প্রচণ্ড চাপে ছিলেন ইসি: পরামর্শ দিতেন গোয়েন্দারা

টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাসের মাথায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার মন্ত্রীপরিষদ। পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অভিযোগ আছে, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশে আর সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। দলীয় সরকারের অধীনে প্রতিবারই প্রভাবিত হয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সরকারের প্রভাবিত করার কাজটি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে দায়িত্ব নিয়েই করতেন গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ফলে নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সংসদ নির্বাচন করতে বাধ্য হতেন নির্বাচন কমিশনরাও।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দলীয় সরকারের অধীনে গত তিন নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে জনমনে। সব মহলে ‘দিনের ভোট রাতে’ করা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক চলছে। নুরুল হুদা কমিশনই দিনের ভোট রাতে করেছে বলে অভিযোগ।

অন্যদিকে, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন দিনের ভোট রাতে না করলেও ভোটের শতকরা হার ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক মহলে এমন আলোচনা বেশ জোরালো। ফলে হানাহানি ছাড়া আওয়ামী লীগের দেওয়া ডামি প্রার্থীরা নির্বাচিত হলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দেয় আউয়াল কমিশন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানান তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। নির্বাচনে ২২৩টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হন। জাতীয় পার্টি জেতে ১১টি আসনে। এ ছাড়া বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি নৌকা প্রতীক নিয়ে একটি আসনে এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও নৌকা প্রতীক নিয়ে একটি আসনে জয়ী হয়। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি হাতঘড়ি প্রতীক নিয়ে একটি আসনে এবং ৬১টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেন।

সিইসির ঘোষণা অনুযায়ী, নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের শতকরা হার ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৫ লাখ ১ হাজার ৫৮৫ জন। তাদের মধ্যে চার কোটি ৯৯ লাখ ৫৫ হাজার ৪৪৫ জন ভোটার ভোট দেন। ভোটের শতকরা হার ৪১ দশমিক ৮ ভাগ।

জানা যায়, বিতর্কিত ওই নির্বাচন করতে চাননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, কাজী হাবিবুল আউয়াল সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের বাধার কারণে তিনি সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করতে পারেননি। এমনকি হাবিবুল আউয়াল পদত্যাগ করে অস্ট্রেলিয়া চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পদত্যাগ করতে পারেননি সরকারের চাপে।

একতরফা নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে হাবিবুল আউয়াল চেয়েছিলেন দেশত্যাগ করতে। কিন্তু সরকারের উপর মহলে বিষয়টি জানাজানি হলে তাকে ঠেকাতে শক্ত অবস্থানে যায় আওয়ামী লীগ সরকার। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ওই সময় তাৎক্ষণিকভাবে সিইসির সঙ্গে দেখা করতে আসেন তিন গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান কর্তারা। তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর পদত্যাগ বা দেশত্যাগে আর সাহস দেখাননি কাজী হাবিবুল আউয়াল। এরপর থেকে গোয়েন্দাদের কঠোর নজরদারিতে থাকেন হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।

গত বছরের ৭ নভেম্বর হঠাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে দেখা করতে আসেন তিন গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান কর্তারা। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল হামিদুল হক এবং পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলাম সিইসির সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন। এরপর সিইসির সঙ্গে বৈঠক করেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল টি এম জোবায়ের। তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে কোন কোন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তা নিয়ে মুখ খোলেননি কেউই। তবে সিইসি ওই সময় পদত্যাগ করে দেশের বাইরে চলে যেতে চেয়েছিলেন। ডামি প্রার্থীদের মাধ্যমে একতরফা নির্বাচনের পক্ষে ছিলেন না সিইসি।

নির্বাচন কর্মকর্তাদের অনেকের অভিযোগ, ওই সময় তিন গোয়েন্দাপ্রধান সিইসিকে (কাজী হাবিবুল আউয়াল) চরমভাবে হুমকি দিয়েছিলেন।

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার কাছে তার কমিশনের সময় এবং কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে হওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হয়েছে, সে বিষয়ে প্রথম সারির এক গণমাধ্যম জানতে চায়। জবাবে নুরুল হুদা বলেন, নির্বাচনে কোনো অনিয়মের দায় এককভাবে সিইসি বা কমিশনারদের দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ নির্বাচনের সময় ৯৫ শতাংশ ক্ষমতা দেওয়া হয় রিটার্নিং কর্মকর্তা ও প্রিজাইডিং অফিসারদের কাছে। এ ছাড়া যখন সারাদেশে একযোগে নির্বাচন হয়, তখন কেন্দ্রে কখন ব্যালট যায় বা অনিয়ম হয়, সেগুলো কমিশনে বসে দেখা যায় না। তবে, রিটার্নিং ও প্রিজাইডিং অফিসারদের মাধ্যমে যদি রিপোর্ট আসে তখন নির্বাচন কমিশন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু আমাদের সময় আমরা ব্যাপকভাবে অভিযোগ পাইনি। তবে যেগুলো পেয়েছিলাম সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh