নতুন বিতর্কে জড়াচ্ছে ইসি

ইভিএম প্রকল্প অনুমোদন দেয়নি সরকার। প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পের পর এবার নিজের করা ভোটের গেজেটের ফল নিজেই যেন বাতিল করতে পারে সেই আইন চেয়ে নতুন বিতর্কের সূত্রপাত করল নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

গেজেট প্রকাশের পরও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ভোট বাতিলের ক্ষমতা চায় কাজী হাবিবুল আউয়ালের এই কমিশন। আর এ সংক্রান্ত আরপিও আইনে সংশোধনী প্রস্তাব তারা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরও ফলের ব্যাপারে আপত্তি, আপিল ও শুনানির সুযোগ থাকে। সেসব নিরসন করেই ইসি ফলের গেজেট প্রকাশ করে। তারপরও যদি কোনো আপত্তি অভিযোগ থাকে সেটার জন্য চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির। কিন্তু ইসি চাচ্ছে এই ক্ষমতা নিজের কাছে নিতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা করা হলে তা হবে আদালতের ক্ষমতার ওপর অনেকটা হস্তক্ষেপ। এ ধরনের আইন করা উচিত না। নীতি-নৈতিকতা এবং সমতা পরিপন্থী হবে। যা ইসি ও নির্বাচনকে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। 

ইসি সূত্রে জানা গেছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আউয়াল কমিশন আরপিওতে কিছু সংশোধনের প্রস্তাব করেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, আরপিওতে ভোট বাতিলের ক্ষমতা সংক্রান্ত সংশোধনী প্রস্তাবে আইন মন্ত্রণালয়ের সায় মিলেছে। সে সুবাদে ভোটে অনিয়ম করে কেউ জয়ী হলে এবং সেই নির্বাচনের ফলের গেজেট প্রকাশ হওয়ার পরও তা বাতিলের ক্ষমতা পেতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আইন মন্ত্রণালয় ইসিকে বলেছিল যে, আরপিওর ৯১ ধারাতে তাদের সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে ইসি বলেছে, ৯১ ধারাতে সেটা কভার করে না। 

উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ প্রণয়নের পর এ পর্যন্ত ১২ বার সংশোধন এসেছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে অন্তত ২১০টি বিষয়ে সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে।

এই আইন ও ক্ষমতার সপক্ষে যুক্তি-উদাহরণ তুলে ধরে কমিশনার রাশেদা সুলতানা ময়মনসিংহের দুর্গাপুরের একটি ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আমি জয়েন করার কিছুদিন পরই একটা ফাইল এলো। তাতে দেখলাম যে দুর্গাপুরে একটি নির্বাচনে বোধহয় ব্যালট ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল। তখন কমিশন গেজেট হওয়ার পর ভোট বাতিল করেছিল। কিন্তু হাইকোর্ট বলে দিল যে গেজেট হওয়ার পর কমিশনের করার কিছু থাকে না। তিনি বলেন, এরকম পরিস্থিতি যদি সামনে আসে কমিশনের হাতে অবশ্যই একটা ক্ষমতা থাকা উচিত, যে ক্ষমতাবলে ওই নির্বাচনটা বন্ধ করে দেওয়া যায়। কারণ যিনি ডিপ্রাইভড হলেন বলে মনে করেন, তার তো ক্ষতিপূরণের জায়গা নেই। এ কারণে আমরা সংশোধনী আনার প্রয়োজন মনে করেছি।

আরপিও সংশোধনে আইন মন্ত্রণালয়ের আপত্তির বিষয়ে ইসি রাশেদা সুলতানা বলেন, আমরা ইভিএমে আঙুলের ছাপ না মিললে প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত ভোটের সুযোগ সর্বোচ্চ ১ শতাংশ করতে চেয়েছি। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় বলেছে, এর প্রয়োজন নেই। কারণ এটি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বিধি বা পরিপত্র দিয়েই করা সম্ভব। তাই আইন মন্ত্রণালয়ের এই ব্যাখ্যাকে মেনে নিয়ে আমরা এটিকে চাহিদা থেকে বাদ দিতে বলেছি। 

এদিকে ইসিতে কর্মরত বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারা বলছেন, এটা করা ইসির জন্য ঠিক হবে না। কারণ গেজেট প্রকাশের পর ইসির কাজ শেষ। গেজেটের আগে ইসি যাচাই করেই তা প্রকাশ করে। এখন এই ধরনের আইন করা হলে তা হবে ইসির জন্য বিতর্কিত। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির জন্য আদালত রয়েছে। ইসির গেজেটের বিপরীতে সে আদালতে বিচারের আশ্রয় নিতে পারবেন। 

এই সংশোধনের ব্যাপারে ইসির এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ভোটের সময় কোনো অভিযোগ পেলে কমিশন খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পারে বিদ্যমান আইনে। এখন ভোটের সময়ের পরে থেকে ফল প্রকাশের পর, এমনকি গেজেট প্রকাশের আগে নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ের অভিযোগ কমিশন তদন্ত করে অনিয়মের প্রমাণ পেলে ভোট বাতিল করতে পারবে- এজন্য ৯১ অনুচ্ছেদে দুটি উপধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

আর এ ব্যাপারে কাজী রকীবউদ্দিন কমিশনের সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, ভালো কিছু এভিডেন্স এসে গেছে ইসির হাতে। কিন্তু এর মধ্যে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। তখন ইসির দেখেও কিছু করার থাকে না। এই জন্য নির্বাচন কমিশনের হাতে গেজেট হওয়ার পরও কিছু ক্ষমতা থাকলে অন্তত এক মাসের মতো একটা নির্দিষ্ট সময় ক্ষমতা থাকলে ভালো হয় বলে আমি মনে করছি। 

নির্বাচনী ফলের গেজেট প্রকাশের পর তা বাতিলের ক্ষমতা ইসিকে দেওয়া প্রসঙ্গে সাবেক জজ, সংবিধান বিশ্লেষক ইকতেদার আহমেদের অভিমত হলো, ইসি নিজেই তো সন্তুষ্ট হয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে। সে আবার কীভাবে গেজেট বাতিল করবে? এটা তো সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে। ইসি কখন গেজেট করে, যখন সে ফলের ব্যাপারে অভিযোগ পেলে তা তদন্ত করে যখন দেখে তা বস্তুনিষ্ঠ নয়, তারপর সে গেজেট করল। তার নিজের করা গেজেট নিজেই কীভাবে বাতিল করবে? এটা করবে আদালত। নির্বাচন কমিশনের গেজেট করার ব্যাপারে যদি কোনো অন্যায় হয়ে থাকে, তাহলে সেটা আদালতের এখতিয়ার। গেজেট করার পর ইসির কোনো এখতিয়ার থাকার কথা না। 

আরপিওতে এই ক্ষমতা ইসিকে দেওয়া প্রসঙ্গে তার অভিমত, এটা করা হলে সেটা আদালতের ক্ষমতার ওপর অনেকটা হস্তক্ষেপ করা হবে। এ ধরনের আইন করা উচিত না। এ ধরনের আইন নীতি ও নৈতিকতার পরিপন্থী। সমতারও পরিপন্থী হবে এ ধরনের আইন। কারণ ইসি নিজে সন্তুষ্ট হয়েই গেজেট করেছে। তাহলে সে নিজেই কেন তার গেজেট বাতিল করবে?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //