একজন শ্যামসুন্দর বেনেগল ও বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক

শ্যাম বেনেগল- নামটি সম্প্রতি বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব করে উঠে আসছে- খবরে এবং আলোচনায়। এর কারণ বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকারিভাবে, যে চলচ্চিত্রটির ৬০ ভাগ অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার আর বাকি ৪০ ভাগ অর্থায়ন করছে ভারত সরকার। বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হতে যাওয়া সেই চলচ্চিত্রের পরিচালক রূপে দায়িত্ব পেয়েছেন- ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের এই খ্যাতিমান পরিচালক এবং চিত্রনাট্যকার শ্যাম বেনেগল।  

তিনি ১৯৩৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের হায়দ্রাবাদ রাজ্যের ত্রিমুলঘেরিতে এখনকার তেলেঙ্গানা রাজ্যের এক ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্টে জন্মেছেন। তার মূল নাম শ্যামসুন্দর বেনেগল। বাবা শ্রীধর বি. বেনেগল একজন আলোকচিত্রী ছিলেন। চলচ্চিত্রে হাতেখড়ি বলা চলে বাড়িতেই, বাবার হাতে। মাত্র ১২ বছর বয়সে, কিশোরবেলায় শ্যামসুন্দর তার প্রথম চলচ্চিত্র বানান বাবার দেওয়া একটি ক্যামেরা দিয়ে।

ভারতের খ্যাতিমান আরেক চলচ্চিত্রকার গুরুদত্ত ছিলেন শ্যামসুন্দরের আত্মীয়। হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতির পাঠ নেওয়া শ্যাম এখানে গড়ে তোলেন- হায়দ্রাবাদ ফিল্ম সোসাইটি। কর্মজীবনের শুরুতে শ্যামবাবু ১৯৫৯ সালে কপিরাইটার হিসেবে যুক্ত হন মুম্বাইয়ের লিন্টাস অ্যাডভার্টাইজিং নামের একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। ধীরে ধীরে তিনি সেখানে ক্রিয়েটিভ হেড হিসেবে প্রমোশন পান নিজের কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতার গুনে।

এরই মধ্যে তার প্রথম প্রামাণ্যচিত্র ‘ঘর বেঠা গঙ্গা’ তৈরি হয়। ৬৩ সালে তিনি নতুন আরেকটি বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হন। সেখানে তিনি শ’য়ের অধিক প্রামান্যচিত্র এবং বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করেন; কিন্তু তার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরির জন্য ১০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। দীর্ঘ এই সময়ে তিনি নিজের চলচ্চিত্রের কাহিনি লিখছিলেন। ১৯৬৬ সালে শ্যাম শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন পুনেয় ভারতীয় চলচ্চিত্র ও দূরদর্শন সংস্থায়।

এবং এই প্রতিষ্ঠানে তিনি দুই মেয়াদে চেয়্যারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি নির্মাণ করেন- ‘আ চাইল্ড অব দ্য স্ট্রিটস’। চলচ্চিত্রটি তুমুল প্রশংসা কুড়োতে সক্ষম হয় সেই সময়ে। ৮৩ বছরের বর্ষীয়ান ভারতীয় পরিচালক শ্যামসুন্দর বেনেগল সব মিলিয়ে ৭০টি প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। শ্যাম নির্মিত অধিকাংশ কাজই সমাদৃত ও গুরুত্বপূর্ণ। 

বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীনির্ভর কাহিনিচিত্রের (বায়োপিক) পরিচালক হিসেবে শ্যাম বেনেগালকে নিযুক্তির বিষয়টি নিশ্চিতির পর যদিও স্যোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। কেউ অভিনন্দন জানাচ্ছেন, কেউবা প্রশ্ন তুলছেন। ভারতের প্যারালাল সিনেমার অন্যতম পুরোধা শ্যাম বেনেগাল পরিচালনা করবেন বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক এটা সত্যি আনন্দের বিষয়।

কেননা তিনি ‘মহাত্মা গান্ধি’-‘জওহরলাল নেহরু’-‘সুভাষচন্দ্র বসু’র মতো জাতীয় ব্যক্তিত্বকে নিয়ে চলচ্চিত্র বানিয়ে সফল হয়েছেন, কুড়িয়েছেন প্রশংসাও। শ্যাম বেনেগল দক্ষ বলেই হয়তো সুনাম কুড়িয়েছেন বানিয়েছেন- ১৯৭৭ সালে ‘ভূমিকা’ নামের বায়োপিকটি প্রশংসিত-আলোচিত-সমালোচিত মারাঠি অভিনেত্রী হঙসা ওয়াদেকারের জীবন নিয়ে নির্মিত। এটি ছিল তার সফল প্রথম কাহিনিচিত্র। ১৯৮৫ সালে ‘নেহেরু’ নামের তিন পর্বে বিভক্ত তথ্যচিত্রের যুগ্ম পরিচালক ছিলেন শ্যাম। সঙ্গে ছিলেন সোভিয়েত পরিচালক ইউরি আলদোখিন। এটিও দুই বন্ধু দেশ ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছিল। সিনেমার নান্দীপাঠ করেছিলেন নেহরু তনয়া ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী। 

এ ছাড়া সত্যজিৎ রায় (১৯৮৫), সরদারি বেগম (১৯৯৬), জুবেইদা (২০০১), দ্য মেকিং অব দ্য মহাত্মা (১৯৯৬), নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস : দ্য ফরগটেন হিরো (২০০৪) নামের কাহিনিচিত্রগুলো শ্যাম বেনেগল তৈরি করেন। ভারতীয়দের বিশেষত ভারতীয় বাঙালিদের কাছে নেতাজি মানে বিল্পব। সেই মহান মানুষকে নিয়েও তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে মন জয় করে নেন পুরো ভারতীয় ও বাংলাভাষীদের। পরিশেষ কথাগুলো হলো এমন, যে চলচ্চিত্র নির্মাতা এত বড় বড় মানুষদের নিয়ে চলচ্চিত্র বানিয়ে সফল হয়েছেন তিনি দায়িত্ব পেয়েছেন-আমাদের জাতির পিতার জীবনকে সেলুলয়েডের আবদ্ধ করতে। এখন আমরা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছি বঙ্গবন্ধু উপাধী পাওয়া সেই অমর কবির জীবনচিত্র দেখার ক্ষণ আসছে কখন, কবে ঘোষণা করবেন শ্যাম বেনেগল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বায়োপিক সম্পন্ন হয়েছে ।

এ সিনেমার ৫০টি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দেশীয় তারকা অভিনয়শিল্পী। তারা রীতিমতো অডিশন দিয়েছেন। কেউ কেউ তো একাধিক অডিশনও দিয়েছেন। এরই মধ্যে প্রধান চরিত্রগুলোতে কারা অভিনয় করবেন এ নিয়ে অনেক খবর সামনে এসেছে। কিন্তু কোনোটাই চূড়ান্ত ছিল না। অবশেষে জানা গেল কারা সিনেমাটিতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন। গতকালই বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে অভিনয়শিল্পীদের সেই তালিকা। সে অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করবেন চিত্রনায়ক আরিফিন শুভ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনা হলেও তিনি যে চরিত্রটি করছেন, এটি প্রায় সবাই জানতেন। কারণ এরই মধ্যে খবর পাওয়া গেছে চরিত্রটির প্রস্তুতির জন্য শুভ ভারতেও গিয়েছিলেন।

সবচেয়ে বেশি খবর এসেছে এ সিনেমার প্রধান নারী চরিত্র অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব (রেনু) চরিত্রে কে অভিনয় করবেন তা নিয়ে। কখনো নাম এসেছে জয়া আহসানের, কখনো নুসরাত ইমরোজ তিশা, কখনো জ্যোতিকা জ্যোতি কখনো মাসুমা রহমান নাবিলার। চরিত্রটি নিজের করে নিলেন তিশা। তিনি অভিনয় করবেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী রেনুর বড়বেলার চরিত্রে। কমবয়সী রেনুর চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর বড় পর্দায় ফিরবেন তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী শিশুশিল্পী প্রার্থনা ফারদিন দীঘি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার চরিত্রটি নিয়েও দর্শকের আলাদা আগ্রহ ছিল। যদিও এ চরিত্র নিয়ে তেমন কোনো কথা হয়নি। তাই খানিকটা অবাক করে দিয়ে শেখ হাসিনার ছোটবেলার চরিত্রে নাম এলো নুসরাত ফারিয়ার! শেখ হাসিনার অন্য দুই বয়সের চরিত্রে অভিনয় করবেন জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি ও ওয়ানিয়া জারিন আনভিতা।

ঐতিহাসিক আরো কিছু চরিত্রে অভিনয় করবেন দেশের খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। রাইসুল ইসলাম আসাদ করছেন আবদুল হামিদ খান ভাসানীর চরিত্র, সায়েম সামাদ করছেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের চরিত্র, চিত্রনায়ক ফেরদৌস করছেন তাজউদ্দীন আহমদ, শহীদুল আলম সাচ্চু করছেন এ কে ফজলুল হক, তৌকীর আহমেদ করছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সমু চৌধুরী করছেন মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, দিলারা জামান করছেন বঙ্গবন্ধুর মা, খায়রুল আলম সবুজ করছেন তার বাবা এবং ফজলুর রহমান বাবু করছেন খন্দকার মোশতাক আহমদের চরিত্র। ইতিমধ্যে এর জন্য এফডিসির বিভিন্ন ফ্লোরে সেট নির্মাণ চলছে। ‘বঙ্গবন্ধু’ মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে আগামী বছর।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //