আশরাফুল ইসলাম আকাশ
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:৪৬ এএম
আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:৫২ পিএম
গ্রাম-বাংলার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ পুতুল। সত্যি বলতে গেলে, গ্রামে থেকেছে কিন্তু পুতুলের বিয়ে দেয়নি এমন ছেলেমেয়ে হয়তো একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কত ঝগড়া, খুনসুটি ছিল পুতুল খেলাকে কেন্দ্র করে। গ্রাম নয় শুধু শহরের ছেলেমেয়েদের শৈশবজুড়েও পুতুলের বিশেষ প্রভাব আছে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, যেসব শিশু ছেলেবেলায় পুতুল খেলে তারা সংসার জীবনে সার্থক হয়! পুতুল এবং পুতুল নাচ এক জমজমাট সময় পার করেছে বাংলাদেশে। পুতুল নাচ এমন একটি আর্ট যেখানে শিল্পকলার প্রায় সব উপাদান বিদ্যমান। গল্প, কবিতা, নাটক, অভিনয়, গান, নাচ, ভাস্কর্য এবং অন্যান্য দৃশ্যমান আর্টের সার্থক মিলন ঘটেছে পুতুল নাচে।
পুতুল নাচের স্মৃতিচারণ করে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের গ্রামের বাড়িতে সবচেয়ে বিত্তশালী লোকটির পেশা ছিল পুতুল নাচ। বছরে ছয়মাস পুতুল নাচ দেখিয়েই তিনি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন। এতটাই জনপ্রিয় ছিল পুতুল নাচ। কিন্তু কালের বিবর্তনে অনেক কিছুই যেমন আজ আর নেই, তেমনি নেই পুতুল নাচের সেসব সোনালি দিন।
পুতুল নাচ নিয়ে গবেষণা করেন অধ্যাপক ড. হারুন রশিদ। তিনি দীর্ঘদিন পুতুল নাচ নিয়ে গবেষণা করে ৫০/৫৫টি দলের নাম উদ্ধার করতে পেরেছেন যারা পুতুল নাচ করে। তবে বর্তমানে মাত্র ২০/২৫টি দল পুতুল নাচচর্চাকে নিয়মিত লালন করে আসছেন।
তিনি জানান, বাংলাদেশের পুতুল নাচের কথা বলতে গেলে ধন মিয়ার কথা উল্লেখ করতে হয়। পুতুল নাচের মধ্যে নতুনত্ব এনেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত এই পুতুল নাচের কুশলী। কৃষ্ণনগর গ্রামে গিরিশ আচার্যের পুতুল নাচের একটা দল ছিল।
ধন মিয়া সেই দলে ছিলেন প্রাথমিক অবস্থায়। তার কাজ ছিল পুতুল নাচের তালে তালে গান করা। পুতুল নাচের শিল্পটিকে ভালবেসে ফেলেছিলেন ধন মিয়া। শেষ পর্যন্ত নিজেই পুতুল নাচের প্রদর্শনী শুরু করেন। তার পুতুল নাচের দলটার নাম ছিল ‘রয়েল বীণা অপেরা’।
তিনি বাংলাদেশের পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে প্রদর্শিত পুতুল নাচকে নিয়ে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও। ‘বড়শি বাওয়া’, ‘বাঘের কাঠুরিয়াকে ধরে নেয়া’ এবং ‘ বৈরাগী বৈরাগীনির ঝগড়া’সহ বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী প্রদর্শন করে ধন মিয়া বিদেশেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আশির দশকে এই মানুষটা পুতুল নাচ দেখাতে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন। পুতুল নাচে মুগ্ধ করে তিনি অর্জন করেছিলেন বেশ কিছু পুরস্কার।
পুতুল নাচ নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন মোস্তাফা মনোয়ার। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বাংলাদেশের যে গ্রামগুলোতে নিশুতি রাত আগে পুতুল নাচের গল্প চলতো, আজকাল সেসব আর হয় না। গ্রামগুলোতে শহুরে হাওয়া প্রবেশ করেছে যুগের হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। একান্নবর্তী ঘর ভেঙে সংসারগুলো ছোট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবেগ অনুভূতিরাও ফিকে হতে শুরু করেছে। আজ আর অনেক কিছুই আগের মতো নেই। নেই পুতুল নাচের ঐতিহ্যও। এখন আর অতটা আমেজ নেই। বিখ্যাত পুতুল নাচিয়ে ধন মিয়ার ছেলে অবশ্য পুরনো আবেগ আঁকড়ে ধরে আছেন এখনো। বাবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অভ্যাস এখনো ছেড়ে যায়নি তাকে। পুতুল নাচের পেশাটার সঙ্গেই আছেন এখন পর্যন্ত । কিন্তু পুতুল নাচের অবস্থা আসলেই করুণ।
মুস্তফা মনোয়ার আরো বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও পুতুল নাচের ভূমিকা আছে। দলে দলে মানুষগুলো তখন শরণার্থী শিবিরে যাচ্ছিল। প্রাণের দেশটি ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট বুকে পুষে রেখেছিল তারা। শরণার্থী ক্যাম্পের দিনগুলোতে তারা নিশ্চয়ই ভাবতো দেশ নিয়ে। কেমন আছে প্রিয় স্বদেশ? সেই দুঃসহ সময়টায় এই মানুষগুলোকে একটু স্বস্তি দিতে পুতুল নাচ করা হতো। পুতুল নাচের মাধ্যমে দেখানো হতো হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী। মানুষ আবার আশায় বুক বাঁধতো।
যদিও পুতুল নাচ হারিয়ে যাচ্ছে তবুও বাংলাদেশের পুতুল নাচ যে আসলেই শক্তিশালী সেটির প্রমাণ মেলে ২০১৩ সালের একটি ঘটনায়। শিল্পকলা একাডেমির সার্বিক সহযোগিতায় ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় ‘ওয়ার্ল্ড পাপেট কার্নিভাল ২০১৩’-তে বাংলাদেশের একটি দল অংশ নেয়। প্রথমবারের মতো এই কার্নিভালে ড. রশীদ হারুনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ থেকে যায় টিমটি।
৪৬টি দেশের ৬৩টি দলের মধ্যে ‘বেস্ট ফোক পাপেট মিউজিক্যাল অ্যাওয়ার্ড’ জিতে নেয় বাংলাদেশ। কি অসাধারণ অর্জন! এমন অর্জনে স্বপ্ন তো দেখাই যায় যে, শিল্পটিকে আরেকটু উৎসাহিত করলে নিশ্চয়ই এটি আরও সম্মান বয়ে নিয়ে আসতে পারবে ভবিষ্যতে। সঙ্গে আবহমান গ্রামীণ জীবনের আখ্যানগুলো অন্তরে লালিত হবে। কাঠের চশমা পরা মানুষগুলোর মানবিকবোধ জেগে উঠবে কাঠের পুতুলের জবানে।
ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সবাই চাইছে যে আমাদের ঐতিহ্যবাহী শিল্পটা বেঁচে থাকুক তাই অনেক পেশাদার শিল্পী ধর্মনিরপেক্ষভাবে পুতুল নাচের দল গঠন ও পরিচালনা করে যাচ্ছেন। আর এ চাওয়াটার কারণে বাংলাদেশে দলগুলো টিকে আছে। আবার অনেক সময় লক্ষ্য করা যায় আগ্রহের জায়গা থেকে শিল্পকে আঁকড়ে ধরলেও চাহিদার জোগান মেটাতে পারিশ্রমিক না থাকায় পিছিয়ে পরছেন অনেকেই।
সরকারের পক্ষ থেকে শিল্পকলার মাধ্যমে বার্ষিক যে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে সেটি অবশ্যই ভালো কিন্তু যথার্থ নয়। বর্তমান সময়ে এই শিল্পটিতে অনেক প্রতিযোগিতা, সকলে একই প্ল্যাটফর্মে কাজ করলেও কলাবেরেশনের অভাবে একসঙ্গে কোনো উদ্ভাবনী পদক্ষেপ নিতে পারছেন না শিল্পীরা। বছরব্যাপী পুতুল নাচের যে কার্যকলাপ চলবে সেটির কোনো পরিকল্পনা নেই বা শিল্পটি আজ থেকে আগামী দশ বছর পরে কোনো জায়গাটাতে থাকবে সে ধরনের কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আমাদের দেশে নেই।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh