কতগুলো আসনে ইভিএম ব্যবহার হবে, তা রাজনৈতিক দল ও প্রযুক্তিবিদদের সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। 

সিইসি আরো বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট করব, নাকি ১০০ আসনে করব, নাকি মোটেও করব না; এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ওই দিন প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে বসেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এম কায়কোবাদ, বুয়েটসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদ ও শিক্ষকরা। তারা সেখানে গিয়ে ইভিএম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখেন। এমনকি এর গঠন পদ্ধতি, বিভিন্ন সার্কিট তারা খুলেও দেখেন। পরে তারা ইভিএমের বিষয়টি দেখে আশ্বস্ত হয়েছেন। 

ইভিএম পরীক্ষা করে বের হয়ে শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইভিএমে নিখুঁতভাবে ভোট দেওয়া সম্ভব, কারচুপির সুযোগ নেই।’

তবে এসব কথায় আস্থা রাখতে পারছেন না সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা। বিশেষ করে বিএনপি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ের জন্য ঐকমত্যের ভিত্তিতে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এ জন্য সমমনা দলগুলোকে নিয়ে বৃহৎ একটি আন্দোলন করতে চায় তারা। এ নিয়ে একাধিক রাজনৈতিক দলের সাথেও বৈঠক করেছে বিএনপি। এছাড়াও শিগগির ইভিএমের ‘ত্রুটি’ জাতির সামনে তুলে ধরতে নানা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করছে বিএনপি। তারা ইভিএমকে ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভোট চুরির যন্ত্র’ হিসেবেই দেখে আসছে। 

বিএনপি বলছে, প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে এটা করা যায়, ভোটার যে প্রতীকেই ভোট দিক না কেন, নির্দিষ্ট প্রতীকেই ভোট পড়বে। কোন প্রতীকে ভোট পড়েছে তার কোনো কাগজের প্রমাণও থাকে না। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া তৈমূর আলম খন্দকার (স্বতন্ত্র প্রার্থী) অভিযোগ করেছিলেন, ইভিএম কারসাজিতে তিনি হেরেছেন।

ইভিএম নিয়ে জাফর ইকবালের মন্তব্যের বিষয়ে বিএনপির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী রিয়াজুল রিজু বলেন, জাফর ইকবাল সাহেব একজন শিক্ষাবিদ। উনার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইমেজ আছে; কিন্তু তিনি যে এ ধরনের কথা বলতে পারেন এটা অবিশ্বাস্য। কারণ উনি বলেছেন, এটাকে (ইভিএম) ভার্চুয়ালি ডাইভার্ট করা যাবে না। এটা তো হার্ডওয়্যারের বিষয় না, সফটওয়্যারের বিষয়। এখানে আপনি যেভাবে প্রোগ্রামিং দেবেন সেভাবে কাজ করবে। আর এটা চালাবে তো মানুষ। তারা যদি এটাকে ভালো কাজে ব্যবহার করে তাহলে ভালো। যদি অসৎ উপায়ে ব্যবহার করে তাহলে অসৎ হবে।

তিনি আরো বলেন, আমরাও কাজ করছি। আমি ইভিএম বানিয়ে দেখিয়ে দেব জাফর ইকবাল সাহেবকে, যেখানে আপনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারবেন। এখানে আপনি একজনকে ভোট দেবেন; কিন্তু ভোট চলে যাবে অন্যজনের কাছে। এটা আমরা কোরবানির ঈদের পর জাতির সামনে তুলে ধরব।

জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, নির্বাচনে ইভিএম ভালো; কিন্তু যারা সেটি পরিচালনা করবেন তারা নিরপেক্ষ নন। তাই ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না।

অন্যদিকে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ইভিএম নিয়ে যে সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে দেশের রাজনৈতিক মহল, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময়, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে তা দূর করার চেষ্টা করছে ইসি। এর পরেই আগামী নির্বাচন ইভিএমেই হবে এমন ঘোষণা দিতে চায় সিইসি আউয়াল। সেই লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন ইভিএম নিয়ে দেশের প্রযুক্তিবিদ ও বিভিন্ন পেশার সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে আরো বৈঠক করবে। মূলত ইভিএমেই ভোট হবে, তা চূড়ান্ত করার আগে এই নিয়ে বিতর্ক দূর করতে চায় কমিশন। বড় ধরনের সমালোচনা এড়াতেই এই কৌশলে হাঁটছে আউয়াল কমিশন।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পরামর্শে ইভিএমের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতেও আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশন কাজ করবে।

কমিশন বলছে, বিরোধী দল থেকে আসা অভিযোগ ছাড়া ইভিএম নিয়ে যে সন্দেহ-অবিশ্বাস বা বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে না কমিশন। এগুলো বিবেচনায় নিয়েই কমিশন নিজেরা কিছু বৈঠক করেছে। আরো করবে। যাদের কাছ থেকে জানা প্রয়োজন আরো জানবে।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে একটা দ্বিমত রয়েছে। আমরা সবার সাথে বসছি মূলত ইভিএম সম্পর্কে বুঝতে। প্রযুক্তিবিদদের সাথে বসেছি। তারা এটা বুঝেছেন। আমরাও বুঝেছি। ওনারা কনভিন্সড। আমরাও বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের সাথে বসব। আমরা নিজেরাও প্রযুক্তিটি সম্পর্কে আরো বুঝতে চাই।’ 

আরেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খান বলেন, পূর্বে কী ছিল, ভবিষ্যতে কী আসবে জানি না। সুষ্ঠু নির্বাচন আমরা করে দেখাব। এটি আমার কাছে আমানত। জাতীয় নির্বাচনে প্রতিটি কেন্দ্র সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে, যা আমরা ঢাকা থেকে পর্যবেক্ষণ করব। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তখনই নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাবে।

ইভিএম নিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘ইভিএমের প্রতি আস্থা ফেরাতে রাজনৈতিক দলগুলোর এক্সপার্টদের সাথে আমরা বসব। সেটি নির্বাচনের আগেও হতে পারে। প্রয়োজনে প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের বিদেশি এক্সপার্টও আনতে পারেন। আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে আছি। এরপরও আগামী সংসদ নির্বাচনে কতটি আসনে ইভিএমে নির্বাচন হবে তা সময়ই বলে দেবে।

নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগও রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে ইভিএম নিয়ে বিএনপির সমালোচনার জবাব দেবে বলে জানিয়েছেন দলের একাধিক নেতা। তারা বলছেন, যৌক্তিক দিক তুলে ধরে ইভিএম নিয়ে যে মিথ্যাচার চলছে, সেদিক থেকে জনগণকে সচেতন করে তোলা হবে।

আগামী নির্বাচনের আগে যেসব স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেসব নির্বাচনে শতভাগ ইভিএম ব্যবহার করা হবে। সে নির্বাচনগুলোতে জয়-পরাজয়ের কোনো হিসাব না করে ইভিএমে কারচুপির কোনো সুযোগ নেই, তা স্পষ্ট করবে ক্ষমতাসীনরা। পাশাপাশি ইভিএমে ভোটের ফল ও ভোটগ্রহণ দ্রুত সম্ভব হয় এই প্রচারও চালাবে আওয়ামী লীগ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //